প্রবন্ধ
নামাযের প্রভাব
নামাযের
আদ্যোপান্ত নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায়, নামায কত
বড় প্রভাবক বিষয়। মুমিন যদি সচেতনভাবে নিয়মিত নামায আদায় করে, তাহলে অবশ্যই নামায তাকে ভেতরে-বাইরে উন্নত থেকে উন্নত
অবস্থানে নিয়ে যাবে। নামাযের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করুন :
এক. নামায
হচ্ছে পবিত্রতা
নামাযের
জন্য পবিত্রতা অর্জন অপরিহার্য। তাহলে নামায আদায়ের শুরু পবিত্রতা অর্জনের
মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন -
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا
اِذَا قُمْتُمْ اِلَي الصَّلٰوةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ وَ اَيْدِيَكُمْ اِلَي
الْمَرَافِقِ وَ امْسَحُوْا بِرُءُوْسِكُمْ وَ اَرْجُلَكُمْ اِلَي الْكَعْبَيْنِ
وَ اِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا وَ اِنْ كُنْتُمْ مَّرْضٰۤي اَوْ
عَلٰي سَفَرٍ اَوْ جَآءَ اَحَدٌ مِّنْكُمْ مِّنَ الْغَآىِٕطِ اَوْ لٰمَسْتُمُ
النِّسَآءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَآءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا
فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَ اَيْدِيْكُمْ مِّنْهُ مَا يُرِيْدُ اللهُ
لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِّنْ حَرَجٍ وَّ لٰكِنْ يُّرِيْدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَ
لِيُتِمَّ نِعْمَتَهٗ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.
হে
ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযের উদ্দেশ্যে ওঠো তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও কনুইসহ হাত
ধৌত করবে। তোমাদের মাথায় মাসেহ করবে এবং পা টাখনুসহ (ধৌত করবে)। আর যদি গোসল জরুরি
এমন নাপাক অবস্থায় থাক, তাহলে
সমধিক পবিত্রতা অর্জন করবে (গোসল করবে)। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা
তোমাদের কেউ শৌচস্থান থেকে আসে কিংবা স্ত্রী সহবাস কর; অতঃপর পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটির ইচ্ছা করবে; তা দ্বারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও হাতে মাসেহ করবে। আল্লাহ
তোমাদের ওপর কোনোরূপ কষ্ট আরোপ করতে চান না, তিনি
তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর দান পূর্ণ করতে চান। যাতে তোমরা
শোকর কর। - সূরা
মায়েদা (৫) : ৬
ওযু-গোসলের
বিধান পবিত্রতার জন্য। তবে এর মাধ্যমে যে পরিচ্ছন্নতাও অর্জিত হয় তা তো খুবই
স্পষ্ট। ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত হচ্ছে মিসওয়াক, যা ওযুর সময় আরো তাকীদপূর্ণ। মিসওয়াকের তাৎপর্য উল্লেখ করে
হাদীস শরীফে বলা হয়েছে -
السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ، مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ.
মিসওয়াক
হচ্ছে মুখের পবিত্রতা (পরিচ্ছন্নতা) ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়। - সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫
আমরা জানি, মানুষের উন্নত জীবনের অনুষঙ্গগুলোর একটি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা।
ইসলামী জীবনধারায় তা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ ইসলামে ফরজ-নফল সবধরনের নামাযে
পবিত্রতা অপরিহার্য। আর আগে বলা হয়েছে, ওযু-গোসলের
বিধানের অন্যতম সুফল ও তাৎপর্য হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা। কাজেই নিয়মিত নামায আদায়কারী
যখন নিজেকে পাক-পবিত্র রাখবে তখন এর মধ্য দিয়ে তার মধ্যে পরিচ্ছন্নতার স্বভাবও
তৈরি হবে।
উল্লেখ্য, পবিত্রতা সাধারণ পরিচ্ছন্নতার চেয়ে উন্নত বিষয়। ইসলামে
পবিত্রতার যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তার ন্যূনতম সুফলটি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা, যা সভ্য জীবনের অতি বড় অনুষঙ্গ।
পবিত্রতার
দ্বারা শুধু দৈহিক পরিচ্ছন্নতাই নয়, পাপের
কালিমা থেকেও পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়। হাদীস শরীফে পবিত্রতার এই সুফল অত্যন্ত
হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।
আবু
হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -
إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ -أَوِ الْمُؤْمِنُ- فَغَسَلَ وَجْهَه خَرَجَ مِنْ وَجْهِه كُلُّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْه مَعَ الْمَاءِ -أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ- فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ -أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ- فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلُّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلاَهُ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوبِ.
কোনো মুমিন
বান্দা যখন ওযু করে, ওযুতে সে
যখন তার মুখমণ্ডল ধৌত করে তখন তার মুখমণ্ডল থেকে পানির সাথে ঐসব গোনাহ ঝরে পড়ে, যার দিকে সে দুই চোখ দিয়ে তাকিয়েছিল। এরপর যখন সে দুই হাত
ধৌত করে তখন দুই হাত থেকে পানির সাথে ঐসকল গোনাহ ঝরে পড়ে, যা সে হাত দিয়ে করেছিল। এরপর যখন সে দুই পা ধৌত করে তখন
পানির সাথে ঐসকল গোনাহ বের হয়ে যায়, যার মধ্যে
সে পা দিয়ে চলেছিল। পরিশেষে সে গোনাহ থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। - সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪
উসমান ইবনু
আফফান রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِه، حَتَّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِه.
যে ওযু করে
ও উত্তমরূপে ওযু করে, তার শরীর
থেকে গোনাহসমূহ বের হয়ে যায়। এমনকি তার নখের নিচ থেকেও বের হয়ে যায়। - সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৫
আবু
হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -
أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ. قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ! قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ، فَذূلِكُمُ الرِّبَاطُ.
আমি কি
তোমাদেরকে ঐ বিষয়ের দিকে নির্দেশনা দেব না, যারা
দ্বারা আল্লাহ তাআলা গোনাহসমূহ মুছে দেবেন এবং মর্তবাসমূহ বুলন্দ করবেন?
সাহাবীগণ
বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, অবশ্যই বলুন।
তিনি বললেন, কষ্টের সময়গুলোতে পূর্ণ ওযু করা, মসজিদের দিকে অধিক পদক্ষেপ এবং এক নামাযের পর অন্য নামাযের
অপেক্ষা করা। এই হচ্ছে ‘সীমান্ত প্রহরা’। - সহীহ
মুসলিম, হাদীস ২৫১
সহীহ
মুসলিমের একটি দীর্ঘ হাদীসে ওমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضَّأُ فَيُبْلِغُ -أَوْ فَيُسْبِغُ- الْوُضُوءَ ثُمَّ يَقُولُ: أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُه، إِلاَّ فُتِحَتْ لَه أَبْوَابُ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةُ، يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ.
তোমাদের যে
কেউ উত্তমরূপে ওযু করে বলবে -
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُه.
তার জন্য
জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে, যে দরজা
দিয়ে ইচ্ছা সে প্রবেশ করবে। - সহীহ
মুসলিম, হাদীস ২৩৪
তিরিমিযীর
বর্ণনায় এই দুআয় কালেমায়ে শাহাদাতের সাথে এই কথাটুকুও আছে -
اللّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ، وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ.
ইয়া
আল্লাহ! আমাকে অধিক তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং পূর্ণ পবিত্রতা
অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। - জামে
তিরমিযী, হাদীস ৫৫
তাহলে দেখা
যাচ্ছে, মনোযোগ ও আন্তরিকতার সাথে সুন্নাহ মোতাবেক ওযু
করার দ্বারা শুধু দৈহিক পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতাই অর্জিত হয় না, গোনাহের কালিমা থেকেও পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়। সর্বোপরি
আল্লাহ তাআলার অপার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।
দুই. নামায
আল্লাহ তাআলার স্মরণ
আল্লাহর
স্মরণ সকল পুণ্যের চাবিকাঠি, সকল পাপ
থেকে বাঁচার উপায়। মানুষ যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয় বা আল্লাহকে ভুলে যায়
তখনই সে অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হয়। মানুষের মনে আল্লাহর স্মরণ যত গভীর হবে, ততই তা জীবন ও কর্মকে পরিশীলিত করবে।
নামায
হচ্ছে আল্লাহ তাআলার স্মরণের গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে -
اِنَّنِیْۤ اَنَا اللهُ لَاۤ
اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعْبُدْنِیْ وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِیْ.
নিশ্চয়ই
আমিই আল্লাহ। আমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। অতএব আমার ইবাদত করবে এবং আমার স্মরণে
নামায আদায় করবে। - সূরা ত্বহা
(২০) : ১৪
বান্দার
প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাওহীদ অবলম্বন করা। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আকীদা-বিশ্বাসে সম্পূর্ণরূপে
শিরক থেকে পবিত্র হয়ে যাওয়া এবং এক আল্লাহর ইবাদত করা।
আল্লাহ
তাআলার সবচেয়ে মহিমান্বিত ইবাদত হচ্ছে নামায। বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে নামায
আদায় করবে। নামাযেও আল্লাহকে স্মরণ করবে।
এই আয়াতে
বর্ণিত সম্বোধন হযরত মূসা আ.-কে লক্ষ করে হলেও কুরআন মাজীদে তা বর্ণনার তাৎপর্য
হচ্ছে উম্মতে মুহাম্মাদীও এই বিধানের অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তে নামাযের যে ওয়াক্ত
নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তাতে অবশ্যই আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে এবং তাঁর স্মরণে
নামায আদায় করতে হবে। এর বাইরেও অন্যান্য সময় আল্লাহর স্মরণে নফল নামায আদায় করা, এমনকি কখনো নিদ্রা বা অন্য কোনো কারণে নামায কাযা হয়ে গেলে
চেতন হওয়া মাত্র যখন নামাযের কথা মনে পড়ে তখন পবিত্র হয়ে নামায আদায় করাও এ আয়াতের
বিধানের অন্তর্ভুক্ত।
অন্য আয়াতে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে -
اُتْلُ مَاۤ اُوْحِيَ اِلَيْكَ مِنَ الْكِتٰبِ
وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ
الْمُنْكَرِ وَ لَذِكْرُ اللهِ اَكْبَرُ وَ اللهُ يَعْلَمُ مَا
تَصْنَعُوْنَ.
আপনার কাছে
যে কিতাব ওহী করা হয়েছে তা পাঠ করুন এবং নামায আদায় করুন। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও
গর্হিত কাজ থেকে নিষেধ করে। আর আল্লাহর স্মরণ তো সবচেয়ে বড়। তোমরা যা কর আল্লাহ তা
জানেন। - সূরা
আনকাবূত (২৯) : ৪৫
এই আয়াতে
নামাযের দুটো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নামায নামাযীকে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে নিষেধ করে। নামাযে
কুরআন তিলাওয়াত করা হয় আর কুরআন মানুষকে সব রকমের অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে নিষেধ
করে। কারণ নামাযের কিয়াম, রুকু, সিজদা, নামাযের
যিকির ও তাসবীহ নামাযীকে আল্লাহ তাআলার সাথে তার আব্দিয়াতের সম্পর্ক নবায়ন করে
দেয়। কাজেই যে নামাযের উচ্চারিত-অনুচ্চারিত বাণী শ্রবণ করে, সে বুঝতে পারে যে, নামায তাকে
সব রকমের অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে বলছে।
দ্বিতীয়
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্লাহর
স্মরণ। এটি আরো বড় বৈশিষ্ট্য। চিন্তা করলে বোঝা যাবে, নামাযী মুখ, অন্তর ও
গোটা দেহের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণে নিবেদিত হয়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাঁর ইবাদতের
জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর সর্বোত্তম ইবাদত হচ্ছে নামায, যা মন-মস্তিষ্ক, মুখ ও
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা সম্পন্ন হয়। আলী রা. থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের নামাযে পঠিত দুআর বৃত্তান্ত সম্বলিত একটি দীর্ঘ হাদীসে সিজদার দুআ
সম্পর্কে আছে যে, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় বলতেন -
اللّূهُمَّ لَكَ سَجَدْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ، سَجَدَ وَجْهِى لِلَّذِى خَلَقَه وَصَوَّرَه، وَشَقَّ سَمْعَه وَبَصَرَه، تَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ.
ইয়া
আল্লাহ! আপনারই জন্য সিজদা করেছি, আপনারই
প্রতি ঈমান এনেছি, আপনারই
সামনে অনুগত-সমর্পিত হয়েছি। আমার মুখমণ্ডল তাঁকেই সিজদা করেছে, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, রূপ দান করেছেন, এর চোখ-কান
কেটেছেন। প্রভূত বরকতময় আল্লাহ, সকল
স্রষ্টার সর্বোত্তম স্রষ্টা। - সহীহ
মুসলিম, হাদীস ৭৭১
নামাযে
রুকু-সিজদার তাসবীহ ও অন্যান্য রোকনের যিকির-তিলাওয়াতে আল্লাহ তাআলার স্মরণের
অত্যন্ত গভীর উপাদান রয়েছে। নামাযী যত বেশি আল্লাহকে স্মরণ করবে, আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্বকে অন্তরে জাগ্রত করবে, ভেতর-বাইরে একাগ্র-একনিষ্ঠ থাকবে, নামায ততই পূর্ণাঙ্গ হবে এবং নামাযের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ততই
অর্জিত হতে থাকবে।
বলার
অপেক্ষা রাখে না যে, আল্লাহর
স্মরণই অভিষ্ট লক্ষ্য এবং এটি ঐ মহান উপাদান, যা মানুষকে
দুনিয়া-আখেরাতে মহা কল্যাণের অধিকারী করে এবং চূড়ান্ত অকল্যাণ থেকে রক্ষা করে।
এখানে
আরেকটি বিষয়ও রয়েছে। আর তা হচ্ছে, বান্দা যখন
আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহ তাআলাও তাকে স্মরণ করেন। ইরশাদ হয়েছে -
فَاذْكُرُوْنِیْۤ اَذْكُرْكُمْ.
তোমরা
আমাকে স্মরণ কর, তাহলে আমি
তোমাদের স্মরণ করব। - সূরা
বাকারা (০২) : ১৫২
আল্লাহ
তাআলা বান্দাকে স্মরণ করার অর্থ, তাঁর পক্ষ
থেকে অনুগ্রহে ভূষিত হওয়া, নূর, হেদায়েত, রহমত ও
মাগফিরাত লাভ করা। আল্লাহ তাআলার এই মহা অনুগ্রহ যে বান্দার নিজের কর্ম থেকে অনেক
অনেক বড় তা তো বলাই বাহুল্য। বান্দাও আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ্ও বান্দাকে স্মরণ করেন। কিন্তু আল্লাহর স্মরণ
বান্দার স্মরণের চেয়ে অনেক বড়, অনেক মহান।
আল্লাহ তাআলার দয়ায় বান্দা গোনাহ থেকে পাকসাফ হয়ে যায়।
আবু
হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -
أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهَرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ، يَغْتَسِلُ فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسًا، مَا تَقُولُ ذلِكَ؟ يُبْقِي مِنْ دَرَنِه؟ قَالُوا: لَا يُبْقِي مِنْ دَرَنِه شَيْئًا، قَالَ: فَذلِكَ مِثْلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا.
বল তো, তোমাদের কারো দরজায় যদি একটি নহর থাকে, যাতে সে প্রতিদিন পাঁচ বার গোসল করে, তাহলে কী বল, তার দেহে
কি কোনো ময়লা থাকতে পারে? সাহাবায়ে
কেরাম বললেন, তার দেহে
কোনো ময়লাই থাকবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটি হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উপমা। - সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৮
তিন.
নামাযে রয়েছে পঠন, শ্রবণ ও
উপলব্ধি
নামায
ধ্যান-খেয়ালের সাথে আদায় করা কাম্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে -
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ،
الَّذِيْنَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ .
নিশ্চয়ই
মুমিনগণ সফল হয়েছে, যারা তাদের
নামাযে বিনয়াবনত।... - সূরা
মুমিনুন (২৩) : ১-২
উসমান রা.
থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -
مَا مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُهُ صَلاَةٌ مَكْتُوبَةٌ، فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا، إِلاَّ كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ، مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً،وَذلِكَ الدَّهْرَ كُلَّه.
যে
মুসলিমের সামনে ফরয নামায উপস্থিত হয়, অতঃপর সে
ভালোভাবে ওযু করে, খুশূ
অবলম্বন করে, উত্তমরূপে
রুকু করে, এই নামায তার পূর্বের গোনাহসমূহের কাফফারা হয়ে
যায়, যে পর্যন্ত সে কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। আর
এই পুরস্কার সবসময়ের জন্য। - সহীহ
মুসলিম, হাদীস ২২৮
তাহলে বোঝা
যাচ্ছে, ক্ষমা ও সাফল্য তাদের জন্য, যারা খুশূর সাথে নামায আদায় করে। খুশূ মূলত অন্তরের নম্রতা।
আর এর বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থিরতা ও নম্রতার মধ্য দিয়ে। বলার
অপেক্ষা রাখে না যে, বান্দা
তখনই নামাযে খুশূওয়ালা তথা বিনয়াবনত হয় যখন তার উপলব্ধিতে থাকে যে, সে মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়েছে। নামাযে যা
বলা হয় এবং যা পড়া হয় তার দিকে মনোযোগ নিবিষ্ট রাখে। আলেমগণ বলেছেন, খুশূর প্রথম ধাপ হচ্ছে, নামাযে
পঠিত বিষয়াদির দিকে ধ্যান রাখা। যা বলা হচ্ছে তা অন্তর থেকে বলা, যা পড়া হচ্ছে অন্তর থেকে পড়া। এভাবে মনোযোগের সাথে যখন
নামায পড়া হবে তখন তা মুমিনের সাফল্যের উপায় হবে। তার ঈমান বাড়তে থাকবে, ইলম বাড়তে থাকবে। অন্তরের অবস্থার উন্নতি হবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে স্থিরতা আসবে এবং চিন্তা-চেতনায়, কাজ-কর্মে বিনয়, নম্রতা ও
আল্লাহমুখিতা তৈরি হবে।
চার. নামায
হচ্ছে দুআ
আরবী ভাষায় ‘সালাত’ শব্দের মূল
আভিধানিক অর্থ দুআ। কুরআন মাজীদেও ‘সালাত’ শব্দটি এই
অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে ইরশাদ হয়েছে -
خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ
صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ اِنَّ
صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ.
তাদের
সম্পদ থেকে সদাকা গ্রহণ করুন; যার
মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন। আর তাদের জন্য দুআ করুন। নিশ্চয়ই
আপনার দুআ তাদের জন্য প্রশান্তির উপকরণ। - সূরা তাওবা
(৯) : ১০৩
নামাযকে ‘সালাত’ নামে
নামকরণের অন্যতম কারণ নামাযের তিলাওয়াত ও যিকির-তাসবীহতে দুআর উপস্থিতি। ইমাম নববী
রাহ. বলেন -
هذا قول جماهير أهل اللغة العربيّة والفقهاء وغيرهم.
এটি
অধিকাংশ আরবী ভাষাবিদ, ফিকহশাস্ত্রবিদ
ও অন্যদের বক্তব্য।
লক্ষ করলে
দেখা যাবে, নামাযের সিংহভাগ বিষয়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে
দুআ। সূরাতুল ফাতিহা, যা প্রতি
নামাযে অবশ্যপঠনীয়, তার
গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার কাছে সরল পথের প্রার্থনা ও দুআ।
সহীহ
মুসলিমে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন -
قَسَمْتُ الصَّلَاةَ بَيْنِي وَبَيْنَ عَبْدِي نِصْفَيْنِ، وَلِعَبْدِي مَا سَأَلَ.
আমি
সালাতকে (অর্থাৎ, সূরাতুল
ফাতিহাকে) আমার ও আমার বান্দার মাঝে অর্ধাঅর্ধি ভাগ করেছি। আর আমার বান্দা যা
চেয়েছে তা সে পাবে।
বান্দা যখন
বলে -
اَلْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ
الْعٰلَمِيْنَ.
(সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি
জগৎসমূহের প্রতিপালক।)
আল্লাহ
তাআলা বলেন -
حَمِدَنِيْ عَبْدِيْ.
আমার বান্দা
আমার প্রশংসা করেছে। যখন সে বলে -
الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ.
(যিনি সকলের প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু)
আল্লাহ
তাআলা বলেন -
أَثْنَى عَلَيَّ عَبْدِي.
আমার
বান্দা আমার গুণগান করেছে। যখন সে বলে -
مٰلِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ.
(যিনি কর্মফল-দিবসের মালিক)
আল্লাহ
তাআলা বলেন -
مَجَّدَنِي عَبْدِي.
আমার
বান্দা আমার মহত্ব বর্ণনা করেছে।
যখন সে বলে -
اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِيَّاكَ
نَسْتَعِيْنُ.
[(হে আল্লাহ) আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য
চাই।]
তখন আল্লাহ
তাআলা বলেন -
هَذَا بَيْنِي وَبَيْنَ عَبْدِي، وَلِعَبْدِي مَا سَأَلَ.
এটা আমার ও
আমার বান্দার মাঝে। আর আমার বান্দা যা চেয়েছে তা সে পাবে।
যখন সে বলে -
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ
الْمُسْتَقِيْمَ، صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ، غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ
عَلَيْهِمْ وَ لَاالضَّآلِّيْنَ.
তখন আল্লাহ
তাআলা বলেন -
هَذَا لِعَبْدِي وَلِعَبْدِي مَا سَأَلَ.
এটা আমার
বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চেয়েছে তা সে পাবে। - সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৫
এছাড়া
নামাযের ছানা, রুকু-সিজদার
তাসবীহ ইত্যাদিও পরোক্ষভাবে দুআ। কারণ মহান দাতার সামনে তাঁর প্রশংসা ও পবিত্রতা
বর্ণনা তাঁর কৃপা লাভেরই প্রার্থনা। একারণে কোনো কোনো হাদীসে আল্লাহর যিকিরকেও ‘দুআ’ নামে
আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে -
আরাফার দিন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ দুআ এই ছিল -
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
আর নামাযের
আত্তাহিয়্যাতু ও দরূদের পর বিশেষভাবে দুআ পাঠের নিয়ম রয়েছে।
সহীহ
বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ‘আত্তাহিয়্যাতু’ শিক্ষা দান করেছেন। এরপর বলেছেন -
ثُمَّ يَتَخَيَّرُ مِنْ الدُّعَاءِ أَعْجَبَهُ إِلَيْهِ فَيَدْعُو.
এরপর
নামাযী তার কাছে সবচেয়ে পছন্দের দুআটি নির্বাচন করে দুআ করবে। - সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৩৫
সালামের
মাধ্যমে নামায সমাপ্ত হয়। সালামের বাক্যটিও মূলত দুআ। নামায সমাপ্ত হওয়ার পর হাদীস
শরীফে বিভিন্ন দুআর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখানে কিছু দুআ উল্লেখ করছি।
সহীহ হাদীস
থেকে নামাযের পরের কিছু দুআ
১. ছাওবান
রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে তিনবার
ইস্তিগফার করতেন এবং বলতেন -
اللّهُمَّ أَنْتَ السَّلَامُ
وَمِنْكَ السَّلَامُ، تَبَارَكْتَ ذَا الْجَلَالِ وَالْإكْرَامِ.
[ইয়া আল্লাহ! আপনিই ‘সালাম’ (শান্তিদাতা)। শান্তি আপনারই পক্ষ থেকে। হে প্রতাপ ও
মর্যাদার মালিক! আপনি প্রভূত বরকতময়।] - সহীহ
মুসলিম, হাদীস ৫৯১
নামাযের পর
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরোক্ত দুআ পড়ার বিষয়টি উম্মুল মুমিনীন
আয়েশা রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯২]
২. মুগীরা
ইবনে শো‘বা রা.-এর
কাতিব ওয়াররাদ বলেন, মুগীরা
ইবনে শো‘বা রা.
মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা.-কে লিখেছেন যে, আল্লাহর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক (ফরয) নামাযের সালাম ফেরানোর পর
বলতেন -
لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، اللّূهُمَّ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ.
(আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁর, প্রশংসা তাঁর। তিনি সব কিছুর ওপর শক্তিমান। ইয়া আল্লাহ!
আপনি যা দান করেছেন তা রোখার কেউ নেই। আর আপনি যা থেকে বঞ্চিত করেছেন তা দেওয়ার
কেউ নেই। আর সম্পদশালীর সহায়-সম্পদ আপনার বিরুদ্ধে কোনোই কাজে আসবে না।) - সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৪৪, ৬৩৩০, ৭২৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৩
৩.
আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রা. প্রতি নামাযের শেষে যখন সালাম ফেরাতেন বলতেন -
لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ، لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ، وَلَا نَعْبُدُ إِلَّا إِيَّاهُ، لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ، وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ، لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ، وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ.
(আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁর, প্রশংসা তাঁরই। আর তিনি সব কিছুর ওপর শক্তিমান। শক্তি ও
পরিবর্তন একমাত্র আল্লাহরই তাওফীকে।
আল্লাহ
ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করি। দান তাঁর। মর্যাদা তাঁরই, আর তাঁরই জন্য উত্তম প্রশংসা।
আল্লাহ
ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। উপাসনা-আনুগত্য একান্তই তাঁর জন্য। কাফিরদের তা অপছন্দের
হলেও।)
তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি নামাযের শেষে এই
বাক্যগুলো দ্বারা ‘তাহলীল’ করতেন। - সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৪
‘তাহলীল’ অর্থ ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’ বলা। উপরের দুআয় এই বাক্যটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে।
৪. হযরত
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি নামাযের পর তেত্রিশ বার ‘তাসবীহ’ করবে, তেত্রিশ বার ‘হাম্দ’ করবে এবং
তেত্রিশ বার ‘তাকবীর’ বলবে, ফলে নিরানব্বই হল, এরপর এই
দুআ দ্বারা একশত পূর্ণ করবে -
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
তার
পাপরাশি সাগরের ফেনা সমপরিমাণ হলেও ক্ষমা করে দেওয়া হবে। - সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৭
৫. হযরত
মুয়ায ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত
ধরলেন এবং বললেন, হে মুয়ায!
আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে
ভালবাসি। আল্লাহর কসম আমি তোমাকে ভালবাসি। এরপর বললেন, তোমাকে অসিয়ত করছি - হে মুয়ায!
কোনো নামাযের পর এই দুআ পড়তে ছেড়ো না -
اللّূهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ.
ইয়া
আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করুন; যেন আপনার
যিকির করি, আপনার শোকর করি এবং আপনার সুন্দর ইবাদত করি। - সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২২
এছাড়া আরো
যিকির ও দুআ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
তাহলে দেখা
যাচ্ছে, নামাযের ভেতর-বাহির মহান আল্লাহর কাছে
প্রার্থনায় পরিপূর্ণ।
পাঁচ.
নামায আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উপায়
এই নামায
মুমিনকে আল্লাহর নৈকট্য দান করবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে -
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَ اسْجُدْ
وَ اقْتَرِبْ۠ .
কখনো নয়, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। আপনি সিজদা করুন এবং (সিজদা ও
অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে) নিকটবর্তী হোন। - সূরা আলাক
(৯৬) : ১৯
নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায পড়তেন আবু জাহল নানাভাবে তাঁর নামাযে
বাধা সৃষ্টি করত। আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার পরোয়া না
করে নামায আদায়ে যত্নবান থাকার নিদের্শ দান করেছেন। তাঁর সকাশে সিজদা করতে এবং
তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে বলেছেন। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, নামাযে সিজদা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের বড় উপায়।
হাদীস
শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ.
বান্দা
আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সিজদাবনত। - সহীহ
মুসলিম, হাদীস ৪৮২
এখানে
আল্লাহ তাআলার বিশেষ নৈকট্যের কথা বলা হয়েছে। সাধারণভাবে গোটা সৃষ্টিজগৎ আল্লাহ
তাআলার জ্ঞান ও কর্তৃত্বের ভেতরে। এদিক থেকে সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুই আল্লাহ তাআলা
থেকে দূরে নয়। মুমিন-কাফের সবার সকল কর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পূর্ণ
অবগত। গোটা সৃষ্টিজগত তাঁর কবজার ভেতরে। তবে এটা হচ্ছে সাধারণ নিকটবর্তিতা। কিন্তু
আল্লাহ তাআলার বিশেষ নৈকট্য শুধু সৎকর্মপরায়ন মুমিনদের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّ رَحْمَتَ اللهِ قَرِیْبٌ
مِّنَ الْمُحْسِنِیْنَ.
নিশ্চয়ই
আল্লাহর রহমত ঈমানদার সৎকর্মপরায়নদের অতি নিকটে। - সূরা আরাফ
(০৭) : ৫৬
সেই
নৈকট্যের অর্থ তাঁর সন্তুষ্টি, দান ও
অনুগ্রহ। কাজেই সিজদার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্টি অর্জন করে, সবচেয়ে বেশি দান ও অনুগ্রহের পাত্রে পরিণত হয়।
উপরের
পাঁচটি বিষয় নামাযের মৌলিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত, এই বিষয়গুলো রক্ষা করে নামায আদায় করা হলে নিঃসন্দেহে এই
নামায বান্দার গোটা জীবন ও কর্মে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করবে। তার
চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস
ঈমানের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হবে, স্বভাব-চরিত্র
নির্মল ও পবিত্র হবে, কাজ-কর্ম
পরিশুদ্ধ ও গোনাহমুক্ত হবে। মহান আল্লাহ তাআলার দান ও অনুগ্রহে তার গোটা জীবন
সমৃদ্ধ ও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
আমাদের কর্তব্য, এই নামায শিক্ষা করা এবং সন্তান-সন্ততিকে এই মহা সম্পদের অধিকারী করে যাওয়ার চেষ্টা করা।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
স্থানীয় ভাষায় খুৎবা প্রদানঃ একটি দালীলিক পর্যালোচনা
...
অযু: ভিতর-বাহিরের পবিত্রতা অর্জনের উপায়
অযু এমন একটি আমল, যা আমরা প্রতিদিন করি এবং একাধিকবার করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য অযুর প্রয়োজন হয়। ...
ফজর নামাজ আদায়ে ১০ পুরস্কার
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَّلاةُ ، فَإِنْ ...
কাবলাল জুমআ চার রাকাত ; একটি দালিলিক পর্যালোচনা
একজন সম্মানিত আলিমের একটি কথা, যিনি রিয়াদ থেকে পি.এইচ.ডি করেছেন এবং এখন এদেশের একটি ইসলামী বিশ্ববিদ...