প্রবন্ধ

স্ত্রীর অধিকার ও স্বামীর কর্তব্য

লেখক:মুফতী হেদায়াতুল্লাহ
১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫
১০৩৩৯৫ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

মানুষের জীবনে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সঙ্গী হলো তার স্ত্রী। সুখে-দুঃখে, বিপদে- আপদে, ঘরে-সফরে বিবাহ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন স্ত্রী সর্বদা নিজেকে স্বামীর সেবায় নিয়োজিত রাখেন। এজন্য আল্লাহ তা'আলা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে পরস্পরের পোশাকের সাথে উপমা দিয়েছেন। তিনি বলেন,

هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ. 

অর্থ: স্ত্রীগণ তোমাদের পোশাকস্বরূপ আর তোমরা স্ত্রীদের পোশাকস্বরূপ। (সূরা বাকারা-১৮৭)

অর্থাৎ পোশাক যেমন শরীরের সাথে লেগে থাকে তেমনি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও অবিচ্ছেদ্য এবং সর্বদা লেগে থাকার। আল্লাহ তা'আলা স্ত্রীদেরকে সৃষ্টি করেছেন স্বামীদের প্রেমাষ্পদ হিসেবে, স্বামীদের শান্তি অর্জনের জন্য। ইরশাদ হচ্ছে,

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً

অর্থ : আল্লাহ তা'আলার নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি হল; তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রূম-২১)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لم ير للمتحابين مثل النكاح. 

অর্থ: বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয় তার অনুরূপ আর কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ১৮৪৭) 

তিনি আরো বলেন, মুমিন ব্যক্তি তাকওয়া অর্জনের পর উত্তম বিবি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন জিনিস অর্জন করতে পারে না। (প্রাগুক্ত; হা.নং ১৮৫৭) 

স্ত্রী হল স্বামীর অর্ধেক দীন-ধর্ম সংরক্ষণকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কোন বান্দা বিবাহ করে তখন সে তার অর্ধেক দীনদারী পূর্ণ করে নিল। অতএব সে যেন বাকিটুকুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে। (শু'আবুল ঈমান; হা.নং ৫১০০) 

যে স্ত্রী তার জীবন-যৌবন উজাড় করে, রূপ-লাবণ্য বিলীন করে, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন বিসর্জন দিয়ে অপরিচিত একজন পুরুষের শুধু 'কবুল' কথায় আস্থা রেখে এতকিছু করলো, স্বামীর জীবনে এত কল্যাণ আর এত সুখ-সম্ভার বয়ে আনলো, তার জন্য স্বামীর কী করণীয় তা জানা ও সে অনুযায়ী কর্তব্য পালন করা স্বামীর জন্য জরুরী। ইসলাম স্ত্রীকে এমন কতগুলো অধিকার দিয়েছে যদি স্বামীরা সেগুলো যথাযথভাবে আদায় করে তাহলে উভয়ের জীবন হবে আরো সুখকর ও শান্তিময়। ইসলাম নির্দেশিত স্বামীর কর্তব্য ও স্ত্রীর অধিকারগুলো নিম্নরূপ।


১. ভরণ-পোষণের দায়িত্ব: 

ইসলাম স্বামীকে হালাল অর্থ দ্বারা সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দিয়েছে। শরীয়তের কোথাও স্ত্রীকে চাকুরী করা বা অর্থ উপার্জনের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

 وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بالْمَعْرُوفِ.

অর্থ : স্বামীর জন্য আবশ্যক হল, ন্যায়সঙ্গতভাবে স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। (সূরা বাকারা-২৩৩)

তাছাড়া কেউ কারো সেবায় নিয়োজিত থাকলে তার সর্ববিধ খরচাদি সেবা গ্রহণকারীর উপরই ন্যস্ত থাকে। সুতরাং স্ত্রীর বেলায়ও এ নীতি প্রযোজ্য হবে। আরাফার ময়দানে বিদায়ী ভাষণে এবং জীবনের অন্তিম সময় যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবান আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল, আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল তখনো তিনি বলেছিলেন,

الله الله في النساء فإنهن عوان في أيديكم. 

অর্থ: স্ত্রীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কারণ, তারা তোমাদের হাতে আবদ্ধ। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ২০৬৯৫)

সাহাবী হযরত মু'আবিয়া ইবনে হায়দা রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রতি আমাদের স্ত্রীদের কী কী অধিকার রয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তোমরা খাবে তাদেরকেও খাওয়াবে, যখন তোমরা পরিধান করবে তাদেরকেও পরতে দিবে। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ২১৪২)

এজন্য স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়া, তার হাত খরচের জন্য পৃথকভাবে কিছু অর্থ দেয়া স্বামীর দায়িত্ব। যাতে ছোট ছোট প্রয়োজন যা সর্বদা বলা সম্ভব নয় স্ত্রী যেন নিজেই তা পূর্ণ করতে পারে এবং আল্লাহর রাস্তায় কিছু কিছু খরচ করতে পারে। শুধু এতটুকু নয়; শরীয়তের দৃষ্টিতে স্বামীর স্বচ্ছলতা থাকলে স্ত্রীর জন্য চাকরানী ও সেবিকার ব্যবস্থা করাও জরুরী। অবশ্য স্বামী স্বচ্ছল না হলে রান্না-বান্নার কাজ তখন স্ত্রীর দায়িত্বে এসে যায়। কিন্তু স্ত্রী যদি রুগ্নতার কারণে অথবা বড় ঘরের কন্যা হওয়ার কারণে নিজে কাজ করতে সক্ষম না হয় তবে স্বামীর দায়িত্ব হল, প্রস্তুতকৃত খাবার ক্রয় করা অথবা অন্য কারো মাধ্যমে রান্নার ব্যবস্থা করা। আর পোশাকাদীর ক্ষেত্রেও শরীয়তের সীমা- রেখা ও স্বামীর সামর্থের মধ্যে থেকে স্ত্রীর রুচি পছন্দের খেয়াল করা জরুরী। অনেকে স্ত্রীর রুচি ও পছন্দকে গুরুত্ব না দেয়াকে অতি দীনদারী মনে করে, যা মোটেও ঠিক নয়।


২. বসবাসের ব্যবস্থা: 

বসবাসের জন্য স্ত্রীকে প্রয়োজন অনুযায়ী পৃথক ঘর অথবা পৃথক কামরা দেয়া জরুরী, যেখানে সে স্বাধীনভাবে স্বামীর সাথে সময় যাপন করতে পারে এবং নিজের মালামাল হেফাযত করতে পারে। স্ত্রী যদি স্বামীর পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের সাথে একত্রে থাকতে না চায় তাহলে তাকে পৃথক রাখা স্বামীর কর্তব্য। আর চুলার আগুন পৃথক করা তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়তের দৃষ্টিতে শ্বশুর-শাশুড়ীর খিদমত করা স্ত্রীর উপর ওয়াজিব নয়। তবে পুত্রবধূগণ স্বেচ্ছায় তা করলে বহুগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে। মূলত স্বামীর মাতা-পিতার খিদমত করা স্বামীর দায়িত্ব। সে নিজে করবে অথবা অন্য লোক দিয়ে করাবে। বর্তমান সমাজে অনেক স্বামী জোরপূর্বক স্ত্রীকে মাতা-পিতার শাসনাধীন রাখে। তাদের সেবা করতে বাধ্য করে। ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে একান্নভুক্ত থাকা সওয়াবের কাজ ও গৌরব জ্ঞান করে, যা স্ত্রীর প্রতি অন্যায় ও জুলুম। শরীয়তের দৃষ্টিতে মাতা-পিতার করণীয় হল, পুত্র ও পুত্রবধূকে স্বাধীনভাবে থাকতে দেয়া। স্বেচ্ছায় তারা যতটুকু সেবা করে ততটুকুতে খুশি থাকা এবং সে জন্যে তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। পুত্রবধূ  ঘরে এলে সংসারের যাবতীয় কাজ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে 'রিটায়ার্ড পার্সন' মনে করা সঠিক কাজ নয়। এক্ষেত্রে শাশুড়ীগণ সে সময়টি স্মরণ করতে পারেন যখন তিনিও এই বয়সে কারও ঘরে পুত্রবধূ হয়ে এসেছিলেন।


৩. মহর আদায় করা : 

মহর মূলত একটি সম্মানী যা দ্বারা স্ত্রীকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে স্বামীর সামর্থ্যানুযায়ী মহর নির্ধারণ করা সবচেয়ে উত্তম। যতটুকু মহর নির্ধারণ করা হবে তা পরিপূর্ণ আদায় করা জরুরী। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً

অর্থ : স্ত্রীদেরকে তাদের মহর যথাযথভাবে আদায় করে দাও। (সূরা নিসা-৪)

স্ত্রীর লাজুকতা বা অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কিংবা চাপ প্রয়োগ করে কখনোই স্ত্রীকে মহরের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা জায়েয নয়।


৪. স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার: 

স্ত্রীর ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। তার সাথে নম্র আচরণ করা এবং তাকে খুশি রাখা স্বামীর কর্তব্য। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ.

অর্থ: তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদাচরণ কর। (সূরা নিসা-১৯)

হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا وخياركم خياركم لنسائهم.

অর্থ: মুমিনদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার চরিত্র উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১১৬২) 

এ ধরনের আরো বহু বর্ণনা হাদীসগ্রন্থে রয়েছে যেখানে স্ত্রীর কাছে ভালো হওয়া পুরুষের জন্য প্রকৃতার্থে ভালো হওয়ার মানদণ্ড নির্ণয় করা হয়েছে। কারণ স্বামীর প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সর্ববিষয় অন্যের কাছে গোপন থাকলেও স্ত্রীর কাছে তা স্পষ্ট থাকে। তাই স্বামী বাস্তবে ভালো না হলে অন্যের দৃষ্টিতে যত ভালোই হোক স্ত্রীর কাছ থেকে ভালো হওয়ার সার্টিফিকেট কখনোই পাবে না।

অনেকে বাইরে বেজায় ভদ্রলোক, কিন্তু স্ত্রীর ক্ষেত্রে ভদ্রতার কোন তোয়াক্কা করে না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে, গালমন্দ করে, আবার অনেকে তাদের গায়ে হাত তোলে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে প্রহার করতে নিষেধ করে বলেন,

لا تضربوا إماء الله

অর্থ : তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে প্রহার করো না। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ২১৪৬)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দিন কোন বিবি কিংবা চাকর-নওকরকে প্রহার করেননি। আর যারা স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে তাদেরকে অভদ্র বলেছেন। স্ত্রীর বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনের ক্ষেত্রে পরিবারে শান্তি- শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য শরীয়তে স্বামীকে হালকা প্রহারের অনুমতি দেয়া হলেও ভদ্র শ্রেণীর কাছ থেকে সেটা কাম্য নয় বলা হয়েছে।


৫. স্ত্রীর সাথে রাত্রিযাপন: 

প্রয়োজন অনুযায়ী স্ত্রীর জৈবিক ও দৈহিক চাহিদা পূরণ করা স্বামীর দায়িত্ব। প্রতি চার মাসে অন্তত একবার স্ত্রীর সাথে দৈহিক মেলামেশা করা স্বামীর জন্য আবশ্যক। স্বামী যদি তার হক আদায় না করে আর স্ত্রী কোন গুনাহে জড়িয়ে পড়ে তবে তার জন্য দায়ী হবে স্বামী এবং এর জন্য পরকালে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। সমাজের বহু মানুষ বিয়ে করে স্ত্রীকে শ্বশুর-শাশুড়ীর খিদমত আর ঘর পাহারা দেয়ার জন্য রেখে বিদেশে চলে যায়। বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরে সাক্ষাত হয় না। স্বামী বিদেশে কীভাবে দিন কাটাচ্ছে এবং স্ত্রী দেশে কী দুঃসহ রাত-দিন যাপন করছে তা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষ থেকে সামান্য ত্রুটি পাওয়া গেলে তো কথাই নেই, তার মুখে চুনকালি দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়। চিন্তা করে দেখুন, স্ত্রীর প্রতি এটা কত বড় জুলুম! শরীয়ত তো শুধুমাত্র শ্বশুর-শাশুড়ীর খিদমত আর ঘর পাহারা দেয়াকে স্ত্রীর কাজ নির্ধারণ করেনি। আল্লাহ তা'আলা স্বামীদেরকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন,

أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنْتُمْ

অর্থ : বিবিদেরকে বসবাস করাও যেখানে তোমরা বসবাস কর। (সূরা তালাক-৬)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন, তোমরা স্ত্রীদের পোশাক স্বরূপ আর স্ত্রীরা তোমাদের পোশাক স্বরূপ। আজ স্বামী কর্তৃক সেই পোশাক খুলে ফেলার কারণে, তার হক আদায় না করার কারণে স্ত্রীরা অন্যায়ে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রী অপরাধী হলেও মূল অন্যায়টা স্বামীর। কেননা স্বামীর শরয়ী বিধান লঙ্ঘনের দরুণই স্ত্রীর পক্ষ হতে সীমালঙ্ঘনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই ইসলামের ফায়সালা হল, স্বামী হয়তো বিয়ের আগে প্রবাস জীবন কাটাবে অথবা চার মাস পরপর বিবির সান্নিধ্যে চলে আসবে অথবা বিবিকে সাথে নিয়ে বিদেশে সফর করবে।


৬. স্ত্রীকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান: 

স্বামীর কাছে স্ত্রীর যেমন জৈবিক অধিকার রয়েছে তেমনি ধর্মীয় অধিকারও রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا

অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবারকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। (সূরা তাহরীম-৬)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

الرجل راع على أهل بيته وهو مسؤول عن رعيته. 

অর্থ: পুরুষ তার পরিবারের যিম্মাদার, তাকে তার পরিবারের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫২০০) 

তাই বিবাহ ইচ্ছুক প্রত্যেক পুরুষের কর্তব্য হল, দীনদার নারী বিবাহ করা। তাহলে স্ত্রী স্বেচ্ছায় দীনের উপর চলবে। আর যদি অশিক্ষিত বা জেনারেল শিক্ষিত নারী বিবাহ করা হয় তাহলে তাকে নামায-রোযা, মাসআলা-মাসাইল, ইবাদত-বন্দেগীর হায়েয-নিফাস প্রভৃতির বিধান, বিদ'আত ও রুসূমাত পরিহার করা ইত্যাদি বিষয়ক ইলম শিক্ষা দেয়া স্বামীর জন্য আবশ্যক। অন্যথায় দুনিয়াতে চরম অশান্তি সৃষ্টি হবে আর পরকালেও ভীষণ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। 


৭. স্ত্রীর চারিত্রিক বিষয়: 

অনেকে স্ত্রীর চারিত্রিক বিষয়ে অহেতুক সন্দেহ করে, তার প্রতি মন্দ ধারণা রাখে। এটা গুনাহের কাজ। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ. 

অর্থ: কিছু কিছু ধারণা সরাসরি গুনাহ। (সূরা হুজুরাত-১২)

এক্ষেত্রে স্বামীর করণীয় হল, বিবাহের পূর্বে সর্ববিষয়ে সাধ্যানুযায়ী যাচাই- বাছাই করা। বিবাহের পরে স্পষ্ট দলীল ব্যতীত স্ত্রীর প্রতি কোন মন্দ ধারণা না করা। বরং নিজের জীবনের অন্যায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা। আর এই বিশ্বাস রাখা যে, যে বিবি আমার জন্য উপযুক্ত ও কল্যাণকর আল্লাহ তা'আলা আমার জন্য তাকেই বরাদ্দ করেছেন। অতএব আমি তাকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবো।

কারণ সূরা নূরে এসেছে,

الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ

অর্থ: মন্দ নারীগণ মন্দ পুরুষদের জন্য আর মন্দ পুরুষগণ মন্দ নারীদের জন্য, উত্তম নারীগণ উত্তম পুরুষদের জন্য আর উত্তম পুরুষগণ উত্তম নারীদের জন্য। (সূরা নূর-২৬)

অতএব আশা করা যায়, আমি যদি সৎচরিত্রের অধিকারী হই তবে আমার স্ত্রীও চরিত্রবতী হবে। অনেকে স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলনের গোপনীয় বিষয় বন্ধু- বান্ধবদের কাছে প্রকাশ করে দেয়, এটা মারাত্মক গুনাহের কাজ এবং স্ত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ণ করার শামিল। এমন গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরী।


৮. স্ত্রীর মান-অভিমান 

ইসলাম স্বামীর সাথে স্ত্রীর মান-অভিমানের অধিকার দিয়েছে। যেহেতু স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের তনুদেহ ভিন্ন তাই একজনের সর্ববিষয় অপরজনের কাছে ভালো না লাগাই স্বাভাবিক। উপরন্তু নারীদের বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

استوصوا بالنساء خيرا فإنهن خلقن من ضلع وإن أعوج شيء في الضلع أعلاه فإن ذهبت تقيمه كسرته.

অর্থ: হে পুরুষগণ! তোমরা নারীদের ব্যাপারে আমার কাছ থেকে কল্যাণের অসিয়ত গ্রহণ কর। নিশ্চয় তাদেরকে পাঁজরের বক্র হাঁড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি তুমি তাকে সম্পূর্ণ সোজা করতে যাও তবে ভেঙ্গে ফেলবে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫১৮৬)

অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের জ্ঞান-বুদ্ধি কম বলে অবহিত করেছেন। তাই পুরুষদেরকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। স্ত্রীদের বক্রতা আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্য্য মনে করতে হবে। তাদের মান-অভিমান সয়ে যেতে হবে। হাদীসে রাসূলের সাথে বিবিদের অনেক মান-অভিমানের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। যেমন একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক স্ত্রী হযরত আয়েশা সিদ্দীকার ঘরে রাসূলের জন্য একটা বাটিতে কিছু হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। এদিকে আয়েশা রাযি. এর ঘরে অন্য স্ত্রীর হাদিয়া পাঠানোতে তাঁর অভিমান হল। তাই আয়েশা রাযি. খাবারের পাত্রটি ভেঙ্গে ফেললেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে ক্ষিপ্ত হলেন না; বরং পড়ে যাওয়া খাবারগুলো নিজ হাতে একত্রিত করলেন এবং সেই পাত্রের পরিবর্তে আরেকটি পাত্র দিয়ে খাদেমকে জানিয়ে দিলেন, তোমাদের মায়ের অভিমান হয়েছে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫২২৫)

এ ধরনের বহু ঘটনা রাসূলের জীবনে ঘটেছে যা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরী।


৯. স্ত্রী যখন অভদ্র, বদমেযাজী: 

স্ত্রী অভদ্র ও বদমেযাজী হলেও ইসলাম স্বামীকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছে এবং প্রতিদান হিসেবে পরকালে স্বামীর জন্য মহাপুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। স্ত্রীর ভালো দিকগুলো নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করতে বলেছে। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে বলেছে। কারণ অভদ্র হওয়া সত্ত্বেও সে তো স্বামীর খিদমত, রান্না-বান্না, সংসার পরিচালনা ও সন্তানাদি লালন-পালনসহ প্রতিনিয়ত অসংখ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অতএব কদাচিৎ তার পক্ষ থেকে কিছুটা কষ্ট পেলে তা সয়ে যাওয়াই স্বামীর কর্তব্য। এক্ষেত্রে লোকমান হাকীমের একটি ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে।

প্রসিদ্ধ আছে যে, লোকমান হাকীম একজন কৃতদাস ছিলেন। একবার তার মুনীব তাকে ভালোবেসে তার জন্য বড় একটি লাল বাঙ্গি নিজ হাতে কাটলেন। তারপর বাঙ্গির টুকরোগুলো তার মুখে তুলে দিচ্ছিলেন। লোকমান হাকীম আনন্দচিত্তে খেয়ে চলছিলেন। মুনীব শেষ টুকরোটি হাতে নিয়ে বললেন, সবগুলো তোমাকে খাওয়ালাম; এটি আমি খাই। তিনি টুকরোটি মুখে নিয়ে সাথে সাথে ফেলে দিলেন। বললেন, বাঙ্গিটি দেখতে এত ভালো অথচ ভেতরে এমন তিতা! তুমি খেলে কিভাবে? লোকমান হাকীম উত্তর দিলেন, আপনার এই হাত থেকে জীবনে কত নেয়ামত লাভ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। আজ না হয় একটু কষ্টই পেয়েছি, তাই বলে তা ফিরিয়ে দেই কিভাবে?

এই ছিল বুযুর্গ ব্যক্তির কৃতজ্ঞতা। ঠিক স্ত্রীদের ক্ষেত্রেও একই কথা। তাদের থেকে প্রাপ্ত কষ্টের দিকে না তাকিয়ে তাদের দ্বারা অর্জিত সুখের প্রতি লক্ষ্য করা উচিত। তবেই কষ্ট ফুরিয়ে যাবে। 


১০. স্ত্রী সুন্দরী নয় বা অপছন্দনীয়: 

কারো স্ত্রী অসুন্দর, বেঁটে বা অপছন্দনীয় হলে এসব কারণে যদি পরনারীর প্রতি মন আকৃষ্ট হয় তাহলে ভাবা উচিত যে, আমার পাপের কারণে হয়তো আল্লাহ তা'আলা আমার জন্য এই স্ত্রী বরাদ্দ করেছেন। আর সে তার নেক আমলের কারণে আমার মত সুদর্শন স্বামী পেয়েছে। তাহলে আমি হলাম তার নেক আমলের প্রতিদান আর সে হল আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাছাড়া সুন্দর- অসুন্দর ইত্যাদি দোষ-গুণ আল্লাহ তাআলার দান। তাতে স্ত্রীর কোন ক্ষমতা নেই। আল্লাহ যদি তার স্থানে আমাকে সৃষ্টি করতেন তখন আমারই বা কি করার ছিল! বা এখনো যদি আমার সৌন্দর্য্য কেড়ে নেন, বিকলাঙ্গ বা পঙ্গু করে দেন তাহলে আমার কি করার থাকবে? তাই এখানেও ধৈর্য্য ধারণ করা জরুরী। পরস্ত্রীর প্রতি মন আকৃষ্ট হলে ইসলামের নির্দেশ হলো নিজ স্ত্রী নিয়ে মশগুল হয়ে যাওয়া। কারণ হিসেবে হাদীসে বলা হয়েছে,

فإن معها مثل الذي معها. 

অর্থ: উক্ত নারীর সাথে যা আছে নিজ স্ত্রীর মাঝেও তাই আছে। অতএব পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। (সুনানে দারিমী; হা.নং ২৩৮৮)

মনে রাখতে হবে, একটি মেয়ে তার বাবা-মা, ভাই-বোন সকলকে ছেড়ে স্বামীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। এখন স্বামীই তার একমাত্র আপন। সে স্বামীই যদি তার দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তার জীবনে সুখ পাওয়ার আশা আর কার কাছ থেকে করবে!


১১. স্ত্রী নিঃসন্তান বা কন্যা সন্তান প্রসবিনী: 

স্ত্রীর গর্ভে সন্তান না হলে অথবা কেবল কন্যা সন্তান হলে অনেকেই স্ত্রীকে দোষারোপ করে। অথচ পুত্র বা কন্যা সন্তান দান করা স্ত্রীর আয়ত্তাধীন নয়; বরং সেটা একমাত্র আল্লাহরই দান। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে,

يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ

অর্থ: আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। (সূরা শূরা-৪৯) উপরন্তু ডাক্তারী পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যা থাকে স্বামীর; স্ত্রীর নয়। তাহলে তার প্রতি এই জুলুম কেন? তাই আল্লাহ যা দান করেন কন্যা হোক বা পুত্র, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা চাই। স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া বা নির্যাতন করা অন্যায়। এক্ষেত্রে দু'আ করা যেতে পারে, হে আল্লাহ! আমার জন্য তুমি যে নেক সন্তানের সিদ্ধান্ত করেছ তা আমাকে তুমি দান কর।


১২. একাধিক বিবাহ: 

ইসলামের দৃষ্টিতে একাধিক বিবাহ নারীর প্রতি জুলুম করার উদ্দেশ্যে নয়। বরং নারীর অভিভাবকত্ব প্রদান ও তার হক আদায়ের জন্য এ ব্যবস্থা। নারীদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি হওয়ায় ভরণ-পোষণের সামর্থ্য ও তাদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার শর্তে ইসলাম একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। উল্লিখিত শর্ত কারো মাঝে বিদ্যমান না থাকলে কেবল এক বিবি নিয়ে জীবন যাপন করতে বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি একাধিক বিবাহ করে আর স্ত্রীদের প্রতি ইনসাফ করে না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সতর্ক করে বলেন,

إذا كان عند الرجل امرأتان فلم يعدل بينهما جاء يوم القيامة وشقه ساقط.

অর্থ: যদি কারো দুজন বিবি থাকে আর সে তাদের মাঝে সমতা রক্ষা না করে তবে কিয়ামতের দিন সে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ তার এক কাঁধ একদিকে ঝুঁকে থাকবে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১১৪১)

বর্তমান সমাজে যাদের একাধিক বিবাহ করার সামর্থ্য নেই, যারা ইনসাফ বলতে কিছুই বোঝে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই একাধিক বিবাহ করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করে। আর ইসলামের শত্রুরা তাকে দলীল বানিয়ে বলে বেড়ায়- ইসলাম একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়ে নারীদের প্রতি জুলুম করেছে। এজন্য একাধিক বিবাহের ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। সামর্থ্যবান ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়ীদের যেমন একাধিক বিবাহের মাধ্যমে নারীদের অভিভাবকত্ব গ্রহণের প্রতি এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে তেমনি সামর্থ্যহীন ও বে- ইনসাফগারদেরও তা থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকতে হবে।


১৩. তালাক প্রসঙ্গ: 

স্ত্রী যদি স্বামীর অবাধ্য হয়, শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে জীবন যাপন করতে না চায় তখন তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ইসলাম কয়েকটি কার্যকরী নীতিমালা প্রয়োগের আদেশ করেছে। সেসব ধারা অতিক্রম ব্যতীত তাকে তালাক দেয়া শরীয়ত সম্মত নয়।

আল্লাহ তা'আলা বলেন,

وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا

অর্থ : তোমরা যে সকল স্ত্রীদের অবাধ্য হওয়ার আশঙ্কা কর তাদেরকে উপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে (শর্ত সাপেক্ষে) শাসন কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অন্বেষণ করো না। (সূরা নিসা-৩৪) 

এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তিনটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন- (১) উপদেশের মাধ্যমে বুঝিয়ে সংশোধন করা, (২) প্রয়োজনে গভীর অসন্তুষ্টি প্রকাশের জন্যে তার সাথে শয্যা ত্যাগ করা, (৩) প্রয়োজনে পূর্বে উল্লিখিত পন্থায় দৈহিক হালকা শাসন করা। তারপরেও যদি সংশোধন না হয় তবে স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ থেকে দুজন সালিস (তৃতীয় পক্ষ) নির্ধারণ করে তাদের মাধ্যমে সমঝোতা করার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। যদি তারপরও পরস্পরে সমঝোতা না হয়; সমাধানের চারোটি পন্থাই ব্যর্থ হয় তাহলে বিজ্ঞ কোন আলেম বা মুফতীর শরণাপন্ন হয়ে এক তালাক প্রদান করা। তারপরও যদি সঠিক পথে না আসে তাহলে পুনরায় দ্বিতীয় তালাক, তারপর না হলে সেই পর্যায়ক্রমে তৃতীয় তালাক প্রদান করা। উপরোক্ত ধাপসমূহ পার হওয়ার পূর্বে কোন অবস্থায়ই স্ত্রীকে তালাক দেয়া শরীয়ত সম্মত নয়। অথচ বর্তমানে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে এগুলোর কোনই তোয়াক্কা করা হয় না। কথা কাটাকাটি আর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তালাক দেয়া হয় বা শরঈ প্রয়োজন ও যোগ্যতা ছাড়া শুধু প্রথম স্ত্রীর প্রতি রাগ মিটানোর জন্য দ্বিতীয় বিবাহ করে প্রথম স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া শুরু করে, এ সবই অপরিপক্ক অবলা নারীর প্রতি জুলুম ও অন্যায়। 

সত্য বলতে কি, সমাজের অধিকাংশ নারী-পুরুষই বর্তমানে ইসলামের পারিবারিক নীতি সম্পর্কে অনবগত থাকে। ফলে সাধারণ লোক তো বটেই বাহ্যিকভাবে দীনদার এমন কিছু লোকও নিজের অজান্তেই স্ত্রী ও পরিবারের অধিকারের প্রতি চরম উদাসীন বা জুলুমবাজ। কাজেই পারিবারিক জীবনে তারা সুখের পরিবর্তে দুঃখ-কষ্ট আর বিবাহ বিচ্ছেদের সম্মুখীন হয়। যদি বিবাহ ইচ্ছুক প্রত্যেক নারী-পুরুষ বিবাহের পূর্বে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, সন্তানাদির অধিকার, শ্বশুর-শাশুড়ী ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার সম্পর্কে অবগত হতো তবে তাদের পারিবারিক সমস্যা বহুলাংশেই কেটে যেতো। বিজ্ঞ পাঠক অবগত আছেন যে, এক সময় মালয়েশিয়ায় শতকরা ৭০ ভাগ বিবাহই ভেঙ্গে যেত। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটতো। কিন্তু ড. মুহাম্মদ মাহাথির সাহেব যখন আইন প্রণয়ন জারি করলেন যে, 'দেশের সকল বিবাহ ইচ্ছুকদেরকে বিবাহের পূর্বে একমাস ছুটি দেয়া হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে ইসলামী পারিবারিক দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, এরপর বিবাহের উপযুক্ত সাব্যস্ত হবে।' তখন থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ক্রমে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বর্তমানে তা নেমে শতকরা ৭ ভাগে এসে ঠেকেছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আরো কমে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের এ মুসলিম দেশেও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাধ্যতামূলক এমন কোন প্রশিক্ষণ কোর্স বিজ্ঞ ও হক্কানী উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে চালু করা হলে নিশ্চয় দেশবাসী অনেক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতো। তবে এটা সহজসাধ্য কাজ নয়। এজন্য এ ধরণের প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সবাই যদি এসব বিষয়ে সচেতন হই এবং অন্তত বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম কর্তৃক বাংলায় রচিত পুস্তক থেকে ইসলামী পারিবারিক জীবন ও নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়াদি ভালোভাবে অধ্যয়ন করি তাহলেও অনেকটা লক্ষ্য অর্জন হতে পারে। এক্ষেত্রে হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. রচিত ইসলামী পারিবারিক জীবন, বাংলার বিদগ্ধ আলেমে দীন শাইখুল হাদীস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক দা.বা. রচিত ইসলামী বিবাহ নামক কিতাব দু'টি নিয়মিত অধ্যয়ন করা অত্যন্ত জরুরী।

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

বিবিধ

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দাঃ

শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা

মাওলানা ইমদাদুল হক

আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ

মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

আবদুল্লাহ আল মাসউদ

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আল্লামা ইকবাল

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

শাইখ আলী তানতাভী

মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ