প্রবন্ধ
দাওয়াত, হাদিয়া ও উপঢৌকন
হাদিয়া, উপঢৌকন ও দাওয়াত আদান- প্রদান ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল ও প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মিল-মহব্বত অটুট রাখতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার মত যাদুকরী শক্তি রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদর্শের মধ্যে। যুগযুগ ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অনুপম আদর্শের অনুসরণ করে মুসলমানরা লাভ করেছে সুখ-সমৃদ্ধ সমাজ ও পরিবেশ। ফলে অমুসলিমরাও এ আদর্শকে অনুকরণ করে জাগতিক উন্নতির পথকে সুগম করছে।
এজন্যই মানচিত্র আর সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, দল-মত ও গোত্র- বর্ণের বৈষম্য পেছনে ফেলে বিশ্বের সকল দেশের কূটনীতিকরা আজো এই প্রথাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে মজবুতভাবে। হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান প্রদান করো, তাহলে তোমাদের পারস্পরিক মিল-মহব্বত, প্রেম- ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। (আলআদাবুল মুফরাদ লিলবুখারী; হা.নং ৫৯৪)
তিনি আরো বলেন, তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান করো, কেননা তা অন্তরের বিদ্বেষ দূর করে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২১৩০)
দাওয়াত ও হাদিয়া গ্রহণ করার প্রতিও তিনি যথেষ্ট উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা দাওয়াত কবুল করো, হাদিয়া প্রত্যাখ্যান করো না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৪০৭)
আরো বলেছেন, যদি আমাকে একটি খুর (পায়া)-এর দাওয়াতও করা হয় তাহলে তা আমি কবুল করব। একটি খুর হাদিয়া দেয়া হলেও তা আমি সাদরে গ্রহণ করব। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫১৭৮)
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের পাঁচটি হক রয়েছে। (১) সালামের উত্তর দেয়া, (২) অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-শুশ্রুষা করা, (৩) জানাযায় শরীক হওয়া, (৪) দাওয়াত কবুল করা, (৫) হাঁচিদাতার 'আলহামদুলিল্লাহ'র জবাবে 'ইয়ারহামুকাল্লাহ' বলা। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১২৪০)
প্রিয় পাঠক! উপরোল্লিখিত হাদীসসমূহে এ বিষয়টি স্পষ্ট হল যে, দাওয়াত, হাদিয়া ও উপঢৌকন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। এর প্রতি তিনি উৎসাহিত করেছেন এবং এর সওয়াব, উপকার ও কল্যাণ প্রভূত ও অগণিত। তবে এ সওয়াব, উপকার ও কল্যাণ তখনই সাধিত হবে যখন তা শরীয়ত সম্মতভাবে সম্পাদন করা হবে, সুন্নাত মোতাবেক হবে। অন্যথায় তা বিদআত ও গুনাহের কাজ বিবেচিত হবে।
দাওয়াত প্রদানের সহীহ তরীকা
১. দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য মহব্বত প্রকাশ। এজন্য যাকে দাওয়াত করা হবে তার আরামের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরী। এমন যেন না হয় যে, দাওয়াত খাওয়াটা তার জন্য মুসীবত হয়ে দাঁড়াল। (ইসলাহী খুতুবাত ৫/২৩৯)
২. হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, দাওয়াতের ৩টি স্তর রয়েছে।
সর্বোত্তম স্তর : বর্তমান পরিবেশে সবচেয়ে উঁচু স্তরের দাওয়াত হল, যাকে দাওয়াত করা উদ্দেশ্য মেজবান নিজ ইচ্ছানুপাতে তাকে নগদ অর্থই হাদিয়া দেয়া। এতে মেহমানের কোন কষ্ট পোহাতে হবে না। উপরন্তু ঐ টাকা খরচের ব্যাপারে তার পূর্ণ স্বাধীনতাও থাকবে। ইচ্ছা করলে সে খানার মধ্যেও খরচ করতে পারবে কিংবা তার চেয়েও বেশি কোন প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। এতে তার কোনই কষ্ট হল না; বরং আরাম হল এবং উপকারও বেশি হল।
মধ্যম স্তর : যাকে দাওয়াত করার ইচ্ছা হয়, আপ্যায়নের আয়োজন করে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া। আপ্যায়ন বা খানা নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ায় এ জাতীয় দাওয়াত মধ্যম স্তরে নেমে এসেছে। তবুও যেহেতু মেহমানের কোথাও যাওয়ার কষ্ট করতে হলো না, সুবিধা মতো খেয়ে নেয়ার সুযোগ পেল তাই এ পন্থাটাও নিন্দনীয় নয়; বরং ভালোই বলা চলে।
নিম্নস্তর : যাকে দাওয়াত খাওয়ানো উদ্দেশ্য তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে মেহমানদারী করা। অনেক সময় বন্ধু-বান্ধবদের বাসা ৩০/৪০ মাইল বা ততোধিক দূরে থাকে, সেক্ষেত্রে তাকে দাওয়াত করে আনার অর্থ হল, সে ২/৩ ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বের হবে। একশত বা দুইশত টাকা ভাড়া খরচ করবে। অতঃপর বাড়িতে এসে খানা খাবে। তাহলে এতে তাকে আরাম পৌঁছানো হল না; বরং কষ্ট দেয়া হল। অথচ এর বিপরীতে যদি তার বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে দেয়া হত অথবা নগদ অর্থ দিয়ে দেয়া হত তাহলে সেটাই মেহমানের জন্য স্বাচ্ছন্দের এবং আনন্দের হতো, উপকারীও হতো। (ইসলাহী খুতুবাত ৫/২৩৯)
দাওয়াত কবুল করার বিধান
১. দাওয়াত কবুল করার উদ্দেশ্যও মহব্বত প্রকাশ করা। সুতরাং মহব্বত করে কেউ দাওয়াত করলে তা মহব্বতের সাথেই কবুল করা উচিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, তিনি কারো দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করতেন না। মেজবান অতি সাধারণ কেউ হলেও তিনি তার দাওয়াত কবুল করতেন। এমনকি কোন কোন সময় একজন সাধারণ ক্রীতদাসের দাওয়াতেও কয়েক মাইল সফর করে তার কুটিরে উপস্থিত হয়েছেন। (ইসলাহী খুতুবাত ৫/২৩৮)
অবশ্য দাওয়াত কবুল করা সুন্নাত তখনই হবে যখন তাতে গুনাহের সংমিশ্রণ থাকবে না। যেমন নারী পুরুষের একসাথে খানার ব্যবস্থা করা অথবা খানার আসরে গান-বাজনা ইত্যাদি গুনাহের কাজ চলতে থাকা। কেননা এমন স্থানে দাওয়াতে যাওয়ার অর্থ হল, নিজেকে গুনাহে লিপ্ত করা। (ইসলাহী খুতুবাত ৫/২৪৩)
এ ব্যাপারে মাসআলা হল, যদি পূর্ব থেকেই জানা থাকে যে, দাওয়াতে অংশগ্রহণ করলে কোন কবীরা গুনাহে লিপ্ত হতে হবে তাহলে সেখানে অংশগ্রহণ করা নাজায়েয। আর যদি ধারণা হয় যে, সেখানে কোন গুনাহ হলে সে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, তাহলে মেহমান যদি সাধারণ মানুষ হয় তার জন্য সেখানে অংশগ্রহণ করার অনুমতি থাকবে। আর যদি তিনি গুরুত্বপূর্ণ ও অনুসরণীয় ব্যক্তি হন তাহলে তার জন্য সেখানে কোন অবস্থাতেই শরীক হওয়া জায়েয নেই। (ইসলাহী খুতুবাত ৫/২৪৫, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৬/৪২২)
২. কারো সম্পূর্ণ অথবা অধিকাংশ আয়-উপার্জন যদি হারাম থাকে তাহলে জেনে-শুনে এমন ব্যক্তির দাওয়াত কবুল করা জায়েয নেই। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৪২০)
৩. যাকে দাওয়াত করা হয় শুধু সে-ই যাবে। অতিরিক্ত কাউকে সাথে নিবে না (অনুমতি ছাড়া)। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৪৬১)
হাদীসে বিনা-দাওয়াতী মেহমান সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ লোক চোর হয়ে প্রবেশ করল, আর ডাকাত হয়ে বের হল। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৩৭৪১)
[এছাড়া মেহমান ও মেযবানের আদব শিরোনামে আদাবুল মু'আশারাত নামক কিতাবে আরো বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। পাঠকদের তা দেখে নেয়ার অনুরোধ রইল।]
১. বরযাত্রীর দাওয়াত : শরীয়তে বরযাত্রীর দাওয়াত বলতে কোন দাওয়াত নেই। এটা মেয়ের বাবার উপর যুলুম করারই নামান্তর। যে লোকটা ১৫/২০ বছর তার মেয়েকে ভরণ-পোষণ দিয়ে মানুষ করে আজ আরেকজনের হাতে উঠিয়ে দিচ্ছে তার অন্তরে তো দুঃখের কোন শেষ নেই। সেক্ষেত্রে যদি তার উপর দাওয়াত খাওয়ানোর বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় (বিশেষ করে ২০০/৩০০ মানুষ বা আরো বেশি শর্ত করে) তাহলে এটা তার উপর কী পরিমাণ যুলুম হবে! সেটা একমাত্র হৃদয়বানরাই বুঝতে পারে।
২. জন্ম দিনের দাওয়াত, মৃত্যু বার্ষিকী, তিনদিনা ও চল্লিশার দাওয়াত। শরীয়তে এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। এগুলো বিদআত ও কুসংস্কার। সুতরাং এগুলো থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য।
৩. মুসলমানীর দাওয়াত: মুসলমানী বা খতনা করার সাত দিনের মাথায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক মানুষকে দাওয়াত করার প্রথা বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত আছে। শরীয়তে এরও কোন ভিত্তি নেই।
৪. ওয়ায-মাহফিলে খানার দাওয়াত : বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় ওয়ায-মাহফিল শেষে ব্যাপক আকারে শ্রোতাদের খিচুড়ী, বিরিয়ানী ইত্যাদি খাওয়ানো হয়ে থাকে। এটা ওয়ায-মাহফিলের উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা এর পিছনে পড়ার কারণে আয়োজকদের ওয়ায শোনার সৌভাগ্য হয় না। অপরদিকে শ্রোতারাও বয়ানের তুলনায় সেদিকেই গুরুত্ব বেশি দেয়; মনোযোগ সহকারে বয়ান শোনার তাওফীক হয় না। এটা পরিত্যাজ্য। এতে অনেক খারাবী আছে। বিস্তারিত জানার জন্য মাজালিসে আবরার; পৃষ্ঠা ৩৬৮ দ্রষ্টব্য।
৫. গণচাঁদার সম্মিলিত দাওয়াত: বড় কোন ব্যক্তির জন্মদিবস বা মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে অথবা অন্য কোন উপলক্ষে বিভিন্ন দোকান বা বিভিন্ন বাড়ি থেকে গণচাঁদা উঠিয়ে খিচুড়ী বা বিরিয়ানী পাক করে ধুমধাম করে খাওয়া এবং অন্যকে দাওয়াত করার প্রথাও আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা জায়েয নেই। কেননা এর দ্বারা গরীব-অসহায় চাঁদা দিতে না পারায় মনে কষ্ট পায়। অপরদিকে অনেকে চাপের মুখে চাঁদা দিয়ে নিত্য প্রয়োজন মিটাতে কষ্টে ভোগে। স্বাভাবিক হলে বুঝতো কোন ক্রমেই নিজ প্রয়োজন রেখে এসব কাজে সন্তুষ্টচিত্তে অর্থ ব্যয় করতো না।
হাদীসে আছে,لا يحل لمسلم أن يأكل مال أخيه إلا بطيب نفس منه অর্থ : কোন মুসলমানের জন্য তার ভাইয়ের সম্পদ খাওয়া তার মনতুষ্টি ছাড়া জায়েয নেই। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ২১০৮২)
বর্তমানে আমাদের মাদরাসাগুলোতে বছরের শেষে বিভিন্ন জামাআতের ছাত্ররা বিশেষ করে দাওরায়ে হাদীসের ছাত্ররা সম্মিলিত চাঁদা উঠিয়ে আসাতিযায়ে কেরামকে যে দাওয়াত করে থাকে সেটাও এর আওতায় পড়ে। আকাবিরে দেওবন্দ এটাকে অপছন্দ করতেন। এজন্য এটা থেকে পরহেয করা উচিত।
হাদিয়া প্রদানের সহীহ তরীকা
১. হাদিয়া একটি ব্যক্তিগত আমল। সুতরাং হাদিয়া দিবে গোপনে। হাদিয়া গ্রহীতার উচিত, হাদিয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু বর্তমান অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হাদিয়াদাতা হাদিয়ার কথা প্রকাশ করার ইচ্ছা করে আর গ্রহীতা গোপন রাখার চেষ্টা করে।
২. হাদিয়া যদি টাকা ছাড়া অন্য কিছু হয়, তবে গ্রহীতার রুচি জেনে নিবে। তারপর তার পছন্দনীয় জিনিসটাই হাদিয়া দিবে।
৩. হাদিয়ার সময় বা হাদিয়া দেয়ার পরে নিজের কোন প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করবে না। কেননা এতে হাদিয়া গ্রহীতার মনে স্বার্থ হাসিলের সন্দেহ জাগবে না।
৪. হাদিয়ার পরিমাণ এত বেশি (ভারী) না হওয়া; যা হাদিয়া গ্রহীতার বোঝা মনে হয়।
৫. যাকে হাদিয়া দিবে, তার কাছে হাদিয়ার বিশুদ্ধতা প্রমাণ করা ছাড়া হাদিয়া পেশ করবে না।
৬. হাদিয়া ফেরত দিলে ফেরত দেয়ার কারণ ভালোভাবে জেনে নিবে এবং ভবিষ্যতে সেদিকে খেয়াল রাখবে।
৭. যথাসম্ভব রেল কিংবা ডাকযোগে হাদিয়া পাঠাবে না। কেননা এতে হাদিয়া গ্রহণকারীর নানারকম কষ্ট পোহাতে হয়।
৮. হাদিয়া গ্রহীতার অনুমতি ছাড়া বা তাকে না জানিয়ে তার বাসায় বা তার সীটে কোন কিছু হাদিয়া রেখে দিবে না। এতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৯. কাউকে সফরের সময় এই পরিমাণ হাদিয়া দিবে না, যা বহন করা তার পক্ষে কষ্টকর হয়। যদি একান্তই দেয়ার ইচ্ছা হয় তাহলে তার বাসায় পৌঁছে দিবে।
১০. হাদিয়া দেয়ার সময় স্পষ্ট বলে দিবে যে, এটা হাদিয়া। অন্যথায় শুধু সামনে রেখে দিলে বিভিন্ন সম্ভাবনা থাকে। যেমন- দীনের জন্য দান, সদকা, আমানত ইত্যাদি। (আদাবুল মু'আশারাত থেকে সংগৃহীত)
হাদিয়া গ্রহণ
১. কেউ কোন কিছু হাদিয়া দিলে বিনিময়ে তাকেও কিছু হাদিয়া দেয়া উচিত। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২৫৮৫) আর বিনিময় দেয়া সম্ভব না হলে কমপক্ষে মৌখিক এই বলে দু'আ দিবে جزاك الله خيرا (আল্লাহ তা'আলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন)। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২০৩৫)
২. হাদিয়া যেহেতু মহব্বতের নিদর্শন। এজন্য কারো কাছ থেকে কোন কিছু হাদিয়া পেলে হাদিয়াদাতার মনোরঞ্জনের জন্য তার সামনে তা ব্যবহার করে দেখানো উত্তম।
৩. কারো কাছ থেকে কোন হাদিয়া পাওয়ার সাথে সাথে হাদিয়াদাতার সামনেই তা দান করা কিংবা চাঁদা হিসেবে অথবা অন্য কাজে খরচ করা অনুচিত। কেননা এতে হাদিয়াদাতা কষ্ট পান। (আদাবুল মু'আশারাত; পৃষ্ঠা ৬৯)
হাদিয়া দেয়ার উত্তম কয়েকটি স্থান
হাদিয়া যেহেতু মুসলমানদের পারস্পরিক মহব্বতের নিদর্শন। সুতরাং মুসলমান বলতে যে কাউকে হাদিয়া দেয়া সুন্নাত বলে বিবেচিত হবে। তবে তার সাথে যদি আরো কারণ যুক্ত হয় তাহলে আরো বেশি সওয়াব হবে। যেমন-
১. আত্মীয়তার সম্পর্ক: আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দেয়া হলে হাদিয়ার সওয়াব পাওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করারও সওয়াব পাওয়া যাবে।
২. প্রতিবেশী : প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিলে হাদিয়ার সওয়াবের সাথে সাথে প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার ও তার হক আদায়ের সওয়াবও পাওয়া যাবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. এর পরিবারে একটি বকরী জবাই করা হলে তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে বলেন, أهديتم لجارنا اليهودي؟ أهديتم لجارنا اليهودي؟ অর্থ: তোমরা কি আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিয়েছো? তোমরা কি আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিয়েছো? আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, জিবরাঈল আমীন আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে এত বেশি তাকীদ করতে থাকেন যে, আমার ধারণা হয়, না জানি তিনি প্রতিবেশীকে আমার ওয়ারিশ বানিয়ে দেন। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৯৪৩)
৩. উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন: এতে কোন সন্দেহ নেই যে, উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীনকে মানুষ একমাত্র আল্লাহ তা'আলার উদ্দেশ্যেই মহব্বত করে। কারণ এতে দুনিয়াবী কোন স্বার্থ নেই। তাই উলামায়ে কেরামকে হাদিয়া দেয়া একমাত্র আল্লাহর জন্যই হবে। আর ইখলাসের সাথে আল্লাহর জন্য কোন কাজ করলে যে সওয়াব বেশি হয় এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরন্তু এতে দীনের খিদমতও নিহিত আছে। এসব বিবেচনা করেই তাবলীগের মুরুব্বীয়ানে কেরামের পক্ষ থেকে সাধারণ মুসলমানদের প্রতি নির্দেশনা হল, যখন উলামায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাত করতে যাও তখন তাদের জন্য হাদিয়া নিয়ে যাও। তাই ইমাম, খতীব, মুআযযিন, মাদরাসার শিক্ষকসহ সকল উলামায়ে কেরামের খিদমত করা ও তাদেরকে সাধ্যমতো হাদিয়া দেয়া আমাদের উচিত। এটা আমাদের জন্য ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে। শাইখ সা'দুদ্দীন রহ. বলেন, আমাদের মাশাইখে কেরাম (তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে) বলতেন, যে ব্যক্তি চায় যে তার ছেলে আলেম হোক; তার জন্য উচিত উলামা-ফুকাহায়ে কেরামের প্রতি খেয়াল রাখা, তাদের সম্মান করা, তাদের দাওয়াত করা ও তাদেরকে হাদিয়া দেয়া। এতে কোন কারণ বশত তার ছেলে যদি আলেম না-ও হতে পারে, তার নাতি (পরবর্তী প্রজন্ম) অবশ্যই আলেম হবে। (তা'লীমুল মুতা' আল্লিম [মাকতাবাতুল হেরা); পৃষ্ঠা ২০)
মূলত আমাদের অন্তরে দীন এবং ইলমে দীনের গুরুত্ব কমে গেছে। অন্যথায় উলামায়ে কেরামকে (যাদের থেকে আমরা দীন শিখে থাকি) যতই হাদিয়া দেয়া হোক না কেন, সেটা অনেক কম, একেবারেই সামান্য। হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ. একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, এক মন্ত্রীর ছেলে সূরা বাকারা শেষ করলে তিনি ছেলের উস্তাদকে আড়াই'শ স্বর্ণমুদ্রা (যা বর্তমানে ৯৩ ভরি স্বর্ণ থেকেও বেশি) হাদিয়া দেন। উস্তাদ হাদিয়া পেয়ে বললেন, এত বেশি হাদিয়া! আমি আর কি খিদমত করেছি? মন্ত্রী উস্তাদকে আলাদা ডেকে বললেন, সামনে থেকে আপনি আমার ছেলেকে আর পড়াবেন না। কারণ আপনার অন্তরে সূরা বাকারার মর্যাদা আড়াই'শ স্বর্ণমুদ্রা থেকে কম। আর আমার হাদিয়ার দাম আপনার নিকট সূরা বাকারা থেকেও বেশি। আপনারই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমার ছেলের অন্তরে কুরআনে কারীমের কি মর্যাদা সৃষ্টি হবে। (মাজালিসে আবরার; পৃষ্ঠা ১৪)
প্রচলিত হাদিয়ার আরো কিছু রীতি-নীতি
১. চাঁদা উঠিয়ে হাদিয়া দেয়া হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, কোন এক গ্রামবাসীর দাওয়াতে একবার দুপুরবেলা বের হলাম। সেখান থেকে যখন বিদায় নেয়ার সময় হল, তখন গ্রামের লোকেরা আমাকে হাদিয়া দেয়ার জন্য গোটা গ্রাম থেকে কিছু কিছু সংগ্রহ করে জমা করল। আমি জানতে পেরে তাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করে বললাম, এতে অনেক অপকারিতা রয়েছে-
প্রথমতঃ চাঁদা দানকারী খুশি মনে দিচ্ছে, না চাপে পড়ে দিচ্ছে, সেদিকে আজকাল চাঁদা গ্রহণকারীরা লক্ষ্য করে না।
দ্বিতীয়তঃ যদি একথা মেনেও নেয়া হয় যে, চাঁদাদাতারা সন্তুষ্ট হয়ে চাঁদা দিয়েছে, তবুও তাতে হাদিয়ার উদ্দেশ্য সফল হবে না। কারণ হাদিয়া দেয়া- নেয়ার উদ্দেশ্যই হল পরস্পর মহব্বত বৃদ্ধি। কিন্তু এতে তা অর্জিত হয় না। কারণ কে কি পরিমাণ দিয়েছে তা আদৌ জানা যায় না।
তৃতীয়তঃ অনেক সময় কোন ওযরের কারণে হাদিয়া গ্রহণ করা অসঙ্গত হয়ে পড়ে। আর হাদিয়াদাতা ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় না। এছাড়া সম্মিলিত হাদিয়া যাচাই করা খুবই জটিল। অতএব যদি হাদিয়া দিতে হয় তাহলে নিজ হাতেই দেয়া উত্তম। (আদাবুল মু'আশারাত; পৃষ্ঠা ৭১)
২. বিবাহ অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক বিভিন্ন হাদিয়া:
ক. লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কনের জন্য বিরাট প্যাকেটে করে হাদিয়া পাঠানো হয় এবং এটাকে জরুরী মনে করা হয়। এটা একটা কুপ্রথা। এ থেকে বেঁচে থাকা জরুরী। (মাজালিসে আবরার; পৃষ্ঠা ৫২৩)
খ. বিবাহ অনুষ্ঠানে কনে বা বরকে প্রদত্ত হাদিয়া বা উপঢৌকন বিবাহ অনুষ্ঠানে যেসব উপঢৌকন বা হাদিয়া বর বা কনেকে দেয়া হয়, এর অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাতার মনোতুষ্টি বা সন্তুষ্টি থাকে না। শুধুমাত্র চক্ষুলজ্জার খাতিরে বা সামাজিক চাপে পড়ে দিয়ে থাকে। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে অন্যের মাল তার আন্তরিক সন্তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা বা খাওয়া জায়েয নেই। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ২১০৮২)
উপরন্তু এ ধরনের মাল গ্রহণ করার জন্য টেবিল সাজিয়ে কে কী দিল, কী পরিমাণে দিল? এর জন্য খাতা-কলম নিয়ে বসা জঘন্য অপরাধ এবং আত্মমর্যাদাহীনতার পরিচায়ক। এ থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরী। (জায়েয- নাজায়েয ২/৫৮, মাজালিসে আবরার; পৃষ্ঠা ৫২৩)
অবশ্য কেউ যদি কারো ওলীমার দাওয়াতের খরচের ব্যাপারে সাহায্য করে তাহলে সেটা জায়েয হবে। বরং হাদিয়া দেয়া ও আরেক ভাইকে উপকার করার সওয়াব হবে। হযরত যয়নব রাযি. এর সাথে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহপরবর্তী ওলীমার দাওয়াতে হযরত উম্মে সুলাইম রাযি. খেজুর, ঘি ও পনির দ্বারা তৈরি এক ধরনের খানা (হাইসা) হাদিয়া দিয়েছিলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলো দ্বারা ওলীমা করেছিলেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫১৬৩)
গ. বিবাহের পর বর পক্ষের নতুন কেউ কনের বাড়িতে গেলে অথবা কনে পক্ষের নতুন কেউ বরের বাড়িতে আসলে তাকে কাপড়-চোপড় হাদিয়া দেয়াকে জরুরী মনে করা হয়। এটাও একটা সামাজিক কুপ্রথা। এর থেকেও বেঁচে থাকা অপরিহার্য। (মাজালিসে আবরার; পৃষ্ঠা ৫২৩-৫২৪)
৩. মুসলমানীর দাওয়াতেও বিবাহের মত উপঢৌকন বা উপহার আদান-প্রদানের ব্যাপক প্রচলন আমাদের দেশে রয়েছে। এর বিধানও বিবাহের উপঢৌকনের মত নাজায়েয এবং পরিত্যাজ্য। (প্রাগুক্ত)
৪. অনুরূপভাবে আকীকার দাওয়াতেও বাচ্চাকে হাদিয়া বা উপঢৌকন পেশ করা হয়। এটাকেও জরুরী মনে করেই করা হয়। এটাও নাজায়েয। (প্রগুক্ত)
৫. গ্রামাঞ্চলে অনেকে মাদরাসার হুযূর বা মসজিদের ইমাম-মুয়াযযিন সাহেবকে বাড়িতে খানার দাওয়াত করে থাকে। খানা শেষে তাকে কিছু টাকা হাদিয়া দেয়াকে জরুরী মনে করা হয়। এমনকি কোন কোন সময় হাদিয়া না দেয়াকে দোষণীয় মনে করা হয়। এটা ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার; দাওয়াত খাওয়ানো একটি সুন্নাত আর হাদিয়া দেয়া আরেকটি সুন্নাত। কেউ একটি করল, আরেকটি করল না, তাতে দোষের কি আছে? হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, কোন এক সফরে কিছু লোক আমার সাথে দেখা করল এবং একের পর এক সবাই আমাকে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে হাদিয়া দিতে শুরু করল। আমি তাদেরকে নিষেধ করে বললাম, তোমরা এভাবে হাদিয়া দিতে থাকলে অন্যেরা হয়তো মনে করবে, বাড়িতে নিলেই হাদিয়া দিতে হয়। তাই গরীব লোকেরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় আমাকে বাড়িতে দাওয়াত দিতে পারবে না। (আদাবুল মু'আশারাত; পৃষ্ঠা ৭১)
প্রিয় পাঠক! সংক্ষিপ্ত এই নিবন্ধে দু'টি বিষয় উঠে এসেছে-
১. ইসলামে হাদিয়া-তোহফা ও দাওয়াত প্রদানের গুরুত্ব ও তার পদ্ধতি।
২. দাওয়াত ও হাদিয়ার নামে আমাদের সমাজে প্রচলিত রসম-রেওয়ায ও তার অশুভ পরিণতি।
আসুন, আমরা সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও নব উদ্ভাবিত রসম-প্রথা বর্জন করি এবং শরীয়তসম্মত পন্থায় দাওয়াত ও হাদিয়া আদান-প্রদান করে ইহকাল ও পরকালের জীবনকে সুখময় করে তুলতে সচেষ্ট হই।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
মায়ের কোল শিশুর প্রথম বিদ্যালয়
আল্লাহ তা'আলা অনুগ্রহ করে পিতা- মাতাকে সন্তান উপহার দেন। শিশুরা আসলে জান্নাতের ফুল। প্রতিটি শিশুই স্...
উপকার ও কৃতজ্ঞতা
সমাজে চলতে আমাদের অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এ সহযোগিতা যে কেবলই বিপদ ও সংকটের মুহূর্তে প্রয়োজন হয় ...
মসজিদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো
মসজিদ আল্লাহ তাআলার ঘর এতে তাঁর যিকির ও ইবাদত হয়। তাঁর বড়ত্ব ও মহিমার বর্ণনা হয়। তাঁর তাওহীদ ও রু...
والدین اور اولاد کے باہمی حقوق
بچوں کی مناسب نشوونما کے لیے تربیت و پرورش کی مناسب تدبیر والدین کا فرض ہے۔ ان کی جسمانی صحت کو درست...