প্রবন্ধ

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ও কিছু কথা

লেখক:মুফতী আব্দুল্লাহ মাসুম
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
১৫৩৪ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

সম্প্রতি সরকার জনগণের কল্যাণে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে গত ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে এ বিষয়ে আইন পাশ হয়। 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ (২০২৩ সনের ০৪ নং আইন' নামে তা অভিহিত[1]এরপর গত ১৩ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩' নামে এ সংক্রান্ত বিধিমালা সম্বলিত একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছেসব শেষে গত ১৭ আগস্ট, ২০২৩ সরকার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেছে[2]। যখন এই লেখা লিখছি তখন ১৮ আগস্ট, ২০২৩ ইং।

 

ইতোমধ্যে এ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। এর অর্থনৈতিক ভিত্তি, যৌক্তিকতা নিয়ে যেমন কথা হচ্ছে, তেমনি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের স্কিমে অংশগ্রহণ করা মুসলিম জনগণের জন্য বৈধ হবে কি না-এ বিষয়টিও বেশ আলোচনা হচ্ছে।

 

আমরা মনে করি, সরকারের এই উদ্যোগটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এতে জীবন সায়াহ্নে মানুষের আর্থিক ঝুঁকি কিছুটা হলেও লাঘব হবে। এর সুযোগটি মূলত বেসরকারি চাকরিজীবি, অন্যান্য সকলের জন্য কিছু নিয়ম-নীতির আওতায় উন্মুক্ত থাকবে। অর্থ বিভাগের এক তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এ দেশের ছয় কোটির বেশি কর্মজীবীর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কাজ করেন বেসরকারি খাতে। তারা সকলেই এর আওতাভুক্ত হতে পারবেন। এছাড়া অন্যান্য পেশার মোট চার শ্রেণীর মানুষ নিয়ে ১০ কোটি মানুষকে এর আওতাভুক্ত করা সরকারের লক্ষ্য। বলে গণমাধ্যম থেকে জানা যায়।

 

অর্থনৈতিক দিক থেকে, চলমান মুদ্রাস্ফীতির লাগামহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এ স্কিম জনগণের জন্য কতটুকু কাজে দিবে, সরকার আদৌ তা ফেরত দিতে সক্ষম হবে কি না বা ফেরত দিতে গিয়ে অর্থনৈতিক অন্য কোনো সমস্যা তৈরির দিকে নিয়ে যাবে কি না-বিষয়গুলো অর্থনীতিবিদগণ আলোচনা করবেন। ইতোমধ্যে কেউ কেউ অর্থনৈতিক দিক থেকে এর শঙ্কার কথাও ব্যক্ত করছেন। আমরা সেদিকে আলোচনায় যাব না।

 

শরীআহ দৃষ্টিকোণ থেকে এ স্কিমে অংশগ্রহণের সুযোগ আছে কি না, না থাকলে এর বিকল্প কাঠামো কী হতে পারে, আমরা এখানে সেই বিষয়টি আলোচনা করতে চাই। কারণ মানুষ আমাদের কাছে এ বিষয়টি জানতে চায়।

 

উল্লেখ্য, গত জানুয়ারি, ২০২৩-এ সরকার যখন এ বিষয়ে আইন প্রকাশ করে, তখন আইএফএ কনসালটেন্সি (শরীআহ কনসালটেন্সি ফার্ম) থেকে আমরা এর উপর একটি অর্থনৈতিক ও শরীআহ পর্যালোচনা লিপিবদ্ধ করেছি। এর শরীআহ বিকল্পও উল্লেখ করেছি। কনসালটেন্সি ফার্মের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সচিবালয়ে চিঠিও প্রেরণ করা হয়েছে যে, এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই। সরকারের এ উদ্যোগকে কীভাবে  শরীআহসম্মত করা যায় এ বিষয়ে আমাদের কিছু মডেল ও প্রস্তাবনা আছে। সেটি নিয়ে কথা বলতে চাই। কিন্তু আমরা এর কোনো প্রকার উত্তর পাইনি। তবে এখনও আশা রাখি- সরকার উদ্যোগী হলে, এ বিষয়ে এখনও আলোচনা করা সম্ভব। শরীআহসম্মত উপায়ে কিভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কীম চালু করা যায়- তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

 

আলোচনা এ জন্য দরকার, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশের অধিক জনগোষ্ঠী মুসলিম। আর্থিক বিষয়ে শরীআহ পরিপালনে তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী। বিশেষত শেষ জীবনে অন্তত মানুষ চায় না হারাম বা সুদী কোনো বিষয়ে জড়িয়ে নিজের ইহকাল ও পরকাল নষ্ট করতে। এদিকে প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম-পুরোপুরি শরীআহপরিপন্থী একটি স্কিম।

 

এতে সন্দেহ নেই, এর মূল লক্ষ্য সঠিক। এর সাথে দ্বিমত নেই। তবে সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য যে অবকাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ শরীআহপরিপন্থী অবকাঠামো। এ জন্যই আমরা এর বিকল্প শরীআহসম্মত অবকাঠামো নিয়ে কথা বলতে চাই। আর না হয়-বাস্তবে তা সর্বজনীন হবে না। মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ তা গ্রহণ করবেন না। আপাতত কীভাবে তা শরীআহপরিপন্থী অবকাঠামো-তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এর আগে এই স্কিমের কিছুটা পরিচিতিমূলক আলোচনা করে নেয়া যেতে পারে।

 

সর্বজনীন পেনশন স্কিম পরিচিতি

 

এ বিষয়ে প্রকাশিত আইন, গেজেট অনুসারে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের অধীন ছয়টি পরিকল্পিত প্যাকেজের মধ্যে প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা এবং প্রবাসী নামে চারটি প্যাকেজ প্রাথমিকভাবে চালু করা হয়েছে। প্রগতি প্যাকেজ বেসরকারি চাকরিজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করবে। অন্যদিকে সুরক্ষা স্ব-কর্মসংস্থান ব্যক্তিদের জন্য, নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য সমতা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য প্রবাসী প্যাকেজ গঠন করা হয়েছে। বাকি দুটি প্যাকেজ পরে চালু করা হবে।

 

১৮ বছরের বেশি বয়সী যেকোনো নাগরিক ৬০ বছর বয়সে না পৌঁছানো পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ করে অবসরজীবনের সময় পেনশন সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

 

সাধারণ নিয়ম অনুসারে ১৮-৫০ বছর বয়সী যেকোনো নাগরিক এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। তবে ৫০ বছরেরও বেশি বয়সী কেউ যোগ দিতে চাইলে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যোগ দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাকে একটানা ১০ বছর ধরে কিস্তি দিতে হবে। ১০ বছর পর গিয়ে তিনি নির্ধারিত রিটার্ন পাবেন। (বিধিমালা, ধারা: ০৪)

 

বিধি অনুসারে, কোনো স্কিমের চাঁদাদাতা মাসিক পেনশন প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জনের পূর্বেই মারা গেলে তার নমিনী পুরো জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ পাবে। আর পেনশন চলাকালীন তার বয়স ৭৫ হওয়ার পূর্বে ইন্তেকাল হয়ে গেলে তার বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত তার নমিনীকে পেনশন দেয়া হবে। (বিধিমালা, ধারা: ০৫, ০৬)

 

তবে মনে রাখতে হবে, আইন অনুযায়ী, চাঁদাদাতাকে পেনশন দেওয়া শুরু হবে ৬০ বছর বয়সের পর। এরপর তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন মাসে মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের পেনশন পাবেন।

 

বিধিমালা অনুসারে কোন স্কিমে কী পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে, সেই চাঁদার বিপরীতে মাসিক পেনশন প্রাপ্তির পরিমাণ কী হবে তা স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে। যেমন: ১৮ বছর বয়সে ডিমে অংশগ্রহণ করার পর ৪২ বছর যাবৎ কিস্তি পরিশোধ করার পর ৬০ বছর বয়সে গিয়ে মাসিক পেনশন প্রাপ্তি দাঁড়াবে, ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা। ৫০ বছর বয়সে কেউ যোগ দিলে, ১০ বছর পর ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে পেনশন প্রাপ্তি দাঁড়াবে, ৭ হাজার ৬৫১ টাকা। এভাবে যার চাঁদা প্রদানের সময় ও পরিমাণ অধিক হবে, সে হিসাবে তার প্রাপ্তি বৃদ্ধি হবে। সময় ও পরিমাণ হ্রাস হলে, প্রাপ্তিও তুলনামূলক হ্রাস হবে।

 

স্কিমের মূল কথা

 

মূলত প্রস্তাবিত স্কিমে হুবহু কনভেনশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স নীতি ও পলিসি অনুসরণ করা হয়েছে। একটি লাইফ ইন্সুরেন্স প্রোডাক্টে প্রথমে দেখা হয়, বীমা গ্রাহকের বয়স। বয়স যতো বেশি হয়, তার প্রিমিয়াম প্রদানের হারও সে তুলনায় বাড়তে থাকে। তেমনিভাবে বীমার মেয়াদ যতো বেশি হবে, ততো প্রিমিয়ামের হার কম হবে। মেয়াদ যতো কম হবে, প্রিমিয়াম হার বেশি হবে। অর্থাৎ রিস্ক বা ঝুঁকি যতো বাড়বে প্রিমিয়াম প্রদানও সে হারে বৃদ্ধি হয়। যেমন: কেউ ২০ বছর বয়সে একটি সঞ্চয়ী মেয়াদি বীমায় অংশগ্রহণ করল। বীমার মেয়াদ ৫ বছর। বীমা অংক ১ লক্ষ টাকা। তাহলে একটি কোম্পানির পলিসি অনুসারে তাকে বীমা অংকের প্রতি এক হাজারে বছরে প্রিমিয়াম দিতে হবে ২১৯.৬৭ টাকা। অংকে সেটি বছরে দাঁড়ায়, ২১ হাজার ৯৬৭ টাকা। ০৫ বছরে হবে ১ লক্ষ ১ হাজার ৮৩৫ টাকা। আবার যদি বয়স হয় ৪০ বছর, তাহলে তার বীমা অংকের প্রতি এক হাজারে বছরে প্রিমিয়াম দিতে হবে ২২০.১৪ টাকা। ০৫ বছরে হবে ১ লক্ষ ১০ হাজার ৭০ টাকা।

 

এর অর্থ-বয়স যতো বেশি হবে প্রদেয় সে হারে বাড়বে। আমাদের প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমেও অনেকটা তাই হয়েছে। বয়স যতো বেশি হবে, তার রিটার্ন ততো কম হবে। বয়স যতো কম হবে, রিটার্ন ততো অধিক হবে। পার্থক্য হলো, সাধারণ বীমা পলিসিতে বয়স বৃদ্ধি হলে প্রিমিয়াম প্রদানের হারও বেড়ে যায়। আর এখানে চাঁদার হার বয়স বেশি হলেও। বৃদ্ধি হয় না। তবে প্রাপ্তি কমে যায়। কিন্তু বীমা পলিসিতে প্রাপ্তি কমে না। ড়ান্ত ফলাফল প্রায় অভিন্ন। দুটিতেই ঝুঁকি বিশ্লেষণ করত প্রাপ্তি নির্ধারণ করা হয়। সাধারণ বীমা পলিসিতে সেই ঝুঁকি এ্যানালাইসিস করে প্রিমিয়াম কমানো- বাড়ানো হয়। আর সর্বজনীন পেনশন স্কিমে রিটার্ন কমানো-বাড়ানো হয়।

 

সাধারণ বীমা পলিসিতে মানুষের সাধারণ গড় আয়ু হিসাব করা হয়। এখানেও তাই করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বলছে ২০২২ সালে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৪ বছর। এ হিসাবে একটি লোক সাধারণত ৭২ বছর আয়ু পায়। ধরা যাক, প্রবাসী স্কিম অনুযায়ী কেউ ৫০ বছর বয়সে স্কিম চালু করল। তাহলে তাকে ১০ বছরে মোট চাঁদা দিতে হবে ৬ লক্ষ টাকা। ৬০ বছর বয়সের পর লোকটি প্রতি মাসে পেনশন পাবে ৭৬৫১ টাকা। ১২ বছর বেঁচে থাকলে তার প্রাপ্তি দাঁড়াবে ১১ লক্ষ ১ হাজার ৭৪৪ টাকা। এরপর মারা গেলে তার নমিনী আরও ৩ বছর পেনশন পাবে। মোট ১৫ বছর পেনশন দেয়া হবে। প্রদেয় পেনশন দাঁড়াবে ১৩ লক্ষ ৭৭ হাজার ১৮০ টাকা।

 

লক্ষণীয়, এই ১৫ বছর পর্যন্ত পেনশন প্রদান এখানে নিশ্চিত। হয় চাঁদাদাতা পাবে, নতুবা তার নমিনী পাবে। অর্থাৎ ৬ লক্ষ টাকার বিপরীতে সে/তার নমিনী পাবে ১৩ লক্ষ ৭৭ হাজার প্রত ১৮০ টাকা। জমার দ্বিগুণের অধিক প্রাপ্তি। এটি নিশ্চিত। 

হ্যাঁ, পেনশন শুরু হওয়ার আগে মারা গেলে, তখন কেবল আল্লামা জমাকৃত টাকা মুনাফাসহ পাবে। মুনাফার হার বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়নি। যা একটি অস্পষ্টতা তৈরি করে রেখেছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রাপ্তি পূর্বের প্রাপ্তি হারের তুলনায় কম হবে।

আবার দেখুন, ৪৫ বছর বয়সে স্কিমে প্রবেশ করলে, ৬০ বছর বয়সের পর তার মাসিক পেনশন প্রাপ্তি হবে ১৪,৪৭২ টাকা। এখানে প্রাপ্তি প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, তার জমা হয়েছে বেশি।

 

সুদের উপস্থিতি

 

পূর্বোক্ত বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট, স্কিমে চাঁদাদাতা যে পরিমাণ সঞ্চয় করবে, সব সময় এর অধিক পাবে। মূল প্রদেয় সঞ্চয় ফেরত পাওয়া যেমন নিশ্চিত, তেমনি এর সাথে অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়াও নিশ্চিত। পেনশন শুরু হওয়ার আগে মারা গেলে মুনাফাসহ সঞ্চয় পাবে। সেই মুনাফার হার কী হবে- তা বিধিমালায় বলা হয়নি। তবে বোঝা যায়, সেটি প্রচলিত সুদী সঞ্চয়ের হার-ই হবে। আর পেনশন শুরু হওয়ার পর মারা গেলে প্রাপ্তি নিশ্চিত। এই নিশ্চিত প্রাপ্তিকে যদিও বিধিমালার ধারা ৩ এর ২-এ বলা হয়েছে 'সম্ভাব্য' প্রাপ্তি। তবে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, "আমরা একটা ফর্মুলা দিয়ে এই মুনাফার ব্যাপারটা ঠিক করেছি। ওখানে উল্লেখ করেছি এটা বাড়তে বা কমতে পারে। তবে আমাদের ফর্মুলা অনুযায়ী এর চেয়ে কমার সম্ভাবনা নেই।" (বিবিসি বাংলা, "সর্বজনীন পেনশন কত টাকা জমা দিলে কত টাকা পাবেন", ১৭ আগস্ট, ২০২৩)

 

মোদ্দাকথা, উক্ত স্কিমে সুদের উপস্থিতি স্পষ্ট। এ কারণে এ স্কিমে অংশগ্রহণ করা শরীআহ দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ নয়। হারাম। লব্ধ মুনাফা হারাম আয় বলে বিবেচিত হবে।

কেউ বলেন, এখানে সরকারের ফান্ডে বিনিয়োগ করা হয়। আর ইসলামে ব্যবসা-বিনিয়োগ বৈধ। এর জবাব হলো, ইসলামী বাণিজ্য আইন অনুসারে প্রদেয় বিনিয়োগের উপর তে। অতিরিক্ত পেতে হলে সেটি বাস্তব ব্যবসা হতে হবে। যেখানে  লাভ-লসের সুযোগ থাকবে। প্রাপ্তি সুনির্দিষ্ট অংকে নির্ধারিত হবে না। বরং মুনাফার শতকরা হারে নির্ধারিত হবে। বৈধ খাতে ব্যবসা করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে সেসব কিছুই নেই। সুতরাং সরকারের সঞ্চয় পত্র স্কিম যেমন সুদী স্কিম হওয়ার ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ ও দ্বিমত নেই। এখানেও তাই। একে কেউ কেউ বিনিয়োগ বললেও এটি ব্যাংকে ডিপিএসে বিনিয়োগের মতো। ইসলামী বিনিয়োগ নয়।

 

প্রচলিত পেনশন ও সর্বজনীন পেনশন: বিভ্রান্ত না হই

 

এখানে এ বিষয়টি পরিষ্কার থাকা উচিত, প্রচলিত সরকারি পেনশন ও সর্বজনীন পেনশন এক নয়। প্রচলিত সরকারি পেনশন শরীআহ দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ। এতে সন্দেহ নেই। ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি চাকরিজীবির সামগ্রিক চাকরির উপর অতিরিক্ত পারিশ্রমকি অথবা চাকরির উপর বিশেষ অনুদান। এর সাথে পরিশ্রম জড়িত। পরিশ্রমের বিপরীতে প্রাপ্তি। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে কোনো শ্রমের বিনিময় নেই। সরাসরি টাকার বিপরীতে অতিরিক্ত টাকার আদান-প্রদান। অতএব প্রচলিত পেনশন বৈধ হলেও সর্বজনীন পেনশন বৈধ নয়।

 

কেউ মনে করতে পারেন, এখানে সরকার তার জনগণকে আর্থিক উপকার দিচ্ছে। সরকার মূলত সবার। সরকারের ফান্ড বস্তুত জনগণের। সুতরাং জনগণের টাকাই জনগণ পাচ্ছে। এতে অবৈধ হওয়ার কী আছে?

 

এর জবাব হলো, এতটুকু তো ঠিক যে, সরকারের তহবিল মূলত সামগ্রিকভাবে জনগণের সম্পদ। তবে এখানে লক্ষণীয় হলো, চুক্তি। চুক্তির দুটি পক্ষ এখানে বিদ্যমান। একদিকে চাঁদাদাতা। অপরদিকে সরকার। এই দুটি পক্ষের মাঝে সুদের চুক্তি হচ্ছে। তাই তা সুদী চুক্তি হিসাবেই বিবেচিত হবে। যেমন: সরকারি ব্যাংক, সরকারের সঞ্চয়পত্র, সরকারের প্রাইজ বন্ড সবই সুদী চুক্তি হিসাবে সকলের কাছে স্বীকৃত।

 

গারারের উপস্থিতি

 

ইসলামের বাণিজ্য আইন অনুসারে কোনো লেনদেন অবৈধ (Invalid Contract) হওয়ার অন্যতম কারণ, তাতে 'গারার' (Uncertainty) বিদ্যমান থাকা। ইসলামী আইন বা ফিকহের পরিভাষায় 'গারার' এমন লেনদেনকে বলা হয়, শরীয়ত বর্ণিত পন্থায় যার পরিণতি অজ্ঞাত। অথবা বলুন, যে কারবারের মূল চুক্তি বা পণ্যে কিংবা মূল্যে শরীয়ত বর্ণিত পন্থায় অনিশ্চয়তা থাকে সেটাই গারারযুক্ত লেনদেন। আল্লামা সারাখসী রহ. এর পরিচিতি দিয়েছেনে এভাবে, 'গারার এমন লেনদেন যার পরিণতি লুকায়িত (অস্পষ্ট)।'-আল-মাবসূত: ১২/১৯৪

 

আল্লামা কাসানী রহ. এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে, 'গারারহচ্ছে অনিশ্চয়তাযুক্ত এমন লেনদেন, যাতে হওয়া এবং না হওয়া উভয় দিক বিদ্যমান।'-বাদায়েউস সানায়ে ৪/৩৬৬ 

সহীহ হাদীসে একে নিষেধ করা হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কংকর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় করতে ও গারারযুক্ত লেনদেন থেকে নিষেধ করেছেন।'-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৬৯১

 

আলোচিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যদিও প্রদেয় সঞ্চয় সব সময় ফেরত পাওয়া নিশ্চিত। তবে এতে গারার (Uncertainty) আছে। তা এভাবে যে, একজন চাঁদাদাতা এতে অংশগ্রহণের পর সে জানে না তার প্রাপ্তি কী পরিমাণ দাঁড়াবে। পেনশন শুরু হওয়ার পর মারা গেলে একধরনের প্রাপ্তি। এর আগে মারা গেলে অন্য ধরনের প্রাপ্তি। দুই প্রাপ্তি সমান নয়। পূর্বে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রথম প্রাপ্তি তার জন্য তুলনামূলক দ্বিতীয় প্রাপ্তির তুলনায় অধিক ও বেশি লাভজনক। যদিও সর্বাবস্থায় তার প্রদেয় সঞ্চয় সব সময় ফেরত পাবে।

 

প্রকাশ থাকে যে, এক ধরনের অনিশ্চয়তা বা (Uncertainty) সব ব্যবসাতেই থাকে। তাই বলে ব্যবসা হারাম নয়। এখানে যে অনিশ্চয়তা (Uncertainty) এর কথা বলা হয়েছে, তা একটি বিশেষ অনিশ্চয়তা (Uncertainty) যা শরীয়তে 'গারার' নামে পরিচিত। এর প্রয়োগ ও সীমানা নির্ধারিত। সুতরাং সবকিছুকে একভাবে চিন্তা করলে বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

 

অবৈধ বিনিয়োগ

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ সূত্রে জানা গেছে- এ তহবিলের অর্থের একটা অংশ দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে খাটানো হবে। সূত্রগুলো জানায়, সরকার ঋণের একটা অংশ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে এবং আরেকটা অংশ সঞ্চয় কর্মসূচি থেকে নিয়ে থাকে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা শুরু হলে এ ধরনের অর্থায়ন তথা ঋণের ঘাটতি হবে না। এখান থেকে স্পষ্ট, এ তহবিল মূলত সরকারের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ হবে। যা সুদী বিনিয়োগ হিসাবে সুপরিচিত। সুতরাং সরাসরি না হলেও চাঁদাদাতার টাকা সরকারের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ হচ্ছে, যা অবৈধ বিনিয়োগ।

 

আল-আকলু বিল বাতিল (অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রহণ) 

 

কোরআনুল কারীমে অর্থনৈতিক যেসব কারবার নিষেধ করা ভুল হয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো, 'আল-আকলু বিল বাতিল' বা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা। কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে,

 

يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ.

 

হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না. তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টিক্রমে কোনো ব্যবসা করা হলে তা জায়েয।-সূরা নিসা (৫): ২৯ 

'আল-আকলু বিল বাতিল' বা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা দ্বারা বোঝানো হয়েছে, বিনিময় ছাড়া কারও সম্পদ গ্রহণ করা বা ভক্ষণ করা।-তাফসীরে কুরতুবী: ৫/১৫ 

আলোচিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিধিমালায় আছে, (ধারা : ৫/৫) কোনো চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তি চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে, তার পেনশন হিসাবটি স্থগিত হয়ে যাবে। পুনরায় চালু করতে হলে নির্ধারিত জরিমানা দিয়ে চালু করতে হবে। এখানে লক্ষণীয়, কেউ এভাবে তিন কিস্তি দেয়ার পর টাকা আর না দিলে, তার প্রদেয় টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এই ফেরত না দেয়াটাই বিনিময় ছাড়া অন্যের সম্পদ গ্রহণ করার নামান্তর। বস্তুত সাধারণ জীবন বীমা পলিসিতে পেইড আপ অপশনকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। ওখানে নিয়ম হলো, দুই বছরের আগে প্রিমিয়াম প্রদান বন্ধ করলে প্রদত্ত টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। সুতরাং উক্ত বিধিমালার এ অংশটি কোরআনুল কারীমের সাথে সাংঘর্ষিক।

 

সারকথা 

 

উপরোক্ত বিশ্লেষণে এ কথা স্পষ্ট যে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম আদ্যোপান্ত একটি অনৈসলামিক ও শরীআহপরিপন্থী স্কিম। এতে সুদ, গারার, আল-আকলু বিল বাতিল ও অবৈধ বিনিয়োগসহ শরীআহপরিপন্থী নানা সমস্যা রয়েছে। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য এতে অংশগ্রহণ করা, উপকৃত হওয়া বৈধ নয়।

 

বিকল্প সমাধান

 

আমরা আগেই বলেছি, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মূল চিন্তার সাথে ইসলামের দ্বিমত নেই। বরং একটি প্রশংসনীয় চিন্তা ও লক্ষ্য। তবে এর জন্য যে পথ নির্বাচন করা হয়েছে, সেটি গলদ। এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরীআহসম্মত নানা পেনশন স্কিম আছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শরীআহ কনসালটেন্সি ফার্ম 'আইএফএ কনসালটেন্সি' একটি শরীআহসম্মত হালাল পেনশন স্কিম অবকাঠামো অঙ্কন করেছে। এগুলো সামনে রেখে সরকার চাইলেই বাস্তব অর্থে একটি সর্বজনীন শরীআহসম্মত স্কিম চালু করা সম্ভব। আমরা আশা করবো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। পরবর্তীতে হালাল পেনশন স্কিম নিয়ে আলোচনা করা হলো।

 

সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম (প্রস্তাবিত) 

সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম কী?

 

সাধারণ সর্বজনীন পেনশন স্কিম হলো, এক ধরনের সুদভিত্তিক ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি সেভিংস পরিকল্পনা। যা জীবনের শেষ দিকে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়ে থাকে। অপরদিকে সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম হলো, শরীআহ নীতি অনুসারে পরিচালিত একটি পেনশন স্কিম। হালাল পেনশন অবকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকে। যথা :

১. অন্তর্নিহিত শরীআহ চুক্তি।

২. হালাল বিনিয়োগ।

৩. পরিবেশ বান্ধব বিনিয়োগ।

 

সাধারণ সর্বজনীন পেনশন স্কিম ও সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিমের মাঝে পার্থক্য

 

সাধারণ পেনশন স্কিম হয়ে থাকে, রিবা, গারার, ইত্যাদি শরীআহপরিপন্থী উপাদানযুক্ত। অপরদিকে হালাল পেনশন স্কিম হয়ে থাকে সব ধরনের শরীআহপরিপন্থী উপাদান থেকে মুক্ত। তবে দুটির মাঝে মিল হলো, দুটিই ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক উপকার দিয়ে থাকে।

 

কেন সর্বজনীন হালাল পেনশন গ্রহণ করা অগ্রগণ্য?

 

হালাল পেনশন একটি সার্বিক কল্যাণমুখী উদ্যোগের নাম। প্রচলিত গতানুগতিক সর্বজনীন পেনশন স্কিমের তুলনায় এর যৌক্তিক দিকগুলো নিম্নরূপ:

১. সম্পদ ভিত্তিক বিনিয়োগ। সাধারণ পেনশন স্কিমের বিনিয়োগ হয়ে থাকে সুদী খাতে। সুদ হলো, অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ একটি অনুৎপাদনশীল খাত। অপরদিকে হালাল পেনশন স্কিমের বিনিয়োগ হয়ে থাকে সম্পদ ভিত্তিক খাতে।

 

২. ঝুঁকিমুক্ত। সাধারণ পেনশন স্কিমে অর্থনৈতিক ঝুঁকি তুলনামূলক অধিক। কারণ এতে বিনিয়োগ হয়ে থাকে সুদী পদ্ধতিতে। যা সম্পূর্ণ ঝুঁকিযুক্ত। অপরদিকে হালাল পেনশন না স্কিমের বিনিয়োগ হয়ে থাকে সম্পদ ভিত্তিক খাতে। যা তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ।

 

৩. নৈতিকতা ও স্বচ্ছতাপূর্ণ। সাধারণ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের তুলনায় নৈতিক মান ও স্বচ্ছতা অধিক থাকে। কারণ এখানে কেবল আল্লাহর দেয়া শরীআহ নীতি অনুসরণ করা হয়। যা মানুষকে তাকওয়া ও খোদাভীতি চর্চা করতে শেখায়। এ কারণে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা এখানে তুলনামূলক কম হয়।

 

সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিমের শরীআহ অবকাঠামো

 

আইএফএ কনসালটেন্সির শরীআহ টিম সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিমের যে শরীআহ অবকাঠামো পেশ করেছে, তার সারসংক্ষেপ হলো :

 

প্রস্তাবিত সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিমের মূল শরীআহ অবকাঠামো হবে 'তাবাররু-মডেল' এর ভিত্তিতে।

 

তাবাররু মডেল কী?

 

তাবাররুঅর্থ-অনুদান, কন্ট্রিবিউশন। তাবাররু মডেল বলতে বোঝানো হয়, একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকলের কন্ট্রিবিউশনে গড়ে উঠা তাবাররু পুল। যা থেকে পুলের নীতি অনুসারে সংশ্লিষ্ট জনবলকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়। তাবাররু মডেলটির মূল থিম হলো।

 

১. যারা এ মডেলে অংশগ্রহণ করবে, তারা সকলে যে চাঁদা প্রদান করবে, সেটি মূলত একটি অনুদান হিসাবে বিবেচিত হবে।

২. সকলের অনুদানে একটি 'তাবাররু পুল' গঠন হবে। 'তাবাররু পুল'-ই হবে সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। এটি একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে বিবেচিত হবে। এ পুলের মালিক এককভাবে কেউ থাকবে না। (মূল ফান্ডটি ওয়াকফ হতে হবে।) 

৩. তাবাররু পুল থেকে পুলের নীতি অনুসারে নানা সুবিধা পুলে অংশগ্রহণকারীদেরকে প্রদান করা হবে। এ পুল পরিচালনা বাবদ কর্তৃপক্ষ একটি পারিশ্রমিকও গ্রহণ করতে পারবে।

 

সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম ও তাবাররু মডেল

 

সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিমের মূল মডেল হবে উপরোক্ত তাবাররু মডেল। এ মডেলের ভিত্তিতে এখানে দুটি পক্ষ তৈরি হবে। যথা:

১. সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট নিয়োগপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ।

২. সাধারণ চাঁদাদাতা।

উক্ত দুটি পক্ষের মাঝে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে-তাবাররু পুল/তহবিলের ভিত্তিতে। প্রত্যেকের প্রদত্ত চাঁদা মূলত তাবাররু পুলে কন্ট্রিবিউশন হিসাবে বিবেচিত হবে। আর প্রদেয় হবে মূলত তাবাররু পুল/তহবিলের নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত। উক্ত তহবিল পরিচালনা বাবদ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ একটি সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করতে পারবে। যার শরীআহ ভিত্তি হবে, ইজারা ও ওয়াকালাহ চুক্তি।

 

এ প্রসঙ্গে আরও কিছু নীতিমালা হলো:

 

-তাবাররু পুল/ফান্ড এর একটি স্বতন্ত্র নীতিমালা থাকবে। এ নীতিমালা অনুসারে চাঁদাদাতাদেরকে প্রস্তাবিত সুবিধা প্রদান করা হবে।

-দুটি একাউন্ট থাকবে। যথা:

 

ক. মূল তাবাররু পুল একাউন্ট।

খ. নিয়োগপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের নিজস্ব একাউন্ট। 

 

দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হবে।

 

-তহবিলের অর্থের প্রতিনিধি হিসাবে সরকারের নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ তা সরকারের নানা খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। উক্ত খাতসমূহের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকবে-

-হালাল খাত হবে। সরকারের মুদারাবা বন্ড, সুকুক ইত্যাদি।

- পরিবেশ বান্ধব হবে।

-ঝুঁকি তুলনামূলক কম হবে।

-পুলের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে দুই ভাবে :

 

ক. গ্রাহকদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে।

খ. বিনিয়োগ করে মুনাফা লাভের মাধ্যমে।

 

-এ পুল পরিচালনা বাবদ একটি স্বতন্ত্র সুপারভাইজারি শরীয়াহ বোর্ড থাকবে। শরীয়াহ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হবে। বিশেষত বিনিয়োগ কার্যক্রম হালাল হওয়ার বিষয়টি তাঁরা নিশ্চিত করবেন।

 

-পিউরিফিকেশন মেথড থাকবে। যদি কখনো কোনো বিনিয়োগ থেকে হারাম ইনকাম এসে যায়, তাহলে তা শরীআহ বোর্ডের সহায়তায় চিহ্নিত করে পৃথক করা হবে। সরকারের নানা দারিদ্র বিমোচন প্রকল্পে বা রাস্তা-ঘাট নির্মাণে ব্যয় হবে। 

-পুলের অর্থ থেকে গ্রাহকদেরকে সুদবিহীন করজে হাসানা প্রদান করা যাবে। তবে করজ প্রদান করার জন্য প্রকৃত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করা যাবে, যা প্রকৃত খরচ অনুপাতে হতে হবে।

 

এ হলো, সংক্ষেপে তাবাররু মডেল অনুযায়ী সর্বজনীন হালাল পেনশনের জন্য প্রস্তাবিত অবকাঠামো। এ অবকাঠামো বাহরাইনসহ নানা মুসলিম দেশে চর্চিত। সুতরাং বাংলাদেশেও যদি উপরোক্ত শরীআহ সম্মত হালাল পেনশন স্কিম বাস্তবায়ন করা হয়, তবে তা একদিকে মানুষের প্রয়োজন, অপর দিকে সরকারের প্রয়োজন সবই পূরণ হবে, পাশাপাশি তা শরীআহসম্মতও হবে। নিম্নে উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিমের একটি সংক্ষিপ্ত ডায়াগ্রাম দেখানো হলো।

https://lh7-rt.googleusercontent.com/docsz/AD_4nXeGokX4Z3efxRrSgGfOz9-2HcoAzlm8gWru2kdLSK_WvVocUkTI9u6KIwmYuyXJ2eKcHe-sPjWqxCJ9_-fOCyQuB5KWIPZZx9Xpwe1O4WfLiAFPr7qBRtU3xUCMqPm14bMYguAmHUR-E4FvkpX1d7twWps?key=Z-WCavtUWHXNJWjCpr72Uw

 

ইসলামিক পেনশন ভহবিল নকশা

 

(আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য প্রণীত শরীআহ গাইডলাইন, আইএফএ কনসালটেন্সি, পৃ. ১৭৫)

 

বিনিয়োগ প্রতিনিধি মডেল

 

এক্ষেত্রে আরও একটি মডেল প্রস্তাব করা যায়, তা হলো-

 

ইনভেস্টম্যান্ট এজেন্সি মডেল। আরবীতে বলে-ওয়াকালাহ বিল ইছতিছমারমডেল। এ মডেলের সারকথা হলো :

-চাঁদাদাতা বা ইউনিট হোল্ডারগণ হবে বিনিয়োগকারী।

-পেনশন ম্যানেজম্যান্ট হবেন সেই ইউনিট হোল্ডারগণের পক্ষে বিনিয়োগ প্রতিনিধি।

-তারা বিনিয়োগ প্রতিনিধি হিসাবে নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করবেন।

-বিনিয়োগ প্রতিনিধি হিসাবে শরীআহ বোর্ডের দিক-নির্দেশনায় শরীআহসম্মত খাতে বিনিয়োগ করবেন।

-বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা বিনিয়োগকারীগণ এককভাবে পাবেন। (পূর্ব নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ কর্তন করার পর)

পাকিস্তানের MCB-Arif Habib Savings and Investments Limited কোম্পানি Pension Fund Manager হিসাবে কাজ করার জন্য অনুমোদিত। তাদের Alhamra Islamic Pension Fund (ALHIPF) এর অধীনে পরিচালিত হয় উপরোক্ত মডেলে Shariah-compliant-Islamic Voluntary Pension Schemeস্কিমটি ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয়। তখন এর ফান্ডের পারফরমেন্স ছিল মাত্র ২.৯৯%। ২০২২ এ হার দাঁড়ায় ৭.৮৩[3] 

শরীআহ বোর্ডে আছেন-মুফতি তাকী উসমানী, ডক্টর যুবায়ের উসমানী, ডক্টর ইজায আহমাদ সামদানী[4]

 

মোটকথা, শরীআহসম্মত উপায়ে হালাল পেনশন স্কিমের নানা মডেল করা সম্ভব। প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। 

 

প্রস্তাবিত সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম কেন গ্রহণ করা উচিত?

 

মাননীয় সরকারের প্রস্তাবিত থিমের তুলনায় আমাদের প্রস্তাবিত সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম নানা দিক থেকে অগ্রগণ্য ও অনুকরণীয়। যথা:

 

১. অর্থনীতির বিচারে

 

সর্বজনীন স্কিমের আওতায় যে বিষয়টি সবচেয়ে মূখ্য তা হলো, মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা। প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী ৬০ বছর পর গ্রাহক আর্থিক সুবিধা ভোগ করা শুরু করবেন। এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ফান্ডের সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিত করা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, উক্ত তহবিল যদি সম্পূর্ণ পৃথক রাখা যায় আর এর বিনিয়োগ হয় সম্পদ ভিত্তিক সেক্টরে তাহলে এ দুটি উপাদান এমন যা উক্ত ফান্ডের সাসটেইনেবিলিটি এনশিওর করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবে। পক্ষান্তরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী সরকারের প্রস্তাবে উক্ত দুটি শক্তিশালী উপাদান তথা ফান্ড সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ ও সম্পদ ভিত্তিক বিনিয়োগ অনুপস্থিত। 

প্রকাশ থাকে যে, ফান্ড সরকারের প্রস্তাবেও পৃথক থাকবে, তবে আমাদের শারীআহ ফ্রেমওয়ার্কে পৃথক থাকার অর্থ, এর একটি আইনী সত্ত্বাও স্বীকার করা। এ ফান্ডে না গ্রাহক, না সরকার কারও মালিকানা থাকবে না। এতো স্বচ্ছ পৃথকীকরণ বিদ্যমান কাঠামোতে নেই।

 

২. গ্রহণযোগ্যতার বিচারে

 

যেমনটি শুরুতে বলা হয়েছে, এ দেশে ৯০ শতাংশের অধিক জনগোষ্ঠী মুসলিম। দেশের আলেম সমাজের বৃহৎ প্রভাব রয়েছে সমাজে। চাইলেই যেকোনো আর্থিক প্রোডাক্ট এ দেশে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব নয়। এর বড় উদাহরণ প্রচলিত সঞ্চয়পত্র। এটির আবেদন হারিয়ে যাওয়ার পেছনে শরীআহসম্মত না হওয়াও একটি কারণ। তদ্রূপ দেশে ইসলামী বীমাও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রকৃত অর্থে শারীআহ পরিপালন না করা অন্যতম কারণ। সুতরাং ফান্ড সুদৃঢ় করতে হলে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রায়োরিটি পাবে। সেটি করতে হলে শরীআহ ফ্রেমওয়ার্কিংয়ের বিকল্প নেই।

 

৩. আস্থার বিনির্মাণ

 

সরকারের যেকোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মানুষের আস্থার বিনির্মাণ অন্যতম একটি ইস্যু। আলোচিত প্রোডাক্টটি শরীআহসম্মত না হওয়ায় মুসলিম জনগণের আস্থা তৈরি হবে না।

 

শেষ কথা

 

প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একে আমরা সানন্দে সাধুবাদ জানাই। একই সাথে এর গ্রহণযোগ্যতা, আস্থা, টেকসই ও শরীআহ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা মনে করি, বিদ্যমান সর্বজনীন পেনশন স্কিমের পরিবর্তে আমাদের প্রস্তাবিত সর্বজনীন হালাল পেনশন স্কিম গ্রহণ করা হলে, তা সর্ববিবেচনায় শ্রেষ্ঠ একটি কাজ বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা সরকারের পক্ষ থেকে একটি অবিস্মরণীয় অবদান হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি সদকায়ে জারিয়াও হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

 

আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হালাল সর্বজনীন পেনশন বাস্তবায়নের উদ্যোগী হবেন। এক্ষেত্রে দেশের হক্কানী উলামায়ে কেরাম ও আইএফএ কনসালটেন্সি টিম সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ইনশাআল্লাহ।

 

লেখক: সহকারী মুফতী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন

সহযোগিতায়, মুফতী যুবায়ের আব্দুল্লাহ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম দিলুরোড, মগবাজার, ঢাকা

 



[1]  http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1421.html

[2]  https://www.dpp.gov.bd/bgpress/bangla/index.php/document/get_extraordinary/49984

[3] https://www.mcbfunds.com/mfunds/alhamra-islamic-pension-fund-debt/

[4]  https://www.mcbfunds.com/downloads-2-2/shariah-certificate/

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম : বিভ্রান্তি নিরসনে মুসলমানদের যা জানা দরকার

...

আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৯৭৮০ বার দেখা হয়েছে

লেনদেনে অসচ্ছতাঃ প্রতিকার কী?

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৫৩৬ বার দেখা হয়েছে