প্রবন্ধ

নবীজীর ভালোবাসা ও সুন্নাতী যিন্দেগী

লেখক:মাওলানা শফীকুর রহমান
১৫ জানুয়ারী, ২০১৫
১০১৮৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

হযরত সালমান মনসুরপুরী রহ. বলেন, নবীজীর মুহাব্বত হৃদয়ের শক্তি, রূহের খোরাক, চোখের শীতলতা, দেহের সজীবতা, অন্তরের জীবন, জীবনের সাফল্য, সাফল্যের প্রাণ। মোটকথা মুহাব্বতই সবকিছু। (ইশকে রাসূল; পৃষ্ঠা ৫)


মুহাব্বতের কারণ

সাধারণত কেউ কাউকে চারটি কারণে মুহাব্বত করে।

১. জামাল (সৌন্দর্য)

২. কামাল (যোগ্যতা) 

৩. নাওয়াল (দয়া-অনুগ্রহ) 

৪. কারাবাত (আত্মীয়তা)

জামাল (সৌন্দর্য): সুন্দরের প্রতি মানুষ চিরকালই দুর্বল। সৌন্দর্যের আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া নিতান্তই কঠিন। মুহাব্বত-ভালোবাসার যত ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছে তার অধিকাংশই সৌন্দর্যঘটিত। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সকল সৌন্দর্যের অনন্য সমাহার। নবীভক্ত হযরত হাসান বিন সাবিত রাযি. বলেন,

وأحسن منك لم تر قط عيني، + وأجمل منك لم تلد النساء.

خلقت مبرأ من كل عيب، + كأنك قد خلقت كما تشاء.

অর্থ : আমার আঁখিযুগল আপনার চেয়ে সুন্দর কাউকে দর্শন করেনি।আপনার চেয়ে সুদর্শন কাউকে কোন নারী জন্মও দেয়নি। 

আপনাকে সকল প্রকার ত্রুটি মুক্ত করে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেন আপনি আপন চাহিদা মোতাবেক সৃজিত হয়েছেন। (রূহুল মা'আনী ১১/৬১)

হযরত আলী রাযি. বলেন, من رآه بديهة هابه، ومن خالطه معرفة أحبه، يقول ناعته: لم أر قبله ولا بعده مثله অর্থ : কেউ হঠাৎ নবীজীকে দেখলে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। আর ক্ষণিক পরিচয়ে তার ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে যায়। তার অবয়ব আকৃতির বর্ণনা দানকারী এ কথা বলতে বাধ্য, আমি তার মত আর কাউকে দেখিনি; পূর্বেও না, পরেও না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৬৩৮)

কামাল (যোগ্যতা): যোগ্যতার প্রতিও মানুষ দুর্বল। বড় বড় শাইখুল হাদীস, পীর-মাশায়েখ, মুফতী-মুফাসসির, মুহাদ্দিস-মুদাররিস, ইমাম-খতীব ও ওয়ায়েয-বক্তাকে মানুষ ভালোবাসে তাদের বাহ্যিক আকৃতির কারণে নয়; তাদের চারিত্রিক গুণাবলী ও যোগ্যতাই সে ভালোবাসার কারণ। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন যোগ্যতার প্রশ্নে সকল আলোচনার উর্ধ্বে। 

আল্লাহ তা'আলা বলেন,وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا অর্থ : আর আপনি যা জানতেন না, তিনি (আল্লাহ) তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আপনার উপর আল্লাহ তা'আলার অসীম করুণা রয়েছে। (সূরা নিসা-১১৩)

নাওয়াল (দান ও অনুগ্রহ): মানুষ অনুগ্রহের দাস। মানুষকে যেন অনুগ্রহকারীর প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। এই যে দিন-রাত মেম্বার-চেয়ারম্যান আর মন্ত্রী-মিনিস্টারদের পেছনে মানুষ ঘুরঘুর করে, তাদের গুণ কীর্তন করে বেড়ায়, এর অন্য কোন কারণ না থাকলেও দান-দক্ষিণার বিষয়টি অবশ্যই বিদ্যমান।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন উম্মাহর প্রতি সবচে বড় মুহসিন ও অনুগ্রহশীল। আল্লাহ তা'আলা বলেন لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عنتُمْ ... الخ  অর্থ : তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকেই এমন একজন রাসূল আগমন করেছেন, যার কাছে তোমাদের ক্ষতিকর বিষয়াদি নিতান্ত কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের খুবই হিতাকাঙ্ক্ষী এবং মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, করুণাপরায়ণ। (সূরা তওবা-১২৮) 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إنما أنا قاسم والله يعطي অর্থ : আমি হলাম বণ্টনকারী, আর দানকারী হলেন আল্লাহ তা'আলা। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৭১)

কারাবাত (আত্মীয়তা): মাতা-পিতা সন্তানকে আদর-সোহাগ করে, সন্তানেরা মাতা-পিতাকে ভক্তি-ভালোবাসা জানায়, অনুরূপ নিকটাত্মীয় নিকটাত্মীয়কে কদর- সম্মান করে- তার মূলে আছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন উম্মতের সবচে' বেশি আপন, সবচে' বেশি নিকটাত্মীয়। 

النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ

অর্থ : নবী মুমিনদের কাছে তাদের আপন সত্তার চেয়েও বেশি প্রিয় আর নবীর স্ত্রীগণ হচ্ছে তাদের মা। (সূরা আহযাব-৬)


নবীজীর মুহাব্বত

উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, মানুষকে মুহাব্বত করার সবগুলো কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে পূর্ণরূপে বিদ্যমান। উপরন্তু কুরআন ও সুন্নাহয় নবীজীকে মুহাব্বত করার নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

 قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ ... الخ 

অর্থ : বলুন! তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তান-সন্ততি, তোমাদের ভাই-বেরাদর, তোমাদের পতি-পত্নী, তোমাদের গোত্র- বংশ, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসায় যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তার রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর তাঁর বিধান (শাস্তি) আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না। (সূরা তওবা-২৪) 

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين. অর্থ : তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষের চেয়ে আমি তার নিকট বেশি প্রিয় না হই। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৫) সুতরাং নবীজীর মুহাব্বত যুক্তির দাবি, কুরআনের আদেশ এবং ঈমানের আলামত।


নবীজীকে মুহাব্বত করার অর্থ 

জুনায়েদ বাগদাদী রহ. বলেন,'মুহাব্বতের অর্থ হল প্রেমাষ্পদের পছন্দনীয় বস্তু গ্রহণ করা, যদিও তা নিজের কাছে অপছন্দ লাগে এবং তার অপছন্দনীয় বস্তু পরিত্যাগ করা যদিও তা নিজের কাছে পছন্দনীয় মনে হয়। এজন্যই বলা হয়, প্রেমিকজন প্রেমাষ্পদের বাধ্য হয়ে থাকে। (ইশকে রাসূল; পৃষ্ঠা ৮)

সুতরাং নবীজীকে মুহাব্বত করার অর্থ হল, তার অনুসরণ করা, তার আদর্শ গ্রহণ করা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা। নবীজী সাল্লাল্লাহু বলেন, 'যে আমার সুন্নাতকে যিন্দা করল সে আমাকেই ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসল সে আমার সাথেই জান্নাতে থাকবে।' (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৬৭৮)

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, 'আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়।' (সূরা নিসা-৬৪)

সুতরাং নবীজীকে মুহাব্বত করার অর্থ হল, তার সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়া ও তার আদর্শ মেনে চলা। এখন কেউ যদি নবীজীর আশেক হওয়ার দাবি করে এবং তার মুহাব্বতের দাবিদার হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে সুন্নাতী জীবন-যাপন করতে হবে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় তা ধোঁকা ও প্রতারণা বিবেচিত হবে। কবি বলেন,

تعصي الرسول وأنت تظهر حبه + هذا لعمري في الفعال لبديع. 

لو كان حبك صادقا لأطعته + إن المحب لمن يحب مطيع. 

অর্থ : তুমি রাসূলের অবাধ্যতা করছো, আবার তাকে ভালোবাসারও দাবি জানাচ্ছো। জীবনের কসম! বড় অভিনব তোমার দাবি! 

মুহাব্বত সাচ্চা হলে অবশ্যই তুমি তার আনুগত্য করতে। কারণ প্রেমিকজন প্রেমাষ্পদের অনুগত হয়ে থাকে। (খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত ৩১/১১০)


সাহাবায়ে কেরামের মুহাব্বত

সাহাবায়ে কেরাম হলেন এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ জামাআত। যারা নবীজীকে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং ঈমান অবস্থায় নবীজীর সংশ্রব অবলম্বন করেছেন।

সুখে-দুঃখে, ঘরে-বাইরে সর্বাবস্থায় নবীজীকে সঙ্গ দিয়েছেন। নিজেদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজেদের প্রাণের চেয়েও তাকে বেশি ভালোবেসে নবীপ্রেমের বিরল সব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। যা তাদেরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত-অনুরক্ত ও অনুরাগী-অনুসারীর পরিচিতি দান করেছে। তাদের নবীপ্রেমের প্রসিদ্ধ ঘটনাবলীরও বর্ণনা শুরু করলে বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থ রচিত হয়ে যাবে। 


উরওয়া ইবনে মাসউদের ঐতিহাসিক উক্তি 

হুদায়বিয়া ঘটনায় উরওয়া ইবনে মাসউদকে মক্কাবাসী কাফেররা মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিল। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভক্তি-শ্রদ্ধা, ইযযত-সম্মান ও প্রেম-আসক্তির বহমান ঝর্নাধারা অবলোকন করে এক দিলজাগানিয়া অভিব্যক্তি পেশ করেছিলেন-

'হে আমার সম্প্রদায়! জীবনে বহু রাজা- বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিসরা- কায়সারের দরবারেও আমি গিয়েছি। নাজাশীর সাথেও আমার সাক্ষাত হয়েছে। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদকে তাঁর অনুসারীরা যে পরিমাণ ভক্তি-শ্রদ্ধা করে কোনও রাজা-বাদশাহকে তার অনুসারীদের এই পরিমাণ ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে দেখিনি। খোদার কসম! তিনি থুথু ফেললে তাঁর অনুসারীরা যমীনে পড়তে দেয় না, তাদের কেউ না কেউ তা লুফে নিয়ে নিজের চেহারা ও শরীরে মলে নেয়। কোন কাজের আদেশ দিলে তারা তা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার উযূতে ব্যবহৃত পানি নিয়ে তারা কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। তিনি কথা বললে তন্ময় হয়ে শোনে। সম্মানের কারণে তাঁর দিকে চোখ উঠিয়েও তাকায় না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২৫৮১) 

এখন আমরা সাহাবায়ে কেরামের এমন কয়েকটি ঘটনা পেশ করবো, যেগুলো দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তারা কীভাবে নবীজীকে ভালোবাসতেন এবং তাঁর সুন্নাতকে কীভাবে বাস্তবায়ন করেছেন।

১. ইবনে আবী শাইবা আতা রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়ান করছিলেন। এক পর্যায়ে লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা বসে পড়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. ছিলেন মসজিদের বাইরে রাস্তায়। তিনি নবীজীর আওয়াজ শোনামাত্র সেখানেই বসে পড়লেন। বয়ানের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আমি তো বসতে বলেছিলাম তাদেরকে যারা মসজিদের কিনারায় ছিল, তুমি তো ছিলে রাস্তায়, তুমি কেন সেখানেই বসে পড়লে? তিনি বললেন, হুযূর! আপনার 'বসে পড়' কথাটি যখন কানে পৌঁছল, তখন আব্দুল্লাহর ক্ষমতা ছিল না যে, সে তার পা এক কদমও আগে বাড়াবে। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ১০৯৩) 

২. একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণের আংটি পরিধান করলেন। তা দেখে সাহাবায়ে কেরামও স্বর্ণের আংটি ব্যবহার শুরু করলেন। পরবর্তীতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমি কখনো আর এ আংটি ব্যবহার করব না। তখন সাহাবায়ে কেরামও তা ছেড়ে দেন। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪২২০)

৩. ইসলামের শুরু যামানায় একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়ছিলেন। হঠাৎ জিবরীল আ. এসে সংবাদ দিলেন যে, নবীজীর জুতা মুবারকে নাপাকী লেগে আছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে নামাযের মধ্যেই জুতা খুলে ফেললেন। নবীজীর জুতা খোলা দেখে সাহাবায়ে কেরামও জুতা খুলে ফেললেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জিনিস তোমাদেরকে জুতা খুলতে উদ্বুদ্ধ করল? তারা বললেন, আপনাকে দেখেছি তাই। নবীজী বলেন, আমার জুতায় তো নাপাকী লেগে ছিল। কিন্তু তোমাদের ব্যাপার তো এমনটি নয়। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৬৫০)

৪. যায়েদ ইবনে আসলাম বর্ণনা করেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. কে জামার বোতাম খুলে নামায পড়তে দেখলাম। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি নবীজীকে এমনটি করতে দেখেছি, তাই আমিও বোতাম খুলে নামায পড়ি। (সুনানে বাইহাকী; হা.নং ৩১১৩)

৫. হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় চুক্তির বিষয় চূড়ান্ত করার জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দূত হয়ে হযরত উসমান রাযি. মক্কায় তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে চাচাত ভাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করেন। সকালে মক্কার সরদারদের সঙ্গে আলোচনা করতে যখন বাড়ি থেকে বের হলেন তখন তার পায়জামা নিসফে সাক পর্যন্ত উঠানো ছিল। নবীজীর সাধারণ অভ্যাস ছিল নিসফে সাক পর্যন্ত লুঙ্গি-পায়জামা উঠিয়ে রাখা। তখন হযরত উসমান রা.-এর চাচাত ভাই বলতে লাগল, জনাব! আরবদের নিয়ম হল, যার লুঙ্গি-পায়জামা যত বেশি টাখনুর নিচে লটকানো থাকবে তাকে তত বেশি বড় মাপের মনে করা হবে, এ কারণেই নেতারা লুঙ্গি পায়জামা ঝুলিয়ে পরে। এখন আপনি যদি এভাবে পায়জামা উঁচু করে তাদের কাছে যান,তাদের দৃষ্টিতে আপনার কোন মর্যাদা বাকি থাকবে না এবং আলোচনায়ও আগ্রহ দেখাবে না। জবাবে হযরত উসমান রাযি. বললেন,لا هكذا إزرة صاحبنا অর্থ: না, আমি এর চেয়ে নিচে নামাতে পারব না। আমাদের প্রিয় নবীর লুঙ্গি এমনই থাকে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ৩৬৮৫২) 

৬. হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রাযি.ছিলেন ইরান বিজেতা। যখন ইরানে কিসরার উপর হামলা করা হল তখন কিসরা আলোচনার জন্য হযরত হুযাইফা রাযি. কে রাজদরবারে আহ্বান করল। তিনি সেখানে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে তার সামনে খানা পরিবেশন করা হল। তিনি আহার গ্রহণ শুরু করলেন। খানার মাঝে হঠাৎ হাত থেকে কিছু খানা নিচে পড়ে গেল। নবীজীর শিক্ষা হল, খাদ্যের কোন অংশ পড়ে গেলে তা উঠিয়ে প্রয়োজনে পরিষ্কার করে খাওয়া; সেটাকে নষ্ট না করা। কারণ, জানা নেই খানার কোন অংশে বরকত নিহিত থাকে। এ শিক্ষা অনুযায়ী হযরত হুযাইফা রা. পতিত খানা উঠানোর জন্য হাত বাড়ালেন। সামনে উপবিষ্ট এক ব্যক্তি কনুইয়ের মৃদু আঘাতে তাকে ইশারা করল- জনাব! একি করছেন? এটাতো পৃথিবীর সুপার পাওয়ার কিসরার রাজদরবার। এখানে পড়ে যাওয়া খাদ্য উঠিয়ে খেলে সম্মান মাঠে মারা যাবে। তারা আপনাকে নিচু জাতের লোক মনে করবে। 

হযরত হুযাইফা রাযি. তখন এক বিস্ময়কর বাক্য উচ্চারণ করলেন। যা সর্বকালে মুসলিম উম্মাহর সাফল্যের চাবিকাঠির মর্যাদা রাখে। তিনি বললেন,اأترك سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم لهؤلاء الحمقاء؟ অর্থ: তবে কি এসব নির্বোধ-বোকাদের খাতিরে আমি নবীজীর সুন্নাতকে ছেড়ে দেবো? কখনই না। চাই তারা ভালো মনে করুক অথবা খারাপ, সম্মান করুক বা উপহাস। আমার দ্বারা তো নবীজীর সুন্নাত ছেড়ে দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। (ইসলাহী খুতুবাত; পৃষ্ঠা ১৪৮)


সুন্নাতের ফযীলত

এটা অনস্বীকার্য যে, সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোন তরীকা-পদ্ধতি, মত ও পথে শান্তি-সফলতা নেই। একমাত্র সুন্নাতে নববীর মধ্যেই রয়েছে মুসলমানদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্য ও কামিয়াবী। সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামীনের রেযা ও সন্তুষ্টি। 

১. আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, 'আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের মুহাব্বত করবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (সূরা আলে ইমরান-৩১)

২. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 'আমার প্রতিটি উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে; অস্বীকারকারী ব্যতীত। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, অস্বীকারকারী কে? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হল সেই অস্বীকার করল। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৮৫১)

৩. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ফিতনা-ফাসাদের যামানায় যে আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে সে শদীদের সওয়াব পাবে। (ত্ববারানী আউসাত; হা.নং ৫৪১৪)

8. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের মাঝে দু'টি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দু'টিকে আঁকড়ে ধরবে ততক্ষণ পর্যন্ত গোমরাহ হবে না। (মুআত্তা ইমাম মালেক; হা.নং ১৫৯৪)

৫ . এক সাহাবী নবীজীর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? নবীজী বললেন, তুমি তার জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছো? তিনি বললেন, প্রস্তুতি তো বেশি একটা নিতে পারিনি, তবে আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে মুহাব্বত করেছি। নবীজী বললেন, যার সাথে যার মুহাব্বত হবে তার সাথে তার জান্নাত হবে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৩২৫)

প্রিয় পাঠক! এতক্ষণের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বত আমাদের ঈমানের অঙ্গ। মুহাব্বত করার সবগুলো কারণই তার মধ্যে বিদ্যমান। আর তাকে মুহাব্বত করার অর্থ হল, তার আদর্শ মেনে চলা, তার সুন্নাত অনুযায়ী জীবন গড়া। যেমনটি গড়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. বলেন, কেউ যদি দাবি করে, সে সাহাবায়ে কেরামের চেয়েও নবীজীকে বেশি ভালোবাসে, সে আসলে পাগল। আর সাহাবায়ে কেরামের মুহাব্বতের মধ্যে না ছিল ঈদে মীলাদুন্নবী, না ছিল জন্মদিবস আর না প্রচলিত মীলাদ-কিয়াম, না মীলাদ কেন্দ্রিক তাবারুক বিতরণ ও জশনে জুলুস। মুমিনের কর্তব্য হল, সে সাহাবায়ে কেরামের তরয ও তরীকায় নবীজীকে মুহাব্বত করবে এবং তার সুন্নাত অনুযায়ী জীবন গড়বে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ অর্থ : তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব-২১)

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

নিজের যিন্দেগীতে ফাতেমী সুন্নত যিন্দা করুন

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৭৪৩ বার দেখা হয়েছে

নামায খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত

...

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৪৬৬৮ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ