প্রবন্ধ
বালা-মুসীবতের কারণ ও প্রতিকার
মহান রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ
অর্থ: তোমাদের উপর যে সব বিপদাপদ আপতিত হয় তা তোমাদেরই কর্মফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। (সূরা শূরা; আয়াত ৩০) আল্লাহ রব্বুল আলামীন পুরো বিশ্বজগতকে বিশেষ কুদরতে সৃষ্টি করেছেন এবং অত্যন্ত সুচারুরূপে এর পরিচালনা করছেন। মানবজাতির কল্যাণার্থে তিনি পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন সাধারণ ও বিশিষ্ট বহু নেয়ামত। আল্লাহ তা'আলার সাধারণ ও ব্যাপক নেয়ামতরাজির মধ্যে আকাশ-বাতাস, আগুন-পানি, বৃষ্টি-মাটি প্রভৃতি অন্যতম। এগুলো এমনই নেয়ামত যার দ্বারা মানুষ সার্বক্ষণিক উপকৃত হয়। কিন্তু অনেক সময় এগুলো দ্বারাই মানুষ নানা রকম দুর্যোগ-দুর্বিপাকের শিকার হয়। অনাবৃষ্টি- অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকাণ্ড- বজ্রপাত, ভূমিকম্প-ভূমিধ্বস, বন্যা-খরা প্রভৃতি জনপদের পর জনপদ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এতে প্রাণহানী ঘটে হাজার হাজার বনী আদমের। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, গবাদি পশু। আল্লাহ তা'আলা উল্লিখিত আয়াতে বলছেন, এই যে বিভিন্ন রকম আসমানী ও যমীনী বালা-মুসীবত মানুষের জীবনে দেখা দেয় তা মানুষের বদ আমল ও মন্দ কর্মের দরুন দেখা দেয়; এতে আল্লাহ তা'আলার কোনও দোষ নেই। সুতরাং বালা-মুসীবতে নিপতিত হলে আল্লাহ তা'আলার ব্যাপারে অভিযোগ ও আপত্তি তোলা মোটেই সমীচীন নয়। বরং কৃতকর্মের ব্যাপারে অনুশোচনা করত নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয়া উচিৎ। হযরত হাসান রাযি. বলেন, এ আয়াত নাযিল হলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (অর্থ) ঐ সত্তার কসম যার কুদরতী হাতে আমার প্রাণ- কারও শরীরে সামান্য আঁচড় লাগে, অথবা শিরা-উপশিরা ধড়ফড় করে, অথবা পা পিছলে পড়ে যায়- এগুলো তার গোনাহের কারণে হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)
হযরত আলী রাযি. থেকেও উল্লিখিত আয়াতের তাফসীরে অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। বুযুর্গানে দীন বলেন, যেমনিভাবে শারীরিক বিভিন্ন অসুখ ও কষ্ট গোনাহের কারণে হয়ে থাকে, তেমনিভাবে ‘আত্মিক রোগও গোনাহের কারণে হয়ে থাকে। কেননা একটি গোনাহ অপর একটি গোনাহের কারণ হয়ে থাকে, ঠিক যেমন একটি নেকী আরেকটি নেকীর কারণ হয়ে থাকে। (মা'আরিফুল কুরআন ৭/৭০১)
অপর এক আয়াতে মহান রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থ: মানুষ নিজ হাতে যা কামায়, তার ফলে স্থলে ও জলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কতক কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করাবেন বলে, হয়তো এর ফলে তারা ফিরে আসবে।
(সূরা রূম-৪১)
এই আয়াতে ফাসাদ বা অশান্তি বলতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, জাহাযডুবি, বরকতশূন্যতা, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুর আগ্রাসন, জালিমের আধিপত্য ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। (তাফসীরে মাযহারী ৭/২৮৪, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন)
বোঝা গেলো, এই যে আমাদের উপর একের পর এক বালা-মুসীবত ধেয়ে আসছে তার মূল কারণ আমাদের গোনাহ ও পাপাচার। তবে আল্লাহ তা'আলা পরম করুণাময় বলে আমাদেরকে প্রত্যেক গোনাহের শাস্তি দেন না, বরং বহু গোনাহ মাফ করে দেন। যদি প্রত্যেক গোনাহের কারণে তিনি পাকড়াও করতেন তাহলে একজন মানুষও বাঁচতে পারতো না। বাস্তবতা এটাই যে, আল্লাহ তা'আলা অনেক গোনাহ মাফ করে দেন। আর যে গোনাহগুলো মাফ করেন না সেগুলোর শাস্তিও দুনিয়াতে পুরোপুরি দেন না; আংশিক বা যৎসামান্য অংশেরই শাস্তি দিয়ে থাকেন। উল্লিখিত আয়াতে কারীমায় ‘কতক কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করাবেন' বলে এটাই ব্যক্ত করা হয়েছে। মানুষ যখন কোন গোনাহে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ তা'আলার নাফরমানীতে জড়িয়ে পড়ে তখন তার প্রতিক্রিয়ায় কখনও বৃষ্টিবর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে অন্যান্য বোবাপ্রাণীদেরও কষ্ট হয়। এ সময় বোবাপ্রাণীরা মানুষের জন্য আল্লাহর দরবারে বদ-দু'আ করতে থাকে। উপরন্তু কিয়ামতের দিন তারা মানুষের বিপক্ষে মোকদ্দমাও দায়ের করবে। উল্লিখিত আয়াতদ্বয় ও তার তাফসীর এবং নিম্নলিখিত হাদীসসমূহের মধ্যে কারও মনে বৈপরীত্যের সন্দেহ দেখা দিতে পারে- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الدنيا سجن المؤمن وجنة الكافر
অর্থ: দুনিয়া মুমিনের জেলখানা, কাফেরের উদ্যান। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৫৬)
অপর এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে
عن مصعب بن سعد عن أبيه قال قلت يا رسول الله أي الناس أشد بلاء؟ قال الأنبياء ثم الأمثل فالأمثل
অর্থ: পৃথিবীতে সর্বাধিক বালা-মুসীবত আসে আম্বিয়ায়ে কেরামের উপর। অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী তাদের উপর। অতঃপর যারা এদের নিকটবর্তী তাদের উপর। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২৩৯৮, সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ৪০২৩)
অপর এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে—
المؤمن يموت بعرق الجبين
অর্থ: মুমিন তার কপালের ঘামের মধ্য দিয়ে ইন্তেকাল করে। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ৯৮২, সুনানে নাসায়ী; হাদীস ১৮২৯)
বৈপরীত্যের সন্দেহ দেখা দেওয়ার কারণ হলো, সাধারণভাবে আমরা যেটা প্রত্যক্ষ করি সেটা হলো, পৃথিবীতে মুমিন- মুসলমানগণ ব্যাপকভাবে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে থাকে আর কাফেররা আরাম- আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে। এখন আয়াতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী যদি দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-আপদ গোনাহের শাস্তি স্বরূপই হয়ে থাকে তাহলে তো ব্যাপারটি উল্টো হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ কাফেরদেরকে ভয়ানক সব শাস্তি ও দুঃখ-কষ্টে নিপতিত করার দরকার ছিল আর মুমিনদেরকে আরাম-আয়েশে রাখার কথা ছিল।
এর উত্তর হলো, আয়াতে কারীমায় গোনাহকে বিপদাপদের কারণ বলা হয়েছে ঠিক কিন্তু বিপদাপদের একমাত্র কারণ বলা হয়নি। অর্থাৎ কারও উপর যদি বিপদাপদ আসে তাহলে সেটা তার গোনাহের কারণেই আসে এমনটি জরুরী নয়; বরং এর পেছনে অন্যান্য কারণও থাকতে পারে। উদাহরণত তাকে পরীক্ষা করা, তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা বা দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে আখেরাতের শাস্তি মওকুফ করা ইত্যাদি। সুতরাং উল্লিখিত হাদীসসমূহের সঙ্গে আয়াতদ্বয়ের বৈপরীত্য নেই ।
কুরআনে কারীমের বহু আয়াতও এই বক্তব্য সমর্থন করে। উদাহরণত আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
অর্থাৎ আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনও) কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনও) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনও) জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। (সূরা বাকারা-১৫৫)
বোঝা গেলো, বিপদাপদ ও বালা-মুসীবত ধৈর্যের পরীক্ষার জন্যও হতে পারে যে, এসব মুসীবত সত্ত্বেও কে আল্লাহর উপর আস্থা রাখে, আর কে আল্লাহকে অভিযুক্ত করে।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
অর্থ: (হে মুসলিমগণ!) তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের উপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট এবং তাদেরকে করা হয়েছিল প্রকম্পিত, এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার সঙ্গীগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মনে রেখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। (সূরা বাকারা-২১৪)
লক্ষ্য করুন, নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম এবং তাঁদের সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তা'আলার অতি প্রিয় বান্দা ছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের জীবনেও এমন সব ভয়াবহ ও মারাত্মক বিপদাপদ এবং চরম দুঃখ-কষ্ট এসেছে যে, তাঁরা আল্লাহর সাহায্য অবিলম্বে আসার আকাঙ্ক্ষায় বলতে বাধ্য হয়েছেন, 'মাতা- নাছরুল্লাহ! আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?
তাছাড়া জানা কথা যে, নবী-রাসূলগণ মাছুম বা নিষ্পাপ হয়ে থাকেন। তথাপি তাঁদের উপর বিপদাপদ এসেছে। বোঝা গেলো, বালা-মুসীবত স্রেফ গোনাহের সঙ্গে শর্তযুক্ত নয়; বরং অন্য কোন বিশেষ হিকমত ও উপযোগিতার কারণেও বালা- মুসীবত আসতে পারে।
ফিরে আসি আগের কথায়। বালা-মুসীবত যদিও সব সময় গোনাহের কারণে আসে না কিন্তু কুরআন-হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী অধিকাংশ সময় গোনাহের কারণেই এসে থাকে। নিম্নলিখিত হাদীসটি লক্ষ্য করুন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إذا اتخذ الفيء دولا, والأمانة مغنما, والزكاة مغرما, وتعلم لغير الدين, وأطاع الرجل امرأته, وعق أمه, وأدنى صديقه, وأقصى أباه, وظهرت الأصوات في المساجد, وساد القبيلة فاسقهم, وكان زعيم القوم أرذلهم, وأكرم الرجل مخافة شره, وظهرت القينات والمعازف, وشربت الخمور, ولعن آخر هذه الأمة أولها, فليرتقبوا عند ذلك ريحا حمراء, وزلزلة, وخسفا, ومسخا, وقذفا, وآيات تتابع كنظام بال قطع سلكه فتتابع.
অর্থ: যখন (এক) গনীমতের মালকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করা হবে, (দুই) আমানতের মালকে গনীমতের মালের মতো যথেচ্ছা ব্যবহার করা হবে, (তিন) যাকাত প্রদানকে জরিমানা মনে করা হবে, (চার) দুনিয়া হাসিলের জন্য দীন শিক্ষা করা হবে, (পাঁচ) পুরুষেরা স্ত্রীদের তাবেদারী করে মায়ের অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে, (ছয়) বন্ধুদেরকে কাছে টেনে পিতাকে দূরে ঠেলে দিবে, (সাত) মসজিদগুলোতে শোরগোল হতে থাকবে, (আট) পাপাচারী লোক গোত্রের সর্দার হবে, (নয়) নীচ প্রকৃতির লোক জাতির হর্তকর্তা হবে, (১০) জুলুম ও অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্য লৌকিকতা বশত মানুষকে সম্মান করা হবে, (১১) নর্তকীর সংখ্যা বেড়ে যাবে, (১২) বাদ্যযন্ত্রের প্রসার ঘটবে, (১৩) মদ (ও নেশাদ্রব্য ব্যাপকভাবে) পান করা হবে, (১৪) পরবর্তী প্রজন্ম পূর্বসুরীদের অভিশাপ দিবে তখন তোমরা অপেক্ষা করো অগ্নিঝড়, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, আকৃতি- বিকৃতি, উল্কাবৃষ্টি এবং এমন ক্রমাগত বিপর্যয়ের যেমন কোন পুরনো মালা ছিড়ে গেলে দানাগুলো একের পর এক দ্রুত বেরিয়ে আসে। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২২১১)
অপর এক হাদীসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«ما ظهر الغلول في قوم قط إلا ألقي في قلوبهم الرعب، ولا فشا الزنا في قوم قط إلا كثر فيهم الموت، ولا نقص قوم المكيال والميزان إلا قطع عنهم الرزق. ولا حكم قوم بغير الحق إلا فشا فيهم الدم. ولا ختر قوم بالعهد إلا سلط الله عليهم العدو»
অর্থ: (এক) যখন কোন জাতি আমানতে খেয়ানত করেছে, আল্লাহ তাদের অন্তরে শত্রুভীতি ঢেলে দিয়েছেন, (দুই) যে জাতির মধ্যে ব্যভিচার (অশ্লীলতা) বৃদ্ধি পেয়েছে, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে, (তিন) যখন কোন জাতি ওজন ও পরিমাপে কম দিয়েছে, তারা প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে, (চার) যখন কোন জাতি না-হক বিচার করেছে, তখন তাদের মধ্যে রক্তপাত, হানাহানি ছড়িয়ে পড়েছে, (পাঁচ) যখন কোন জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের উপর শত্রুকে চড়াও করে দিয়েছেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক হাদীস ১৩২৩)
দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, প্রথম হাদীসে বর্ণিত ১৪ টি আর দ্বিতীয় হাদীসে বর্ণিত ৫টি গোনাহ ও অপকর্মের সব ক'টিই বর্তমানে ব্যাপকভাবে সংঘটিত হচ্ছে। শুধু এগুলোই নয়, এগুলো ছাড়া আরও বিভিন্ন গোনাহ দ্বারা আমাদের দেশ ও সমাজ কলুষিত। ফলে আমাদের ওপর নেমে আসছে একের পর এক বালা- মুসীবত, আযাব-গযব।
এই তো সেদিন ২২ জুলাই ২০২২ সালে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্পে আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছে দেড় সহস্রাধিক মানুষ। সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছে অর্ধশতাধিক বনী আদম, আহত হয়েছে পাঁচশতাধিক। চলমান বন্যায় শুধু সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় মারা গেছে ৮৮ জন আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০ লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে বাংলাদেশেই মারা যাচ্ছে তিনশতাধিক। অনুরূপভাবে নিকট ও দূর-অতীতের বিভিন্ন সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ও সুনামীতে মুহূর্তেই প্রাণ হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ক্যান্সারসহ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে প্রতিদিন কতো লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তার হিসেব নেই। এক করোনার ছোবলেই পুরো পৃথিবীতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে এপর্যন্ত ৬৩ লক্ষাধিক মানুষ।
এমনই এক চরম দুর্যোগ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আমাদের ভাবা উচিৎ,এতো এতো দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সম্মুখীন হয়েও আমরা কয়টি গোনাহ বর্জন করতে পেরেছি এবং নেকীর কাজে আমাদের যে সীমাহীন গাফলতি তার কতোটুকু ক্ষতিপূরণ করতে পেরেছি। যদি আমরা তা না করে থাকি তাহলে এই ধারাবাহিক মুসীবত ও দুর্যোগ থেকে কিভাবে মুক্তির আশা করতে পারি! কেউ বিষ পান ছাড়বে না আবার বেঁচে থাকারও আশা করবে, এটা কি করে সম্ভব! গোনাহ ও আল্লাহর নাফরমানী তো বিষতুল্য। ধ্বংস ও বরবাদী এর অনিবার্য পরিণতি। এই ধ্বংস ও বরবাদী থেকে আত্মরক্ষা করতে চাইলে নিজেদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيْرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
অর্থ: জেনে রেখো, আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। (সূরা রা'দ-১১)
এজন্য আযাব-গযব থেকে বাঁচতে হলে হিম্মত করে গোনাহ ছেড়ে দেয়া এবং হিম্মত করে নেকীর কাজ শুরু করে দেয়া আমাদের প্রধান কর্তব্য। তবে মুহূর্তেই সব গোনাহ ছেড়ে দেয়া এবং সকল নেককাজ সম্পন্ন করে ফেলা অতো সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে মরদুদ শয়তান, পাশবিক চাহিদা, দূষিত পরিবেশ এবং জেঁকে বসা বদঅভ্যাস আমাদের প্রধান শত্রু হয়ে দেখা দেয়। এজন্য বুযুর্গানে দীন আমাদেরকে বিশেষ ধারাক্রম অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা বলেছেন, তিনটি গোনাহ এরূপ রয়েছে যেগুলো ছাড়তে পারলে অন্যান্য গোনাহ ছেড়ে দেয়া সহজ হয়। ১. বদ নেগাহী-কুদৃষ্টি। ২. বদ যুবানী-কুকথা।বদ গোমানী-কুধারণা। তাঁরা আরও বলেছেন, তিনটি নেককাজ এমন রয়েছে, যেগুলোর উপর আমল করতে পারলে অন্যান্য নেকীর কাজ সহজ ও আসান হয়ে যায়। ১. সালামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার। ২. উন্নত কাজে ও উন্নত স্থানে ডানদিককে প্রাধান্য দেওয়া, নিম্নমানের কাজে ও নিম্নমানের স্থানে বামদিককে প্রাধান্য দেওয়া। ৩. বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা। হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক হারদূয়ী রহ, বালা-মুসীবত চলাকালীন আমাদেরকে বিশেষভাবে তিনটি কাজে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ১. ইলম তথা দীনী জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ। ২. আল্লাহ তা'আলার প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা বৃদ্ধির পন্থা জেনে তা বাস্তবায়ন। ৩. অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টির উপায় জেনে খোদাভীতি অর্জন।
জনসাধারণের জন্য ইলম অর্জনের সহজ পন্থা হলো- (ক) জুমু'আর দিন আগেভাগে মসজিদে গিয়ে এবং হক্কানী উলামায়ে কেরামের দীনী মজলিসগুলোতে শরীক হয়ে মনোযোগ দিয়ে দীনী কথা শ্রবণ করা। (খ) হক্কানী উলামায়ে কেরাম লিখিত নির্ভরযোগ্য দীনী কিতাব অধ্যয়ন করা। (গ) দাওয়াত-তাবলীগের মেহনতে বের হয়ে পারস্পরিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করা।
আল্লাহর প্রতি মহব্বত বৃদ্ধির পন্থা হলো- (ক) আল্লাহর নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করে শোকরগোজার হওয়ার চেষ্টা করা। (খ) দৈনিক কমপক্ষে ১০০ বার কালিমা তাইয়িবা পাঠ করা, ১০০ বার ইস্তিগফার করা এবং ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করা। (গ) যে কোন নেকীর কাজ করার সময় এর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে মহব্বত বৃদ্ধির নিয়ত করা। (ঘ) কোন নির্ভরযোগ্য পূর্ণাঙ্গ সীরাতগ্রন্থ পাঠ করা। (ঙ) কোন আল্লাহওয়ালা বুযুর্গের নিয়মতান্ত্রিক সান্নিধ্য অবলম্বন করে নিজেকে সংশোধন করতে থাকা। অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার উপায় হলো- (ক) বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। (খ) আল্লাহর জেলখানা জাহান্নাম ও তার শাস্তির কথা চিন্তা করা। (গ) কোন খোদাভীরু বুযুর্গের সান্নিধ্য অবলম্বন করে তার দেয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী আমল করতে থাকা।
উল্লিখিত পন্থায় ইলমে দীন হাসিল, আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধি, খোদাভীতি অর্জন এককথায় গোনাহ বর্জন ও নেকী অর্জনের পাশাপাশি দুর্দশাগ্রস্ত ও দুর্যোগকবলিত মানুষের সেবায় সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়াও বিপদাপদ থেকে আত্মরক্ষার অন্যতম উপায়। আল্লাহ তা'আলা আমল করার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
গবেষণা এবং গবেষণার হকদার কারা
...
হক ও বাতিল : বুঝার মানদণ্ড কী?
[গত ৭ শাবান ১৪৪০ হি. মোতাবেক ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ঈ. রবিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর তাবলীগ জামাতের মারকাযে হযরত ম...