প্রবন্ধ

ঈমান সুরক্ষায় কুসংস্কার থেকে দূরে থাকুন!

লেখক:মুফতী উমর ফারুক বিক্রমপুরী দা.বা.
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১
৫১৯০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

আমাদের সমাজে সামাজিকতা ও নিয়মনীতি পালনের নামে বহু কুপ্রথা ও কুসংস্কার প্রচলন রয়েছে। শরীয়তে এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। এর মধ্যে কিছু আছে নাজায়েয ও বিদ'আত পর্যায়ের আর কিছু আছে কুফর ও শিরক পর্যায়ের। নাজায়েয ও বিদ'আত, কুফর ও শিরক প্রতিটিই ঈমানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই কুসংস্কারগুলোর বেশীরভাগই বিজাতি, বিধর্মী বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের রীতি ও প্রথা থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। অনেক ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান অজ্ঞতাবশত এ সকল কুসংস্কারকে ধর্মীয় আবেগ নিয়ে খুব আগ্রহ ও গুরুত্ব সহকারে পালন করে থাকে। আবার অনেক আধুনিক ব্যক্তিবর্গ এগুলোকে ফ্যাশন বা উন্নত কালচার মনে করে পালন করে। অথচ ঈমান হেফাজতের জন্য প্রতিটি মুসলমানের এ সকল কুসংস্কার থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দূরে থাকা কর্তব্য। যে সকল কুসংস্কার থেকে মুসলমানদের দূরে থাকা অতিআবশ্যক সেগুলোর কিছু এই-

১. যেসব লোকের পরপর কয়েকজন সন্তান অল্প বয়সে মারা যায় তাদের কোন সন্তান বেঁচে গেলে সেই সন্তানের বিচিত্র সব নাম রাখা হয়। যেমন ফেলানী, হেলানী, টেপা, পঁচা, ইত্যাদি। তারা মনে করে এরকম আজেবাজে ও শ্রুতিকটু নাম রাখলে এর প্রতি আজরাইলের নজর থাকে না, ফলে সন্তানটি বেঁচে যায়। এভাবে পরপর কয়েকজন মারা যাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া সন্তানটিকে 'মল্লি ছেলে' বলা হয়। অতঃপর এই মল্লি ছেলের এক কান ফুটো করে তাতে ছোট একটা লোহা/তামা/পিতল ইত্যাদির রিং পরিয়ে দেয়া হয়। অনেকে আবার এরূপ ছেলের মাথার পিছন দিকের কিছু চুল না কেটে অনেক লম্বা করে রাখে। এর দ্বারা নাকি ছেলে শিশুকে মেয়ে বানিয়ে আজরাইলকে ধাঁধাঁয় ফেলে ফাঁকি দেয়া হয় এবং মেয়ে মনে করে হযরত আজরাইল তাকে ফেলে যায় আর এই ফাঁকে ছেলেটি বেঁচে যায়। তাদের ধারণায় মেয়ে সন্তানের প্রতি আজরাইলের আকর্ষণ কম, আর ছেলে সন্তানের প্রতি আকর্ষণ বেশি। এ সকল ধারণা সম্পূর্ন অমূলক, মিথ্যা, ভ্রান্ত ও কুফরী। এর দ্বারা ঈমানের মারাত্মক ক্ষতি হবে। কারণ উল্লিখিত সকল কাজই একমাত্র আল্লাহ তা'আলার হাতে। সন্তানের জীবন আল্লাহই দেন আবার মৃত্যুও আল্লাহই দেন। হযরত আজরাইলের হাতে এরূপ কোন ক্ষমতা নেই। তিনি তো কেবল আল্লাহর হুকুমের গোলাম। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা'আলাই বান্দাকে ছেলে দেন এবং মেয়েও তিনিই দেন। তার নিকট ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া আল্লাহ তা'আলা সর্বশক্তিমান। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু এমনকি প্রতিটি অণু-পরমাণুও তার সামনে পরিষ্কার। অতএব এ সকল আজেবাজে নাম দিয়ে বা ছেলেকে মেয়ে বানিয়ে তাকে ধোঁকা দেয়া বা তাকে ধাঁধাঁয় ফেলা সম্ভব নয়। তাই এ সকল ঈমান বিধ্বংসী চিন্তাধারা ও কুসংস্কার থেকে সকলের বিরত থাকা জরুরী। 

২. অনেক মুসলমান সন্তানদেরকে আদর- সোহাগ করে লক্ষ্মী বলে ডাকে। বলে- 'তুমি আমার সোনা, ময়না, লক্ষ্মী! আবার ছেলে-মেয়ে বুদ্ধিমান হলে, কাজকর্মে মনোযোগী হলে বলে, 'আমার ছেলেটা/ মেয়েটা খুব লক্ষ্মী।' অনুরূপভাবে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও লক্ষ্মী কথার প্রচলন আছে। তারা বলে, 'কাস্টমার হলো দোকানের লক্ষ্মী, কাস্টমারের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই।' আবার ব্যবসায় উন্নতি হলে বলে, 'আমার দোকানে লক্ষ্মী আছে।' এগুলো ঈমানবিধ্বংসী কথা। লক্ষ্মী মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ দেবতার নাম। অনুরূপভাবে হিন্দুরা লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী বলে শুভ-অশুভে বিশ্বাস করে এবং লক্ষ্মী দেবতার সন্তুষ্টির জন্য লক্ষ্মীপূজা করে। কিন্তু ইসলামে লক্ষ্মী- অলক্ষ্মী তথা শুভ-অশুভ বলতে কিছু নেই। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে থাকে, একমাত্র আল্লাহ তা'আলার হুকুমেই ঘটে থাকে। পবিত্র কুরআনে আছে- إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ (অর্থ:) হুকুম চলে কেবলই আল্লাহর। (সূরা আন'আম-৫৭)

সুতরাং হিন্দুদের দেখাদেখি কোন মুসলমানের জন্য সন্তান বা অন্য কিছুকে কাউকে লক্ষ্মী বলে সম্বোধন করা কিছুতেই বৈধ হবে না এবং শুভ-অশুভে বিশ্বাস করাও জায়েয হবে না। এত ঈমানের মারাত্মক ক্ষতি হবে। 

৩. ছোট শিশুকে নিয়ে বাইরে বের হওয়ার আগে শিশুর বাবা-মা অথবা অভিভাবক শিশুর কপালের এক পাশে কাজলের ফোঁটা দিয়ে দেয়, যাতে শিশুর উপর কারো নযর না লাগে এবং এতে নাকি শিশুটি অমঙ্গল থেকে রক্ষা পায়। এটাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কুসংস্কার এবং ঈমানবিরোধী কাজ।

৪. শিশুদের দুধের দাঁত পড়ে যখন নতুন দাঁত গজায় তখন নতুন দাঁতটি যাতে সুন্দর হয়, সে জন্য পড়ে যাওয়া দাঁতটি ইঁদুরের গর্তে ফেলে বলা হয়; 'ইঁদুর ভাই! ইঁদুর ভাই! পঁচা দাঁত নিয়ে যাও, ভালো দাঁত দিয়া যাও।' এটা বললে নাকি শিশুর নতুন গজানো দাঁত সুন্দর ও মজবুত হয়। এটা সম্পূর্ণ অমূলক, কুসংস্কার এবং শরীয়তবিরোধী নাজায়েয কাজ। ইঁদুরের সাথে মানুষের দাঁত ভালো-মন্দ হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এ ব্যাপারে ইঁদুরেরও কিছুই করার ক্ষমতা নেই। বাস্তবে সে কিছু করেও না। বরং সব কিছু আল্লাহ তা'আলার হুকুমেই হয়ে থাকে।

৫. যাত্রাকালে কালো বিড়াল, ঝাড়ু, খালি কলস, পেঁচা ইত্যাদি দেখলে অথবা কোন নিঃসন্তান লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে নাকি যাত্রা নাস্তি হয়, শুভ হয় না। এ ছাড়া যাত্রাকালে পেছন থেকে ডাকা, হাঁচি দেয়া ইত্যাদিকেও অমঙ্গলকর মনে করা হয়। আবার যাত্রা শুরু করার সময় কেউ হোঁচট খেলে বা কোন জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে একটু অপেক্ষা করে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। এতে নাকি ঐ অমঙ্গলটা আর থাকে না এবং অমঙ্গলের আশংকাটা কেটে যায়। শরীয়তে এগুলোর কোন ভিত্তি নেই; সবই ভ্রান্তবিশ্বাস ও কুসংস্কার। 

৬. কেউ কেউ বলে, বাপ-কাঠামো মেয়ে ভাগ্যবতী আর মা-কাঠামো ছেলে ভাগ্যবান হয়। এটাও সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারো ভাগ্যের সঙ্গে তার নিজের কিংবা অন্য কারও গঠন-কাঠামোর সম্পর্ক নেই। মানুষের কিসমত তথা ভাগ্য তো তার জন্মের পূর্বেই লিখা হয়ে গিয়েছে। এখন জন্মের পরে এসে শারীরিক গঠনের সঙ্গে ভাগ্য নির্ধারণের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

৭. শিশু কর্তৃক পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে হাঁটা নাকি অসুখ-বিসুখ ডেকে আনার লক্ষ্মণ। এ কারণে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে হাঁটা শিশুকে মুরব্বীরা ধমক দিয়ে বলে- 'ভালো করে হাঁটু, এভাবে হেঁটে বিপদ ডেকে আনবি নাকি? এ বিশ্বাসটিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এভাবে হাঁটার সঙ্গে অসুখ-বিসুখ ডেকে আনার কোনও সম্পর্ক নেই।

৮. অনেকে মনে করে, ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় ডিম খেতে নেই। কারণ এতে নাকি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হওয়ার আশংকা থাকে। এটা অমূলক ও ভুল বিশ্বাস। কারণ ডিমের সঙ্গে পরীক্ষার ভালো-খারাপের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া কারও ক্ষতি করার জন্য ডিমের নিজস্ব কোন শক্তি নেই। বরং ডিম একটি পুষ্টিকর খাদ্য। এটা খেলে শরীর-স্বাস্থ্য সবল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং এই অমূলক বিশ্বাস পরিহার করা আবশ্যক।

৯. খাবার রান্না করার পর স্ত্রীরা স্বামী বা গৃহকর্তার আগে খেয়ে নিলে নাকি স্ত্রীর অমঙ্গল হয়। এ জন্য স্ত্রীরা নিজেদের প্রবল ক্ষুধা লাগা সত্ত্বেও স্বামীর খানা খাওয়ার আগে নিজেরা খায় না; বরং স্বামীর খানা শেষ হলে তারপর খায়। অনেক সময় স্ত্রী আগে খেলে স্বামী রাগও করে। এটা সম্পূর্ণ অমূলক কল্পনা। খানার ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, যখন যার প্রয়োজন হবে তখন সে খেয়ে নিবে। স্ত্রী প্রয়োজনে স্বামীর আগেও খেতে পারবে। এতে তার অমঙ্গলের কিছুই নেই। প্রয়োজন না হলে পরেও খেতে পারবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো স্ত্রীদেরকে নিয়ে একসঙ্গে খানা খেতেন।

১০. অনেকে রাতের বেলা গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে না। এতে নাকি অমঙ্গল হয়। একান্ত প্রয়োজনে গাছের কাছে নাকি তিনবার অনুমতি নিয়ে ছিঁড়তে হয়। এটাও অমূলক ধারণা। শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই।

১১. অনেক এলাকায় কুরবানীর পশু যবাই করার সময় ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত সংগ্রহ করে ফলবান গাছের গোঁড়ায় ঢেলে দেয়া হয়। এতে নাকি গাছটি ফল বেশী দেয়। শরীয়তে এই ধারণারও কোন ভিত্তি নেই।

১২. কোন কোন এলাকায় নদীভাঙ্গন রোধ করার জন্য 'গঙ্গার মা'-এর নামে নদীতে যিন্দা মুরগী, ছাগল ইত্যাদি ছেড়ে দেয়া হয়। আবার বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য কলাপাতায় রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এতে নাকি নদীভাঙ্গন রোধ হয়। এটা সম্পূর্ণ অমূলক, ভিত্তিহীন, গর্হিত ও সুস্পষ্ট শিরক। এর দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। 

১৩. খানা খাওয়ার সময় হাঁচি আসলে বলা হয়, কেউ তোমাকে স্মরণ করছে। ডান হাতের তালু চুলকালে বলা হয়, তোমার হাতে টাকা আসবে। বাম চোখ একাএকা লাফাতে থাকলে বলা হয়, তোমার অমঙ্গল হবে। দাঁড়কাক ডাকাডাকি করলে প্রিয়জনের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ইঙ্গিত মনে করা হয়। এগুলো সবই নিছক কুসংস্কার। শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই। বরং মাখলুকের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে উল্লিখিত ভ্রান্ত আকীদা ও গর্হিত কর্মকাণ্ডসহ সকল ঈমানবিধ্বংসী বিশ্বাস ও কর্ম থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম : বিভ্রান্তি নিরসনে মুসলমানদের যা জানা দরকার

...

আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৯৮১৫ বার দেখা হয়েছে

ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ (৩য় পর্ব)

...

মাওলানা ইমদাদুল হক
৯ নভেম্বর, ২০২৪
১৮২২ বার দেখা হয়েছে

মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৫৩৩৪ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →