প্রবন্ধ
রঙিন দুনিয়ার ধোঁকা ও বাস্তবতা :
লেখক:মুফতি তারেকুজ্জামান
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
৬৮২৯ বার দেখা হয়েছে
০ মন্তব্য
যত দিন যাচ্ছে, মানুষের চাহিদা ততই বাড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তি মানবজীবনে কিছু সুবিধা দিলেও কেড়ে নিয়েছে জীবনের সজীবতা। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন উদ্ভাবন মানুষকে ক্রমশ অমানুষ বানিয়ে দিচ্ছে। সামাজিক জীবনে হৃদ্যতা, আতিথেয়তা ও স্বার্থহীনতা বিরল জিনিসে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বাসের ক্ষেত্রগুলো দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। অসততা, অস্বচ্ছতা ও ধোঁকাবাজি এখন সর্বত্র জায়গা করে নিচ্ছে। আধুনিক দুনিয়ার বহির্ভাগ তো চকচকে, কিন্তু এর অভ্যন্তরে ভয়ংকর অন্ধকার। বাহিরটা দেখতে যতটা সুন্দর, ভেতরটা ঠিক ততটাই কুৎসিত। মোটকথা, সমাজের চোখে আধুনিক সময়ের মানুষ সুখী বলে মনে হলেও ভেতরে ভেতরে কষ্টের দাবানলে সে প্রতিদিন জ্বলেপুড়ে মরছে। না পারছে কাউকে বলতে, আর না পারছে হৃদয়ে জমে থাকা কষ্টগুলো সহ্য করতে। এ হিসেবে বলা যায়, মানবজাতি অত্যন্ত কঠিন ও সঙিন একটি সময় পার করছে।
বিলাসী একটি বাড়ি, নিউ মডেলের একটি গাড়ি আর একটি সরকারি চাকরি যেন মানুষের পরম আরাধ্য। পাশাপাশি কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের কামনা, সুন্দরী রমনীর বাসনা, আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের তামান্না মানুষকে পরিণত করেছে পুরোপুরি যান্ত্রিক এক রোবটে। দুনিয়ার এ আকর্ষণ মূলত এক মরীচিকা, যা দূর থেকে দেখতেই কেবল সুন্দর, কিন্তু বাস্তবতা সেখানে কেবলই শূন্য। আগের সময়ের ন্যাচারাল জীবনই ছিল প্রকৃত জীবন। আর সে ন্যাচারাল জীবনের সাথে সংগতিপূর্ণ একমাত্র জীবনব্যবস্থা ছিল ইসলাম। তখন জাগতিক কিছু সুবিধা কম থাকলেও সমাজে ছিল শৃঙ্খলা আর মানুষের জীবনে ছিল সুখ, শান্তি ও সজীবতা। শিশুদের কোলাহলে ছিল প্রাণবন্ততা, আর বড়দের জীবনে ছিল নিয়ন্ত্রিত কর্মব্যস্ততা। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা এসে মানুষের জীবনের অর্থই পাল্টে দিয়েছে। সুন্দর জীবনকে করে তুলেছে অশান্ত, আর সমাজে সৃষ্টি করেছে অরাজকতা ও চরম বিশৃঙ্খলা।
বর্তমানে মানুষের মারাত্মক এক সমস্যা হলো, অপ্রয়োজনীয় চাহিদাকে নিজের জীবনে জায়গা দেওয়া। কারও হয়তো কোনোই প্রয়োজন নেই, তবুও সে নানা বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার ফাঁদে পড়ে নিজের জীবনে নতুন চাহিদা সংযুক্ত করছে। নিত্যনতুন আসবাব দিয়ে ঘর ভরিয়ে তুলছে। রকমারি পোশাক-আশাকে নিজেকে সজ্জিত করছে। হরেক রকমের বাহারি আইটেমের খাবার দিয়ে উদর পূর্ণ করছে। মানুষকে দেখানোর জন্য, নিজের স্ট্যাটাস বুঝানোর জন্য ডিলাক্স ফ্ল্যাট, ডুপ্লেক্স বাড়ি, আধুনিক গাড়ির পেছনে ছুটছে। এভাবে অপ্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত ও ব্যস্ত মানুষটি আধুনিক লাইফস্টাইল গোছাতে গোছাতে একদিন হঠাৎ করেই কবরে চলে যায়। পেছনে রেখে যায় নিজের কষ্টার্জিত অঢেল সম্পদ আর অকৃতজ্ঞ কিছু ওয়ারিশ। কবরে পোকারা তার লাশ খেতে থাকে, আর এদিকে তার অবাধ্য সন্তানেরা বিনা পরিশ্রমের সম্পদ দিয়ে হারাম বিলাসিতা ও অবৈধ ফূর্তিতে মেতে ওঠে। আহ দুনিয়া! হায় জীবন!
আধুনিক সভ্যতা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মুসলিমদের। যাপিত জীবনে ইসলাম মানার প্রবণতা ও দ্বীনদারিতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে কমিয়ে এনেছে। বস্তুবাদী জীবন মানুষকে ইসলাম ছেড়ে সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভোগবাদী দর্শন মানুষকে পশুর কাতারে নামিয়ে আনছে। পুরো মানবসভ্যতা কেমন যেন দুনিয়ানির্ভর হয়ে পড়েছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আস্তে আস্তে দ্বীনদার ও আলিমদের মাঝেও বিস্তার লাভ করছে। স্বার্থপরতা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসেছে। মুখলিস ভাইদের আত্মত্যাগ ও দাওয়াতের মেহনতে অল্প কিছু মানুষ দ্বীনের পথে অবিচল থাকলেও বেশিরভাগই রঙিন দুনিয়ার ধোঁকায় প্রতারিত হচ্ছে। এ সঙিন মুহূর্তে তাই জীবনের চাহিদাকে সীমিত করে দ্বীনের ক্ল্যাসিকাল বুঝকে আঁকড়ে ধরে জীবন পার করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ আমাদের রঙিন দুনিয়ার ধোঁকা থেকে বাঁচিয়ে রেখে আমৃত্যু দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন।
আধুনিক সময়ে এসে মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে। শান্তির তালাশে মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছে। নিজের ও পরিবারের এত এত চাহিদা পূরণ করেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত শান্তির দেখা। বস্তুত আমরা যখন রবের প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা ছেড়ে তাঁর সৃষ্টির রচিত জীবনব্যবস্থার দারস্থ হয়েছি তখন থেকেই আমাদের জীবন থেকে শান্তি বিদায় নিয়েছে। আমরা রবের বিধান ও তাঁর জীবনব্যবস্থা থেকে যত দূরে সরতে থাকব আমাদের জীবনে অশান্তি তত বেশি প্রকট হয়ে দেখা দেবে। তাই মানবরচিত জীবনব্যবস্থা ও জাগতিক আসবাবে শান্তির তালাশ না করে আমরা যদি আবারও ফিরে যাই সাড়ে চোদ্দশ বছরের আগের জীবনধারায়, যদি আমরা নিজেদের জীবনে ও সমাজে আবারও প্রতিষ্ঠা করি রবের দেওয়া জীবনবিধান তাহলে বেশ নিশ্চয়তার সাথেই বলা যায় যে, মানুষের কাঙ্ক্ষিত সেই সুখ-শান্তি আবার ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের আধুনিক সভ্যতার ধোঁকা বোঝার এবং মানবরচিত জীবনপদ্ধতি ছেড়ে রবের দেওয়া জীবনব্যবস্থায় ফিরে আসার তাওফিক দান করুন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
শয়তান যেভাবে মানুষকে ধোঁকা দেয়
শয়তান মানুষের শত্রু। সে সর্বদা ফাঁদ পেতে বসে থাকে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। শয়তান মানুষকে নানাভাবে ...
মুফতি জাওয়াদ তাহের
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৯৬৫০ বার দেখা হয়েছে
ইস্যুময় জীবন : ধ্বংসাত্মক একটি ফাঁদ
ইস্যুময় জীবন মূলত একটি ফাঁদ, যা মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য ভুলিয়ে তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। ইস্যুর ফাঁদে...
মুফতি তারেকুজ্জামান
৯ নভেম্বর, ২০২৪
২২৫২ বার দেখা হয়েছে