প্রবন্ধ

ফিলিস্তিন সংকট : তোমরাই বিজয়ী হবে...

লেখক:মাসিক আলকাউসার
১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
৮৪২৫ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী


হামদ ও ছানার পর...

وَلَا تَهِنُواْ وَلَا تَحْزَنُواْ وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ.

শ্রদ্ধেয় ভাই ও বন্ধুগণ! আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি তাআলা ওয়াবারাকাতুহু।

আমি আপনাদের সামনে সূরা আলে ইমরান থেকে একটি আয়াত তিলাওয়াত করেছি। এই আয়াতটি ওই সময় অবতীর্ণ হয়েছিল যখন উহুদ যুদ্ধে এক কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সেই যুদ্ধে সাময়িকভাবে মুসলমানগণ আরব মুশরিকদের মোকাবেলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেনকিন্তু তা ছিল ক্ষণিকের। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সেই পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে সত্তরজন সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর চেহারা মোবারক রক্তাক্ত হয়েছিলদান্দান মোবারক শহীদ হয়েছিল। এমনকি এই ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল যেনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে (মাআযাল্লাহ) শহীদ করে দেওয়া হয়েছে। তখন যেই সত্তরজন সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন প্রথম সারির মুসলিমপাক্কা ঈমানদার। ইসলামের ওই সময় এমন সাহাবীদের শাহাদাত বরণ কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। এতে মুসলমানগণ মুষড়ে পড়েছিলেন। তাদের কারো কারো চেহারায় ভেঙে পড়ার সে ছাপ ফুটে উঠেছিল। আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলা ওই দৃশ্যের অবতারণা করতে গিয়ে এবং তাতে যে হতাশা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছিল সেই কারণগুলো বর্ণনা করার জন্য সূরা আলে ইমরানে প্রায় চারটি রুকু নাযিল করেছেন। এতে রয়েছে মুসলমানদের জন্য আসমানী সান্ত্বনাও

আমি আপনাদের সামনে যে আয়াতটি পাঠ করলামসেটিও ওই চার রুকুর মাঝেই রয়েছে। আয়াতটির তরজমা হচ্ছেআল্লাহ তাআলা গোটা মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ করে বলছেনতোমরা ভেঙে পড়ো না। হাল ছেড়ে দিও না এবং হতোদ্যম হয়ে পড়ো না। অস্থির ও পেরেশান হয়ো না। এরপর আল্লাহ ওয়াদা করছেন

وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ.

অর্থাৎ তোমরাই সমুন্নত থাকবেযদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হতে পার। যদি প্রকৃত অর্থে ঈমানওয়ালা হতে পার তবে বিজয় তোমারই। সাময়িক সংকটেক্ষণিকের পরাজয়ে তোমরা ভেঙে পড়বে না। হতোদ্যম ও হীনম্মন্য হবে না। যদি এই যুদ্ধ থেকে বার্তা ও শিক্ষা গ্রহণ করতে পার, (যার বিবরণ আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরানে দিয়েছেন) এবং ঈমানের ওপর অটল অবিচল থাকতাহলে পরিশেষে বিজয়ই হবে তোমাদের ফলাফল।

সান্ত্বনার এ কথাগুলো আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ করে নাযিল করেছিলেন। তবে কুরআন কারীমের কথাগুলো শুধুু সাহাবায়ে কেরামের জন্যই নয়বরং তা কিয়ামত পর্যন্ত আগত গোটা মানবজাতির জন্য। কুরআনের আয়াতসমূহে রয়েছে আমাদের জন্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের জন্য শিক্ষা ও নির্দেশনা। কেননা আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনযা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের মাধ্যমে আমাদের নিকট পাঠিয়েছেনকিয়ামত অবধি অবশিষ্ট রাখবেনইনশাআল্লাহ। কাজেই সকল যুগের মুসলিমদের জন্য এর প্রতিটি আয়াতেই রয়েছে সুমহান শিক্ষা।

আমি আয়াতটি এ মুহূর্তে এজন্য তিলাওয়াত করেছি যেআজ গোটা মুসলিম উম্মাহপৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেনফিলিস্তিনের চলমান সংকটে যারপরনাই ব্যথিত। নিদারুণ পীড়ন অনুভব করছে গাজাবাসীর অসহায়ত্বে। গাজার মতো ছোট্ট একটি শহরে জালিমরা এমন বোম্বিং করছেযাতে এখন পর্যন্ত বিশ হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছেন। হতাহতদের মাঝে বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে। প্রায় সাত হাজার শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে নবজাতকও রয়েছে। শিশুগুলোর জন্মসনদও তৈরি হতে পারেনি। পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে না দেখতেই ওই জালিমরা বোমা মেরে তাদের শহীদ করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

আজ মুসলিম উম্মাহ সীমাহীন মর্মাহত। শুধু মুসলমানরাই নয়অমুসলিমরাও যখন দৃশ্যগুলো দেখছেকীভাবে নিষ্পাপ শিশুদের ফুটফুটে চেহারাগুলো ঝলসে দেওয়া হচ্ছে। কীভাবে অসংখ্য বনী আদম ইট পাথরের নিচে চাপা পড়ে শহীদ হচ্ছে। হদিস পাওয়া যাচ্ছে না অগণিত মানুষের। জানা নেইতারা বেঁচে আছেনা ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের লাশগুলোও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এ সংবাদগুলো সামনে আসার পর মুসলমানই নয়অমুসলিমও চোখে পানি ধরে রাখতে পারছে না। এই ঘটনাগুলোর কারণে তাদের প্রতি শোক ও সমবেদনা রয়েছে। তাদের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অস্থিরতাও আছেহৃদয়ে রক্তক্ষরণও হচ্ছে।

এমন সময় এই আয়াতে কারীমা একদিকে আমাদেরকে সান্ত্বনা দিচ্ছেপাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মনীতিও নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

আজকাল কেউ কেউ এরকমও বলতে চায়হামাসের এই আক্রমণের কারণে গাজার লক্ষ লক্ষ নারী শিশু এবং বেসামরিক নিরীহ মুসলিমদের শহীদ করা হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলগাজার বিশ হাজার শহীদযাদের অনেকের কাফন দাফনেরও সুযোগ হয়নি। নিছক বোম্বিংই নয়বরং ক্ষুধা পিপাসাআহত জখমের কাতরানো দেহ যারা সামলাচ্ছেযাদের পানি-ব্যবস্থা বন্ধবিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধযোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছেএমন ভয়াবহ প্রতিকূলতায় যারা দিনাতিপাত করছেএই পুরোটা সময়জুড়ে আপনি কোনো গাজাবাসীর মুখ থেকে এমন কোনো শব্দ-বাক্য শুনতে পাবেন না যেতারা অভিযোগ করছেহামাসের কারণে আজ আমাদের এই বিপদ-দশা।

উপরন্তু তারা অটুট বিশ্বাসদৃঢ় প্রত্যয় ও মজবুত সংকল্প নিয়েসীমাহীন ধৈর্য ও অবিচলতার সাথে নির্দ্বিধ উচ্চারণ করছেআমরা এসব পরিস্থিতি মাথা পেতে মেনে নিচ্ছি। তবুও আমাদের প্রিয় ভূমির একটি ইঞ্চিও শত্রুর দখলে যেতে দেব না। আমরা এ ভূমি ছেড়ে কোথাও যাব না। পর্বতদৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় তাদের চেতনায় প্রোথিত রয়েছে। আলহামদু লিল্লাহহামাসের পদক্ষেপগুলোও আল্লাহর মেহেরবানীতে ঐশী নুসরতের সঙ্গ লাভ করছে।

ইসরাইলী হায়েনারা গণহত্যা করেছে এবং করে যাচ্ছে। বিশ হাজার মুসলিমকে শহীদ করেছে। তবে সম্মুখ সমরে হামাসের মুখোমুখি হতে এখনো তারা ব্যর্থ। তাদের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রভারি ভারি ট্যাঙ্ক বহরযুদ্ধযান প্রভৃতি সাজ সরঞ্জাম হামাসের মুজাহিদগণের প্রতিরোধ-হামলায় নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে। আজ আমাদের চর্মচক্ষু এ দৃশ্যগুলোর সাক্ষী।

বাস্তব কথা হচ্ছেহামাস এবং গাজার মুসলমানগণ গোটা পৃথিবীকেবিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেআজ আমি সেই বার্তাটুকু আপনাদের খেদমতে পেশ করতে চাচ্ছি

প্রথম কথা হচ্ছেফিলিস্তিন ইস্যুটি ১৯৪৮ সন থেকেবরং তার আগ থেকেই চলমান রয়েছে। ১৯৪৮-এ এসে ইসরাইল নিজের অবৈধ অস্তিত্ব ফিলিস্তিনের বরকতপূর্ণ ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সেই সূচনা থেকেই অত্যাচার ও নিপীড়নের দীর্ঘ অধ্যায় রয়েছেযা নিরীহ ফিলিস্তিনবাসীর ওপর তারা অব্যাহত রেখেছে। এমন কোনো বছর যায়নিযাতে তারা ফিলিস্তিনের মুসলিমদের ওপর নির্মমতার রোলার চালায়নি। নাএমন কোনো বছর যায়নি। এতদ্সত্ত্বেও পৃথিবী বলে আসছিল এবং এখনো বলছেএ সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া দরকার। হাঁশান্তিপূর্ণ সমাধান! টেবিলটকেজাতিসঙ্ঘের অধিবেশনেনিরাপত্তা পরিষদেআরবলীগের মধ্যস্থতায়পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বহুভাবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের এ চর্চা হয়েছে। বহু বৈঠক হয়েছেঅনেক চুক্তি প্রতিশ্রুতি হয়েছে। বহু আলোচনা সমালোচনা ও পর্যালোচনা হয়েছে। কিন্তু এতসব আয়োজন কেবল এজন্যই ছিলযাতে ফিলিস্তিনের মূল ইস্যুটি চাপা পড়ে যায়।

৭ অক্টোবরের আগ মুহূর্তেও ফিলিস্তিন বিষয়টি বিশ্বমঞ্চে এতটা গুরুত্ব পেত না। ব্যসসবাই আপন স্থানে নিশ্চিন্তে নিরাপদে আছে! বলা যায়ফিলিস্তিনের ব্যাপারটিকে যেন কবরস্থ করে দেওয়া হয়েছিল। সময় যত গড়াচ্ছিল মনে হচ্ছিল যেন এটাই হবে নিয়তিভাই ৭৫-৮০ বছর হয়ে গেছেএখন আর এত পেছনের গল্প বলে লাভ কী?! যেভাবে চলছে চলতে থাকুক না! সমস্যা কোথায়?!’

ফিলিস্তিনের ইস্যুটিকে এভাবেই গোরস্তান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। মুসলিমবিশ্ব যেখানে প্রথম প্রথম একটি মুহূর্তের জন্যও ইসরাইলকে সহ্য করতে পারছিল না। ধীরে ধীরে তারাই ইসরাইলকে মেনে নিতে যাচ্ছিল। সোজা কথায়ফিলিস্তিনের জানাযা প্রস্তুত করতেই তারা অংশ নিচ্ছিল।

আল্লাহ তাআলা হামাসের জানবায মুজাহিদদের উত্তম প্রতিদান দান করুনতাদের এই আক্রমণের ফলে বিষয়টি এখন পুরো বিশ্বের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এখন টনক নড়েছে। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব ফিলিস্তিন ইস্যুটি নিয়ে দেখছেভাবছেকথা বলছে। বস্তুত ফিলিস্তিন ইস্যুটি যেন এখন নবজীবন লাভ করেছে। এটা হামাসের প্রথম সফলতা। তারা জিহাদের মাধ্যমে জীবন উৎসর্গ করে এই বিষয়টিকে নতুন জীবন দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমে এই কাজটুকু নিয়েছেন।

ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজ নয়। আপনি চিন্তা করুন তোহামাস তেইশ বছর যাবৎ ইসরাইল ও আমেরিকার মতো রথী মহারথীদের’ বড় বড় পরাশক্তিগুলোর এবং পশ্চিমা দুনিয়ার মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। প্রস্তুতি এমনভাবে নিয়েছে যেতারা যেই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে সেখানে থেকেই জিহাদ পরিচালনা করছে। এই টানেলগুলো তেইশ বছরে খনন করা হয়েছে। তাতে এমন শিল্প রয়েছে যেপাঁচ শ কিলোমিটার পর্যন্ত এটা জালের মতো বিছানো। একেকটি টানেল চল্লিশ মিটার গভীরে অবস্থিত। কোনো কোনো টানেল পঞ্চাশ মিটার গভীরে রয়েছে। আবার কোনো কোনোটা আশি মিটার পর্র্যন্ত গভীরে। এজন্য যেওপরথেকে যে বোম্বিং করা হয় তা সাধারণত ত্রিশ মিটার পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে। তাই টানেল তৈরি করতে তারা যেই কৌশল ব্যবহার করেছেতাতে ওদের বোম্বিং ক্ষতি করতে পারবে না। চল্লিশ-পঞ্চাশ মিটার গভীরে টানেলগুলো বিছিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে দুই মাস হয়ে গেছে। এই দুই মাসের অবিরাম নৃশংস বোমা বর্ষণঅত্যাধুনিক সমরশক্তি প্রয়োগট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি ব্যবহার করার পরও এখন পর্যন্ত ইসরাইল এই টানেলগুলো খুঁজে বের করতে পারেনি। ব্রিটেন গোয়েন্দা জাহাজ পাঠিয়েছেযা খুঁজে বের করবেটানেলগুলো কোথায় অবস্থিত। হামাসের হাতে বন্দিদের কোথায় রাখা হয়েছে। এত এত লস্কর তস্করএত ভারী ভারী সমরাস্ত্রএত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সবকিছু ব্যবহার করার পরও এর কোনো হদিস ওরা বের করতে পারেনি। আল্লাহ তাআলা হামাসের মুজাহিদদের মাধ্যমে এই কাজটি নিয়েছেন।

আর যারা এই সুড়ঙ্গ প্রস্তুত করেছেন তাদের ব্যাপারে যে তথ্যগুলো আসছে তা হচ্ছেতারা নিজের জীবন বাজি রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে এ টানেলগুলো প্রস্তুত করেছেন। মাটিতে কাজ করতে করতে তাদের পায়ে পঁচন ধরে গিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্র সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এই আত্মত্যাগ তাঁরা স্বীকার করেছেফলে আল্লাহ তাআলা আজ এর ফলাফল দেখাচ্ছেন।

এই সুড়ঙ্গে বসে বসেই তারা শত্রুকে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে। প্রতিদিন ওদের ট্যাঙ্কগুলো ধ্বংস করে যাচ্ছে। বলা যায় নাতারা কোত্থেকে বেরিয়ে আসবে। হঠাৎ কোত্থেকে এসে ইসরাইলের বিমানট্যাঙ্ক ইত্যাদি তছনছ করে আবার হারিয়ে যাবে। ইসরাইলী সৈন্যরা বলেবুঝতে পারছি নাএরা কোনো জিনজাতি। নাকি ভিন্ন কোনো জাতিযারা মুহূর্তে কোত্থেকে এসে আমাদের ট্যাঙ্কগুলো ধ্বংস করে দিয়ে আবার উধাও হয়ে যায়। ইসরাইলের নোংরা মানোবৃত্তি এবং নির্মম পাশাবিকতা বিশ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনীর জীবন কেড়ে নিলেও হামাসের জানবায মুজাহিদদের শহীদের তালিকায় হাতেগোণা কয়েকটি নাম মাত্র। আর এর মোকাবেলায় ইসরাইলের হাজারো সৈন্য নিহত হয়েছে। এমনকি সেনা অফিসারও বাদ পড়েনি। রণাঙ্গনে আল্লাহ তাআলা হামাসকে বিজয় দান করেছেন।

১৯৬৭ সনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে তিন দেশ মিলে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলমিশরজর্ডান ও সিরিয়া। তিন রাষ্ট্র মিলে চেয়েছিল ইসরাইলকে ধরাশায়ী করতেকিন্তু মাত্র ছয় দিনে ইসরাইলই তাদেরকে কাবু করে ফেলেছে। তিন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মিলে ছয় দিনও ওদের মোকাবেলা করতে পারেনি। অথচ দুই মাস গত হয়ে চলেছেহামাস ওদেরকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। কেন এমন হলকারণ ওইসময় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করেআরব জাতীয়তাবাদ। তখন যুদ্ধের শ্লোগান ছিলআলইযযাতু লিলআরাব’ তথা আরবদের জন্য সম্মান। ইসরাইলের প্রতিপক্ষকে আরব বলে অভিহিত করা হতআরব-ইসরাইল যুদ্ধ।

পক্ষান্তরে আলহামদু লিল্লাহহামাস প্রথম দিন থেকেই আল্লাহর নামে লড়ছে। এখানে আলইযযাতু লিল্লাহ’ স্লোগান মুখরিত হয়। প্রতিটি আঘাতে তাদের জবানে ধ্বনিত হয়আল্লাহু আকবারআল্লাহুম্মা সাদ্দিদআয় আল্লাহ আপনি আমাদের যথাযথ নিক্ষেপের তাওফীক দান করুন। এভাবেই তারা নিক্ষেপ করে।

তাদের মাঝে অসংখ্য হাফেযে কুরআন রয়েছেন। দীর্ঘ একটি প্রশিক্ষণ ও তরবিয়ত গ্রহণের পর তারা দায়িত্ব পায়। দ্বীনী তরবিয়তে তাদেরকে উজ্জীবিত করা হয়। তারা কেবল সংগঠনের কর্মীদেরই তরবিয়ত করেনিগাজার সাধারণ মুসলিমদেরও তারা তরবিয়ত করেছে। আপনি লক্ষ করবেনছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত নিজেদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপর বসে আল্লাহকে স্মরণ করছে। নিজের হাতে শরীরে নাম লিখে ঘুমাচ্ছেজানা নাইসকাল হতে যদি ভবন-চাপা পড়িতাহলে বিকৃত চেহারা দেখে যেন পরিচয় পেতে ব্যাঘাত না ঘটে।

গাজার সাধারণ জনতার মাঝে এই যে ঈমানী চেতনা ও জযবা বিরাজ করছেআল্লাহ তাআলা হামাসের মুজাহিদীনের মাধ্যমে এই পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এটা হামাসের মহান বিজয়।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছেহামাসের জানবায মুজাহিদীনের এ আত্মত্যাগ এবং গাজার মুসলমানদের কুরবানী গোটা বিশ্বের সামনে ইসরাইলের খোলস খুলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত যুদ্ধনীতিগুলো একটি একটি করে ওরা লঙ্ঘন করছে। নারীদের ওপর হামলা করাশিশুদের হত্যা করাজনবসতি ধ্বংস করানিরীহ লোকদের হত্যা করাহাসপাতালে বোম্বিং করাহাসপাতালের স্পর্শকাতর বিভাগনিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো টার্গেট করা... ইসরাইলের এই অপরাধ প্রবণতাগুলো বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ পেয়েছে। তাদের নামধারী কিছু মিত্র ব্যতীত সাধারণ জনতাচাই সে অমুসলিম হোক না কেনঅকপটে ঘোষণা করছেইসরাইলের মানবতা বলতে কিচ্ছু নেই। এটি একটি হিংস্র হায়েনা গোষ্ঠীর নাম। আমেরিকা লন্ডন জাপান প্রভৃতি অমুসলিম দেশে এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। পুরো বিশ্বের পর্দায় ইসরাইল বিবস্ত্র হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ওদের আজ এ দশা মুজাহিদীনের সেই আত্মত্যাগের অবদান। কুরআন বলছে

وَلَا تَهِنُواْ وَلَا تَحْزَنُواْ وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ.

অর্থাৎ হতোদ্যম হয়ে পড়ো নাহাল ছেড়ে দিও না। চিন্তা ও পেরেশানী করো না। যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকতবে বিজয় শিরোধার্য।

ইনশাআল্লাহএমন কিছুই ঘটবে। একথা ঠিকহামাসের কাছে সেই শক্তি নেইযা আমেরিকার আছে। সেই শক্তি নেইযা ইসরাইলের আছেকিন্তু তাদের কাছে সেই শক্তি আছেযার সামনে সকল শক্তি পরাস্ত হতে বাধ্য। আর তা হচ্ছেআল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। আল্লাহর ওপর ঈমানআল্লাহর কুদরতের ওপর ঈমানআল্লাহর রহমতের ওপর ঈমান। এটা সেই ঈমানী শক্তিযার ফলে দুই মাস অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। ইসরাইল চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে গাজা উপত্যকা। ইসরাইলী বাহিনী ঢুকে পড়েছে শহরের ভেতরে। এতকিছুর পরও একটি ইঞ্চিও তারা কবজা করতে পারেনি। ইনশাআল্লাহকখনো পারবেও না। কাজেই কুরআন যে বলছেমনোবল ভেঙো নাঅস্থির হয়ে পড়ো নাযদি মুমিন হওবিজয় তোমার হবেই। এখন আমাদের কর্তব্যপ্রকৃত মুমিন হওয়া। প্রকৃত অর্থে আল্লাহর ওপর ঈমান রেখে দেখনিজের পরীক্ষা নাওযেখানে ঈমানের খেলাফ কোনো কাজ করছতা পরিত্যাগ করআল্লাহর প্রতি ঈমান মজবুত করআল্লাহর ওপর ভরসা রাখতুমি যদি এমন হতে পার তাহলে আল্লাহ বলেনআমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছিবিজয় তোমারই হবে। তোমারই শির উঁচু হবে।

ভাইয়েরা আমারযদিও আমরা এ পরিস্থিতিতে নিজেদের অসহায় মনে করছি। সশরীরে গিয়ে তাদের সাথে জিহাদে শরীক হতে পারছি না। কিন্তু কুরআন বলছেযদি মুমিন হতে পার তবে বিজয়ই হবে তোমার নিয়তি। কাজেই সকলের দায়িত্বস্বীয় অবস্থান থেকে নিজেকে খাঁটি মুমিনে পরিণত করা। খাঁটি মুমিনের অর্থ হচ্ছেআল্লাহর নাফরমানী এবং গুনাহের পথ পরিহার করা। আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করা। জীবনকে ইসলামী রঙে রাঙানো। নিজের ইবাদত-বন্দেগীলেনদেনআচার-বিচারস্বভাব-চরিত্রজীবন-জগৎসমাজ পরিবেশ ইত্যাদি সবকিছু ইসলামী অনুকরণে সাজানো। যদি এমনটি করতে পারেতাহলে ইনশাআল্লাহ কুরআনের প্রতিশ্রুতি সর্বাধিক সত্য

وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ.

তোমরাই বিজয়ী হবেযদি তোমরা মুমিন হতে পার।

ইনশাআল্লাহএমনটাই ঘটবে। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে আমাদের সেই তাওফীক নসীব করুন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

[জুমাপূর্ব বয়ান, জামে মসজিদজামিয়া দারুল উলূম করাচী২৩ জুমাদাল উলা ১৪৪৫ হিজরী

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

দ্বীনরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি ব্যয় করা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৫৪৭৭ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →