প্রবন্ধ

বয়স্কদের ইলম শেখা : কিছু সমস্যা ও সমাধান

লেখক:মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
৬ জুলাই, ২০২৪
৩৮২৩ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

আপনারা আর সাধারণ তালিবুল ইলম যারা তারা এক নয়। যেহেতু আপনারা সকলেই বয়স্ক। একেকজন একেক পেশার সঙ্গে যুক্ত। আপন স্থানে সবাই ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই আপনারা ইলম শেখার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। এটা অনেক বড় বিষয়। আপনাদের সঙ্গে এই দিক থেকে সাহাবায়ে কেরামের অদ্ভুত মিল রয়েছে। বস্তুত নৈশ বা বয়স্ক মাদরাসার এই শিক্ষাপদ্ধতি রাসূল ﷺ -এর যুগের সুফফার শিক্ষাপদ্ধতির নতুন রূপায়ণ।

কেননা ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরাম রাযি. সকলেই ছোট ছিলেন না; বরং তাদের অধিকাংশই ছিলেন বয়সে বড়। বয়স তাদের ইলম অণ্বেষণ ও শিক্ষাগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। 

যেমন হযরত সিদ্দীকে আকবর ছিলেন রাসূলে আরাবীর পর উম্মতের সবচেয়ে বড় আলেম। ইলমের ময়দানে তাঁর বিচরণ শুরু হয় প্রায় ৪০ বছর বয়সে। হযরত উমর ফারুক রাযি.-ও ৩০ বছর বয়সে ইলমের ময়দানে পা রাখেন। এছাড়া আবু যর রাযি., আবুদ দারদা রাযি., প্রমুখ উম্মতের সবচেয়ে জ্ঞানী এ মহামানবগণ ইলম শিখেছেন বয়স অনেক হয়ে যাবার পর। 


اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. ‏‏يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ  

بارك الله لنا ولكم في القرآن  العظيم ونفعني وإياكم بما فيه من الآيات والذكر الحكيم وجعلني وإياكم من الصالحين. أقول قولي هذا وأستغفر الله لي ولكم فاستغفروه إنه هو الغفور الرحيم. اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى الِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ.

মুহতারাম হাজেরীন! হাতে সময় কম। আরও মেহমান আছে। তাদের থেকে দামী ও জরুরি কথা শুনবেন। মাঝখানে আমাকে সময় দেয়া হয়েছে। আল্লাহর তাওফীকে অল্প সময়ে কথা শেষ করার ইচ্ছা রাখছি। এর জন্য প্রথমেই আপনাদের কাছে দোয়া কামনা করছি, আল্লাহ তাআলা যেন উপকারী কথা বলার তাওফীক দান করেন আমীন। 

বয়স্ক শিক্ষা : সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে অদ্ভুত মিল!

আজ আপনাদের সবক উদ্বোধন বা ইফতেতাহী মজলিস। অনেকেই ভর্তি হয়েছেন। অনেকে হবেন। আপনারা আর সাধারণ তালিবুল ইলম যারা তারা এক নয়। যেহেতু আপনারা সকলেই বয়স্ক। একেকজন একেক পেশার সঙ্গে যুক্ত। আপন স্থানে সবাই ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই আপনারা ইলম শেখার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। এটা অনেক বড় বিষয়। আপনাদের সঙ্গে এই দিক থেকে সাহাবায়ে কেরামের অদ্ভুত মিল রয়েছে। বস্তুত নৈশ বা বয়স্ক মাদরাসার এই শিক্ষাপদ্ধতি রাসূল ﷺ-এর যুগের সুফফার শিক্ষাপদ্ধতির নতুন রূপায়ণ।

কেননা ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরাম রাযি. সকলেই ছোট ছিলেন না; বরং তাদের অধিকাংশই ছিলেন বয়সে বড়। বয়স তাদের ইলম অণ্বেষণ ও শিক্ষাগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। 

যেমন হযরত সিদ্দীকে আকবর ছিলেন রাসূলে আরাবীর পর উম্মতের সবচেয়ে বড় আলেম। ইলমের ময়দানে তাঁর বিচরণ শুরু হয় প্রায় ৪০ বছর বয়সে। হযরত উমর ফারুক রাযি.-ও ৩০ বছর বয়সে ইলমের ময়দানে পা রাখেন। এছাড়া আবু যর রাযি., আবুদ দারদা রাযি., প্রমুখ উম্মতের সবচেয়ে জ্ঞানী এ মহামানবগণ ইলম শিখেছেন বয়স অনেক হয়ে যাবার পর। 

ইমাম বুখারী রহ. বলেন

وَقَدْ تَعَلَّمَ أَصْحَابُ النَّبِيّ فِي كِبَرِ سِنِّهِمْ

বয়স বেশি হওয়ার পরও ইলম শিক্ষা কর। কারণ অধিকাংশ সাহাবী তো বয়স অধিক হওয়ার পরই দীনি ইলম শিক্ষা করেছেন। 

(সহীহ বুখারী : ৩৯)

কিছু অপ্রিয় অভিজ্ঞতা 

আলহামদুলিল্লাহ আজকের এই মজলিসের সকলেই বয়স্ক। এ জন্য আপনাদের প্রতি এই মুহূর্তে অন্তরে একটু আলাদা মহব্বত অনুভব করছি। তবে এই লাইনে কয়েক বছর থেকে কাজ করার সুবাদে কিছু অপ্রিয় অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। উদ্দেশ্য হল, একজন দীনি ভাই হিসেবে আপনাদেরকে সতর্ক করা। আশা করি বিষয়গুলো গুরুত্ব-সহকারে আমলে নিবেন।   

প্রথম সমস্যা : বয়স বেশি হওয়ার কারণে মনে রাখতে পারিনা

একটি সমস্যার কথা অনেকেই আমাদেরকে বলেন। তা হল কোনো কিছু মুখস্থ করতে হলে অনেক সময় লাগে। বয়স বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে কিছুই মনে রাখতে পারি না। আমার দ্বারা ইলম শেখা আর হবে না। 

সমাধান

এদের উদ্দেশ্যে প্রথম কথা হল, কঠিন মনে হলেই লেজ গুটিয়ে পালানোর চিন্তা করা যাবে না। আপনার কাজ হল, চেষ্টা করে যাওয়া। যেই রাস্তা কঠিন সেই রাস্তায় চেষ্টার পরিমাণ চারগুণ করতে হয়। যে জিনিস বুঝতে পারছেন না, সেই জিনিস চৌদ্দবার পড়লে না বুঝার মতো কিচ্ছু থাকবে না। চেষ্টা যখন করতেই হবেই সুতরাং আজ থেকেই শুরু করুন। দেখবেন সাফল্য একদিন আসবেই। একটা উদাহারণ দেই

একটি প্রেরণা-জাগানিয়া ঘটনা

শাফেয়ী মাযহাবের অন্যতম ইমাম আবু বকর আল-কফ্ফাল রহ.। বয়সের কোঠা ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়ার পর ইলম অন্বষণে ব্রতী হন। আল্লামা সুবুকী রহ. তাঁর ব্যাপারে বলেন

الإمام الجليل أبو بكر القفال الصغير، شيخ طريقة خراسان

মহান ইমাম আবু বকর আল-কফ্ফাল। খুরাসানের তরিকতের ইমাম।

(তাবাকাতুশ-শাফিইয়্যা : ৫/৫৪)

এ মহান মনীষীর জীবনে উল্লিখিত সমস্যাটি এসেছিল। তবুও সে প্রতিবন্ধকতা দূর করে তিনি কীর্তিমানদের মাঝে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন।

ইলম শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার পর প্রথমে তুর্কিমিনিস্তানের একজন শায়খের কাছে যান। তিনি তাকে কিতাবুল মুযানীর এ তিনটি শব্দ প্রথম দিন শেখান

هذا كتاب اختصرته

এ পাঠ গ্রহণ করে তিনি ছাদে চলে যান। এশা থেকে ফজর পর্যন্ত এ তিনটি শব্দই মুখস্থ করতে থাকেন। সারা রাত জেগে থাকার কারণে শেষ রাতে একটু চোখ লেগে আসে। তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সারা রাত ধরে কী পড়েছেন কিছুই মনে পড়ছে না। তিনি এ কথা ভেবে লজ্জিত হচ্ছিলেন যে, শায়খকে আমি কী বলব। এ দুশ্চিন্তার মাঝেই হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। এমন সময় প্রতিবেশী এক মহিলা বলল

يا أبا بكر لقد أسهرتنا البارحة في قولك هذا كتاب اختصرته

আবু বকর! গতকাল রাতে هذا كتاب اختصرته বলে বলে তো সারা রাত আমাদের ঘুমাতে দাওনি।

মহিলার অভিযোগভরা কথার মাঝেই তিনি যেন খুঁজে পেলেন হারানো সম্পদ। শায়খের কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন। শায়খ তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেন

لا يصدَّنَّك هذا عن الاشتغال، فإنك إذا لازمت الحفظ والاشتغال صار لك عادة

এ কারণে যেন তোমার ইলম শেখার আগ্রহে ভাটা না পড়ে। কারণ তুমি যখন ইলম চর্চায় নিমগ্ন থাকবে এবং সবসময় মুখস্থ করতে থাকবে তখন তা তোমার অভ্যাসে পরিণত হবে। 

(মুজামুল বুলদান : ৫/১১৬)

শায়েখের কথা সত্যি হয়েছিল। কঠিন অধ্যাবসায় ও চেষ্টা-মুজাহাদার মাধ্যমে এমন দুর্বল মুখস্থশক্তির অধিকারী মানুষটিই হয়েছিলেন নিজ যুগের বরেণ্য ইমাম। ৪১৭ হিজরিতে তিনি ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছিলেন। এ কারণে তাঁর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে

عاش ثمانين سنة أربعين جاهلا وأربعين عالماً

অর্থাৎ আশি বছর বেঁচেছিলেন। ৪০ বছর জাহিল বা মূর্খ হয়ে। আর ৪০ বছর আলেম হয়ে।

(মু’জামুল বুলদান :  ৫/১১৬)

আসলে যদি দিলে সাচ্চা ইরাদা ও পোখতা হিম্মত থাকে তাহলে সব কঠিনকেই আল্লাহ তাআলা সহজ করে দেন। আর যদি শত চেষ্টার পরও মুখস্থ না হয় বা না বুঝে আসে তবুও এ চেষ্টার কারণে আল্লাহ তাআলা আজর ও সাওয়াব আমাদের দান করবেন।

দ্বিতীয় সমস্যা : অলসতা ও উদ্যমহীনতা

দ্বিতীয় সমস্যা হল, অনেকে জযবার সঙ্গে ভর্তি হন। কিন্তু পরবর্তীতে পেয়ে বসে অলসতা। যার কারণে এক দিন আসেন তো দুই দিন আসেন না। তাছাড়া যেহেতু এখানে সবাই বয়স্ক, তাই সবক ফাঁকি দিলে উস্তাদের শাসনের ভয়ও থাকে না। এভাবে এক সময় জান্নাতের এই পথ থেকে ছিটকে পড়েন।

সমাধান

মূলত অলসতা, উদ্যমহীনতা ও উদাসীনতা এমন রোগ যা মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য থেকে পিছিয়ে দেয়। কোনো স্বপ্ন কোনো লক্ষ্যই আরামের না। আরাম কেদারায় বসে বসে ইন্টারনেটে সময় নষ্ট করলে, সফলতার মুকুট আপনা-আপনি ডাউনলোড হয়ে যাবে না। 

সুতরাং প্রথমেই আপনাকে উক্ত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আপনি বলবেন, আমি যা চাই তাই করতে পারব। শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকি উসমানী দা. বা. বলেন سستی کاعلاج چستی অলসতার চিকিৎসা হিম্মত। সুতরাং প্রথমেই আপনাকে কষ্ট ও মেহনত করার জন্য হিম্মত করতে হবে, এই রোগ থেকে উত্তরণের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। 

সিমাক আলহানাফি রহ. বলেন

سَمِعْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ يَكْرَهُ أَنْ يَقُولَ : إنِّي كَسْلاَنُ

আমি ইবনু আব্বাস রাযি. সম্পর্কে শুনেছি, তিনি কাউকে ‘আমি অলস’ এ কথা বলতে পছন্দ করতেন না। 

(মুসান্নাফ ইবনি আবী শাইবা : ৯/৬৭)

নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করুন

দ্বিতীয়ত যখন অলসতা ভর করে ঠিক তখন নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করুন। সাথীদের অবস্থান চিন্তা করে অলসতার বীজ না এনে চেষ্টায় তেজ আনুন।  এভাবে ভাবুন যে, অলসতা, উদ্যমহীনতা ও উদাসীনতা এগুলো তো শয়তানের সৃষ্ট, ব্যর্থ মানুষের স্বভাব। সুতরাং আমি কেন শয়তানের শিকারে পরিণত হয়ে ব্যর্থদের কাতারে শামিল হব। তারপর তাআউয তথা আউযুবিল্লাহ ও ইস্তেগফার পড়ে পুনরায় ইলম শেখায় আত্মনিয়োগ করুন।

দোয়া করুন

তৃতীয়ত অলসতা, উদ্যমহীনতা ও উদাসীনতা থেকে মুক্তির জন্য হাদিসে যে সব দোয়া শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সেগুলো পড়–ন। যেমন

اللَّهُمَّ إنِّي أعُوذُ بكَ مِنَ الهَمِّ والحَزَنِ، والعَجْزِ والكَسَلِ، والبُخْلِ والجُبْنِ، وضَلَعِ الدَّيْنِ، وغَلَبَةِ الرِّجَالِ

হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে। 

(বুখারী : ২৮৯৩)

ফজরের পরে ঘুম বর্জন করুন

চতুর্থ, ফজরের পরে ঘুম বর্জন করুন। কেননা এটাও অলসতা ও উদ্যমহীনতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সুতরাং এই সময়ে না ঘুমিয়ে নামায আদায় করে তাসবীহ-তাহলীল, যিকর-আযকার ও তেলাওয়াত শুরু করে দিন। এমনটি করতে পারলে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর দোয়া পাবেন এবং আপনার সারদিনের কাজে অলসতা কেটে যাবে। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর দোয়াটি দেখুন, তিনি বলেন

اللَّهُمَّ بَارِكْ لِأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا

হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরু বরকতময় করুন। 

(তিরমিযী : ১২১২)

আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মুমিন অধিক প্রিয়

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

المُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ، و احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، واسْتَعِنْ بِاللَّهِ، ولَا تَعْجَزْ

আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন থেকে অধিক উত্তম ও প্রিয়। তুমি ঐ জিনিসে যত্নবান হও, যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো ও উৎসাহহীন হয়ো না।

(মুসলিম : ৪৮২২)

তৃতীয় সমস্যা : সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার

বর্তমানে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, ইমো, টিকটক আর ইউটিউবের মতো অ্যাপের ঘেরাটোপে বন্দী অনেকেই। স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ বা টেলিভিশন আপনার কাছে মনে হতে পারে এগুলো আপনি হ্যান্ডেল করছেন, তবে বাস্তব সত্য হলো এগুলোই আপনাকে দিনে দিনে কাবু করছে, আপনাকে চালাচ্ছে। একটি মাত্র স্মার্টফোন বাসা-অফিস-মাদরাসাসহ সব কিছুতেই ভাগ বসিয়েছে।

যার ফলে অনেকেই আবেগে ইলম শেখার জন্য তো আসেন, কিন্তু এগুলোর অপব্যবহারের কারণে সময়ের বরকত পান না। তখন বাসা-অফিস-মাদরাসা এসবের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খান। এরপর বিরক্ত হয়ে ইলম শেখার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

সমাধান

এক্ষেত্রে সমাধান একটাই। তা হল এসবের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। নিজেকে নিজের কাছে জবাবদিহিতার স্তরে রাখতে হবে। বিশেষত এগুলো যেন আপনার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে না পারে, সে দিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন। দেখবেন ইলম ও আমলে মন বসবে এবং অলসতাও হার মানবে। কোনো কাজ কখন করবেন, এক্ষেত্রে একটি রুটিন তৈরি করুন। তারপর রুটিন মাফিক চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। রুটিনের বরখেলাফ হয়ে গেলে কিছু সাদকা করে দিয়ে অথবা অন্য কোনো নফল আমল করে নিজের নফসকে শাস্তি দিবেন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

مِنْ حُسْنِ إسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ

একজন ব্যক্তির ইসলামের পরিপূর্ণতার একটি লক্ষণ হল যে, তার জন্য জরুরী নয় এমন কাজ সে ত্যাগ করে। 

(তিরমিযী : ২২৩৯)

হাসান বসরী রহ. বলেন

 مِنْ عَلاَمَةِ إعْرَاضِ اللهِ عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَجْعَلَ شُغْلَهُ فِيمَا لاَ يَعْنِيهِ 

কোনো বান্দা থেকে আল্লাহর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নিদর্শন হল, অনর্থক কাজ-কর্মে তাকে ব্যস্ত করে দেওয়া।

(জামেঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম : ১/২৯৪)

চতুর্থ সমস্যা : আলেমদের মতভেদের পিছনে পড়া 

যেহেতু এখানকার তালিবুল ইলমরা সবাই বয়স্ক। তাই অনেকের মধ্যে এই সমস্যাটাও দেখা যায় যে, কোন্ আলেম কী বলেছেন, এটা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। ভাবেন আমিও তো মাদরাসায় পড়ছি সুতরাং আমিও তো কিছু জানি। 

সমাধান 

ইলম অর্জনের সূচনালগ্নে আপনি আলেমদের মতভেদের পেছনে পড়বেন না। কেননা এতে আপনার সময় নষ্ট হয়ে যাবে এবং আপনার চিন্তা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। বরং আপনি যে কিতাব পড়ছেন বা যে বিষয়টি পড়ছেন সেটাকে আত্মস্থ করার জন্য আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করুন।

জাফর সাদিক রহ. বলেন

إياكم والخصومة، فإنها تشغل القلب، وتورث النفاق، وتكسب الضغائن

ধর্মীয় বিষয়ে তর্কবিতর্ক থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা অন্তরকে ব্যতিব্যস্ত রাখে, মুনাফেকির দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং বিদ্বেষ তৈরি করে।

(মীযানুল হিকমাহ : ১/৭৪৪)

পঞ্চম সমস্যা : উস্তাদের প্রতি আস্থাহীনতা ও আদবহীনতা

যেহেতু বিভিন্ন পেশা থেকে এখানে আপনারা এসেছেন। অনেকে হয়ত নিজস্ব কর্মস্থলে বস বা বড় কর্মকর্তা। এখানে আসার পর দেখতে পান, উস্তাদরা বয়সে তার চেয়ে ছোট। তখন মনে মনে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়। নিজের ছেলে নাতি কিংবা ছোট ভাইয়ের বয়সী উস্তাদের সঙ্গে আচরণে আদবহীনতা দেখা যায়। এটা ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে মস্ত বড় বাধা। 

সমাধান 

আদব অনেক বড় বিষয়। আলেমদের মাঝে প্রসিদ্ধ আছে, আগে আদব তারপর ইলম, যেমন আগে অযু তারপর নামায। অযু ছাড়া যেমন নামায হয় না। আদব ছাড়াও ইলমের নূর পাওয়া যায় না।

আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক রহ. বলেন

 ﻃﻠﺒﺖ ﺍﻷﺩﺏ ﺛﻼﺛﻴﻦ ﺳﻨﺔ، ﻭﻃﻠﺒﺖ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻋﺸﺮﻳﻦ ﺳﻨﺔ، ﻭﻛﺎﻧﻮﺍ ﻳﻄﻠﺒﻮﻥ ﺍﻷﺩﺏ ﻗﺒﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ

আমি ৩০ বছর আদব শিখেছি আর ২০ বছর ইলম শিখেছি এবং সালাফুস সালেহীনরা ইলম শিখার আগে আদব শিখতেন। 

(গায়াতুন নিহায়া : ১/১৯৮)

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন

ﻛﺎﺩ ﺍﻷﺩﺏ ﻳﻜﻮﻥ ﺛﻠﺜﻲ ﺍﻟﻌﻠﻢ 

আদব হচ্ছে ইলমের এক তৃতীয়াংশ।

(সিফাতুস সাফওয়াহ : ১/৪৫)

সুতরাং বয়স আপনার বেশি তো কী হয়েছে? যিনি আপনাকে পড়ান, তিনি তো আপনার উস্তাদ। সুতরাং তাঁর প্রতি আস্থা ও আদবের যেন কমতি না থাকে। তাঁকে ডাকার সময়, তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়, তাঁর সামনে বসার সময়, তাঁর নাম নেয়ার সময় যেন আদব থাকে। কেননা এটাই হচ্ছে— আপনার কল্যাণ, সফলতা এবং ইলম হাছিলের চাবিকাঠি। আপনি উস্তাদকে তাঁর নাম ধরে ধরে ডাকবেন না যে, অমুক সাহেব। এভাবে ডাকেন তো অফিসের বড় কর্মকর্তা তার চেয়ে ছোট কোনো কর্মকর্তাকে! বরং এভাবে বলবেন, উস্তাদজী, হযরত, হযরতজী। 

আলহামদুলিল্লাহ আমাদের কওমী মাদরাসাগুলোর মূলধন এটাই যে, এখানকার ছাত্ররা নিজেদের উস্তাদের প্রতি পরিপূর্ণ আদব দেখিয়ে চলে। 

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আব্বাস রাযি.

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আব্বাস রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেছিল, রাসূল ﷺ এবং আপনার মধ্যে কে বড়? 

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন 

هُوَ أَكْبَرُ وَأَنَا وُلِدْتُ قَبْلَهُ

বড় তো তিনিই, তবে আমি তাঁর আগে জন্মগ্রহণ করেছি।

(সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/৭৮)

এটাকে বলা হয় আদব। ইলম পেতে হলে এই আদব আপনার মাঝেও থাকা চাই। যদি আপনার কাছে উস্তাদের কোনো ভুল চোখে পড়ে কিংবা কোনো বিস্মৃতি ধরা পড়ে তাহলে এটার কারণে আপনার চোখে যেন উস্তাদের মর্যাদা খাটো হয়ে না যায়। কেননা এটি আপনার ইলম থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। ভুল থেকে বাঁচতে পারেন এমন কেউ কি আছে?

ষষ্ঠ সমস্যা : কুরআনের ক্লাসকে গুরুত্ব না দেয়া

আপনাদের মধ্যে বিরাট বড় একটি অংশ পাওয়া যাবে, যারা ছোটবেলা কুরআন শিখেন নাই বা শিখলেও ভুলে গেছেন। নামায সহিহ হওয়া পরিমাণ শুদ্ধ করে কুরআন তিলাওয়াত জানেন না। এখন মাদরাসায় ভর্তি হয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু আফসোস! এখনও অনেককে দেখা যায়, কুরআন সহিহ করার বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বহীন! এমনও দেখা যায়, বাকি ক্লাসগুলোর গুরুত্ব যে পরিমাণ আছে, সে তুলনায় কুরআন সহিহ করার গুরুত্ব এদের কাছে নেই।

সমাধান 

এই শ্রেণির লোকদের জন্য শত আফসোস! এদের কী এই অনুভূতিটুকুও নেই যে, নামায সহীহ হওয়া পরিমাণ কুরআন বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াত শেখা তার জন্য ফরযে আইন। এরা ইলম শিখতে আসে, কিন্তু কুরআন সহিহ করাকে যেন ইলমই মনে করে না। সমাজে লুঙ্গি খুলে পাগড়ি বাঁধার একটা কথা প্রচলিত আছে। এদের বেলায় এই প্রবাদটা শত ভাগ প্রযোজ্য। দুঃখিত এই শ্রেণির লোককে আমি তালিবে ইলম বলতেও লজ্জাবোধ করছি। কেননা যার কাছে আল্লাহর কালাম সহিহ করার গুরুত্বই নেই, সে কী করে তালিবে ইলম হতে পারে। এরা জযবার সঙ্গে আসে, কিন্তু নিয়ত এদের শুদ্ধ নয়। কিংবা নিয়ত হয়ত শুদ্ধ, কিন্তু শেখার ক্ষেত্রে কোনটা অগ্রাধিকার পাবে, এটা তাদের অজানা।

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. বলতেন, কুরআন সহিহ করার মত এত বড় প্রয়োজনের জন্য জীবনের এই বিশাল অংশ থেকে এতটুকু সময় দিতে পারবে না। কত বড় স্পর্ধা ও দুঃসাহসের কথা! 

কুরআন সহিহ না করার ক্ষতি

তাছাড়া কুরআন সহিহ করে না পড়লে অর্থের বিকৃতি ঘটে। যেমন ضلال কে ض দিয়ে পড়লে অর্থ হয় পথভ্রষ্টতা। আরظ  দিয়ে পড়লে অর্থ হয় ছায়া। অনুরূপভাবে ضرب কে ض পড়লে অর্থ হবে মারা, চলা আর ز দিয়ে পড়লে অর্থ হবে পশুর আস্তাবলে প্রবেশ করা। তেমনিভাবে وثق যদিث  দিয়ে পড়া হয় তখন এর অর্থ আস্থা রাখা আর س দিয়ে পড়লে নির্দিষ্ট পরিমাপ বুঝায়। এমন হাজার হাজার শব্দ রয়েছে যার উচ্চারণ পরিবর্তন করলে অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যবর, যের, পেশ পাল্টালেও অর্থ পাল্টে যায়। যেমন ملِك যের দিয়ে পড়লে রাজা অর্থ বুঝায়। আর مَلَك যবর দিয়ে পড়লে ফেরেশতা, আর مُلك  পেশ দিয়ে পড়লে রাজত্ব অর্থ দেয়। লক্ষ্য করুন, সব স্থানে শব্দ একই। শুধু যবর, যের, পেশ পরিবর্তনে অর্থেও পরিবর্তন ঘটেছে। এ জন্য কুরআন সহিহ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।

হারদুঈ হযরতের ঘটনা 

মুহিউস সুন্নাহ শাহ আবরারুল হক রহ. একবার লন্ডন সফরে লিফটের কাছে গিয়ে বললেন ভাই! লেফট কিধার হ্যায়?

তখন মেজবান হযরতের কানে কানে বললেন হযরত! শব্দটা লেফট নয়; বরং শুদ্ধ উচ্চারণ হবে লিফট।

মেযবান ভেবেছিল, হযরত ভুল শব্দ উচ্চারণ করেছেন। মূলত হযরত তো ইচ্ছা করেই লিফটকে বলেছেন ‘লেফট’। তাই মেযবানের কথায় হযরত বললেন, আমি তো এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে, তোমরা কুরআন সহিহ কর, অন্যথায় লিফট ‘লেফট’ হয়ে যাবে।

সপ্তম সমস্যা : না জেনে মাসআলা দেয়া 

আরেকটা সমস্যা হল, যেহেতু আপনারা মাদরাসায় পড়ছেন। অপরদিকে প্রত্যেকের নিজস্ব একটা কমিউনিটি আছে। সেখানে গেলে তাদের অনেকে বিভিন্ন মাসাআলা জিজ্ঞেস করেন। তখন আপনারাও মাসাআলা হরদম বলতে থাকেন। মনে করেন, যেহেতু মাদরাসায় পড়ছি, সুতরাং মাসআলা বলতে না পারলে সম্মান চলে যাবে! অথচ এটা একটা বড় ভুল।

সমাধান

এমনটি কক্ষনো করবেন না। কেননা এটা ইসলামী শরিয়তের সঙ্গে এক ধরণের উপহাস! যথাযথ যোগ্যতা ছাড়া মাসআলা দিতে নেমে পড়া বড় ধরনের গোনাহ। ভাসাভাসা, অস্পষ্ট ও দুর্বল জ্ঞান দ্বারা ফতোয়া প্রদান করা বৈধ নয়। এ জন্য সালাফগণ ফতোয়া প্রদানের ব্যাপারে খুবই ভীত থাকতেন এবং যথাসম্ভব এ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন।

ইমাম মালিক রহ.

একবার ইমাম মালিক রহ.-কে একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, লা আদরী। তখন তাঁকে বলা হলো, এটাতো খুবই হালকা ও সহজ একটি মাসআলা।

কথাটি শুনে তিনি খুবই রেগে উঠলেন। বললেন

ইলমের কোনো জিনিসই হালকা নয়। তুমি কি এই আয়াত শুননি?

 إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلا ثَقِيلا

শীঘ্র আমি তোমার উপর অত্যন্ত ভারী বাণী নাযিল করবো।

(তারতীবুল মাদারিক : ১/৭২)

সুতরাং বিষয়টাকে হালকা করে দেখবেন না। দয়া করে ভাসাভাসা ইলম নিয়ে মাসআলা বলার দুঃসাহস দেখাবেন না।

অষ্টম সমস্যা : পরিবারকে দীন শিক্ষা না দেওয়া

আপনারা দীনি ইলম শেখার স্বপ্ন লালন করছেন, ভালো কথা। একজন মুসলিমের এমনটিই হওয়া উচিত। কিন্তু অনেকের অবস্থা দেখলে মনে হয়, জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া এবং জান্নাত লাভ করা শুধু তার নিজের দরকার। তার ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজনের এগুলোর দরকার নেই। যার কারণে তাদের দীনের বিষয়ে তার মাঝে কোনো টেনশন বা ফিকির নেই।

সমাধান

এক্ষেত্রে আপনার করণীয় হচ্ছে, প্রয়োজনীয় দীন শিক্ষা পরিবারের সবাইকে দেওয়া। কেননা এটা নারী-পুরুষ সকলের জন্য ফরজে আইন। যেমন ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত, অযু, নামায, যাকাত, রোযা, হজ্বের প্রয়োজনীয় মাসায়েল, হালাল-হারামের বুনিয়াদী বিষয়সমূহ শিক্ষা করা প্রত্যেকের জন্য ফরজে আইন। এ শিক্ষা এজন্য জরুরি যে, এতে সে ধীরে ধীরে দীনমনষ্ক ও ইসলামীবোধসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারবে। 

আর বর্তমানে তো এটা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। কেননা এখন বিপথগামিতার উপায়-উপকরণ ও দাওয়াত অতীতের চেয়ে বেশি। ওসব উপকরণ এখন চার দেয়ালের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। এ জন্য অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন অভিভাবকগণ যেন সন্তানদের চোখের উপর রাখেন। আসলে চোখের উপর কতক্ষণ রাখবেন। এটা তাদের বিরক্তিরও কারণ হতে পারে। তাই গোড়া থেকে পরিশীলিত করতে হবে। অন্তরে ঈমান ও তাকওয়া বপন করতে হবে। আর এটা সম্ভব কেবল দীনি শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমেই। 

সুতরাং বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এসব বিষয়ে মুযাকারা করবেন। পরিবারে দীনি আলোচনার অভ্যাস গড়ে তুলবেন। 

বাসায় তালীমের ব্যবস্থা করুন

এ ক্ষেত্রে ‘তালীম’ একটি উপলক্ষ বা সহায়ক হতে পারে। প্রতিদিন সুবিধামত সময়ে দীনি কোনো কিতাব থেকে তালীম হবে, যেখানে পরিবারের সকল সদস্য উপস্থিত থাকবেন। একজন পাঠ করবেন, বাকিরা শুনবেন। এটা ঘরের মধ্যে, পরিবারের লোকদের মাঝে দীনি আবহ বিস্তারে সহায়ক হবে। 

মোট কথা মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার আগে পরিবারের যে দীনি অবস্থা ছিল ভর্তি হওয়ার পরও সেই অবস্থার যেন ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে। ‘বাতির নিচে অন্ধকার’ এ প্রবচনটির মত যেন আপনার অবস্থা না হয়। আপনার ইলম দ্বারা যেন আপনার মতো আপনার পরিবারও উপকৃত হয়। এক্ষেত্রে লজ্জা-শরম বাধা হওয়া মোটেই উচিত নয়। শিক্ষার ব্যাপারে লজ্জার কিছু নেই।

নবম সমস্যা : ইসলাহের বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়া

অনেকেই মনে করেন, ইলম তো শিখছি, এতেই সব হয়ে যাবে। তাবলীগে সময় লাগাচ্ছি, এটাই যথেষ্ট। ইসলাহের জন্য কারো কাছে যেতে হবে কেন? নিজের ইসলাহ নিজে করে নিবো। 

সমাধান

মূলত নিজের ইসলাহের ফিকির করা এবং কার্যতভাবে ইসলাহে লেগে যাওয়া প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। ইসলাহ মানে হল, ঈমানী জীবন গঠন করার চেষ্টা করা। জীবনের প্রত্যেক শাখা ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া। বিষয়টি বলতে তো অনেক সহজ কিন্তু আমলী ময়দানে বাস্তবায়নের একটু কঠিন! এর জন্য প্রয়োজন হয় একজন আল্লাহওয়ালার সোহবত ও তাঁর দিকনির্দেশনা।

আল্লাহ তাআলা বলেন

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا

যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। 

(সূরা আশ শামস : ৯, ১০)

তাসাওউফের মেহনত

এ জন্য তাসাওউফের মেহনত তথা নিয়মতান্ত্রিকভাবে একজন আল্লাহওয়ালার অধীনে থেকে নিজের ইসলাহের চেষ্টা করা অতীব জরুরি বিষয়। এটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সুতরাং একজন আল্লাহওয়ালার সঙ্গে ইসলাহী সম্পর্ক করে নিবেন। তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে যাবেন। তখন ইসলাহ সহজ হয়ে যাবে। গোনাহ ত্যাগ করা ও ইবাদতে মনোযোগী হওয়া সহজ হবে। 

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন, সহজ কথায় তাসাওউফের সার এই যে, যে ইবাদতে অলসতা আসে, অলসতাকে জয় করে ওই ইবাদতের প্রতি আগ্রহী হওয়া। যে গোনাহ কমনীয় মনে হয়, ওই গোনাহ ত্যাগ করে ইবাদতের প্রতি আগ্রহী হওয়া।

পাশাপাশি আল্লাহওয়ালাদের জীবনী ও মাফুযাত পড়বেন। এর দ্বারাও নিজেকে উজ্জীবিত রাখা যায়।

দশম সমস্যা : দোয়া না করা

দোয়ার ব্যাপারে আমরা বেশি উদাসীন। ইলম শিখেছন দোয়াও করবেন। ইলম পাওয়ার জন্য দোয়া করবেন। ইলম অনুযায়ী আমলের তাওফীকের জন্য দোয়া করবেন। ফেতনার যামানা চলছে, তাই আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য। এমনিতে প্রসিদ্ধ আছে

الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ

ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।

(খতিব বাগদাদী, আলজামি’ : ১৫৭০)

তাই তলব মেহনত ও আদবের পাশাপাশি দোয়ারও অভ্যাস করতে হবে।

শেষ কথা

আলোচনা শেষ করছি, বিখ্যাত ফকীহ সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাযি.-এর একটি কথা দিয়ে। কথাটির মাঝে তিনি যেন ইলমের গুরুত্ব ও ফজিলত-সংক্রান্ত কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের সার নির্যাসই তুলে ধরেছেন। তিনি  বলেন

تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ، فَإِنَّ تَعَلُّمَهُ لِلَّهِ خَشْيَةٌ، وَطَلَبَهُ عِبَادَةٌ، وَمُذَاكَرَتَهٌ تَسْبِيحٌ، وَالْبَحْثَ عَنْهُ جِهَادٌ، وَتَعْلِيمَهُ لِمَنْ لَا يَعْلَمُهُ صَدَقَةٌ، وَبَذْلَهُ لِأَهْلِهِ قُرْبَةٌ

তোমরা ইলম শেখো। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম শেখা পরহেযগারিতা, তা অন্বেষণ করা ইবাদত এবং এর পঠন-পাঠন তাসবীহ। আর জ্ঞান-গবেষণায় নিয়োজিত হওয়া জিহাদের অন্তভুর্ক্ত। যারা জানে না তাদেরকে ইলম শিক্ষা দান করা সাদকা এবং ইলম আহরণে আগ্রহীদের কাছে তা বিতরণ করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম।

(মাদারিজুস সালেকীন : ৩/২৪৬)

পরিশেষে দোয়া করি, যা কিছু সঠিক বলেছি, আল্লাহ আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে বসিয়ে দিন। আর যা কিছু ভুল বলেছি, আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে উঠিয়ে নিন। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার এবং নিজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার তাওফীক দান করুন আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

নৈশ মাদরা নৈশ মাদরাসার সবক-উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্্রদত্ত বয়ান অবলম্বনে।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ (৩য় পর্ব)

...

মাওলানা ইমদাদুল হক
৯ নভেম্বর, ২০২৪
১৮০২ বার দেখা হয়েছে

শরীয়তের উপর অবিচলতা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৯৪৪ বার দেখা হয়েছে

ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ (২য় পর্ব)

...

মাওলানা ইমদাদুল হক
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৭৩৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ