প্রবন্ধ
বিবাদ মীমাংসার পথ ও পদ্ধতি
আমাদের চারপাশে অনেক সময় পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে দেখি, মনোমালিন্য হতে দেখি। পরস্পরের এই মনোমালিন্য ও দ্বন্দ্ব দূর করে দেওয়া, তারা যেন আবার আগের রূপেই ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করা অনেক ফজিলতপূর্ণ ও মর্যাদার কাজ। আমরা বর্তমানে প্রায় এটাকে ভুলতে বসেছি, বরং উল্টোটা করি। আমরা দুজনকে আরেকটু ক্ষেপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
ফলে তাদের মধ্যে মীমাংসা দূরের কথা, ক্রোধের আগুনে ক্রমেই বেড়ে ওঠে। আবু দারদা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি কি তোমাদের নামাজ, রোজা ও জাকাত থেকে উত্তম আমল সম্পর্কে অবহিত করব না? সাহাবিরা বলেন, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, তা হলো পরস্পরের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দেওয়া। কেননা পরস্পরের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ লোকদের ধ্বংস করে দেয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩৯)
আর পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতির জন্য আপস-মীমাংসা করে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটার জন্য অনেক খাটুনি করতে হয়। অনেক সময় এর জন্য নিজেকেও কটু কথা শুনতে হয়। কিন্তু এত কিছু সহ্য করেও যারা এভাবে আপসের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে অনেক বেশি পায়।
কিভাবে মীমাংসা করব
প্রজ্ঞার সঙ্গে মীমাংসা করা
বিবাদরতদের প্রতি সহানুভূতি ও মীমাংসার প্রচেষ্টাই ছিল সেলাকদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রে নবী (সা.) সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি সমাজের বিবাদ মীমাংসা করতেন। কারণ, হিংসা-বিদ্বেষ আর কলহ-বিবাদ ছিল আরবদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে হানাহানি লেগে থাকত বছরের পর বছর। সেই জাতিকে তিনি ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব, শান্তি ও সম্প্রীতির যে উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন।
এটা সম্ভব হয়েছে শুধু তাঁর আলোকিত তালিম আর সহৃদয় ও প্রজ্ঞাপূর্ণ তারবিয়াতের কারণেই। কলহ-বিবাদের খবর শুনলে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হতেন, মীমাংসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত যে কুবার অধিবাসীরা লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এমনকি তারা পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু করল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সে সংবাদ দেওয়া হলে তিনি বললেন, ‘চলো তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫১৪)
প্রয়োজনে মিথ্যা বলা
দুজনের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য প্রয়োজনে কিছু মিথ্যা মিশ্রিত কথা বলারও শরিয়ত সুযোগ দিয়েছে। উভয়কে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং তাদের মনের কষ্ট দূর করার জন্য নিজের পক্ষ থেকে কিছু বানিয়ে বলা এটা শরিয়ত অনুমোদিত। কুলসুম বিনতে উকবা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য (নিজের থেকে) ভালো কথা পৌঁছে দেয় কিংবা ভালো কথা বলে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫১৩)
ইসলামে মানুষের মধ্যে আপস নিষ্পত্তি করে দেওয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এই হাদিস দ্বারা পরিস্ফুট হয়। এর জন্য এমনকি মিথ্যা বলা পর্যন্ত অবকাশ আছে, অথচ এমনিতে মিথ্যা বলা কত কঠিন পাপ। বিবাদ নিষ্পত্তি করা যেহেতু একটি মহৎ কাজ, তাই আমাদের কর্তব্য আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ কাজে অংশ নেওয়া কর্তব্য।
হিংসা-বিদ্বেষের ক্ষতি সম্পর্কে অবগত করা
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করা হয়। এরপর এমন সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে শরিক স্থাপন করে না। তবে সে ব্যক্তিকে নয়, যার ভাই ও তার মধ্যে শত্রুতা বিদ্যমান। এরপর বলা হবে, এই দুজনকে আপস রফা করার জন্য অবকাশ দাও, এই দুজনকে আপস রফা করার জন্য অবকাশ দাও, এই দুজনকে আপস রফার জন্য অবকাশ দাও। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৩১২)
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা
সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না। পরস্পর মীমাংসার বিষয়টি অনেকেই খুব সহজেই করতে পারেন। প্রবাদ রয়েছে কিছু কাটে ভারে, কিছু কাটে ধারে। তো যাঁরা সমাজে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁরা যদি সব সময় এ বিষয়টা মাথায় রাখেন, তাহলে কারো মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়ে গেলে সমাধান করা তাঁদের জন্য খুবই সহজ। দুজনের দূরত্ব দূর করে মুহূর্তেই ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দিতে পারেন।
ক্ষমার বাণী শোনানো
ক্ষমা করলে কী লাভ? ক্ষমার দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতে কী পাওয়া যায়। এসব বিষয় পরস্পরকে আলাদাভাবে বোঝানো। ঠাণ্ডা মাথায় তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা। কারণ ক্ষমায় এমন এক জাদু রয়েছে যে আজন্ম শত্রুকেও মুহূর্তের মধ্যেই বন্ধুতে পরিণত করে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন, তা দ্বারা যা উত্কৃষ্ট। ফলে আপনার ও যার মধ্যে শত্রুতা আছে; সেই হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সুরা : ফুসসিলাত, আয়াত : ৩৪)
দুজনকে হাদিয়া দেওয়া
দুজনকেই অন্যজনের পক্ষ থেকে হাদিয়া পৌঁছে দেওয়া। প্রয়োজনে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেও এ কাজ করা। এর সুফল আল্লাহ তাআলা আরো অনেক বেশি দান করবেন।
ইনসাফ করা
মীমাংসার ক্ষেত্রে গিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি না করা, বরং এ ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে ইনসাফের পরিচয় দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুসলিমদের দুটি দল আত্মকলহে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিয়ো। অতঃপর তাদের একটি দল যদি অন্য দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যে সময় পর্যন্ত না সে আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং যদি ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ন্যায়সংগতভাবে মীমাংসা করে দিয়ো এবং (প্রতিটি বিষয়ে) ইনসাফ কোরো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : হুজরাত আয়াত : ৯)