প্রবন্ধ
দু'টি ধারা : কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহ
হিদায়াতের মূল উৎস কুরআন সুন্নাহ'র শিক্ষা। এ শিক্ষা অর্জন করতে হবে শিক্ষকের মাধ্যমে। শিক্ষকের মাধ্যম ছাড়া দুনিয়ার কোন শিক্ষা যেমন গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য নয়, তেমনই কুরআন-সুন্নাহ'র শিক্ষাও অভিজ্ঞ শিক্ষকের মাধ্যম ছাড়া গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য নয়। বর্তমানে সরলমনা কিছু লোক ব্যক্তিগতভাবে দু-চারটি তাফসীর কিংবা দু-চারটি হাদীসের কিতাব পড়ে আমল শুরু করে দেয় এবং অন্যদেরকেও এ কাজে উৎসাহিত করে। কেউ আবার এ জাতীয় স্বঘোষিত পণ্ডিতকে নিজের ইমাম বানিয়ে নেয়। এদের গোমরাহী প্রায় নিশ্চিত। বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দীনের এ লেখাটি উক্ত বিষয়কেই স্পষ্ট করে তুলেছে।-
الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على رسوله الكريم وعلى اله واصحابه اجمعين اما بعد: فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم. لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ ... (آل عمران : (164)
দু'টি ধারা
মানবজাতির সংশোধনের জন্য আল্লাহ তা'আলা দু'টি ধারা একসঙ্গে দান করেছেন। এক. কিতাবুল্লাহ। কিতাবুল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আসমানী কিতাব। যেমন, তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও সর্বশেষ নাযিলকৃত কিতাব কুরআন মাজীদ।
দুই. রিজালুল্লাহ। রিজালুল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম। রিজালুল্লাহ পাঠানো হয়েছে কিতাবুল্লাহর ব্যাখ্যা দানের জন্য, যেন তারা কিতাবুল্লাহ বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজেদের কথা ও কাজের দ্বারা কিতাবুল্লাহর মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করাতে পারেন। এ মর্মে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ
আপনার কাছে আমি যিকর অর্থাৎ কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেছি, যেন আপনি লোকদের সামনে তাদের প্রতি নাযিলকৃত বিষয়গুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা নাহল- ৪৫)
এ প্রসঙ্গে অন্যত্র তিনি বলেন,
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا….
নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তাদের মাঝে তাদেরই মধ্য হতে প্রেরণ করেছেন এমন একজন নবী যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞানের কথা শিক্ষা দেন। (সূরা আলে ইমরান- ১৬৪)
প্রতীয়মান হলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম হলেন মানব জাতির শিক্ষক। প্রত্যেক নবীর আগমনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর কিতাব মানুষদেরকে শেখানো। কেননা শিক্ষকের দিক নির্দেশনা ও ব্যাখ্যাদান ছাড়া আমরা আল্লাহর কিতাব থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখি না। উস্তাদ ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত পড়া-লেখা ফলপ্রসু হয় না। এটা শুধু কিতাবুল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; দুনিয়ার প্রতিটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্যও এটি এক স্বীকৃত নীতি যে, কোন বিষয়ের উপর পারদর্শিতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে হয় এবং যোগ্য শিক্ষকের শিষ্যত্ব বরণ করতে হয়। এছাড়া কেউ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।
১ম দৃষ্টান্ত: কবরস্থান আবাদ হবে
মেডিকেল সায়েন্স বিষয়ে বাজারে বই-পত্রের অভাব নেই। সব ভাষাতেই এ বিষয়ে যথেষ্ট লেখা বাজারে পাওয়া যায়। কোন ব্যক্তি যদি বাজারের এ বইগুলোর সহযোগিতায় কেবল ব্যক্তিগত পড়াশোনার মাধ্যমে ডাক্তার হওয়ার আশা করে তবে তার দ্বারা কবরস্থান তো আবাদ হতে পারে কিন্তু স্বীকৃত ডাক্তার হয়ে সু চিকিৎসার আশা তার থেকে কখনোই করা যায় না। কেননা ডাক্তার হওয়ার জন্য স্বীকৃত পন্থা সে অবলম্বন করেনি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন শিক্ষক কিংবা গুরুজনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেনি। এ জন্যই বিশ্বের কোন রাষ্ট্র এ ব্যক্তিকে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার অনুমতি প্রদান করবে না। সুতরাং প্রকৃত ডাক্তার হতে হলে যেমন কোন শিক্ষকের ছাত্রত্ব গ্রহণ করতে হবে তেমনি কিতাবুল্লাহর শিক্ষালাভের জন্যও রিজালুল্লাহর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে। কেননা এটা মানুষের স্বভাবজাত যে, যতক্ষণ না কোন শিক্ষক তাকে শিক্ষাদান করবে কিংবা কোন দীক্ষাগুরু তাকে দীক্ষা দান করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং কলাকৌশলের কোন শাখাতেই সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।
মানুষ ও জন্তুর মাঝে পার্থক্য
মানুষ ও জন্তু এক নয়। আল্লাহ তা'আলা এদের মাঝে ভিন্নতা দান করেছেন। জম্ভর কোনও শিক্ষক নেই। মানুষের মত তাদের শিক্ষকের প্রয়োজনও খুব একটা নেই। যেমন মাছের পোনা ডিম থেকে বের হয়েই সাতার কাটা শুরু করে দেয়; তাকে সাতার শেখাতে হয় না। সৃষ্টিগতভাবে এক্ষেত্রে তার শিক্ষকের দরকার হয় না। কিন্তু মানুষকে সাতার শিখতে হয়। মাছের পোনার মত সে প্রথমেই সাতার কাটতে পারে না। কোনও ব্যক্তি যদি মাছের পোনার মতো নিজের বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দেয় আর সাতার কাটতে বলে, তাহলে সে মহাবোকা বৈ কিছু নয়। অনুরূপভাবে মুরগির বাচ্চা ডিম থেকে বের হওয়া মাত্র হাটতে পারে। নিজের খাবার নিজে খেতে পারে। পক্ষান্তরে মানুষের সন্তান এমনটি পারে না। তাকে হাটা শেখাতে হয়। ধীরে ধীরে খাবার খাওয়াতে হয়, শেখাতে হয়।
বোঝা গেল, মানুষ আর পশু-পাখি এক নয়। পশু-পাখি শিক্ষানির্ভর নয়। কিন্তু মানুষ সব সময়ই শিক্ষানির্ভর। প্রায় কাজই তাকে শিখতে হয়। আর শেখার কথা উঠলেই প্রয়োজন হয় একজন শিক্ষকের, একজন মুরুব্বীর যিনি তাকে শেখাবেন; তাকে পরিশুদ্ধ করবেন।
২য় দৃষ্টান্ত: বই পড়ে আলমারি বানানো
কারিগরি শিক্ষার বইয়ে টেবিল, চেয়ার,আলমারি ইত্যাদি কীভাবে বানাতে হয় সব কিছুই লেখা আছে। কী কী কাচামাল লাগবে তাও বিস্তারিত দেয়া আছে। বলুন, এ বইটিকে সামনে রেখে আলমারি বানানো যাবে কি? কখনোই তা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে বইটির আদ্যোপান্ত হয়ত আপনার জানা নেই। তবে একজন মিস্ত্রী আপনাকে হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছে যে, আলমারি কীভাবে বানাতে হয়। এখন নিশ্চয়ই আপনার দ্বারা আলমারি বানানো সম্ভব হবে।
৩য় দৃষ্টান্ত: বই পড়ে বিরিয়ানি হয় না
রান্না-বান্না শেখার বই। পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানি, কাবাবসহ সব ধরনের খাবার তৈরির নিয়ম-পদ্ধতি বইটিতে পাবেন। বইটি হাতে নিয়ে যদি আপনি বিরিয়ানি রান্নায় লেগে যান, নির্দেশনা মত লবণ, মরিচ, মসলা ইত্যাদি ব্যবহার করেন। আমি বলব, আপনার রান্নাকৃত বস্তুটি আর যা হোক সুস্বাদু বিরিয়ানি হবে না। আল্লাহই জানেন, সেটা কী অজানা পদার্থে পরিণত হবে!!
বাস্তব নমুনা মানুষের লাগবেই
মোটকথা, শুধু বই পড়ে মানুষ কোনও বিষয়ে দক্ষ ও পারদর্শী হতে পারে না। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। এজন্য মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য একজন উস্তাদ, একজন মুরুব্বী বা একজন দীক্ষাগুরুর প্রয়োজন হয়। দুনিয়ার সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। ডাক্তার হতে হলে বিজ্ঞ ডাক্তারের ছাত্রত্ব গ্রহণ করতে হয়। কারিগরি শিক্ষার জন্য দক্ষ কারিগরের শিষ্যত্ব বরণ করতে হয়। সুস্বাদু বিরিয়ানির স্বাদ আস্বাদন করতে হলে দক্ষ পাচকের শাগরেদ বনতে হয়। তেমনই দীন শিখতে হলে একজন উস্তাদ, মুরুব্বী বা মু'আল্লিমের সামনে হাটু গেড়ে বসতে হবে। তাদের সোহবত কিংবা জীবনাচার দেখা ছাড়া দীন শেখা আদৌ সম্ভব নয়।
শুধু কিতাব পাঠানো হয়নি
বস্তুতঃ অন্তর্নিহিত এ উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা'আলা কিতাবুল্লাহর পাশাপাশি রিজালুল্লাহ পাঠিয়েছেন। কিতাব এসেছে; তার সঙ্গে কোন নবী বা রাসূল আসেননি এমন একটি উদাহরণও কেউ পেশ করতে পারবে না। হ্যা, নবী এসেছেন কিন্তু কিতাব আসেনি, বরং তিনি পূববর্তী কিতাবেরই অনুসরণ করেছেন এরূপ দৃষ্টান্ত অবশ্যই আছে। কিন্তু নবী ছাড়া কিতাব এসেছে এ জাতীয় কোনও দৃষ্টান্ত নেই। কেন নেই? এর কারণ হলো, যদি শুধু কিতাব পাঠানো হতো, মানুষ এ কিতাব দ্বারা নিজে নিজে আত্মশুদ্ধ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ খুঁজে পেতো না। শুধু কিতাব থেকে উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা মানুষের মাঝে নেই। তাই আল্লাহ নবী ছাড়া শুধু কিতাব পাঠাননি। নবী বিহীন কিতাব পাঠানো তার পক্ষে অসম্ভব ছিল এমন নয়। তাছাড়া মুশরিকরাও প্রায় এরকমই দাবী করেছিল যে,
لو لا نزل عليه القرآن جملة واحدة
আমাদের কাছে একবারেই কুরআন পাঠানো হয়নি কেন?'
বস্তুতঃ আল্লাহর জন্য এটা মোটেও কঠিন ছিলো না যে, মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে, তার শিয়রে একটা কিতাব ঝকঝক করছে। আর আল্লাহ আসমান থেকে বলে দেবেন, হে মানবজাতি! এটা তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, তোমরা এর শিক্ষার আলোকে চলবে এবং এরই উপর আমল করবে। কিন্তু আল্লাহ এ জাতীয় কিছু করেননি। তিনি শুধু কিতাব পাঠাননি; বরং কিতাবও পাঠিয়েছেন, সঙ্গে শিক্ষকও পাঠিয়েছেন। এমনটি কেন করেছেন?
কিতাব পড়ার জন্য দুই নূরের প্রয়োজনীয়তা
কারণ, আম্বিয়ায়ে কেরামের শিক্ষার নূর যতক্ষণ না থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিতাব বুঝে আসবে না। শুধু কিতাব থাকলে হয় না, বরং কিতাবের লেখাগুলো দেখার জন্য বাইরের আলোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু পাঠক যদি অন্ধ হয়, তার চোখে যদি জ্যোতি না থাকে, তাহলে বহিরাগত আলোও কোনও কাজে আসে না। অর্থাৎ কিতাব বোঝার জন্য দুই আলো প্রয়োজন। প্রথমত বাইরের আলো অর্থাৎ বাতি বা সূর্যের আলো। দ্বিতীয়ত নিজের আলো অর্থাৎ চোখের জ্যোতি। এ দু 'টির কোনও একটি না থাকলে কিতাব বোঝা তো দূরে থাক পড়াও যাবে না। অনুরূপভাবে হিদায়াত পাওয়ার জন্য শুধু কিতাবুল্লাহ নামক নূর থাকলেই হয় না, বরং রিজালুল্লাহ নামক নূরেরও প্রয়োজন। এ কারণেই কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহ নামক দু 'টি ধারাই আল্লাহ মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন।
'হাসবুনা কিতাবুল্লাহ'র শ্লোগান
একটি ভ্রান্ত দলের শ্লোগান ছিলো, حسبنا كتاب الله অর্থাৎ আল্লাহর কিতাবই আমাদের পথ চলার জন্য যথেষ্ট। শ্লোগানটা দৃশ্যত চমৎকার। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় যথার্থ শ্লোগান! যেহেতু কুরআন মাজীদেই তো এসেছে, تبيانا لكل شيئ 'কুরআন মাজীদে প্রতিটি বিষয়ের বিবরণ রয়েছে'।
কিন্তু বাস্তবে এ শ্লোগানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অত্যন্ত ভয়াবহ। এদের কাছে প্রশ্ন রাখুন, মেডিকেল সায়েন্সের বই তো তোমার কাছে আছে, যেখানে চিকিৎসার প্রতিটি বিষয়ের বিবরণও আছে। কিন্তু শিক্ষক ছাড়া শুধু বইটি পড়ে কি কেউ ডাক্তার হতে পারবে? অনুরূপভাবে শুধু কিতাবুল্লাহ দ্বারা মানুষ হিদায়াত পেতে পারে না। বরং কিতাবুল্লাহর সঙ্গে প্রয়োজন রিজালুল্লাহ তথা আম্বিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা। এটা ছাড়া কিতাবুল্লাহ থেকে ফায়দা গ্রহণ করার কল্পনাও করা যায় না।
মোটকথা, যারা শুধু কিতাবুল্লাহ পেয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের শিক্ষাকে অপাঙক্তেয় মনে করেছে, প্রকৃতপক্ষে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। কারণ, রিজালুল্লাহকে অস্বীকার করা তো কিতাবুল্লাহকে অস্বীকার করার নামান্তর। কিতাবুল্লাহতেই তো রয়েছে, আম্বিয়ায়ে কেরাম হলেন কিতাবুল্লাহর শিক্ষক। শিক্ষক ছাড়া কিতাবুল্লাহ থেকে ফায়দা নেয়ার সুযোগ কোথায়? কিতাবুল্লাহ মানতে হলে রিজালুল্লাহকে মানতেই হবে। রিজালুল্লাহকে অস্বীকার করা মানে কিতাবুল্লাহকেই অস্বীকার করা।
মেডিকেল সায়েন্সের গ্রন্থাদির শুরুতে একটি লেখা সাধারণত সকলের নজর কাড়ে। তা হল, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা নিষেধ। কোন ব্যক্তি যদি এ সতর্কবার্তা ভুলে যায় এবং বই দেখেই সব রোগের চিকিৎসা শুরু করে দেয় তবে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করা ছাড়া তার আর কিছুই হবে না। অনুরূপভাবে যারা রিজালুল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং শুধু কিতাবুল্লাহকেই যথেষ্ট মনে করে তাদের দ্বারা ভ্রষ্টতার পথ সুগম হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না।
শুধু রিজালও যথেষ্ট নয়
আরেকটি দল রয়েছে,যারা রিজালুল্লাহকেই মনে করে সবকিছু। তারা বলে, আমাদের জন্য রিজালই যথেষ্ট। কিতাবুল্লাহতে কি আছে, তা আমাদের জানার দরকার নেই। এই বলে যেই রিজাল তাদের মনঃপূত হয়, তার কাছে গিয়ে ধর্না দেয়। তাকে নিজেদের নেতা মনে করে পূজা শুরু করে দেয়। এরাও ভ্রান্ত, এরাও পথহারা।
সঠিক পথ
প্রান্তিকতামুক্ত সঠিক পথ হলো, কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহর মাঝে সমন্বয় করা। রিজালুল্লাহর শিক্ষার আলোকে কিতাবুল্লাহর উপর আমল করা। উভয়টার সমন্বয় হলে তবেই হেদায়াত পাওয়া যাবে। এদিকে ইঙ্গিত করে এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ما انا عليه واصحابي এখানে ما انا عليه দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কিতাব। আর اصحابی দ্বারা উদ্দেশ্য রিজাল। অর্থাৎ কিতাব, যার উপর আমি আছি তা গ্রহণ করো এবং সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ করো। যে ব্যক্তি এ উভয়টির মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারবে, সে হেদায়াত পাবে।
দীনের এ সরল পন্থা হতে বিচ্যুত বিভ্রান্ত দলের তৃতীয় আরেকটি শ্রেণী হলো, যারা কিতাবুল্লাহ-রিজালুল্লাহ উভয়টিকেই অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান মনে করে। ব্যক্তিগত পড়াশোনার ভিত্তিতে নিজেকে ইমাম আবু হানীফার মত মুজতাহিদ দাবী করে শ্লোগান দিতে থাকে هم رجال فنحن رجال মূলত তাদের এ দাবী মক্তবের বাচ্চা শিশুর ন্যায় যে কিনা هم رجال فنحن رجال এর শ্লোগানে আবেগতাড়িত হয়ে নিজেকে ডাক্তার ভেবে অপারেশনের ছুরি হাতে তুলে নেয়। অথচ এ নির্বোধ এটা বোঝে না যে, দক্ষ ডাক্তার অস্ত্রোপচার করবে স্বীকৃত পন্থায় রোগীর সুস্থতার নিমিত্তে।পক্ষান্তরে তার ছুরি সঞ্চালন রোগীকে মুহূর্তেই পৌঁছে দেবে মৃত্যুর দুয়ারে।
বর্তমান সময়ে এ শ্লোগানটি বেশ সাড়া ফেলেছে 'অমুক সাহেবের কিতাব পড়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে, অনেকেই নামায পড়া শুরু করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি...'। এই দেওবন্দী মৌলবীরা অকারণেই তার বিরোধিতা করছে। মূলত এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ঐ অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তারের মতো, যার চিকিৎসায় ৮/১০ জন মানুষ সুস্থ হলো। এতে তার যশঃ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল এবং লোকেরা তার গুণমুগ্ধ হয়ে লাইন ধরে চিকিৎসা নিতে লাগল। অথচ তাদের জানা নেই যে, কারো হাতে ৮/১০ জন রোগীর আরোগ্য লাভ করা তার ডাক্তার হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ নয়। কেননা উস্তাদের সান্নিধ্যহীন এ অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তারের কাচা হাতে যে কোন সময়ই ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
ঠিক তেমনি কিছু মানুষের ধর্ম অভিমুখী হওয়া এটা তথাকথিত কোন 'ডাক্তার' সাহেবের ক্ষেত্রে রিজালুল্লাহ হওয়ার দলীল নয়। কেননা রিজালুল্লাহর দীক্ষা-বঞ্চিত এ ব্যক্তি যে কোনও সময়ই বরবাদ করে দিতে পারে বহু মুসলমানের আখেরাত।
সাহাবায়ে কেরামের দীন শেখার পদ্ধতি
এ দীনের স্বভাব হলো, সূত্র পরম্পরায় যুগযুগ ধরে তা বাতি হতে বাতি প্রজ্জ্বলনের ন্যায় সীনা হতে সীনায় স্থানান্তরিত হয়ে আসছে। হযরত সাহাবায়ে কেরাম সুফ্ফায় এভাবেই মিশকাতে নবুওয়াত থেকে দীন শিখেছেন। তাদের সামনে না কোন কিতাব ছিল, না কোন দরস ছিল, আর না কোন নেসাবের সীমাবদ্ধতা ছিল; এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রচলিত কোন স্বীকৃতিও তাদের ছিল না। বরং নবীজীর পবিত্র যবান-নিঃসৃত বাণী শ্রবণ এবং দৈনন্দিনের কর্মকাণ্ড অবলোকনই ছিল তাদের পাঠ্যপুস্তক! দীন শেখার এ পবিত্র ধারা খাইরুল কুরূনের গণ্ডি পেরিয়ে অব্যাহত রয়েছে। আজও নবীজীর হাদীস পাঠকালে বলা হয়...قال فلان এটাই হলো সেই সনদ এবং সূত্র পরম্পরা, যা শত বছরের সময়ের প্রাচীর ডিঙিয়ে আমাদের ঈমানের বন্ধন যুক্ত করেছে নবী কারীম আলাইহিস সালামের সাথে।
দীনের জন্য শিক্ষকের মাধ্যম আবশ্যক
ব্যক্তিগত পড়াশোনা আর কোনও দীক্ষাগুরুর নিকট শিক্ষা নেয়ার মাঝে আসমান ও যমীনের পার্থক্য। কেননা দ্বিতীয় পদ্ধতিতে যে নূর ও বরকত শিক্ষার্থীকে স্নাত করবে এবং ইলমে ইলাহীর যে তাজাল্লী তাতে প্রকাশ পাবে, তা প্রথম পদ্ধতিতে কল্পনাও করা যায় না।
এর কারণ হলো, প্রকৃত দাতা তো আল্লাহ তা'আলা। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার সুন্নাত হলো, যখন তিনি দান করেন, তখন একটি মাধ্যমে দান করেন। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ক্ষেত্রেও এ সুন্নাত বহাল ছিল। নবীজীর কাছে ওহী প্রেরণের সময় আল্লাহ তা'আলা জিবরীল আ.কে মাধ্যম বানিয়েছেন। মূসা আ. এর সাথে কথা বলার সময় গাছকে মাধ্যম বানিয়েছেন। তেমনি কিতাবুল্লাহর শিক্ষাদানের জন্য রিজালুল্লাহকে মাধ্যম বানিয়েছেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে গুরু-শিক্ষকের শিষ্যত্ব বরণকে অপরিহার্য করেছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা ঐ জানালার মত, যার মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত সূর্যকিরণ ঘরকে আলোকিত করে তোলে।
আলোচ্য মৌলিক কথাগুলো হৃদয়ে বসাতে পারলে বর্তমানের সব বুদ্ধিপ্রসূত ভ্রষ্ট মতবাদ ও কর্মকাণ্ডের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। যে সকল কোট-টাই পরা ভদ্রলোকেরা কোনও তরবিয়তপ্রাপ্ত স্বীকৃত উস্তাদের শিষ্যত্ব ছাড়াই ব্যক্তিগত পড়াশোনায় নিজেদেরকে ইসলামিক স্কলার হিসেবে পরিচয় দেয় তাদের ছদ্মাবরণ খসে পড়বে ইনশাআল্লাহ।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
আলোকময় কুরআন
আজ জুমু'আর দিন। এ দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এটা পনের পারায় শুরু হয়ে ষোল পারায় শে...
সরল পথ ও বাঁকা পথ
ক. আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, واعْتَصِمُوا يحبل الله جَمِيعًا এবং তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে ধর...
ইলমে দীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ভাবনা
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعم...