প্রবন্ধ

শান্তি সম্প্রীতি ও উদারতার ধর্ম ইসলাম

লেখক:মাওলানা মুহাম্মদ আবূ সাইম
১ মার্চ, ২০১৪
৮১২৪ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

নামে যার শান্তির আশ্বাস তার ব্যাপারে আর যাই হোক, সন্ত্রাসের অপবাদ দেয়ার আগে তার স্বরূপ উদঘাটনে দু'দণ্ড চিন্তা-ভাবনা, কিছুটা অধ্যয়ন এবং নিরপেক্ষ গবেষণা জ্ঞানের দাবী ছিল বৈকি। যথার্থ প্রমাণ ব্যতীত কোন ঘটনার দায়ভার কোন জাতি বা ধর্মাদর্শের উপর চাপানো নেহাত বোকামি, চরম হঠকারিতা ও বেইনসাফী। কিন্তু পাশ্চাত্যবাদীরা অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বর্তমান বিশ্বের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে মুসলমানদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বলে প্রচার করে চলছে। পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত বর্তমান মুসলিম সন্ত্রাসবাদিতার বেশিরভাগই মূলতঃ ইহুদী-খৃস্টবাদী চক্রের চক্রান্তে সৃষ্ট বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য ফাঁদা নীল নকশার খণ্ডাংশ বৈ কিছুই নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য এসব ঘটনার পেছনে উৎপীড়িত নিগৃহীত বিচার-বঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বা দলের হতাশার প্রকাশ হিসেবেও দু'একটি অপতৎপরতা সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু সেটাকে কোনভাবেই সামগ্রিকতার মোড়কে উপস্থাপন করা উচিত হবে না। কেননা, ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান নেই। তাছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের ক্ষেত্রে ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা যার সীমালঙ্ঘন ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।

ইসলাম শান্তির ধর্ম- একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন ছিল না যদি না হলুদ সাংবাদিকতার অভিশাপে আমাদের মন-মগজ ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তির শিকার হতো। বস্তুতঃ অপবাদের অপনোদন এবং সত্যানুসন্ধানীদের আন্তরিক প্রশান্তির জন্যই এ প্রয়াস। যারা বিভ্রান্ত, কুরআনের ভাষায় যাদের হৃদয় মোহরাংকিত এবং ব্যাধিগ্রস্ত তাদের সুবুদ্ধির উদয়ও আমাদের একান্ত কামনা।

ইসলাম সন্ত্রাস কি-না তা জানতে হলে সন্ত্রাসের পরিচয়, সন্ত্রাস সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, সন্ত্রাস নির্মূলে ইসলামের পদক্ষেপ, ইসলামের শান্তি সম্প্রীতি, উদারতা ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রমাণ তথা কুরআন-হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে সবিস্তার আলোচনা আবশ্যক।


সন্ত্রাস কী?

এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার ভাষ্যমতে-Terrorism, the systematic use of terror or unpredictable violence against governments publics or individuals to attain a political objective. অর্থাৎ, সন্ত্রাস হচ্ছে ত্রাসের নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার। অথবা কোন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র, জনগণ বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত ত্রাস সৃষ্টির প্রয়াস। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রব তার 'সন্ত্রাস: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিপন্থী' প্রবন্ধে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন- "প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বিধি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অবৈধভাবে এমন কোনো হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যার মাধ্যমে জীবন, সম্পদ অথবা শান্তির ক্ষতিসাধন হয় অথবা সামাজিক বা ব্যক্তি জীবন হুমকির সম্মুখীন হয় তখন এরূপ মানবীয় অপতৎপরতাকে সন্ত্রাস বা terrorism বলে।" আরো সংক্ষেপে বলা যায়, যে কার্যাবলী গণমানুষের জন্য ক্ষতিকর; যে অপরাধ মানবতা বিধ্বংসী ও শান্তির হন্তারক তাই সন্ত্রাস। এছাড়াও বিভিন্নজন সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বিভিন্নভাবে। সেসব সংজ্ঞায় মৌলিক তেমন কোন পার্থক্যও দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে সমস্যা সৃষ্টি হয় প্রয়োগক্ষেত্র নিয়ে। তার কারণ দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্য। ফলে দেখা যায় একই ব্যক্তি একই কাজের জন্য কারো কাছে নিন্দিত, কারো কাছে নন্দিত। একজন তাকে চিহ্নিত করে বিশ্বসেরা সন্ত্রাসীরূপে, অপরজন তাকে দেয় বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা। এজন্য সৃষ্টির একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্রষ্টার নির্ভুল ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তের মধ্যবর্তী অনতিক্রম্য পার্থক্য বিবেচনা অপরিহার্য। অন্যথায় অন্যায় যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বনী আদমের ঘাতকও নিজেকে শান্তিবাদী ভাবতে পারে। কুরআনের ভাষায়- 'তাদের বলা হয় পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। ওরা বলে আমরাই তো শান্তিবাদী।' (সূরা বাকারা : ১১) আজ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে আমরা এ চিত্রটিই দেখতে পাই। 


সন্ত্রাস: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামের বিধানে না নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নিয়ম আছে, না আছে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার নীতি। কাজেই আল্লাহর পথে বাধাদান, অন্যায়ভাবে দেশ হতে বহিষ্কার, ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা- ফাসাদ, ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, লুটতরাজ-খুন, ধর্ষণ-ব্যভিচার, সম্ভ্রমহানি ও প্রাণনাশের হুমকি এ জাতীয় যাবতীয় জুলুম ও শান্তি-বিনাশী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে ইসলামের অবস্থান। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো নিষিদ্ধ, হারাম ও জঘন্য পাপ। ইরশাদ হচ্ছে- 'যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং এতে বক্রতা খুঁজে তারাই আখিরাত সম্বন্ধে অবিশ্বাসী।' (সূরা আ'রাফ: ৪৫) 'আল্লাহ আমাদের রব একথা বলার অপরাধে যাদেরকে তাদের বসতভিটা থেকে উৎখাত করা হয়েছে, আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।' (সূরা হজ্জ: ৪০)

'ওরা সম্মানিত মাস সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও, এতে যুদ্ধ করা ভীষণ পাপ...। আর আল্লাহর পথে বাধা প্রদান করা এবং সেখান থেকে তার অধিবাসীদের বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা নরহত্যা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ।' (সূরা বাকারা: ২১৭) 'ধর্ম গ্রহণে- জবরদস্তি নেই' (সূরা বাকারা: ২৫৬) 'তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।' (সূরা নিসা: ২৯) 'যারা অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের উদরে আগুন ভক্ষণ করে।' (সূরা নিসা: ১০) 'ঈমান থাকা অবস্থায় কেউ চুরি করতে পারে না।' (বুখারী: ৫৫৭৮)

'খুনি এবং লুটেরা ডাকাতকে শূলিতে চড়িয়ে হত্যা, শুধু খুনি ডাকাতের জন্য মৃত্যুদণ্ড, লুটেরার বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কর্তন এবং ভীতি প্রদর্শনকারীর দেশান্তরের দণ্ড ইসলামের বিধান।' (সূরা মাইদা: ৩৩) 'যে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ্যে ছিনতাই করল সে আমার দলভূক্ত নয়।' (ইবনে মাজাহ : ৩৯৩৭) 'যে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে সে আমাদের মধ্য হতে নয়।' (মুসলিম: ১৬১-৯৮) 'পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করেনি এমন কাউকে হত্যা করা সমগ্র মানব হত্যারই নামান্তর।' (সূরা মাইদা ৩২) 'ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।' (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২) 'যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের পীড়া দেয় এমন অপরাধের জন্য যা তারা করেনি, তারা বহন করে অপরাধ ও সৃষ্টপাপের বোঝা।' (সূরা আহযাব: ৫৮) 'জুলুম কিয়ামত দিবসে অন্ধকার রূপ পরিগ্রহ করবে।' (বুখারী: ২৩১৫) উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস দৃষ্টে সন্ত্রাস সম্বন্ধে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই অনুমেয়। 


সন্ত্রাস নির্মূলে ইসলামের যুগান্তকারী পদক্ষেপ 

সন্ত্রাস দমনে ইসলামের আয়োজন দেখে সকলকে সত্যিই অভিভূত হতে হবে। অনাগত যে শিশুটি তার পিতার পৃষ্ঠদেশে শুক্রবিন্দুরূপে অবস্থানরত, সেখান থেকে তার মায়ের গর্ভাশয়ে নির্গমন প্রক্রিয়াতেও যেন সে অবাধ্য শয়তানের প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকে সে জন্য পিতা-মাতাকে মিলন-পূর্বে আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে পানাহ চাওয়া বিধেয় করে দেয়া হয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই নবজাতকের কানে আযান-ইকামত শোনানোর মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে তাকে একথাই বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, 'মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যই তোমার জীবনের মিশন।' বস্তুতঃ এটাই তার জীবনের প্রথম পাঠ। আসলে অবুঝ শিশুর হৃদয় পরিচ্ছন্ন শে-ট সদৃশ। পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের কার্যকলাপ অথবা আকস্মিক কোন ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রভাব ও প্রচ্ছায়া নবজাতকের মনে অঙ্কিত হওয়া এমনকি গর্ভকালীন মায়ের আচরণও শিশুর পরবর্তী জীবনে রেখাপাত করা বিজ্ঞান সমর্থিত বটে। এ জন্যই জীবনের প্রথম প্রহরে এতসব সতর্কতার আয়োজন। এরপর শিশুর সুন্দর নাম রাখা, তাকে উত্তম নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া এবং পরিণত বয়স পর্যন্ত তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা অভিভাবকের কর্তব্য। 'সন্তানের উপর পিতার তিনটি দায়িত্ব- সুন্দর নাম রাখা, প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া ও উপযুক্ত বয়সে বিবাহের ব্যবস্থা করা'। (শু'আবুল ঈমান: ৮৬৬৬) 

বলুন, শয়তানের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত মাতৃজঠরে যে মানুষটি বেড়ে ওঠে। জন্মের পরক্ষণেই যে পায় তার পথের সন্ধান, সুন্দর নামের ছোঁয়া যার দেহ- মন আচ্ছন্ন করে রাখে। সর্বোপরি উত্তম নৈতিকতা ও ওহীর জ্ঞান যার ভূষণ ও অলংকার। সে কেমন করে সন্ত্রাসের অন্ধকার গলিপথে পা বাড়ায়! অবাধ্যতার ঘাট মাড়ায়! তা সত্ত্বেও যদি কেউ সন্ত্রাসের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহলে তা প্রতিহত করা ও প্রতিকারের দায়িত্ব সকল মানুষের। 'তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎ কাজে আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে।' (সূরা আলে ইমরান: ১১) 'তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব দেয়া হলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, সৎ কাজে আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করে।' (সূরা হজ্জ : ৪১) 'তোমাদের কেউ অন্যায় সংঘটিত হতে দেখলে নিজ শক্তি বলে তা প্রতিহত করবে।' (মুসলিম: ৫০) পিতা-মাতার দয়ার্দ্র শাসন এবং হিতাকাঙ্ক্ষী মুসলমানদের অনুরোধ উপদেশ উপেক্ষা করে যারা সন্ত্রাসে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস দেখায় তাদের প্রতিবিধানে রয়েছে শরীয়তের বজ্রকঠিন বিধি নিষেধ। নরহত্যার মত জঘন্যতা প্রদর্শনের পৈশাচিক দুঃসাহসিকতা প্রদর্শনকারীর শাস্তি কুরআনের ভাষায়- 'নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাস তথা মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়া হল।' (সূরা বাকারা: ১৭৮) নিহত নারী হোক বা নর; মুসলিম হোক বা অমুসলিম, ধনী হোক বা গরিব হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 

খলীফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে এক অমুসলিমকে হত্যা করে বসে একজন মুসলমান। উমর (রা.) স্পষ্ট ঘোষণা দেন, যদি মৃতের অভিভাবকেরা রক্তপণে রাজি না হয়, তাহলে এ ঘাতকের গর্দান উড়িয়ে দিব আমি। হযরত আলী (রা.)-এর শাসনামলেও পুনরাবৃত্তি ঘটে অনুরূপ বিচারের। শুধু ঘাতকই নয়, ভুলবশতঃ হত্যাকাণ্ডে ঘাতকের আত্মীয়-স্বজনকেও টানতে হবে রক্তপণের বোঝা। (ফাতাওয়া শামী : ৬/৫৭৩) এমনকি অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত লাশ যে এলাকায় পাওয়া যাবে সেখানকার অধিবাসীদেরও সম্মুখীন হতে হবে কঠিন জবাবদিহির। (ফাতাওয়া শামী: ৬/৬২৬ কিতাবুল কাসামাহ) যাতে সম্মিলিত সতর্কতা ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় বন্ধ হয় নরহত্যার মত জঘন্য অপরাধ। 'ব্যভিচারের শাস্তি প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড কিংবা একশত বেত্রঘাত।' (সূরা নূর: ২) 'চোর নারী হোক বা পুরুষ তার হাত কেটে দাও।' (সূরা মাইদা: ৩৮) 'খুনি ও লুটেরা ডাকাতকে শূলিতে চড়ানো হবে, লুটেরা ও ছিনতাইকারীর হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে।' প্রাণনাশের হুমকিদাতাকে কারাগারে প্রেরণ অথবা নির্বাসন (সূরা মাইদা: ৩৩) 'মান সম্ভ্রমহানির কাজে শরীয়তে ৩ থেকে ৩৯ বেত্রাঘাতের অনুমতি দেয়া হয়েছে।' (ফাতাওয়া শামী; ৬০, ৬৭) তথ্য সন্ত্রাসের মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা কুরআনী বিধান 'যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বসো।' (সূরা হুজুরাত : ৬) 

সর্বোপরি আল্লাহর পথে বাধাদানকারী,অন্যায়ভাবে বসতভিটা থেকে উৎখাত ও মজলুমের ন্যায্য অধিকার হরণকারীসহ পৃথিবীময় বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে সদা প্রস্তুত ইসলামের মহান মুহাফিজ-জিহাদ ফি- সাবিলিল্লাহ। মূলতঃ এ বজ্রকঠিন শাসনদণ্ডের মাধ্যমেই সকল সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরেছিল ইসলাম। তাছাড়া মানব রচিত দণ্ডবিধির মত ইসলাম শুধু আইন রচনা করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং প্রত্যেক অপরাধ ও শাস্তির সাথে খোদাভীতি ও পরকাল কল্পনা উপস্থাপন করে মানুষের ধ্যান-ধারণাকে এমন এক জগতের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে যার কল্পনা মানুষকে যাবতীয় অপরাধ ও গুনাহ থেকে পবিত্র করে। আর এখানেই ইসলামের স্বতন্ত্রতা। যার অনুসরণই এ অস্থির একবিংশ শতাব্দীতে উপহার দিতে পারে আরেকটি সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব।


জিহাদ বনাম সন্ত্রাস 

প্রসঙ্গত জিহাদের কথা এসে যায়। কেননা, ইসলামকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে জিহাদ। তাছাড়া ইসলামী জিহাদ সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে যে ভুল ধারণা রয়েছে তার নিরসন হওয়াও একান্ত দরকার। মনে রাখতে হবে, ইসলাম হচ্ছে 'complete code of life' অর্থাৎ, পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানে শিষ্টের লালনের সাথে সাথে দুষ্টের দমন নীতিও যে আবশ্যক এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত অঙ্গ কেটে বিচ্ছিন্ন করা আক্রান্তের উপর জুলুম নয়: এহসান, দয়া ও সহমর্মিতা। ইরশাদ হচ্ছে, 'তুমি তোমার ভাইয়ের সাহায্য করো, যখন সে জুলুমের শিকার হয় অথবা হয় জুলুমকারী। বলা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাকে আক্রান্ত হলে সাহায্য করবো, কিন্তু যখন সে জালেম তখন আমি কীভাবে তার সাহায্যকারী হবো? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, 'তুমি তাকে জুলুম থেকে নিবৃত করবে। এটাই তার উপর অনুগ্রহ ও সাহায্য।' (বুখারী: ৬৯৫২) কাজেই জিহাদকে সন্ত্রাসের সাথে একীভূত করে ফেলাটা অদূরদর্শিতা ও জ্ঞান স্বল্পতারই পরিচায়ক হবে।

জিহাদ কী? জিহাদ মজলুম মানবতার রক্ষাকবচ। জিহাদ নির্যাতনের প্রতিবাদমুখর তীব্র ভাষা। জিহাদ অসহায়ের নিরাপত্তা, বঞ্চিতের অধিকার। জিহাদ ইজ্জতের গ্যারান্টি, শান্তির হাতিয়ার। জিহাদ সন্ত্রাস নয়, সন্ত্রাস নির্মূলের জন্যই জিহাদের অবতারণা। দেখুন, জিহাদের বৈধতা দানকারী কুরআনের আয়াত- 'যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ, তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।' (সূরা হজ্জ: ৩৯) 

ফেতনা-ফাসাদ দূরীভূত করে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করাই জিহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। 'তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক, যতক্ষণ না ফেতনা দূরিভূত হয় এবং আল্লাহর দীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।' (সূরা আনফাল : ৩৯)

জিহাদ সাম্রাজ্যবাদীদের তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী স্লোগানের আড়ালে রাজ্য দখলের পাঁয়তারা নয়। জিহাদ নয় অন্যায়ভাবে গণহত্যা, গণধর্ষণ আর লুণ্ঠনের নাম। জিহাদ এক খোদায়ী রহমত যা সকল ধর্মের, সকল মানুষের ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং রক্ষা করে মঠ, মন্দির, গির্জা, মসজিদ। ইরশাদ হচ্ছে- 'আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে বিধ্বস্ত হত খ্রিস্টান সংসার বিরাগীদের উপাসনালয়, গির্জা, ইহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ- যাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম।' (সূরা হজ্জ : ৪০) জিহাদ খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়, ইহুদী নিধনের জন্যও নয় জিহাদ এবং কিতালের ফয়সালা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ার স্বপ্নেও নয়। মুজাহিদের নাঙ্গা তরবারী শুধুই জালিমের জন্য। চাই সে যে ধর্ম-বর্ণ গোত্র-বংশেরই হোকনা কেন। সকল অহংকারীর উদ্ধত শির থেঁতলে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাই জিহাদের পয়গাম। 'কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়রূপে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়।' (সূরা শুরা ৪২) জিহাদ ধ্বংস নয়, সৃষ্টির মহা উল্লাস। রণাঙ্গনের আগুনে প্রহরেই সে ইস্পাতকঠিন আর যুদ্ধ শেষে বিপন্ন মানবতার নিষ্ঠাবান মুহাফিজ। 

ইসলামের প্রথম যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হল। বন্দী হল সত্তর জন কুরাইশ কাফের। কোন কানুন তো ছিল না, ছিল না জেনেভা কনভেনশনের ফাঁকা বুলি। তবুও সাধারণ বন্দীদের দশ জন করে মুসলমানকে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হল। বন্দীদের পোশাক আশাকের ব্যবস্থা করা হল। আহারের জন্য একেকজন বন্দীকে বণ্টন করে দেয়া হল সাহাবাদের মধ্যে। সাহাবারা নিজেরা অর্ধাহারে অনাহারে থেকে তাদেরকে পেট পুরে খেতে দিতেন। হুনাইনের যুদ্ধে ছয় হাজার বন্দীকে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই আযাদ করে দেয়া হয়েছিল। ইসলামের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের ময়দানেও নারী-শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী: ৩০১৪) 

অতএব, জিহাদের ধুয়া তুলে ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্মরূপে চিহ্নিত করার অবকাশ নেই। তবে কথা হল, জিহাদ করতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায়, সঙ্গীন পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট শত্রুর মোকাবেলায়। যষ্টি মধু যেমন মধু নয়- তেমনি অহেতুক ত্রাস সৃষ্টিও জিহাদ নয়। নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশে মুসলমানদের উপর আক্রমণ তো চরম পাশবিকতা ও নিদারুণ বর্বরতা। মদ মদ-ই; ইসলামী লেবেল তাকে হালাল বানাতে পারে না। কেননা, জিহাদের রয়েছে শরীয়তের মানদণ্ডে উত্তীর্ণস বিধিবদ্ধ কানুন। কাজেই জিহাদের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ সন্ত্রাস করলে তার জন্য দায়ী হবে স্বয়ং সে সন্ত্রাসী, জিহাদ নয়।


ইসলাম সন্ত্রাস নয়

ইসলাম সন্ত্রাস নয়। একটু ঠাণ্ডা মাথায় খ্রিস্টীয় ছয় শতকের পৃথিবীর দিকে তাকাই। দেখি ইতিহাস কী বলে- সন্ত্রাসের হিংস্রাঘাতে বিশ্ব সভ্যতা তখন মুখ থুবড়ে পড়েছিল। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল মানবতা ও মানবাধিকার। ফারাওদের হাজার হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস নীলের জলে ডোবার আয়োজন করছিল। সভ্যতার তথাকথিত পীঠস্থান রোম-পারস্যের বালাখানা থেকে ভেসে আসছিল মজলুম ক্রীতদাসের আর্তচিৎকার। চীনের মহাপ্রাচীর ছাপিয়ে উৎপীড়িতের আহাজারী আঘাত হানছিল আকাশের দ্বারে। শুদ্র-বৈশ্যের ক্রন্দনরোল ধ্বনিত হচ্ছিল সিন্ধুর তীরে তীরে। মরু আরবের প্রখর উত্তাপও অবলা নারীর আঁসু মুছতে ব্যর্থতার গ্লানি সইছিল। এমনই অস্থির হয়ে উঠেছিল সেদিন এ পৃথিবী। কবির ভাষায়- কাপিতেছিল এ ধরা অসহায় ভীরু বালিকার সম,শুন্য অঙ্কে ক্লেদে ও পঙ্কে পাপে কুৎসিততম।

ঘুরিতেছিল এ কুগ্রহ যেন অভিশাপ ধূমকেতু, সৃষ্টির মাঝে এ ছিল সকল অকল্যাণের হেতু। সন্ত্রাসের জহর-আলুদা পৃথিবী তখন কামনা করছিল এমন এক কুদরতী কারিশমার, যা বিষহরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে এবং উপড়ে ফেলবে সন্ত্রাস-বৃক্ষের শিকড়। অসহায় ইনসানিয়াতের প্রয়োজন ছিল এমন এক জাদুমন্ত্রের, যার তেলেসমাতিতে সন্ত্রাস দাবানল নির্বাপিত হবে দপ করে এক লহমায় আর মানবতা লাভ করবে নতুন জীবন। এমন নাজুক মুহূর্তে কুদরতে খোদাওন্দী সদয় হল মাটির মানুষের প্রতি। প্রেরিত হল সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অবতীর্ণ হলো সন্দেহাতীত কিতাব আল কুরআন। আগমন ঘটলো দীন-ইসলামের। ইনকিলাব সূচিত হল পাপ-পঙ্কিলতার অভয়ারণ্য অন্ধকার পৃথিবীতে। 

মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধান। দেবতা-পূজারীর মুখে আজ কাবার রবের জয়গান। দুর্ধর্ষ খুনী আজ ইনসানিয়াতের মুহাফিজ, মানবতার ত্রাণকর্তা। ব্যভিচারীর নিকট ব্যভিচার অপেক্ষা ঘৃণিত কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। জীবন্ত কন্যার কবরদাতা নিষ্ঠুর পাষাণ পিতা লজ্জিত-শঙ্কিত! কন্যাই আজ তার কাছে সবচেয়ে আদরণীয়। উটের পানি পান করানো নিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ যারা জিইয়ে রাখতো শত শত বছর, আজ তারাই যুদ্ধের বিভীষিকায় নিজের মরণ পিপাষায় অন্যের পানি! পানি! কাতরানিতে হাসি মুখে বিলিয়ে দেয় আপন পেয়ালা। ডাকাতের তলোয়ার কোষাবদ্ধ। চোরের হাত নিজ নিজ পকেটে। ইয়াতিমের মাল ভক্ষণকারী অনন্যোপায়-সতর্ক। বল, সত্যি করে বল, এসব কার দান? নিঃসন্দেহে ইসলামের এবং একমাত্র ইসলামের।

এমন শান্তির ধর্মে যারা সন্ত্রাসের কালিমা জড়াতে চায়, সূর্যালোকে অবগাহন করেও যারা বলে 'নিশুতি রাত, ঘন অন্ধকার' -তারা যুক্তি দেখায়, পর্যবেক্ষণের কাসুন্দি ঘাটে। অদ্ভুত ওদের পর্যবেক্ষণ, হাস্যকর ওদের যুক্তি। ওরা বসে বসে হিসেব কষে আমেরিকার জোড়া টাওয়ার ধসালো কে? মুসলমান। লন্ডনে বোমা ফাটালো কে? মুসলমান। অমুক জায়গায় নাশকতা সৃষ্টিকারী; আরে, সেও তো মুসলমান। ব্যাস, তিন তিনটে স্থানের হিসাব যেহেতু এক ও অভিন্ন অতএব মুসলমানই সন্ত্রাসী; ইসলামই সন্ত্রাস। জানতে পারি, হিরোশিমা-নাগাসাকি ট্রাজেডির নায়ক কে? কোন শান্তিবাদী মিথ্যা অজুহাতে সন্ত্রাস নির্মূলে সবচেয়ে সফল আফগানিস্তানের কবর রচনাকারী? নিরপরাধ ইরাকের বুকে কার বোমারু- বিমান গর্জায় মুহুর্মুহু? কার বুলডোজার স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনির পাজর গুঁড়ো করে? তোমরা বল, আমেরিকা! তোমরা বল, বৃটেন! তোমাদের সাফ জবাব- ইসরাইল। কেন? আমেরিকানদের কোন ধর্ম নেই? বৃটিশ-ইসরাইলিরা কি কোন ধর্মের অনুসারী নয়? ওদের শান্তি বিনাশী ও মানবতা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডগুলো যদি ধর্মান্ধতা হিসেবে পরিচিতি না পায়, স্পষ্ট ভাষায় 'ক্রুসেড' উচ্চারণের পরও যদি ওদের ধর্ম সন্ত্রাস আখ্যায় আখ্যায়িত না হয় তবে কেন পৃথিবীর পথে-প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার দায়ভার কেবল ইসলামের ঘাড়েই চাপবে? কেন নির্যাতিত নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পবিত্রতায়ই কেবল সন্ত্রাসের কালিমা জড়াবে? এ বড় বেইনসাফী তোমাদের! বড় একচোখা তোমরা!

ইসলাম সন্ত্রাস নয়; বরং ইসলামের মতো শান্তিপ্রিয় ধর্মের অনুসারীরাই তথাকথিত শান্তিবাদীদের নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে যুগে যুগে, দেশে দেশে। ইতিহাসের বিবর্ণ পাতাগুলো এর জ্বলন্ত সাক্ষী। নিরীহ মুসলমানদের উপর মক্কার কাফেরদের অবর্ণনীয় নির্যাতন আক্ষরিক অর্থেই পৈশাচিকতার রূপ ধারণ করেছিল। খুনি বজ্জাতেরা যেখানে নিশ্চিত নিরাপত্তা পেত, সেই 'গ্রীন জোন' কাবা ঘরে কাবার রবের প্রতি সিজদাবনত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথায় উটের নাড়ি-ভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়া, মরুর আগুনে-বালুর উপর পাথর চাপা দেয়া 'আহাদ! আহাদ!' বোললো মুখে বেলাল হাবশী, জ্বলন্ত অঙ্গারে শুইয়ে রাখা খাব্বাবের গোশতহীন কোমর, লজ্জাস্থানে নরাধম আবু জাহেল কর্তৃক বর্ণাঘাতে সুমাইয়ার নির্মম শাহাদাত, শি'আবে আবু তালিবে বয়কটের তিন তিনটি বছর ঘাস-পাতা আর ছাল- বাকল খেয়ে দিন গুজরান ইত্যাকার হাজারো নির্যাতনের ঝড় বয়ে গেছে মক্কাবাসী মুসলমানদের উপর। কিন্তু কখনো প্রত্যাঘাতের অনুমতি দেয়নি ইসলাম।

হিজরতের পর প্রতিরোধ-প্রতিশোধের অনুমতি দেয়া হল। ইনসাফের তরবারী স্পর্শ করল জালিমের শাহরগ। একই তলোয়ারের শাণিত ভাগ অবসান ঘটাল জুলুমবাজীর; অপরভাগ টানিয়ে দিল ইনসাফের শামিয়ানা। কালের আবহে মুসলমানদের অসতর্কতায় যখনই সে তলোয়ারে মরচে ধরেছে, তখনই ওই শান্তিবাদীরা হামলে পড়েছে মুসলমানদের উপর। ৪৯২ হিজরী মোতাবেক ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময় বিজয়ের নেশায় উন্মত্ত হয়ে অসহায় মুসলমানদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল তার উল্লেখ একজন দায়িত্বশীল খ্রিস্টান ঐতিহাসিক নিম্নোক্তভাবে করেছেন- 'বায়তুল মুকাদ্দাসে বিজয়ীবেশে প্রবেশ করার পর ক্রুসেড যোদ্ধারা এভাবে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল যে, যেসব যোদ্ধা ঘোড়ায় চড়ে মসজিদে উমরে (রা.) গিয়েছিল তাদের ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্ত রক্তের বন্যায় ডুবে গিয়েছিল। বাচ্চা শিশুদেরকে পা ধরে দেয়ালগাত্রে আছড়ে মারা হয় অথবা প্রাচীরের ওপর থেকে চক্রাকারে বাইরে নিক্ষেপ করা হয় ...। পরদিন জ্ঞাতসারে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে এর চেয়েও ভয়াবহ ও হৃদকম্প সৃষ্টিকারী নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয় ...। নারী-পুরুষ সবাইকে হত্যা করার পর তাদের দেহ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। অবশেষে এই গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটলে শহরের রক্তাপ্লুত সড়কগুলো আরব বন্দীদের দিয়েই ধৌত করা হয়।' স্পেনের পট-পরিবর্তনের সাথে জড়িত ইউরোপের রক্তাক্ত ইতিহাস যদি সামনে তুলে ধরা হয়, তবে শান্তিবাদীদের সভ্যতা ও তামাদ্দুনের মুখোশ খুলে পড়বে। খোদ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নবম শতাব্দী হতে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমরাস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার ও গণহত্যাসহ বিবিধ উপায়ে নির্যাতনের মাধ্যমে মুসলমানদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। শত শত মানুষকে বন্দী করে তাদের চোখের সামনে তাদের সন্তানকে জবাই করা হয়েছে। লাখ লাখ মুসলমান নিজেদের ঈমানের হেফাজতের খাতিরে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। গ্রানাডার মাঠে মুসলমানদের লিখিত অতি মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য ৮০ হাজার গ্রন্থের বিপুল ভাণ্ডার আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা ফিলিপের শাসিত এলাকায় আরবী ভাষায় একটি বাক্য উচ্চারণ করাকেও অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল সেখানে একে একে মুসলমানদের সকল স্মৃতিসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। কর্ডোভার দ্বিতীয় জামে মসজিদে একাধিক গির্জা নির্মাণ করা হয়। সেখানে অবস্থিত ১২ হাজার গম্বুজবিশিষ্ট হামরা ও জোহরা নামক পৃথিবীর অদ্বিতীয় প্রাসাদ যা আশহাদু-আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ধ্বনিতে সদা মুখরিত ছিল, তার মধ্যে ত্রিকোণ বিশিষ্ট স্তম্ভ ও গির্জা নির্মাণ করা হয়েছে যা আজও বিদ্যমান।

১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে শাহাদত বরণকারী লক্ষ লক্ষ মুসলমানের কথা আজ কারো অজানা নয়। আর বর্তমান প্রেক্ষাপট তো আমাদের চোখের সামনে। আফগান, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, বসনিয়া, সিংকিয়াং, মিন্দানাও, গুজরাট, আরাকানসহ গোটা পৃথিবী মুমিনের রক্তে লাল। জন্মভূমি বাংলাদেশের কথা আর নাই বললাম। তবুও মুমিন সন্ত্রাসী; সভ্য পৃথিবীর জন্য হুমকি। বড় চিন্তিত এ পৃথিবী। আসলে অন্যের চোখে সামান্য খড়কুটা পড়লেও মানুষ তা দেখতে পায়, অথচ নিজের চোখের কড়িকাঠও সে উপেক্ষা করে চলে। মরহুম আকবর এলাহাবাদী চমৎকার বলেছেন- নিজের ঘরের নেয় না খবর, পরের ঘাড়ে চাপায় দোষ 'তেগের বলে জয় ইসলামের' এমন কথাও কয় বেহুঁশ!


শান্তির স্নিগ্ধ পরশ 

'(হে নবী!) আমি তা আপনাকে বিশ্ব জাহানের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ প্রেরণ করেছি।' (সূরা আম্বিয়া: ১০৭) পৃথিবীতে বিরাজিত যাবতীয় অন্যায়- অবিচার, হানাহানি দূর করে শান্তি স্থাপনের জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। উক্ত আয়াত এ কথারই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু ইসলামের শান্তি স্রেফ শান্তিকামীর জন্য, উদ্ধৃত জালিমের জন্য ইসলামই বজ্রাঘাত। এ ব্যাপারটি অনেক নামকাওয়াস্তের মুসলমানও ঠিক মেনে নিতে পারেন না বা মেনে নেন না। তাই ইসলামের দুশমনের ঘাড়ে রদ্দা পড়লেই তারা 'মানবতা গেল, মানবতা গেল' বলে চেঁচিয়ে ওঠেন; 'শান্তিকামী ইসলামের অনুসারীদের এই বুঝি কর্ম! বলে টিপ্পনিও কাটেন কেউ কেউ। মনে রাখতে হবে, অত্যাচারের প্রশ্রয় দেয়া অত্যাচারেরই শামিল। আর ফোঁড়ার পুঁজ বের করার মধ্যেই গোটা দেহের শান্তি নিহিত। কিন্তু পুঁজ বের করার অধিকার এবং ক্ষমতা কেবল ইসলামী সরকারের এবং মুসলিম আদালতের; প্রজা সাধারণের নয়। কেননা তাতে শান্তি আসে না, কেবল অশান্তিই বাড়ে। এবার দেখুন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের পদক্ষেপগুলো-

হাদীসের বাণী- 'মুসলিম তো সে- যার হাত ও মুখ (এর অত্যাচার) থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে, আর মুমিন সেই ব্যক্তি যার নিকট মানুষের রক্ত ও সম্পদ নিরাপত্তা পায়।' (বুখারী : ৬১১৯) অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও দাঙ্গা- হাঙ্গামাকে বলা হয়েছে হত্যা অপেক্ষাও গুরুতর। সামাজিক শান্তি রক্ষার্থে পারস্পরিক সমঝোতা, সম্ভাব ও সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা উঁচু-নিচুর জাত-পাতের ব্যবধান খুঁচিয়ে দিয়ে ইসলাম গেয়েছে সাম্যের গান। 'আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, নেই কালোর উপর সাদার প্রাধান্য। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি কেবল তাকওয়া ও খোদাভীতি।' (মুসনাদে আহমদ : ২১৪০৭) আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার সীমাহীন তাগিদ তো পারস্পরিক শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখারই মানসে। আর এর বিপরীতে রয়েছে কঠোর শাস্তির ঘোষণা! তাছাড়া হদ, কিসাস ও তা'যীরের খড়গ তো আপন তেজে সদা বর্তমান। ইসলামের বিজয়ে ইসলামী সাম্রাজ্যেও কী পরিমাণ শান্তি ও নিরাপত্তার জোয়ার এসেছিল তা আমাদের ধারণারও অতীত। সুদূর হাযারামাওত থেকে অলংকার সজ্জিত এক যুবতী নারী একাকী উটের পিঠে মদীনা সফর করেছেন। পথে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ভয় তার মনে উদিত হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর সভ্য দেশগুলোতে এর একটা নজীরও মিলবে কি? 


সম্প্রীতির অটুট বন্ধন

মানুষ সামাজিক জীব। দলবদ্ধভাবে জীবন-যাপন তার জন্য অপরিহার্য। যাতে সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একে অপরকে সাহায্য করতে পারে এবং বাড়াতে পারে সহযোগিতার হাত। এ উদ্দেশ্যেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলবদ্ধভাবে জীবন-যাপনের প্রতি উৎসাহিত করেছেন- 'যে ব্যক্তি লোকজনের সাথে মিশে এবং তাদের কষ্ট সহ্য করে সে ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম যে লোকজনের সাথে মিশে না এবং তাদের কষ্টও বরদাশত করে না।' (ইবনে মাজাহ: ৪০৩২) বলা বাহুল্য যে, সমাজের সকল মানুষ একই গোত্রীভূত হবে না। তাদের মধ্যে ধর্ম, মত ও পথের অমিল থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজে সকল সদস্যের পারস্পরিক সম্প্রীতি একান্ত জরুরী। যে একাত্মতা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির জনক ইসলাম সে একাত্মতার উন্মেষ ঘটিয়েছে মানবজাতির মধ্যে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- 'মানব জাতি এক জাতি বৈ ছিল না। তার পর তারা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে।' (সূরা ইউনুস: ১৯) অন্য আয়াতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- 'হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করেছি কেবল একে অন্যে চিনে নেয়ার জন্য। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে আল্লাহভীরু ব্যক্তিই সবচাইতে বেশি সম্মানিত।' (সূরা হুজুরাত : ১৩) মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত জনতার উদ্দেশে এ আওয়াজই বুলন্দ করেছিলেন- 'সকল প্রশংসা সেই মহান সত্তার, যিনি তোমাদেরকে মূর্খকালের অহংকার থেকে মুক্ত করেছেন। সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। আর আল্লাহ আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।' (তিরমিযি : ৩২৭০) সুতরাং একই পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে গোটা মানব জাতি ভাই ভাই; কেউ কারো পর নয়। সে জন্য এ পৃথিবীতে বসবাস করতে হবে একই পরিবারভুক্ত ভাই ভাই হয়ে অবিচ্ছেদ্যভাবে সৌহার্দ্য বজায় রেখে। দেখুন পারস্পরিক সম্প্রীতির গুরুত্ব সম্বলিত কুরআনের বাণী-'স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু। তারপর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের অন্তরসমূহে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তারই নেয়ামত স্বরূপ তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের মুখপ্রান্তে; তিনি তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।' (সূরা আলে ইমরান: ১০৩) 'মুমিন প্রীতির পাত্র, যে ভালবাসে না এবং যাকে ভালবাসা হয় না সে কল্যাণ বঞ্চিত।' (মুসনাদে আহমদ: ২২৮৪০) প্রতিবেশীই মুহাব্বতের প্রথম প্রয়োগস্থল। এ জন্যই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যৎসামান্য বস্তু হলেও প্রতিবেশীকে হাদিয়া পাঠাতে উৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- 'হে মুসলিম রমণীরা! কোন প্রতিবেশী যেন তার প্রতিবেশীর কোন বস্তুকে তুচ্ছ জ্ঞান না করে। তা ছাগলের একটি খুর হোক না কেন।' (বুখারী: ৬০১৭) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, 'ঝোল পাকালে বেশী করে পানি দাও এবং তোমার প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নাও।' (মুসলিম : ১৪২-২৬২৫) 'সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি দয়া ও মহানুভবতায় মুমিন বান্দারা এক দেহতুল্য। যখন কোন অঙ্গ ব্যথাক্রান্ত হয়, গোটা দেহ তার সমবেদনায় ভেঙ্গে পড়ে।' (মুসলিম: ৬৬-২৫৮৬) মুমিন বান্দাদের পারস্পরিক সম্প্রীতির অবস্থাটি উক্ত হাদীসে দারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি প্রতিবেশীর সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল। ইরশাদ হচ্ছে- 'আল্লাহর নিকট ঐ প্রতিবেশী সর্বোত্তম যে তার প্রতিবেশীর নিকট সর্বোত্তম।' (তিরমিযি) ইসলামের বদৌলতে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতির যে ঢেউ খেলেছিল, ইতিহাসে তা চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। এক বকরির মাথা সাত ঘর ঘুরে আবার প্রথম জনের নিকট ফিরে আসা অত্যাশ্চার্য নয় কি? সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ও জান্নাতী পরিবেশ যেন বিঘ্নিত না হয় তার জন্য প্রতিবেশীর প্রতি উদাসীন ব্যক্তির কঠোর নিন্দা করেছে ইসলাম। এমনকি তার ঈমান সম্বন্ধে আপত্তি তোলা হয়েছে।

ইরশাদ হচ্ছে- 'শপথ সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, কোন বান্দা নিজের জন্য পছন্দসই বস্তু তার ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করা পর্যন্ত (পূর্ণ) মুমিন হতে পারে না।' (মুসলিম: ৭২-৪৫) 'আল্লাহর শপথ! সে মুমিন নয়, কসম আল্লাহর! সে মুমিন নয়, খোদার কসম! সে মুমিন নয়। বলা হল, কে সে ইয়া রাসূলুল্লাহ? তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যার অত্যাচার থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।' (বুখারী: ৫৬৭০) 'যে ব্যক্তি পেট পুরে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী থাকে অভুক্ত, সে মুমিন নয়।' (বায়হাকী : ১৯৪৫২) সম্প্রীতির এ ঢেউ মুমিনের আঙ্গিনাতে থেমে থাকেনি, আছড়ে পড়েছে অমুসলিমেরও দুয়ারে। নিজ ঘরে বকরি জবাইয়ের সংবাদ শ্রবণে আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের উদ্বেগ কাতর স্বর- আমাদের প্রতিবেশী ইয়াহুদীর গৃহে তোমরা পাঠিয়েছ কি? তোমরা কি আমাদের প্রতিবেশী ইয়াহুদীকে হাদিয়া দিয়েছো? (তিরমিযি : ২০০৭)

পাশ্চাত্যবাদীরা অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে ইসলামকে সাম্প্রদায়িক ধর্ম বলে মনে করে। অথচ প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোন সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়। বিশ্ব স্রষ্টার বিধান বিশ্বের সকল মানুষের জন্য। আর এ কারণেই সংখ্যালঘুদের সাথে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যসুলভ সহাবস্থান বজায় রাখার জন্য উৎসাহ, পুরস্কার ও তিরস্কার সব ধরণের ব্যবস্থাই করেছে ইসলাম। কুরআনের বাণী- 'দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ ইনসাফগারদের ভালবাসেন।' (সূরা মুমতাহিনা: ৬০) সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা দিয়ে ইসলামের ঘোষণা, 'জিম্মিদের রক্ত আমাদের রক্তের মতই (হারাম), তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতই (হারাম)।' সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাইলফলক 'মদীনা সনদ' আজও বিশ্বের বিস্ময়। কাজেই ইসলামকে সাম্প্রদায়িক ধর্ম বলে চিহ্নিত করে ইসলামের সম্প্রীতি অস্বীকারের অপচেষ্টা চক্ষুষ্মানের অন্ধ সাজারই নামান্তর। 


আকাশ ছোঁয়া উদারতা

ক্লান্ত বিধ্বস্ত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। রক্তে রঞ্জিত সারা দেহ। পিচ্ছিল রক্ত শুকিয়ে পায়ে আটকে গেছে জুতো। খুলতে পারছেন না। এমন সময় ফেরেশতাদের সর্দার জিবরাঈল (আ.) অনুমতি চাইলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি চাইলে দু'দিকের পাহাড় চাপা দিয়ে বদ্বখত তায়েফবাসীর দফা-রফা করে দেই! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কণ্ঠে তখন উদারতার বাণী- 'ওরা বুঝে না, ওদের অনাগত খান্দান হয়তো বুঝবে।' আশ্চর্য এমন বেহাল অবস্থায়ও বদ-দোয়ার লেশমাত্র নেই মুখে।

উহুদের ময়দান। শিরস্ত্রাণের দু'দুটো কড়া ভেঙ্গে চোয়ালে ঢুকে গেছে। সেই তায়েফের পুনরাবৃত্তি! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দেহের পবিত্র রক্ত টপটপ করে ঝরছে। কী ব্যথা, কী বেদনা সে খেয়াল নেই দোজাহানের সর্দারের। প্রাণের শত্রুর বরবাদীর আশঙ্কায় ব্যস্ত হাতে রক্ত সামলাচ্ছেন তিনি। তাঁর ভয়, না জানি অন্যায়ভাবে নবীর খুন মাটিতে ঝরে, আর মহাক্রুদ্ধ কাহ্হারের ক্রোধাগ্নিতে ধ্বংস হয় কুফ্ফারে কুরাইশ। কী আকাশ ছোঁয়া উদারতা!

মুনাফেককুল শিরোমণি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল। যার দু'মুখো নীতির কারণে পদে পদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সেই উবাইয়ের কাফনে আমরা স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত কাপড়টি দেখতে পাই। এ যেন 'তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অজ্ঞদের উপেক্ষা কর' (সূরা আ'রাফ: ১৯৯)- এর বাস্তব নমুনা। খাদ্যদ্রব্যে বিষ মিশ্রণ, পাথর চাপা দিয়ে হত্যার প্রচেষ্টা, জাদুটোনার মাধ্যমে দীর্ঘ ছয় মাস অসুস্থতা ভোগসহ মদীনার ইয়াহুদী মুনাফেক চক্র কর্তৃক নবীজীকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার সকল ষড়যন্ত্র স্থান পেয়েছে ক্ষমা ও উদারতার নববী দস্তরখানে। তলোয়ারে নয়; উদারতার মন্ত্রবলেই ইসলাম জয় করেছেন মানব হৃদয়। 

এক ইয়াহুদীর নিকট থেকে ঋণ নিয়েছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সে ইয়াহুদী সাহাবায়ে কেরামের ভর মজলিসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামার গেরেবান চেপে ধরে বলল, মুহাম্মাদ! তোমাদের বংশের ধারাই এমন। ঋণ তো নাও কিন্তু পরিশোধ করতে টালবাহানা কর। লৌহমানব উমর ফারুক (রা.) তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইয়াহুদীকে শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু নবীজী তখন শান্ত ও স্থিরতার মূর্ত প্রতিক। বললেন, 'উমর! তার তো তাগাদা দেয়ার অধিকার আছে। তুমি আমাকে তার পাওনা আদায় করতে বলতে, আর তাকে উপদেশ দিতে নম্রতা অবলম্বনের! যাও, তার প্রাপ্য মিটিয়ে দাও এবং রূঢ় আচরণের কারণে কিছুটা বেশী দিয়ে দাও।'

এ প্রসঙ্গে সেই অতিথির কথাও স্মরণ করা যেতে পারে, যে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে শিশুদের খাবারসহ ঘরের সমুদয় আহার্য একাই ভক্ষণ করেছিল। রাতে পেটের পীড়ায় প্রকৃতির ডাকে সে বিছানা নষ্ট করে ফেলল এবং ভোর হওয়ার পূর্বেই পলায়ন করল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হলেন না; বরং তার ফেলে যাওয়া তলোয়ার বিনয়ের সাথে তাকে ফেরত দিলেন। উপরোক্ত উভয় ঘটনায় মুগ্ধ হয়ে ইয়াহুদীদ্বয় ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইসলামের উদারতার এমন হাজারও ঘটনা সমৃদ্ধ করেছে ইতিহাসের সোনালী পাতাগুলো। 

মক্কার দুর্বল ইসলাম নয়, মদীনার অপরাজেয় ইসলাম যখন কায় খসরুর রাজ দরবারে আঘাত হানতে শুরু করল, তখনও অবাক বিস্ময়ে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল ইসলামের উদারতা। সেদিন জন্মভূমি মক্কার পুনরুদ্ধারে ইসলামের অনুসারীদের দয়ার তলোয়ার প্রতিশোধের রক্তে রঞ্জিত হয়নি। ওয়াহশী, হিন্দা আর ইকরামা বিন আবু জাহালের মতো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরাও শুধু ইসলামের বদৌলতে উদারতার নিরাপদ চাদরে আশ্রয় পেয়েছিল। আরব জাহানের একচ্ছত্র অধিপতির মুখে 'তোমাদের তরে কোন অভিযোগ নেই' এর শাশ্বত বাণী। কাবার চাবিরক্ষক সেই উসমান যে হিজরতের পূর্বে ক্ষমতার দম্ভে নবীজীকে কাবাগৃহে প্রবেশ করতে দেয়নি, কাবার চাবি কিনা সেই উসমানকেই অর্পণ করা হয়েছিল সেদিন চিরকালের জন্য। শুধু নবী যুগেই নয়, খেলাফতে রাশেদসহ সর্বকালেই ইসলামের উদারতায় মুগ্ধ ছিল বিশ্ববাসী। '৫৮৩ হিজরী সনের ২৭ রজব মোতাবেক ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুদীর্ঘ ৯০ বছর পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ক্রুসেডারদের হাত থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করেন। এ সময় সুলতান সর্বসমক্ষে যে সদাশয়তা, উদারতা ও ইসলামী আখলাক চরিত্র প্রদর্শন করেন তা একজন খ্রিস্টান ঐতিহাসিকের লেখনীতে-'জেরুজালেম মুসলমানদের হাতে সোপর্দ করার মুহূর্তে সালাহুদ্দীনের অধীনস্থ সৈনিক ও দায়িত্বশীল অফিসারবর্গ শহরের অলিগলির শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। তারা ছিলেন যে কোন জুলুম ও বাড়াবাড়ির প্রতিরোধে সংকল্পবদ্ধ। ফলে সে মুহূর্তে কোন খ্রিস্টানকেই কোনরূপ দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়নি। মুক্তিপণ পরিশোধ করেছে এমন প্রত্যেক নাগরিককে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সুলতানের নির্দেশে অলিগলিতে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল- যে সমস্ত বৃদ্ধের মুক্তিপণ পরিশোধের সামর্থ নেই তারাও মুক্ত; তারা যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারে। এ ঘোষণার পর বাবুল বা'যার হতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আযাদকৃত লোকেরা দলে দলে বের হতে থাকে। শুধু তাই নয়, সুলতানের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার জন্য পথ্যস্বরূপ বরফ ও ফল- ফলাদি প্রেরণ করেন।

অথচ ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম বিজয়ের পর গডফ্রে ট্যাংকার্ড যখন সেখানকার গলি-ঘুপচিগুলো অতিক্রম করছিল তখন মুসলমানদের ওপর কি জুলুমই না তারা করেছিল। চতুর্দিকে শত শত লাশ পড়ে ছিল এবং আহতদের কাতর আর্তনাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাস। এমতাবস্থায় ক্রুসেডাররা ঐসব নিরপরাধ মুসলমানদের ভীষণ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছিল। এবং জীবিত লোকদের পুড়িয়ে মেরেছিল।'

পাশ্চাত্যের বন্ধুরা! তোমরা টুইন টাওয়ার ধসানোর অভিযোগে শাস্তিস্বরূপ আফগান ভূমিকে শ্মশানে পরিণত করলে। তেল সম্পদ কুক্ষিগত করার নেক নিয়তে ইরাককে করলে বধ্যভূমি। তোমাদের ইঙ্গিতেই মধ্যপ্রাচ্যে আজ ইসরাইলের বিষফোঁড়া। গুজরাট, কাশ্মীর, আরাকান, মিন্দানাওয়ের মুসলিম নিধনে তোমাদেরই কালো হাত। আমরা তো এর বদলা নিতে তোমাদের আমেরিকায় অভিযান ঘোষণা করিনি। ইংল্যান্ড-বৃটেন অভিমুখেও ছোটেনি আমাদের একখানা বোমারু বিমান। বরং তোমাদের পন্যসামগ্রী ক্রয় করে অর্থের যোগান দিয়ে, আমাদের বিমান ঘাঁটি দিয়ে সর্বোপরি আমাদের সেনাবাহিনী ব্যবহার করে সন্ত্রাসী (?) নিধনে উদারতার পরিচয় দিচ্ছি। 'হুজুরের মত চমৎকার! হুজুরের মতে অমত কার' জিগির তুলে, মৌলবাদ নিপাত যাক বলে আল্ট্রা মডারেট মুসলিম দেশের খেতাব কুড়াতে মাথা কুটে মরছি। তবু কি আমরা নন- মডারেটই থেকে যাব। উদারপন্থীর সনদখানা কি আমাদের কপালে জুটবে না কোন দিন?


সহিষ্ণুতা 

সহনশীলতা, মানুষের মহৎ গুণ। সহনশীতার কাঁধে ভর করে মানুষ পৌঁছুতে পারে অভীষ্ট লক্ষ্যে। পরম সহিষ্ণুতাকে কুরআন 'আযমিল উমুর' বা দৃঢ়সংকল্প করে নামকরণ করেছে। কুরআনের বাণী- '(নিপীড়িত হয়েও) যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, তা তো হবে দৃঢ়সংকল্পেরই কাজ।' (সূরা শুরা: ৪৩) অসহিষ্ণুতা ক্রোধেরই বহিঃপ্রকাশ। এজন্য ক্রোধ দমনের সীমাহীন গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনের ইরশাদ- 'যে ক্রোধ দমন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে দেয়, বস্তুত আল্লাহ অনুগ্রহশীলদের ভালবাসেন।' (সূরা নিসা: ১৩৪) হাদিসের বাণী- 'কুস্তিতে পরাভূতকারী (প্রকৃত) বাহাদুর নয়, বাহাদুর তো সেই যে ক্রোধের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণ করে।' (বুখারী: ৫৭৬৩) সহিষ্ণুতার প্রশংসা ও পুরষ্কার ছড়িয়ে আছে কুরআনের পাতায় পাতায় 'আল্লাহ তা'আলা সহিষ্ণুদের ভালবাসেন। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।' (সূরা বাকারা: ১৫৩) '(প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও) তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই তো উত্তম।' (সূরা নাহল: ১২৬) হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি তখনও স্বাক্ষরিত হয়নি। আবু জান্দাল নামক এক সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমানদের নিকট এলেন। তার সারা গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন। হাতে-পায়ে লৌহশৃংখল। মক্কার কাফেররা তাকে ফেরত নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করল। নবীজী তাদেরকে যুক্তি দেখালেন, 'অস্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রের অঙ্গীকার মানায় বাধ্যবাধকতা নেই।' কিন্তু তারা বেঁকে বসল। কিছুতেই ছাড়বে না আবু জান্দালকে। শেষ পর্যন্ত নবীজী তাদের কাছে ভিক্ষা চাইলেন আবু জান্দালকে। কিন্তু তাদের অনড়তায় শুধুমাত্র শান্তির স্বার্থে মজলুম সাহাবীর সকাতর মিনতি 'আমি মুসলমান হয়ে কী নিদারুণ দুঃখ- যাতনা ভোগ করে এখানে এসেছি। এখন আমাকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে' সত্ত্বেও তাদের উদ্ভট ও অযৌক্তিক দাবী মেনে নিলেন। রেখে গেলেন আবু জান্দালকে। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেই উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের সংবাদে নবীজীর হাতে আমরণ সংগ্রামের শপথ নেয়া ১৫০০ সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কী অপূর্ব সহিষ্ণুতা, ধৈর্যের কী চরম পরাকাষ্ঠা। (বুখারী: ২৫৫৩, ফাতহুল বারী)

হযরতের কন্যা যয়নবকে স্রেফ ইসলামের সাথে বিদ্বেষবশত বর্শাঘাতে উটের পিঠ হতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় তার গর্ভপাতসহ মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছিল। কিন্তু নীরবে সয়ে গেলেন দয়াল নবী। (খামীস)

বেলাল হাবশী, আবুজর গিফারী, আম্মার, ইয়াসার, সুমাইয়া, খাব্বাব ইবনে আরতসহ নাম জানা-অজানা কত অসংখ্য সাহাবী ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অনলে দগ্ধ হয়েছেন তার হিসাব কে রেখেছে কোন দিন। তাছাড়া রক্ত ভেজা তায়েফ তো তোমাদেরকে প্রতিনিয়ত সহিষ্ণুতারই সবক শেখায়।

'সয় যে রয় সে'- একথা পরম সত্য। ইতিহাস তো তাই বলে। কোথায় আজ সেসব মুনাফেক দাম্ভিকেরা! যারা বলেছিল, আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে সেখান থেকে প্রবলেরা অবশ্যই দুর্বলদের (মুসলমানদের) বহিষ্কার করব। (সূরা মুনাফিকুন: ৮) অথচ ওহীর মাধ্যমে তাদের এ উদ্ধত ও ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ অবগত হওয়ার পর এবং প্রতিশোধের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ইসলামের সৈনিকেরা সহিষ্ণুতার অভয় পতাকা উড়িয়েছিলেন। ওদের পরিণতি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়, এদের পরিণাম মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখর। ওরা পলীদ, ভাগাড়ের মাটি, এরা স্বর্ণ; সহিষ্ণুতার অনলে দগ্ধ নিখাদ খাঁটি। 

দান করা ভালো কিন্তু নিজেকে পথে বসিয়ে নয়। নিজেকে বিবস্ত্র করে অন্যের লজ্জা ঢাকাও ভালো কথা নয়। এজন্যই সম্প্রীতি ও উদারতার ক্ষেত্রে সীমার বাঁধন রয়েছে ইসলামের। উদারতার পরিচয় দিতে গিয়ে যদি ইসলামকেই বিকৃত করা হয়, সম্প্রীতির বাঁধন আঁটতে গিয়ে ইসলামের গ্রন্থিতেই যদি ঢিল পড়ে এবং জলাঞ্জলি দেয়া হয় ধর্মীয় অনুভূতি, সভ্যতা ও কৃষ্টি কালচার তাহলে সেটা অবশ্যই নিন্দনীয়। কেননা 'স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য অবৈধ ও হারাম'। মূলত পরস্পরে অহিংস মনোভাব বজায় রেখে নিজ নিজ ধর্ম পালনে ব্যাপৃত থাকলে, মানবিক প্রয়োজনে একে অপরকে মন উজাড় করে সহযোগিতা করলে এবং কেউ কারো ধর্ম-কর্মে হস্তক্ষেপ না করলেই সাম্প্রদায়িক উদারতার প্রমাণ মেলে। মণ্ডপ, মন্দির দৌড়ে কিংবা বড়দিনের অনুষ্ঠানে সশরীরে হাজিরা দিয়ে উদারতা প্রদর্শনের কোশেশ নিষ্প্রয়োজন। ইসলাম আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সুতরাং ছাড়াছাড়ি কিংবা বাড়াবাড়ি নয়, বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা অপরিহার্য।


শেষ কথা

সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসীরা যখন সন্ত্রাসের ভিত্তিহীন বানোয়াট অভিযোগ মুসলিম উম্মাহর নবজাগরণের প্রাণসংহারে লিপ্ত, তখন উপসংহারের আঁচড় টানা যুক্তিসঙ্গত কিনা সে তর্কে যাচ্ছি না। তবে উপযুক্ত আলোচনার নিরিখে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সন্ত্রাস নয়, শান্তি, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরম সহিষ্ণুতার ধর্ম ইসলাম। যদি তাই না হবে তাহলে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃব্য হামযার (রা.) হন্তারকের গর্দান থেকে প্রতিশোধের খঞ্জর অপসারণ করে কে তার নিরাপত্তার জামিন হয়েছিল? কে কেড়ে নিয়েছিল দুর্ধর্ষ উমরের খুন পিয়াসী তলোয়ার? প্রতিবেশী ইয়াহুদীর ঘরে খাবার পৌছানোর জন্য উদ্বিগ্ন হতে কে বাধ্য করেছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-কে? 'যে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়', 'অশান্তি যুদ্ধ হতেও গুরুতর', 'জিম্মির রক্ত মুসলমানেরই রক্ত, তার সম্পদ মুসলমানেরই সম্পদ (এর মতোই হারাম)', 'ধর্ম গ্রহণে জবরদস্তি নেই' কোন ধর্মের বাণী? কার তাগিদে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রা.)-এর দায়েরকৃত মামলায় যথাযথ প্রমাণের অভাবে অন্যায় দাবিদার ইয়াহুদীর পক্ষে রায় দিয়েছিল ইনসাফী আদালত? সর্বোপরি অসভ্য, বর্বর, অন্ধকার আরবকে সর্ববিধ পাপাচার থেকে কে নিরস্ত করেছিল? কে দেখিয়েছিল প্রকৃত সভ্যতার আলো ঝলমলে পথ? ইসলাম নয় কি? আর এসব কি ইসলামের শান্তি, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরম সহিষ্ণুতার ঘোষণা করে না? বস্তুত ছাই চাপা পড়ে নিষ্প্রভ হওয়ার বস্তু আর যাই হোক ইসলাম নয়।

'ওরা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভাতে চায়; কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।' অপবাদের নেকাব ছিড়েফুড়ে সত্য উদ্ভাসিত হবেই। এটাই নিয়ম, এটাই চিরন্তন। তবে সতর্ক থাকতে হবে ইসলামের অনুসারীদের। ইসলামের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে ওলামায়ে কেরামসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে। আর আক্ষেপ এখানেই। কবির ভাষায়-'ঘূর্ণিবায়ু তিমির নিশি তুফান তোলা ঢেউ, দুলিতেছে তরী নোঙর ছিড়ে, ঘুমিয়ে মাঝি সেও।' অতএব, সতর্কতা কাম্য। তবেই শান্তি- সম্প্রীতি, উদারতা ও পরম সহিষ্ণুতার পতাকাবাহী ইসলামের বিজয়।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →