প্রবন্ধ

ওলী হওয়ার সহজ পথ

লেখক:মুফতী আব্দুল বারী
২৫ নভেম্বর, ২০১৮
৬০৫৪ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]


হামদ ও সালাতের পর…

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে আজ এখানে একত্র করেছেন ইলমের খাতিরে, দীনের নিসবতে। তোমাদের জন্য পাওয়ার হাউজতুল্য এই জামি'আর বাগানের মধুমক্ষিকা ছিলে তোমরা। আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছো দেশের আনাচে কানাচে। তো বছরের একটা দিন একত্র হলে সবার সাথে সবার মুলাকাত হয়। এটাই বা কম কী? উলামায়ে কেরামের যিয়ারতও ইবাদত। তো সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আজকে তোমরা এখানে একত্রিত হয়েছো। তোমাদের মুখগুলো দেখে খুব ভাল লাগছে। শোকর আল্লাহর! আলহামদুলিল্লাহ!!

ইলমের সংজ্ঞা 

আমি তোমাদের সামনে যে আয়াতটি পাঠ করেছি- إنما يخشى الله من عباده العلماء এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বিশেষ করে এবং বড় আদর করে উলামাদের শানে বলেছেন, ‘তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে তাঁকে কেবল উলামায়ে কেরামই ভয় করে।'এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী রহ. লিখেছেন, এ আয়াতে    علم ও خشية এর মাঝে علة ও معلول এর সম্পর্ক। خشية হল علة আর علم হল معلول । নিয়ম আছে, علة কখনো তার معلول থেকে পৃথক হয় না, একটা অপরটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। অর্থাৎ যে علم এর মধ্যে خشية আছে, সেটাই আল্লাহর নিকট প্রকৃত ইলম, আর যে ইলমের মধ্যে خشية নেই আল্লাহর নিকট তা কোনো ইলমই নয়। সুতরাং যে আলেমের মধ্যে خشية  আছে তিনিই আল্লাহর দরবারে প্রকৃত আলেম। যার মধ্যে এই خشية থাকবে না আল্লাহর নিকট সে প্রকৃত আলেম নয়। 

خشية এর ফায়দা

خشية ই মূল। আল্লাহর خشية ভয়-ভীতি থাকলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সফলতা আর কামিয়াবী অর্জন করা যায়। আল্লাহর ওলী হওয়া যায়। কেননা خشية এর কারণেই সুন্নাতের اتباع হয়। আর সুন্নাতের ইত্তিবা দ্বারা ওলী হওয়া যায়। আর ওলী হতে পারলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা আছে, الا ان اولياء الله لاخوف عليهم ولاهم يحزنون “শুনে রাখ! যারা আল্লাহর ওলী তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তারও কোনো কারণ নেই।'

ওলী কারা ?

আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন, الذين آمنوا وكانوا يتقون ‘ওলী হল তারা... সঠিকভাবে ঈমান আনে যারা, আল্লাহকে ভয় করে- তাকওয়া হাসিল করে যারা। তাকওয়ার অর্থ হল- امتثال الأوامر واجتناب عن النواهى “পালনীয় বিষয়গুলো সুন্নাত তরীকায় মানা আর বর্জনীয় বিষয়গুলো বিলকুল বর্জন করা।' (তাফসীরে বায়যাবী) এরই নামই তাকওয়া। এই তাকওয়া যাদের মধ্যে আসে তারাই ওলী হয়। বুঝা গেল তাকওয়াই হচ্ছে আসল পুঁজি। আল্লাহ তা'আলা বলেন,ومن يتق الله يجعل له مخرجا “যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য সকল সমস্যার সমাধান বের করে দেন।' (সূরা তালাক : ২-৩)

আমরা চিন্তা করলে দুই ধরণের চিন্তা করে থাকি; ১. বিভিন্ন সমস্যার কারণে চিন্তা। ২. রিযিকের জন্য চিন্তা। এখন এ দু'টোর মধ্য থেকে রিযিকের চিন্তাও কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার চিন্তার মধ্যে শামিল। তারপরও রিযিকের কথা আলাদা উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, মানুষ রিযিকের জন্যই বেশি পেরেশানী উঠায়, বেশি পেরেশান হয়। টাকা ও খাবারের সমস্যাই মানুষের কাছে বড়। রিযিকের অভাবেই মানুষ চুরি, ডাকাতি, সুদ- ঘুষসহ যাবতীয় হারাম কাজে লিপ্ত হয়। যার দরুণ মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়, আখলাক খারাপ হয়ে যায়। অতএব তোমরা যদি রিযিকের পেরেশানী দূর করতে চাও এবং যাবতীয় সমস্যার সহজ সমাধান পেতে চাও তাহলে তাকওয়ার গুণ হাসিল করতে হবে। তাকওয়া হাসিল হয়ে গেলে সকল সমস্যার সহজ সমাধান পেয়ে যাবে। কোথায় থাকবে, কোথায় খাবে, কী খাবে, সব দূর হয়ে যাবে। সুতরাং তাকওয়া অর্জনের পেছনেই মেহনত করতে থাক। টাকার পেছনে দৌড়ালে পেরেশানী দূর হবে না। সকল সমস্যার হল্ল আসবে না। এ সব কিছুর সমাধান আর হল্ল একমাত্র তাকওয়া অর্জনের মধ্যে পাওয়া যায়। রিযিকের গোড়া হল তাকওয়া। অতএব তাকওয়া অর্জন কর। সকল প্রকার গুনাহ ছাড়। সুন্নাতের উপর চল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,من أحب سنتي فقد احبني ومن احبني كان معي في الجنة. রাসূলকে ভালবাসার সোজা পথ, রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণ। তার সাথে জান্নাতে যাওয়ার সোজা পথ, ইত্তেবায়ে সুন্নাত'।

বুঝা গেল রাসূলের সাথে জান্নাতে থাকতে হলে সুন্নাতের অনুসরণ অপরিহার্য। এর দ্বারা তাকওয়া হাসিল হবে। আর তাকওয়ার কারণে সব কিছুই আমাদের হাতে চলে আসবে। যে রিযিকের জন্য আমরা দিবানিশি পেরেশানী উঠাই সে রিযিকের অভাবও দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। 

রিযিক কী ? 

আল্লামা কাযী বাইযাবী রহ. বলেন,রিযিক হল ما ينتفع به ‘যে জিনিসের দ্বারা ফায়দা উঠানো যায়' তার সবই রিযিক। এর মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, ঘর-বাড়ি, স্ত্রী- সন্তান, পোশাক-আশাকসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর সবই আল্লাহ তা'আলা ব্যবস্থা করে দিবেন। তোমার চিন্তায়ও ধরবে না যে, কোত্থেকে তা আসছে। সুতরাং তাকওয়া অবলম্বন কর। রিযিকের ব্যবস্থা তিনিই এমন জায়গা থেকে করবেন, যার চিন্তা করতে গেলে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে।


وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لا يَحْتَسِبُ


এমন স্থান থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করবেন যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।' এটা আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহর ওয়াদার ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ আছে? না..কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? কেননা ومن أصدق من الله قيلا ‘আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী আর কে আছে'? দেখবে এই ওয়াদা মোতাবেক এমন অবস্থা হবে যে, তোমার প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুমি কিছুই টের পাবে না। কিন্তু আল্লাহ তোমার দ্বারাই সব করাবেন। তোমাকে ব্যবহার করবেন, তোমাকে কাঁদাবেন, তোমার চোখের পানি ফেলাতে ফেলাতে কাজ নিয়ে নিবেন।

চোখের পানি ফেলো!

মনে রাখবে, আল্লাহর দরবারে চোখের পানি বড় পছন্দের জিনিস, বেশ দামী জিনিস। চোখের পানি ছাড়া কিছুই হয় না। চোখের পানি ছাড়া কোন জিনিসের সমাধান হয় না। পক্ষান্তরে চোখের পানির দ্বারা অনেক কিছুরই সমাধান পাওয়া যায়। এজন্য যখনই কোন পেরেশানী আসে দুই রাকআত সালাতুল হাজত পড়ে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলে চাইবে। চোখের পানি ফেলে আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে তোলো, দেখবে আল্লাহ দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। কারণ তার কাছেই তো রয়েছে সব কিছুর খাযানা, যা কেবল আমাদেরই জন্য, তার তো কোনো কিছুর দরকারই নেই। তাই যত রিযিক আমাদের প্রয়োজন তা আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে। এ বিশ্বাস মনে বদ্ধমূল করে নিতে পারলে আর বড় লোকদের পেছন পেছন দৌড়াতে হবে না।

ইলমকে যলীল করো না

ইমাম বুখারী রহ. এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র বাব (অধ্যায়) লিখেছেন। যার সারাংশ হল, ইলমকে যলীল-অপদস্ত করো না। অর্থাৎ ইলম শিখে পয়সাওয়ালাদের পিছনে দৌড়ে, তাদের জুতা উঠিয়ে নিজেকে এবং নিজের ইলমকে যলীল করবে না, উলামায়ে কেরামকেও অপমান করবে না। তুমি বরং যে কোন হাজতে আল্লাহর কাছে হাত উঠাও, তার কাছেই চাও, দেখবে দেয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত। আসলে দেনেওয়ালার অভাব নেই, লেনেওয়ালারই অভাব। তোমরাই বল, আল্লাহর কাছে কোন কিছুর অভাব আছে? আল্লাহ كن বললেই তো সব হয়ে যায়।


إذا اراد شيئا ان يقول له كن فيكون


তিনি কিছুর ইচ্ছা করলে كن বললেই হয়ে যায়।' এক কোটি টাকার প্রয়োজন? আল্লাহ كن বললেই এসে যাবে। কিভাবে আসবে বুঝতেও পারবে না। আল্লাহর কাছে এক কোটি আর এক টাকা সবই সমান। কোন পার্থক্য নেই। এক টাকাও كن দ্বারা আসে। লক্ষ-কোটি টাকাও كن দ্বারাই আসে। সুতরাং যা কিছু চাওয়ার আল্লাহর কাছেই চেয়ে নিবে।

গনীমত মনে করো

বাবারা! মাদরাসার খেদমতও একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা চাই। যার কাছে সব কিছুর খাযানা, তাকেই রাজি করে নাও, সব পেয়ে যাবে। যারা দরস-তাদরীসের খেদমতে লাগতে পেরেছো, এটাকে গনীমত মনে কর। আমি তো এই দু'আ করি যে, যত ছাত্র ফারেগ হয়েছে এবং যারা ফারেগ হচ্ছে বা হবে আল্লাহ তা'আলা তাদের সকলকে দীনের খাদেম বানান। আল্লাহ যেন একশ'র মধ্যে একশ'কেই তাঁর ওলী বানিয়ে নেন। সব সময়ই আমি এই দু'আ করে থাকি। আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের মাদরাসার ফারেগীনদের সকলকেই দেখলাম, মাশাল্লাহ্ দীনের খেদমতে আছে। এটা আল্লাহর বড় ফযল ও করম। অতএব তোমরা দীনের কোন খেদমতকেই ছোট মনে করো না। তুমি হেদায়াতুন্নাহব পড়াও, বুখারী শরীফ পড়াতে পারছো না এজন্য মন খারাপ করো না। মনে রাখবে, তুমি যদি ইখলাসের সঙ্গে হেদায়াতুন্নাহব বা যে কোন ছোট কিতাবই পড়াও আর কেউ বুখারী শরীফ পড়ায় আমিত্ব দেখানোর জন্য তাহলে তুমিই তার চেয়ে উত্তম, তুমিই তার থেকে অনেক বড়। নূরানী বা হেফজখানায় পড়াও, মন ছোট করো না। কারণ আমি তো বলি, যারা নুরানী বা হেফজখানায় পড়ায় তারা বড়ই ভাগ্যবান। শুধু তা-ই নয়, তারাই প্রথম সারির ভাগ্যবান। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,خيركم من تعلم القرآن وعلمه 'তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যিনি (এখলাসের সাথে) কুরআন শিক্ষা করেন এবং শিক্ষা দেন। ইবতিদায়ী থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত, এমনিভাবে আদব, ফুনুনাত, ইফতা, উলূমুল হাদীস বা তাফসীর এগুলোর মধ্যে কুরআন আছে বিল ওয়াসেতা বা ভায়া হয়ে। পক্ষান্তরে সরাসরি কুরআন আছে কোথায়? মকতবে, নাযেরায় আর হেফযখানায়। হেফয না পড়লেও কমপক্ষে মক্তব পড়া ছাড়া বা কুরআন শরীফ পড়া ছাড়া কেউ আলেম হতে পারে? পারে না। আর হাফেয সাহেবদের কথা কী বলব! হাঁটতে, বসতে, শুইতে সব সময় কুরআন তাদের সাথে থাকছে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হয়তো পড়ছে নয়তো শুনছে, কুরআন ছাড়া তারা থাকতেই পারছে না। এমনকি এটা ছাড়া তাদের অন্য কোন কাজের সুযোগও নেই। কেউ যত বড় আলেমই হয়ে যাক ফাউণ্ডেশন কাদের হাতে গড়া? আপনাদের হাতে গড়া। অতএব মন ছোট করার কোন কারণ নেই। 

হাফেযদের সাথে পারা যায় না

হাদীস শরীফে এসেছে ,من قرأ القرآن حرفا فله عشر حسنات যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পড়ে তার জন্য দশটি নেকী লেখা হয়।' সুতরাং নেকী কামাইয়ের ক্ষেত্রে বা ইবাদত করে হাফেজ সাহেবের সঙ্গে কে পাল্লা দিতে পারবে? এজন্য আমি বলি, “হাফেজদের সঙ্গে ইবাদত করে পারা যায় না।' তবে শর্ত হচ্ছে ইখলাস। ইখলাস না থাকলে এ সকল মেহনত বিফলে যাবে। আপনাদের এই যে এত সম্মান নবীজী দিয়ে গেছেন এগুলোর উপযুক্ত হতে হলে শর্ত হল ইখলাসের সঙ্গে খেদমত করতে থাকা। ইখলাস না থাকলে সব বরবাদ হয়ে যাবে। সুতরাং ইখলাসের সঙ্গে নুরানী নাযেরা আর হেফজখানার খেদমতকে ছোট মনে করা যাবে না। বরং এটাকে গনীমত মনে করতে হবে। অনেকে আছে, যদি জিজ্ঞেস করি, কী কর? একেবারে ছোট হয়ে বলে, হেফজখানায় পড়াই! তার হাবভাব দেখে মনে হয়, হেফজখানায় পড়ানোর খেদমত করে না জানি সে কতটা ঠকে গেছে? মক্তবের কথা বললে তো আরো ছোট হয়ে যায়। এমনটি না হওয়া চাই।

মিয়াজী নূর মুহাম্মাদ যানযানারী রহ 

মিয়াজী নুর মুহাম্মাদ যানযানাবী রহ.-এর নাম তো সবাই শুনেছো নিশ্চয়ই। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর পীর ছিলেন। হাজী সাহেব বাইয়াত হবেন কার কাছে এ নিয়ে খুব চিন্তা করছিলেন। আর মনে মনে কাঙিক্ষত ব্যক্তিটিকে তালাশ করছিলেন। একরাতে স্বপ্নে দেখেন, এক মজলিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ এনেছেন। পাশে মিয়াজী নূর মুহাম্মদ ও অন্যান্য আরো কয়েকজন উপস্থিত। নবীজী তাকে মিয়াজী নূর মুহাম্মদ-এর দিকে ইশারা করে বলছেন, এর কাছে বাইয়াত হও! এটা তো ছিল স্বপ্নের কথা। কিন্তু কে এই ব্যক্তি, কোথায় থাকেন, কিভাবে পাওয়া যাবে কিছুই জানা ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন, কিন্তু এই চেহারার মানুষটিকে পেলেন না। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, এমন এমন চেহারার এক ব্যক্তিকে আমি খুঁজছি, তিনি কে? কোথায় পাওয়া যাবে? ঐ ব্যক্তি চেহারা ও দেহাবয়বের বর্ণনা শুনে বললেন, আমার জানামতে মিয়াজী নূর মুহাম্মাদ নামে এক লোক আছে, আপনার বর্ণনা মোতাবেক সে-ই হবে মনে হয়। তার কথা শুনে হাজী সাহেব যানযানার উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। চলতে চলতে একপর্যায়ে হযরত যানযানাবী রহ.-কে পেয়ে গেলেন। তিনি হযরত যানযানাবীর প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে সামনে এগোচ্ছিলেন। কাছাকাছি হওয়া মাত্রই হযরত যানযানাবী তাকে বলতে লাগলেন, স্বপ্নকে আবার এত গুরুত্ব দিতে হয় নাকি? স্বপ্নে দেখে পাগল হয়ে গেছো? হাজী সাহেব তাজ্জব বনে গেলেন যে, স্বপ্নের কথা তিনি জানলেন কিভাবে? কার সাথে তার সম্পর্ক? কে তাকে জানাল? বস্তুত তার সম্পর্ক তো ছিল আল্লাহর সঙ্গে। তিনিই তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইমদাদুল্লাহ স্বপ্নে দেখেছে, তোমার কাছে বাইয়াত হবে এবং এজন্য সে তোমার কাছে আসছে। মোটকথা হাজী সাহেব আশ্চর্য হলেন এবং তার দিল আরো প্রশান্ত হল । অবশেষে তার কাছে বাইয়াত হলেন এবং পরবর্তীতে তার খেলাফত লাভেও ধন্য হলেন। হযরত নূর মুহাম্মাদ যানযানাবী রহ.মক্তবে পড়াতেন বিধায় তাকে মিয়াজী বলা হত। এবার চিন্তা করে দেখ, মক্তবে পড়ানো কোন ছোট পদ নয়, বরং অনেক বড় পদ। কারণ আমাদের মুরুব্বীদের মুরুব্বী মক্তবে পড়াতেন। হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. মক্তবের বড় আশেক ছিলেন। কোথাও মক্তব কায়েম হয়েছে জানতে পারলে দৌড়ে যেতেন। নূরানী হোক নাদিয়া হোক সবখানেই যেতেন। কারণ নূরানীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা বেলায়েত হুসাইন সাহেব রহ. আর নাদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব রহ. উভয়েই হযরত হাফেজ্জী হুযুরের খলীফা ছিলেন। হুযূর তাদেরকে মক্তবের খেদমতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

অতএব বাবারা! যারা মক্তবে খেদমত করছো নিজেকে ছোট মনে না করে হুশিয়ার থাক। মরা মানুষের মত চুপ করে বসে না থেকে বরং মজবুতভাবে পড়াতে থাক। প্রয়োজনে দশটা ট্রেনিং গ্রহণ করবে। ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে মু'আল্লিমুল মু'আল্লিমীন হয়ে যাবে। এভাবে মজবুতির সঙ্গে মক্তব চালাতে পারলে দেখবে দাওরা পর্যন্ত মাদরাসার যে সুনাম, তোমার মক্তবেরও সেই সুনাম অর্জিত হবে। দাওরা পর্যন্ত মাদরাসার দ্বারা যে ফায়দা হবে, তোমার মক্তবের দ্বারাও সেই ফায়দা হবে। 

বেশভূষা ঠিক রেখো

বুযুর্গানে দীনের তরীকা ছেড়ো না। তাদের লেবাস ছেড়ো না। আফসোস! কোন কোন ছাত্র মাদরাসার পরিবেশে ছিল একরকম, এখন দেখা যায় অন্য রকম। তারা ইজতিহাদ করে। তোমরা ইজতিহাদ করতে যেও না। কেউ কেউ জামা-টুপি বদলে ফেলে। তোমরা করবে না। আমরা যে পাঁচকল্লি টুপি মাথায় দেই। এটা হযরত থানভী রহ এর পসন্দীদা তরীকা। এটা ফরজ-ওয়াজিব নয় যে, এটাই পরতে হবে। আর দুইকল্লি বা কিস্তি টুপি হযরত মাদানী রহ.-এর তরীকা। এটা তিনিও পরতেন এবং তার মুরীদরাও পরে থাকেন। টুপি যেটাই হোক যদি মহব্বতের সঙ্গে মাথায় দেয়া হয় তাহলে বরকত পাওয়া যাবে। আর যদি লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে হয় তাহলে কেয়ামতের দিন তা আগুনের টুপিতে রূপান্তরিত হবে। 

প্রয়োজনীয় শান-শওকতও থাকা চাই

উলামায়ে কেরামের শান-শওকত থাকা চাই। এটা ইখলাসের পরিপন্থী কিছু নয়। বরং এটা আরো বেশি পছন্দনীয় কাজ। ইখলাসের সাথে ইলমের মান রক্ষার্থে শান-শওকত থাকতে পারে। তবে নিয়ত বিশুদ্ধ থাকতে হবে। তাহলে সাওয়াবও পাওয়া যাবে। আমাদের আকাবিরদের মধ্যে এর বহু নযীর আছে। শুধু একজনের কথা বলি, হযরত ইমাম মালেক রহ. যখন দরসে বা কোন ইলমী মজলিসে যেতেন তখন গোসল করতেন। ভাল পোশাক পরিধান করতেন। আতর- সুগন্ধি লাগাতেন। এরপর শাহী আন্দাযে মসনদে তাশরীফ নিতেন। তাদের নিয়ত দুরস্ত ছিল বিধায় তারা বরকত পেয়েছেন। সুতরাং আমরাও যদি শান- শওকত অবলম্বন করতে চাই তাহলে বিশুদ্ধ নিয়তে করতে হবে। আলেমদের মরা মুর্দার ন্যায় চলা উচিত নয়। বরং বুকের মধ্যে বল নিয়ে চলতে হবে।

গোপন গুনাহও ছাড়তে হবে 

যাই হোক, তোমরা সব ফিকির ছেড়ে দিয়ে এক ফিকির ধর। ইত্তিবায়ে সুন্নাতের ফিকির কর। সব কাজে সুন্নাতের অনুসরণ কর। আর একটা গুনাহও করবে না। বিশেষ করে চোখের গুনাহ, মুখের গুনাহ এবং লজ্জাস্থানের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। অনেকে আছে স্বাভাবিক গুনাহ করে না। কিন্তু বাতেনী গুনাহ করতে থাকে। সেগুলোও ছাড়তে হবে।

১. 'বদ নযর'। বদ নযর যেমনিভাবে পর-নারীদের দিকে হয়। এক্ষেত্রে অনেকে বিবাহ করেও কুদৃষ্টি করে, অনেক বিবাহ না করেও কুদৃষ্টি করে। মহিলারা সামনে এলেই দেখতে মনে চায়। আসলেই দেখতে মনে চায়। আলেম মানুষ চুপে চুপে দেখে যেন মানুষ দেখে না ফেলে। তাই হিম্মত করবে যে, বিশ্বসুন্দরী সামনে আসলেও তাকাব না। কারণ বিশ্বসুন্দরীর চেয়ে বেশী সুন্দরী হবে জান্নাতী হুর। বিশ্বসুন্দরীর চেয়ে বেশী আকর্ষণীয় হবে তারা। বিশ্বসুন্দরী তো গান্ধা-পঁচা। এখন তার রুপ আছে। কয়েকদিন পর তার গাল ভেঙ্গে যায়। এদিক দিয়ে লালা পড়ে। ওদিক দিয়ে লালা পড়ে। দেখতেও বিশ্রী দেখায়। তখন কেউ তাকে দেখতেও চায় না। পক্ষান্তরে জান্নাতের হুরগণ হবে মুতাহহারাত-পবিত্র। যাদের রুপ-লাবণ্য দিন দিন বাড়তেই থাকবে। সুতরাং যত কিছুই সামনে আসুক চোখ উঠিয়ে তাকাবে না। নিজে না পারলে শাইখের শরণাপন্ন হবে। তাহলে আশা করা যায়, দুনিয়ার হুরের প্রতি বদ নযর থেকে বাঁচার কারণে জান্নাতী হুরের মালিক হতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

তেমনিভাবে আমরদ-দাড়িবিহীন সুশ্রী বালক-বাচ্চাদের দিকেও বদ নযর হয়। তাই তাদের থেকেও নযর হেফাজত করতে হবে (কোনো প্রয়োজনে তাদের দিকে তাকাতে হলে চোখ খুলে ভাল করে তাকাবে না। বরং ভাসা-ভাসা নযরে তাকাবে)। কেননা এটা এমন গুনাহ যা সবার সামনে হলেও কেউ টের পায় না। হাদীসে এটাকে 'বিষাক্ত তীর' বলা হয়েছে। বিষাক্ত তীর লাগলে যেমনিভাবে মানুষ মরে যায়। তদ্রুপ বদ নযরও কলবকে মেরে ফেলে। আমলের নূর খেয়ে ফেলে। এর দ্বারা অন্যান্য গুনাহের দ্বার খুলে যায়। তাই যত কষ্টই হোক নযর হেফাজত করতে হবে। এটাকে হেফাজত করতে পারলে হাদীসে বলা হয়েছে,وجَدَ حلاوَةَ الإيمانِ ‘ঈমানের স্বাদ পাওয়া যাবে।' আল্লাহ আমাদেরকে ঈমানের স্বাদ নসীব করুন। 

২. গালি-গালাজ করা। যে কাউকেই হোক গালি দেয়া ভালো কাজ নয়। এটা মুনাফিকের কাজ। হাদীসে পড়েছো سباب المسلم فسوق কোনো মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী' কাজ। যা মুনাফেক হওয়ার একটা আলামত। সুতরাং_তলেবে ইলেমদেরকেও কখনো গালি-গালাজ করবে না।

৩. আরো কিছু গুনাহ মুখের দ্বারা হয়ে থাকে। যেগুলো করতে খুবই ভাললাগে। ঘি দিয়ে ভাত খেলে যেমন মজা লাগে তদ্রুপ মুখ দিয়ে এ গুনাহগুলো করতেও খুব মজা লাগে। যেমন : গীবত, শেকায়েত, চোগলখুরী, কূটনামী, অন্যের দুর্নাম-বদনাম ইত্যাদি। অথচ কুরআনের ভাষায় এগুলোকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান বলা হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ!

গুনাহের উৎপত্তিস্থল

যে সমস্ত গুনাহের আলোচনা হল এগুলোর উৎপত্তি স্থল দু'টি, ১. দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান তথা পুরো চেহারার অন্তর্গত চোখ, মুখ ইত্যাদি। ২. দুই রানের মধ্যবর্তী স্থান তথা লজ্জাস্থান। এগুলো হেফাজত করতে পারলে নবীর বাণী হল من يضمن لي مابين لحييه ومابين رجليه اضمن له الجنة 'যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান ও দুই রানের মধ্যবর্তী স্থানকে হেফাজতের গ্যারান্টি দিতে পারবে আমি তাকে জান্নাতের গ্যারান্টি দিচ্ছি।' অতএব চোখ ও মুখের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখ। চোখ কোথায় যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখ। মোটকথা তোমরা পরিপূর্ণ সুন্নত তরীকায় চল। সকল রকম গুনাহ বর্জন কর। তাকওয়া হাসিল কর। দেখবে, সম্মান তোমার খুঁজে বেড়াতে হবে না, সম্মানই তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। 

সম্মান কীসে

তুমি শুধু তাকওয়া-খোদাভীতি তালাশ কর। এতেই চারদিক থেকে সম্মান আসতে থাকবে। সকলেই তোমাকে সম্মান করবে। সম্মান তো আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ কোন বান্দাকে মহব্বত করলে জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে বলে দেন, অমুক বান্দাকে আমি মহব্বত করি, তুমিও তাকে মহব্বত কর। অতঃপর হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আসমানের সকল ফেরেশতাকে বলে দেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে মহব্বত করেন তাই আমিও তাকে মহব্বত করি, অতএব তোমরাও তাকে মহব্বত কর। এভাবে সমগ্র পৃথিবীতে তার ডংকা বাজিয়ে দেয়া হয় যে, তোমরাও তাকে মুহাব্বত কর। আল্লাহর ওলীদেরকে মানুষ যে মুহাব্বত করে এটা এমনি এমনিই করে? কিংবা তারা কি পোস্টার সাঁটিয়ে দেয় যে, আমার কাছে আসো, আমার কাছে আসো!? হক্কানী পীর বুযুর্গরা কি কখনও এগুলো করে? করে না। তারপরও তাদের জন্য মানুষ এত পাগল কেন? বস্তুত মহব্বত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহর পক্ষ থেকেই সব ফায়সালা হয়। হাওলাতী ইজ্জত-সম্মানের কোন প্রয়োজন নেই। তাকাল্লুফী করে বানোয়াটভাবে ইজ্জত কামাই করাকে হাওলাতী ইজ্জত বলা হয়। অনেকে বয়ান করতে বসলে নানা রঙ-ঢং আর অঙ্গভঙ্গির আশ্রয় নেয়। মানুষকে দেখায় যে, আমি খুব বড় বক্তা। এভাবে ইজ্জত তালাশ করার নামই হাওলাতী ইজ্জত। এগুলো স্থায়ী হয় না। এই ওয়াজ দ্বারা মানুষের হেদায়াত হয় না। এই ওয়াজ মানুষের দিলে আছর করে না। তুমি তোমার সাধ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে সহজ সরল ভঙ্গিমায় কথা বল, তবে ইখলাসের সাথে বল, দেখবে এর দ্বারাই কাজ হবে। শ্রোতাদের দিলে আছর হবে।

মুরুব্বী ধরো

সর্বশেষ কথা হল, সকলে ইসলাহের জন্য মুরুব্বী ধরো। শাইখ ঠিক করে নাও। যাকে মনে চায় ইস্তেখারা করে বানিয়ে নিবে। বর্তমানে যারা আছেন তাদের থেকেই বানিয়ে নিবে। কারণ এখন তুমি হাফেজ্জী হুজুর তালাশ করলে পাবে না। এখন ছোট-খাটো যারা আছেন তাদের দিয়েই আল্লাহ কাজ চালাবেন। আল্লাহর নেযাম এমনই। বড় বড় আলেমরা চলে গেছেন। তাই বলে কি মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে? না, মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়নি। সেগুলো আল্লাহ চালাচ্ছেন। এই ছোটদেরকেই আল্লাহ তা'আলা যোগ্যতা দান করে তাদের দ্বারাই বুখারী-মুসলিমের দরস চালু রেখেছেন। মাদরাসা চলছে। ছাত্ররা আলেম হচ্ছে। এটাই আল্লাহর নেযাম। ইসলাহের জন্যও এযুগে যারা আছেন তাদের মধ্য থেকে যার সাথে মন লাগে যত দ্রুত সম্ভব তার সাথে সম্পর্ক গড়ে নাও। অবসর থেকো না। মনে রাখবে, সম্পর্ক করবে ইসলাহের উদ্দেশ্যে। এজন্য সব সময় পাগলপারা হয়ে থাকবে। তোমার মধ্যে কী দোষ আছে তার সবই শাইখের নিকট বলবে। না বললে ইসলাহ হবে কী করে, শাইখ তো আর গায়েব জানেন না। যেমন তোমার মধ্যে কিবির আছে, হাসাদ আছে, রিয়া আছে, লোভ আছে, বুখল আছে। আরো অনেক রোগই আছে। সব শাইখকে জানাতে হবে। তাহলে ইসলাহ সম্ভব হবে। আমি বলি, হযরত থানভী রহ ইসলাহের যে নোসখা ও পন্থা দিয়েছেন সে নোসখা সকলে দিতে পারবে না। আর ইসলাহের জন্য তা লাগেও না। বরং আল্লাহ যাকে খিদমতের জন্য বসিয়েছেন তার দিলে যে নোসখা আসবে তা দিয়েই ইসলাহ হয়ে যাবে। সুতরাং গুনাহ ছেড়ে দাও। যারা এখনও কোন হুক্কানী শাইখের মুরীদ হওনি তারা মুরীদ হয়ে যাও। আর যারা মুরীদ হয়েছো তারা নিজ নিজ শাইখের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলো। আল্লাহ সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

আপনি কি দ্বীনের খাদিম হতে চান?

...

মাওলানা আবু আহমাদ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১০৭৮ বার দেখা হয়েছে

আল্লাহর নিকট ইসলাহের তাওফীক প্রার্থনা করুন

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
৯ নভেম্বর, ২০২৪
১১৬৩ বার দেখা হয়েছে

লেনদেনে সততা ও হালাল জীবিকা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
৮ নভেম্বর, ২০২৪
৩৪২৮ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →