প্রবন্ধ

ঈমান-আমল সুরক্ষিত রাখতে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সঙ্গে থাকুন, অন্যদের সঙ্গ ছাড়ুন

লেখক:মুফতী মনসূরুল হক দাঃ বাঃ
২৭ মার্চ, ২০১৯
৪০৫৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] 


হামদ ও সালাতের পর...

قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: بادروا بالأعمال فتنًا كقطع الليل المظلم بادروا بالأعمال يعني: الصالحة فتنًا كقطع الليل المظلم، يصبح الرجل فيها مسلمًا ويمسي كافرًا، ويمسي مؤمنًا، ويصبح كافرًا، يبيع دينه بعرض من الدنيا


মুহতারাম হাযেরীন! বর্তমানে আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। নতুন নতুন ফেরকা মুসলমানদের দীন ও ঈমান ধ্বংস করে দিচ্ছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাবাণী করেছেন, একটা সময় আসবে, যখন মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, বিকেলে কাফের হয়ে যাবে। আবার বিকেলে মুমিন থাকবে, সকালে কাফের হয়ে যাবে। সে সময়টি যে কতটা জটিল ও কঠিন হবে, এই হাদীস দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়। ওই যামানা সম্পর্কে নবীজী আরও বলেছেন, মানুষ অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে নিজের দীন ও ঈমান বিকিয়ে দিবে। তো সেই যামানা এখন আমাদের সামনে এসে গেছে। আজ হাজারো মানুষ এমনকি নামধারী অনেক আলেম-উলামাও দু'-চারটি পয়সার জন্য বাতিলের দলে যোগ দিচ্ছে। এরা হয়তো ভালো করেই জানে যে, ওটা গোমরাহ ফেরকা, ওদের কথাবার্তা ইসলাম বিরোধী এবং ওদের অবস্থান সহীহ ঈমান-আকীদার বিরুদ্ধে, তথাপি এসব আলেম বাতিলের অন্যায় তরফদারি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে, বাতিলের গোমরাহী কর্মকাণ্ডে সমর্থন দিচ্ছে, এমনকি বাতিলের গোমরাহী কথাবার্তার পক্ষে দলীল সরবরাহ করছে! এই কঠিন মুহূর্তে আল্লাহ তা'আলা যে আমাদেরকে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সোহবতে এসে সুন্নাতের প্রচার-প্রসারের কাজে জুড়ে থাকার তাওফীক দান করেছেন, এটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে আমাদের প্রতি অনেক বড় ইহসান ও  অনুগ্রহ। সারা জীবন সিজদায় পড়ে থেকেও আমরা এই অনুগ্রহের শোকর আদায় করে শেষ করতে পারব না। আজ শত শত লোক দীনের নামে গোমরাহ হচ্ছে। তাদের দাবি হল, তারা দীনের কাজ করছে, অথচ তাদের অন্তর উলামায়ে কেরামের বিদ্বেষে ভরপুর। উলামায়ে কেরামের বিপক্ষে তারা সারাদিন মিথ্যা বলছে, ওয়েবসাইট খুলে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করছে এবং উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে এমন এমন জঘন্য মন্তব্য করছে, যেগুলোর কারণে মন্তব্যকারীর ঈমান থাকে না। উলামায়ে কেরামকে আমরা মামুলি মনে না করি, তারা মামুলি কেউ নন। উলামায়ে কেরাম তো রাসূলের স্থলাভিষিক্ত। তারা তো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তারই কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং তাদের না- হক বিরুদ্ধাচরণ করে ঈমান ধরে রাখা যায় না, ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।

কেউ যদি বলে, এখন থেকে আর হাসপাতাল চালাতে ডাক্তারের প্রয়োজন নেই; আমরা রোগীরাই হাসপাতাল চালাবো। তাহলে বুঝুন, সেই হাসপাতাল কেমন চলবে!? যে হাসপাতাল থেকে ডাক্তারদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয় যে, ডাক্তাররা উল্টাপাল্টা চিকিৎসা করে, কাজেই তাদের দরকার নেই; আমরা রোগীরা কি কম বুঝি? আমরাই চালাবো! তাহলে এমন হাসপাতাল দ্বারা কবরস্থান আবাদ করা ছাড়া জনগণের আর কী ফায়দা হবে? এমন হাসপাতালে রোগীরা দলে দলে মরতে থাকবে, আর বেশি বেশি কবরস্থান আবাদ হবে। কারণ, সেখানে ডাক্তার নেই।

বর্তমানে সহীহ তরীকায় দীনের যত লাইনে যত রকম মেহনত চলছে, সেগুলো রূহানী হাসপাতাল। এই যে আপনারা দীনের কথা শোনার জন্য এই মজলিসে উপস্থিত হয়েছেন, এটা রূহানী হাসপাতাল। অনুরূপভাবে যেসব ওয়াজ মাহফিলে হক্কানী উলামায়ে কেরাম বয়ান করেন সেগুলোও রূহানী হাসপাতাল। দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতও রূহানী হাসপাতাল। অনুরূপভাবে খানকা, যেখানে আত্মশুদ্ধি করা হয়, অন্তরের রোগসমূহের চিকিৎসা প্রদান করা হয় সেটাও রূহানী হাসপাতাল। বলাবাহুল্য এসব রূহানী হাসপাতালের চিকিৎসক হলেন হক্কানী উলামায়ে কেরাম। চিকিৎসা এরাই দিবেন, রূহানী চিকিৎসা উলামায়ে কেরামই দিবেন। এখন যদি বলা হয়, উলামায়ে কেরামের দরকার নেই, এদেরকে সরিয়ে দাও, আমরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররাই রূহানী হাসপাতাল চালাবো, তাহলে সেই হাসপাতালের ধ্বংস অনিবার্য। ওখান থেকে কেউ আর রূহানী খোরাক পাবে না। ফলে দলে দলে রূহ ও আত্মার মৃত্যু ঘটবে। আজকাল এগুলোই চলছে। কেউ কেউ মন্তব্য করছে, উলামায়ে কেরাম হলেন ছাগল, এরা কিচ্ছু বোঝে না, এদেরকে ঘাস-পাতা খেতে দাও। নাউযুবিল্লাহ। এই মন্তব্যের কারণে যে তার ঈমানটাই নষ্ট হয়ে গেল, এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও তার নেই। এই হল কিছু লোকের দীনের নামে মেহনতের হাল-হাকীকত। দীনের মেহনতের দাবীদার হয়েও এরা এসব জঘন্য মন্তব্য করছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে দারুল উলূম দেওবন্দ স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে, এরা একটা বাতিল ফেরকা দাঁড় করাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, দেওবন্দ কোন সাধারণ মাদরাসা নয়। দেওবন্দ আজ সারা দুনিয়ার মাদরাসাসমূহের হেডকোয়ার্টার। দেওবন্দ তো সারা দুনিয়ার মুসলমানদেরকে হেদায়াতের পথ দেখাচ্ছে। দেওবন্দের দায়িত্বশীলগণ গভীর চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা ছাড়া মন্তব্য করতে পারেন না। তারা অনেক ভেবেচিন্তে, দূরদর্শিতার সাথেই মন্তব্য করে থাকেন। তো দেওবন্দ মন্তব্য করেছে যে, ‘মাওলানা সাদ সাহেব একটি নতুন মতবাদ সৃষ্টি করছেন। সাদ সাহেব ও তার অনুসারী এতায়াতকারীরা যেভাবে চলছে, এভাবে চলতে থাকলে তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত থেকে খারেজ হয়ে যাবেন। তারা আমাদের পূর্বসূরী আকাবেরদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবেন।' তো কোন দলের বিরুদ্ধে দারুল উলূম দেওবন্দ যদি এমন মন্তব্য করে এবং এরপরও যদি কিছু সুবিধাভোগী আলেম এই ভ্রান্তদলের সমর্থন করে, তাদের পক্ষে কাজ করে তাহলে সুস্পষ্ট যে, তারা নিছক দুনিয়াবী কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্যই এটা করছেন। তাদের এ কাজের অন্য কোন ব্যাখ্যা আমার বুঝে আসে না। যেখানে হকের কিছুই নেই, সব কুরআন-সুন্নাহর মনগড়া ব্যাখা; অনুরূপভাবে হিন্দুদের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে থেকে নিজেকে আমিরুল মুমিনীন ঘোষণা করা, নিজস্ব সেনাবাহিনী ছাড়াই নিজেকে সারাবিশ্বের মুসলমানদের আমীরুল মুমিনীন বা খলীফা দাবী করা-এসব কি ঐসব আলেমদের চোখে পড়ে না!? 

আজ যেদিকে তাকাই, গোমরাহীর সয়লাব। বড় বড় মাহফিল করা হচ্ছে, আর আয়োজকদের পক্ষ হতে ক্যামেরার ব্যবস্থা করে পুরো মাহফিলের ভিডিও করা হচ্ছে। অথচ এগুলো ছিল হেদায়াতের মাহফিল। হেদায়াতের মাহফিলেই যদি ছবি তোলা হয়, ভিডিও করা হয়, তো সেই মাহফিল দ্বারা কী হেদায়াত আসবে? সেই মাহফিল দ্বারা লোকজনকে গোমরাহ করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। কেউ না জেনে এমন মাহফিলে বসে গেলে এ ধরণের গোনাহ শুরু হওয়া মাত্রই উঠে চলে আসা উচিত। আফসোস, এভাবে দীনের কাজগুলো একে একে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! হোদায়াতের জলসাগুলো গোমরাহীর মাধ্যম হচ্ছে!! অথচ দারুল উলূম দেওবন্দের স্পষ্ট ফতোয়া আছে, শরয়ী অপারগতা ছাড়া, উদাহরণত পাসপোর্ট করা, জমির দলীল করা, জাতীয় পরিচয়পত্র বানানো ইত্যাদি ছাড়া প্রাণীর ছবি তোলা, ভিডিও করা বিলকুল নাজায়েয। বলুন, ওয়াজ মাহফিলের ছবি তোলা ও ভিডিও করার ক্ষেত্রে কী অপারগতা আছে? হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ হতে ছবি তোলার বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু সরকার কি ওয়াজ মাহফিলের ছবি তুলতে আয়োজকদেরকে বাধ্য করেছে? আমার জানামতে ওয়াজ মাহফিলের ছবি তুলে বা ভিডিও করে থানায় জমা দেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা এমনকি অনুরোধও নেই। তাহলে আমরা কেন এমন কাজ করতে যাব? কাজেই যে সমস্ত উলামায়ে কেরাম পুরোপরি হকের পথে আছেন, কোন জাহেরী গোনাহের সাথে জড়িত নন, বাছাই করে করে তাদের সঙ্গে থাকা, তাদের মজলিসে যাওয়া, তাদের কথা শোনা এবং তাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা উচিত। নিজের দীন ও ঈমান রক্ষা করার এটাই একমাত্র উপায়, এর কোন বিকল্প নেই। কাজেই যেখানে বা যে মাহফিলে গিয়ে গোনাহ হতে দেখবেন, সোজা উঠে চলে আসবেন। কেননা, আপনি গিয়েছেন হেদায়াতের প্রত্যাশায়, আর শুরু হয়ে গেছে গোমরাহী। তো কুরআনে পাক আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছে- فَلا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ অর্থাৎ তুমি যখন বুঝতে পারলে এরা আল্লাহর নাফরমানী করছে, উঠে চলে আসো, এদের সঙ্গে বসে থেকো না; চাই এতে যে যা-ই মনে করুক। সুতরাং কাউকে খুশি করার জন্য বা কারও গোস্বা থেকে বাঁচার জন্য ওখানে বসে থাকা যাবে না। কারণ, «لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق» অর্থাৎ মাখলুককে খুশি করার জন্য আল্লাহকে নারাজ করা যাবে না, তাঁর নাফরমানী করা যাবে না!

হাদীসে এসেছে, এক যামানা আসবে, যখন দীনের উপর টিকে থাকা এমন কঠিন হবে, যেমন কঠিন হয় আগুনের টুকরা হাতে ধরে রাখা। মুহতারাম হাযেরীন! বর্তমানে সে যামানা এসে গেছে। মানুষ এখন সকালে মুমিন, আর বিকেলে কাফের হয়ে যাচ্ছে। সামান্য সামান্য বাহানায় নিজেদের দীন-ঈমান নষ্ট করে ফেলছে। এজন্য এখন আর যে কোন ওয়াজ মাহফিলে যাচাই বাছাই ছাড়া অংশগ্রহণ করা যাবে না। আগে জানতে হবে, সেখানে কোন গোনাহের কাজ হবে কিনা? অনুরূপভাবে যেসব বক্তা ওয়াজ করবে তারা হক কথা বলবে কিনা এটাও যাচাই করে নিতে হবে। আজকাল অনেক বক্তা নিজেই ভিডিও করার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে আসে, ফটোগ্রাফার ভাড়া করে নিয়ে আসে। আবার কোন কোন বক্তা টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে। এরূপ বক্তা তো নিজেই গোমরাহ। এমন লোককে দাওয়াত করে বয়ান শুনলে কী ফায়দা হবে, যে কিনা নিজেই গোমরাহ এবং যে কিনা পয়সার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে? এরা মাহফিলে বসেই দাওয়াত দিচ্ছে যে, অমুক দিন অমুক টেলিভিশনে আমার প্রোগ্রাম আছে, আপনারা দেখবেন! তো তারা টেলিভিশন দেখার দাওয়াত দিচ্ছে, আর আমরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছি! প্রতিবাদ করছি না যে, আমরা কি আপনাকে গোমরাহীর দিকে ডাকার জন্য দাওয়াত করেছি? বস্তুত আমাদের দিল মরে গেছে; আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে! কোন অন্যায় কাজ দেখলে, হারাম কাজ দেখলে তার প্রতিরোধ করা, প্রতিবাদ করার যে ঈমানী শক্তি ও স্পৃহা দরকার আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। হাদীসে এসেছে- من رأى منكرا فاستطاع أن يغيره بيده فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان অর্থাৎ কোন অন্যায় দেখলে, কাউকে হারাম কাজে লিপ্ত দেখলে হাতের দ্বারা সেটা পরিবর্তন করে দাও। তা না পারলে মুখের কথা দিয়ে পরিবর্তন কর। তা-ও না পারলে অন্তত মনে মনে সেটা পরিবর্তন করার ফিকির কর। কিন্তু এই সৎসাহস আজ মুসলমানদের মধ্যে নেই।

যে-যা উল্টাপাল্টা করছে, আমরা চোখ বুজে সব মেনে নিচ্ছি, সবকিছু বরদাশত করে যাচ্ছি। এমনকি অন্যায় কাজকে দীনের কাজ মনে করে তাতে সহযোগিতা করছি। আমাদের আকল-বুদ্ধি কোথায় গেল? বিচার-বিবেক কোথায় গেল? গোনাহকে যদি গোনাহ মনে না করা হয়,গোনাহকে যদি হালাল মনে করা হয় তাহলে ঈমান চলে যায়। গোনাহকে গোনাহ মনে করা জরুরী। কেউ যদি গোনাহকে গোনাহ মনে করে তাতে লিপ্ত হয় তাহলে সে ফাসেক হয়ে যায় বটে,কিন্তু ঈমানটা অন্তত রক্ষা পায়।পক্ষান্তরে গোনাহকে হালাল ও জায়েয মনে করে করলে ঈমান চলে যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।

শুরুতে বলেছিলাম, বর্তমানে দীনের নামে নতুন নতুন ফেরকা তৈরি হচ্ছে, যাদের কথা দীন ও ঈমান বিধ্বংসী। বলা হচ্ছে, কুরআন বুঝে পড়া ওয়াজিব। এর সরল অর্থ হল, কেউ না বুঝে পড়লে তার ওয়াজিব তরক করার গোনাহ হবে। কত বড় গলত কথা! অথচ সওয়াব পাওয়ার জন্য অর্থ বুঝা শর্ত নয়। কুরআনে কারীমের শুরুতে যে আলিফ- লাম-মীম লেখা আছে, এর অর্থ তো খোদ সাদ সাহেবও জানেন না, কিয়ামত পর্যন্ত জানা সম্ভবও নয়। অনুরূপভাবে নামাযে যেসব সূরা পড়া হয়, সেগুলোর অর্থ কি আমরা সবাই জানি? জানি না। তাহলে তো তার কথা অনুযায়ী অর্থ না জেনে পড়ার কারণে গোনাহগার হচ্ছি। আবার বিভিন্ন নবীদের সমালোচনা করা হচ্ছে। এমনকি আমাদের নবীজীও বাদ পড়েননি। হ্যাঁ, দীনের নামে আজ এমন সব ফেরকাও তৈরি হচ্ছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, وشر الأمور محدثاتها وكل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة وكل ضلالة في النار. অর্থাৎ নিকৃষ্টতম কাজ হল, দীনের নামে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। আর দীনের নামে উদ্ভাবিত প্রতিটি জিনিস বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহী মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।

এজন্য দীনের নামে কোন কিছু হচ্ছে শুনলেই সেদিকে দৌড় দেয়া যাবে না। আগে যাচাই করে নিতে হবে যে, সেখানে যারা কথা বলবে, তারা আল্লাহওয়ালা কিনা, ইলমওয়ালা কিনা আজকাল সুর শোনার জন্য বক্তা আনা হচ্ছে, কালেকশনের জন্য বক্তা আনা হচ্ছে। পোস্টারে লেখা আছে বিরাট ওয়াজ মাহফিল, পরে দেখা গেল বিরাট কালেকশন মাহফিল। এই তরীকায় কালেকশন করার এবং ধোঁকাবাজি করে মানুষের পকেট খালি করার অনুমতি ইসলাম দেয় না। এজন্য কোন মাহফিলে যেতে হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, হক্বানী উলামায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে যাবেন। যাতে হেদায়াত আসে, গোমরাহী না আসে এবং ঈমান বাড়ে, নষ্ট না হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে বোঝার তাওফীক দান করুন।

মোটকথা, কোন নতুন ফেরকায় শরীক হবেন না। চৌদ্দশত বছর ধরে হক্কানী উলামায়ে কেরাম যা বলে আসছেন, তার ওপর অটল থাকতে হবে। যারাই নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে, তারাই গোমরাহ হয়ে গিয়েছে। উদাহরণত শিয়ারা কাফের কেন? এজন্য যে, তারা মনগড়া জিনিস ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তারা বিশ্বাস করে, তাদের বারো ইমামের মর্যাদা নাকি নবী-রাসূলদের চেয়েও বেশী। নাউযুবিল্লাহ। ব্যস, এরা কাফের হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে কাদিয়ানীরা কাফের কেন? তারা আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী মানে না। বরং তারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে তাদের নবী মানে। কাদিয়ানীরা অনেক সময় সাধারণ মুসলমানদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বলে, আমরাও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী মানি, এমনকি সর্বশেষ নবীও মানি; তবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আসল নবী, আর গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হল ছায়ানবী। কত মারাত্মক ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা! আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা-বিশ্বাস হল, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন খাতামুন্নাবিয়্যিন বা সর্বশেষ নবী এবং তাঁর পরে আসল-ছায়া কোনও ধরণের নবী-রাসূল দুনিয়াতে আসবেন না, আসতে পারেন না। কুরআনে কারীমের প্রায় একশত আয়াত ও পাঁচশতাধিক হাদীস স্বার্থহীনভাবে একথা প্রমাণ করছে। হ্যাঁ, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিয়ামতের কিছুকাল আগে আবারও পৃথিবীতে আসবেন। তবে নবী হয়ে নয়, আমাদের নবীজীর উম্মত হয়ে। এ সময় তিনি আমাদের নবীর শরীয়ত অনুযায়ী খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও বিচার-আচার করবেন। মোটকথা, কাদিয়ানীরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী না মানার কারণে কাফের হয়ে গেছে।

তবে দুনিয়ায় যত বাতিল ফেরকা আছে, সবাইকে দেখা যায়, তারা সাহাবায়ে কেরামের দোষচর্চা করে। সাহাবায়ে কেরামকে দুশমন মনে করে। এই তো কিছুদিন আগে ভারতের এক আলেম মন্তব্য করেছে, সাহাবায়ে কেরামেরও 'জারহ' (সমালোচনা) হওয়া উচিত! যেখানে নবীজী হুশিয়ার করে দিচ্ছেন, আমার সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা লানতের কাজ, অভিশাপের কাজ, সেখানে একটা বড় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হয়ে মন্তব্য করেছে, সাহাবায়ে কেরামের দোষচর্চা হওয়া উচিত! অথচ সাহাবায়ে কেরাম কত বড় উচ্চমর্যাদার অধিকারী! যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে নবীজীকে জীবনে মাত্র একবার এক সেকেণ্ডের জন্য হলেও দেখেছেন এবং ঈমানের হালতে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় ওলী-আউলিয়া মিলেও তার সমমর্যাদার হতে পারবে না। আফসোস! শত আফসোস!! আলেম-উলামার লেবাসে, মাদরাসার সাইনবোর্ডে আজ মন্তব্য করা হচ্ছে যে, সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা হওয়া উচিত! জাতি এদের থেকে গোমরাহী ছাড়া আর কী পাবে!? এর বিপরীতে দেখুন, কয়েকদিন আগে দেওবন্দের শাইখুল হাদীস, মুফতী সাঈ আহমাদ পালনপুরী দা.বা. সিলেটের এক মাদরাসার মাহফিল উপলক্ষে বাংলাদেশে আগমন করেছিলেন। শুনেছি, তিনি আসার পর জানতে পারলেন, স্টেজে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। শুনে তিনি আর স্টেজে উঠলেন না। বললেন, আমি এত কষ্ট করে তোমাদের সঙ্গে গোনাহে শরীক হতে আসিনি! পরে ক্যামেরা সরিয়ে দেয়া হলেও তিনি আর স্টেজে গেলেন না। মুহতামিম সাহেব তার পায়ে পড়ে গেলেন, হুযূর! বয়ান না-হয় না করলেন, স্টেজে গিয়ে শুধু দু'আ করে দিন। তিনি তা-ও গেলেন না। বললেন, যে স্টেজে এতক্ষণ ধরে তোমরা গোনাহের কাজ করেছো, সেখানে আমি কিছুতেই যাবো না। মর্যাদাবোধসম্পন্ন এ ধরণের ব্যক্তিবর্গকে বলা হয় আলেম। এদেরকেই বলা হয় আল্লাহওয়ালা ও হক্কানী। আমাদের দুর্ভাগ্য, এদেরকে দেখেও আমরা নসীহত হাসিল করি না, শিক্ষা গ্রহণ করি না!

এজন্য আপনাদের খেদমতে আরজ, দীনের কাজ তো করতেই হবে, তবে বুঝেশুনে করতে হবে। যে মাহফিল সহীহ তরীকায়, বিশুদ্ধ সুন্নাত অনুযায়ী, গোনাহমুক্তভাবে আয়োজন করা হয় এমন মাহফিল একটা খুঁজে পেলে ওই একটাতেই শরীক হোন। না পেলে শরীক হওয়ার দরকার নেই। দীনের নামে অখাদ্য কুখাদ্য গ্রহণ করার কোন দরকার নেই। হেদায়াতের নামে গোমরাহী খরিদ করার দরকার নেই। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তামাম গোমরাহী থেকে হেফাজত করুন।

অনুলিখন : মাওলানা আবূ সাইম

ইমাম ও খতীব, বসিলা বড় মসজিদ,মুহাম্মাদপুর, ঢাকা। 

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

মিলাদ-কিয়াম এর শরঈ বিধান

...

মুফতী আমীর হোসাইন
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৬২১৭ বার দেখা হয়েছে

কাছরাতে যিকির

...

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৮৭৯ বার দেখা হয়েছে