প্রবন্ধ

মাহে রমযান কুরআন ও তাকওয়ার পথে অগ্রসর হওয়ার মৌসুম

লেখক:মাসিক আলকাউসার
২১ মার্চ, ২০২৪
১৯১৯ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

বছর ঘুরে আবারো বিশ্বের মুসলমানদের দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়েছে রমযানুল মোবারক। রহমত ও মাগফিরাতসহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধসহ অসংখ্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ মাসের জন্য বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকে প্রতিটি মুমিন-মুসলমান। এ মোবারক মাসের বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান দুটি হচ্ছে- তাকওয়া ও কুরআন।

রমযান মাস কুরআনের মাস। এ মাসে নাযিল হয়েছে বিশ্বমানবের হেদায়েত ও কল্যাণের একমাত্র বাণীকালামুল্লাহ-কুরআন মাজীদ। তাই এ মাসের সাথে কুরআনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রমযান এলেই বিশ্বের মুসলমানগণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন কুরআন তিলাওয়াতেকুরআনের তাফসীর শ্রবণে। বিশ্বব্যাপী তারাবী নামাযে অসংখ্যবার খতম হয় পবিত্র কুরআন মাজীদ। লক্ষ লক্ষ হাফেজ ছাহেবের সুললিত কণ্ঠে আল্লাহর কালাম শুনে আপ্লুত হন মুমিন বান্দাগণ। সারা বছর তিলাওয়াতের পাশাপাশি আল্লাহর অনেক বান্দা এ মাসে কুরআন মাজীদ কয়েকবার খতমও করে থাকেন।

এমনিভাবে রমযান যে তাকওয়ার মাসআল্লাহ্কে পাওয়ার মাসআল্লাহভক্তি ও আল্লাহভীতির মাসতা তো রোযা ফরয হওয়ার সেই আয়াতেই বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছেযেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিলযাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। -সূরা বাকারা (০২) : ১৮৩

অর্থাৎ রমযানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া। আর এ তাকওয়া মানেই হলনিজের ইচ্ছার ওপর স্রষ্টার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়াতাঁর নির্দেশাবলি অনুসরণ করানিষেধাজ্ঞাগুলো মেনে তা থেকে দূরে থাকা।

তো রমযান কুরআনের মাসতাকওয়ার মাস। কে না জানেএ দুটি গুণ অর্জনের জন্য একজন মানুষকে কুরআন শিখতে হয়সহীহ-শুদ্ধ কুরআন পড়া জানতে হয়। সাথে সাথে তাকওয়া অর্জনের জন্য শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত আদেশ ও নিষেধ অর্থাৎ তার ওপর অর্পিত অত্যাবশ্যকীয় ফরয দায়িত্বগুলো সম্পর্কে অবগত হতে হয়হারাম কাজগুলো সম্পর্কে জানতে হয়। তবেই সে তাকওয়া অর্জন করে জীবন পরিচালনা করতে পারে।

পরিতাপের বিষয় হলবিশ্বের অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত এবং আগইয়ার’ তথা ভিনধর্মী ও ভিনদেশী বিশ্ব মোড়লদের জাঁতাকলে পিষ্ট মুসলিম উম্মাহর সমস্যা শুধু এক জায়গাতেই থেমে নেইবরং নিজেদের ধর্মবিমুখ ফাসেক-ফুজ্জার শাসকদের জুলুম-বৈষম্যের মাঝেও তারা নিমজ্জিত।

এসবের চেয়ে এখন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছেমুসলিম উম্মাহর কুরআন-বিমুখতা। সাধারণ সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়কুরআন কারীম পড়তে জানেন- এমন মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। তাদের মধ্যে শুদ্ধ তিলাওয়াত করতে পারেন- এমন লোকের সংখ্যা আরো কম।

তেমনি দৈনন্দিন জীবনে একজন মুমিন-মুসলিমের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো আরো অবহেলিত। অন্য ভাষায় বললেমুসলমানদের মাঝে নিজেদের ফরয দায়িত্বগুলো সম্পর্কে অবগতিও দিন দিন কমে আসছে।

সন্দেহ নেইএ যুগেও উম্মতে মুসলিমার সুরক্ষাসুদিন ফিরে আসা এবং আখেরাতে নাজাত পাওয়ার একমাত্র রাস্তা- আবার কুরআনের দিকে ফিরে আসাআবার দ্বীনের পথে ফিরে আসা। এজন্য সকলের প্রয়োজনসহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন শেখা এবং দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা অর্জন করা।

বলার অপেক্ষা রাখে নাএর জন্য কোনো বয়স বা পেশা বাধা হতে পারে না। যেকোনো বয়সেযেকোনো পেশায় থেকে কিছু সময় বের করেযেকোনো মুসলমান একটু উদ্যোগ নিলেই দ্বীনের মৌলিক শিক্ষাগুলো অর্জন করতে পারেন এবং কুরআন মাজীদের সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শিখে নিতে পারেন।

তালীমুদ্দীন একাডেমির শাখাগুলো ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন এধরনের খণ্ডকালীন শিক্ষার আয়োজন রয়েছে। যেসমস্ত এলাকায় আয়োজন নেইসেখানে মুসলমানরা নিজ উদ্যোগে এধরনের ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।

উলামায়ে কেরামহুফফাযে কেরামআইম্মায়ে মাসাজিদের ওপরও দায়িত্ব অর্পিত হয়- সর্বস্তরের মুসলমানদের কুরআনের আওতায় নিয়ে আসাসহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন শিখিয়ে দেওয়াদ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি শেখানোর আয়োজন করা। পাড়া-মহল্লার যে যেখানে অবস্থান করছেসেখানেই দিনের কিছু সময় বের করে তার নিজস্ব পেশায় থেকেও সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন শরীফ শেখা এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি শেখার সুযোগ থাকে।

আমরা আশা করিদ্বীনের রাহবার উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং সর্বস্তরের মুসলমান এ সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদেরকে কল্যাণের পথেহেদায়েতের পথে এগিয়ে নিতে উদ্যোগী হবেন।

জানা কথাবিশ্বকে ওরা গণতন্ত্র-মন্ত্রসহ কত নীতিকত কিছুই তো শিখিয়েছেকিন্তু কোনো কিছুতেই বিশ্বে শান্তি আসেনি। উন্নত থেকে উন্নততর দেশে বাড়ছে হতাশা-ডিপ্রেশনবাড়ছে আত্মহত্যা। কেনএর কারণ খোঁজার জন্য অনেক দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। একথা খুবই স্পষ্টমানুষ দ্বীন থেকে যত দূরে সরবেযত বেশি আল্লাহ-বিমুখ হবেতত তাদের জীবনে কষ্ট-ক্লেশ আর অশান্তি নেমে আসবে। সমাজে বাড়তে থাকবে অত্যাচার-অনাচারনির্যাতন-নিপীড়ন ও পাহাড়সম বৈষম্য। সুতরাং মুসলমানদের আবার ফিরতে হবে কুরআনের দিকেতাকওয়ার দিকে।

রমযানের এই মুবারক মাস কুরআন ও তাকওয়ার পথে অগ্রসর হওয়ার মোক্ষম সুযোগ। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন- আমীন।

রমযানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলশাহরুল খাইরাত- দান-অনুদানের মাস। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এসেছেআবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُونُ فِيْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ  مِّنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآنَ، فَلَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَجْوَدُ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ المُرْسَلَةِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তাঁর দানশীলতা (অন্য সময়ের চেয়ে) অধিক বৃদ্ধি পেত রমযান মাসেযখন জিবরীল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জিবরীল আ. রমযানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং তাঁরা পরস্পর  কুরআন শোনাতেন। তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল হয়ে উঠতেন। -সহীহ বুখারীহাদীস ০৬সহীহ মুসলিমহাদীস ২৩০৮মুসনাদে আহমাদহাদীস ২৬১৬

অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি দান করতেন। বিশ্বের মুসলমানরাও তাঁর অনুসরণ করে এ মাসে তাদের দান-সদকার হাত প্রসারিত করে থাকেনসেটাকে আরো বাড়িয়ে দিতে হবে।

নিজেদের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করেনিজ দেশ তো আছেইএমনকি বাইরেও- বিশ্বের দেশে দেশে যেসকল মাযলুম মুসলমান রয়েছেনযেসমস্ত জায়গায় নির্যাতিত হচ্ছেনযেকোনো সুযোগে সেখানে তাদের কাছে দান-সদকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে কুণ্ঠাবোধ করা যাবে না। রমযান পরবর্তী সময়ও তাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে।

তবেই রমযান যে শাহরুল মুওয়াসাত (সহমর্মিতা-ভ্রাতৃত্ববোধের মাস)শাহরুল খাইরাত (দান-সদকার মাস)- এর সঠিক উপলব্ধি মুসলিম মানসপটে জাগ্রত হবে।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →