প্রবন্ধ
হজ প্রেমময় এক ইবাদত
হজের এই নুরানি পরিবেশ আর স্নিগ্ধ পরশে মানবাত্মা তৃপ্ত হয়, হূদয় হয়ে ওঠে সজীব ও সৌরভ।
মানুষ অনেক কষ্ট করে জীবনের এই পরম সৌভাগ্য অর্জন করে। এই সৌভাগ্য অর্জন করার পর যেন আমাদের ভুলের কারণে আমরা মূল লক্ষ্য থেকে বঞ্চিত না হই, সে জন্য আল্লাহ তাআলা আমাদের কিছু বিধিবিধান দিয়েছেন।
হজের দীর্ঘ সফরে নানা শ্রেণি ও বৈচিত্র্যের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটে।
বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ চোখ ধাঁধানো ও চিত্ত দোলানো নয়নাভিরাম দৃশ্য। এসব দৃশ্যকে চারপাশে রেখে একজন হাজিকে তার হজের কার্যক্রম চালাতে হয়। এ জন্য কখনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও হজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে হাজি সাহেবানগণ। নতুন শহর নতুন দেশ ও নতুন পরিবেশে যাওয়ার পর মানুষের মাঝে এমনিতেই পরিবর্তন আসে।
তার রুচি ও প্রকৃতির মাঝে বিস্তর বিবর্তন ঘটে। এসব বিচিত্র অবস্থা থেকে যেকোনো মুহূর্তে হজের মহিমা ও পবিত্র একনিষ্ঠতা যেন খর্ব না হয়, সে জন্য আল্লাহ তাআলা কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যথায় এই আজীবনের বাসনা ও সাধনা মুহূর্তেই উবে যেতে পারে নিজেদের অগোচরে। হাজি সাহেবগণ যেন তার উদ্দেশ্য ভুলে না যায় সে জন্য আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন নিদর্শন দিয়েছেন তাকে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে।
যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ অবধারিত করে নেয়, সে হজের সময় কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গুনাহ করবে না এবং ঝগড়াও নয়। তোমরা যা কিছু সত্কর্ম করবে আল্লাহ তা জানেন। আর (হজের সফরে) পথ খরচা সঙ্গে নিয়ে নিয়ো। বস্তুত তাকওয়াই উত্কৃষ্ট অবলম্বন। আর হে বুদ্ধিমানরা, তোমরা আমাকে ভয় করে চলো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
একজন হাজিকে হজের সফর শুরু করার পর ইহরাম বাঁধতে হয়।
ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্য
ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্য হলো নিজেকে গাফলত ও উদাসীনতার অন্ধকার থেকে নিজের ভেতর ঈমানি চেতনা ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগ্রত করে তোলা। এবং হিদায়াতের আলোয় আলোকিত করে তোলা। নামাজের তাকবির যেভাবে মুসল্লিকে যাবতীয় স্বাধীনতা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে নিয়ে যায় ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার এক নতুন দুনিয়ায়। তেমনি ইহরাম হাজিকে নিয়ে যায় সাজসজ্জা ও আড়ম্ভরতা থেকে আল্লাহ তাআলার প্রেম ও বিশ্বাসের এক নতুন জগতে। ইহরাম হাজিকে এক পবিত্র অনুভূতি দেয় যে সে এখন চলছে মহামহিম আল্লাহর শাহি দরবারের দিকে।
হজরত শাহ ওলিউল্লাহ (রহ.) লিখেছেন, ‘হজ ওমরার ইহরাম, নামাজের তাকবিরের মতোই তাত্পর্যপূর্ণ। সমর্পণ, ভক্তি নিবেদন প্রকাশের এক অনন্য পন্থা। ইহরামের মাধ্যমে হাজিকে জীবনের সব রকম সাজসজ্জা, অভ্যাস ও বিলাসবহুল জীবন বর্জনে অনুপ্রাণিত ও আগ্রহী করে তোলা হয়। আল্লাহর সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও দীনতা ফুটিয়ে তোলা। রূপকথা প্রেম ও নিমগ্নতা প্রকাশের ব্যাপারে সাহায্য করাই হলো ইহরামের মৌলিক উদ্দেশ্য।’
মিকাত নির্ধারণ
হজের বিধানাবলির মধ্য থেকে মিকাতের আহকাম অন্যতম। শরিয়ত মিকাত কেন নির্ধারণ করেছে! মিকাতে পৌঁছার পর হাজিগণ প্রেম ও বিশ্বাস চিন্তা ও আধ্যাত্মিকতার এক নতুন উপলব্ধি ও চেতনা লাভ করেন। হাজিদের চিত্তে তখন এক অনুভূতি জাগ্রত হয় যে অল্প কিছুক্ষণ পরই ইনশাআল্লাহ মহামহিমের দরবারে আমরা পৌঁছাতে যাচ্ছি। মিকাতের এই ব্যবস্থাপনা না হলে বাইতুল্লাহর হাজিগণ বিশেষ কোনো উপলব্ধি ও অনুভূতি ছাড়াই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করত। মিকাত নির্ধারণের হিকমত ও তাত্পর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) বলেছেন,
‘মিকাত নির্ধারণের রহস্য এই যে হাজিদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে ধুলায় ধূসরিত ও মলিন বদনে বিপন্ন অবস্থায় যেন তারা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করে। অথচ নিজ শহর ও এলাকা থেকে ইহরাম বেঁধে সফর করতে হলে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট স্বীকার করতে হবে। কেননা কারো সফর হবে দীর্ঘ এক মাস, কারো দুই মাস, কারো আরো অনেক বেশি। তাই হাজিদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করার জন্য ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত কয়েকটি স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে হলে এসব স্থান থেকে অবশ্যই ইহরাম বেঁধে নিতে হবে। সবচেয়ে দূরত্বের মিকাত হলো মদিনাবাসীদের মিকাত, জুল-হুলাইফা। অন্যান্য মিকাতের তুলনায় মক্কা থেকে অপেক্ষাকৃত মদিনার মিকাতের দূরত্ব বেশি। কেননা মদিনা হলো প্রিয় নবী (সা.)-এর হিজরতের স্থান, ওহির কেন্দ্র, ঈমানের দুর্গ। সুতরাং আল্লাহর পথে ইবাদতের প্রতিযোগিতায় মদিনাবাসী অন্যদের চেয়ে অধিক অগ্রগামী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। মিকাতের এই দূরত্ব মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য তাদের অধিক কোরবানির এই প্রতীক।
তালবিয়া
হজের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি নির্দেশনা হচ্ছে তালবিয়া পাঠ। হজের কল্যাণ ও উপকারিতা আরো বিস্তৃত করার জন্য এ বিধানটি দেওয়া হয়েছে। গোটা হজেই অনবরত তালবিয়া পাঠের জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, কোন প্রকার হজ সবচেয়ে উত্তম? তিনি বলেন, চিত্কার করা (উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠ) ও রক্ত প্রবাহিত করা (কোরবানি দেওয়া)। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৮২৭)
বস্তুত হাজিদের হূদয়ে ঈমান ও বিশ্বাস প্রেম ও ভালোবাসা এবং আত্ম-নিবন্ধনের অনুভূতি জাগিয়ে তোলার এক অনন্য মাধ্যম তালবিয়া। তালবিয়া পাঠের সঙ্গে সঙ্গে হাজিদের হূদয়ের ঈমানের সুমধুর ঝংকার বেজে ওঠে। এর মাধ্যমে গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ে রুহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার বিদ্যুত্ প্রবাহ। এভাবেই ধীরে ধীরে তাকে প্রস্তুত করে তোলা হয় মহান ইবাদতের প্রতিটি রোকন আদায়ের জন্য। তাই তো কাফনসদৃশ শুভ্র ধুলায় ধূসরিত বিবর্ণ মলিন বদনে সবটুকু আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে হাজিগণ ধ্বনি তোলেন লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক-এর। বান্দা হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, বান্দা হাজির বলে।
এর মাধ্যমেই হজের পুরো সফর হয়ে ওঠে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। মধুময় হয়ে ওঠে আল্লাহ প্রেমের পথে তার এই পথ চলা। হজের হাকিকত ও তাত্পর্য সব সৌন্দর্যসহ স্বমহিমায় ভেসে ওঠে তার সামনে। তার প্রতিটি শিরায় শিরায় ধমনিতে প্রজ্বলিত করে দেয় তাওহিদের নুর। নিজেই নিজের ভেতরে সৌভাগ্যের রাজ্যে দুলতে থাকে।
(আরকানে আরবাআ অবলম্বনে)
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের যেসব ভুল হয়
হজ ও ওমরাহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজ ফরজ এবং ওমরাহ সুন্নত হলেও উভয়ই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ম...
ফযীলতপূর্ণ যিলহজ্ব মাস:
হিজরী বর্ষের সর্বশেষ মাস যিলহজ্ব। বড়ই ফযীলত পূর্ণ মাস এটি। ‘আশহুরে হুরুম’ তথা ইসলামের সম্মানিত চার ম...
হজ্বের বরকত ও ফযীলত
...
ایک سے زائد حج فقہ ترجیحی کی روشنی میں
وہ شخص جو اسلام کی ترجیحات سے واقف ہو اور ہر چیز کے درست مقام کا علم رکھتاہو، کبھی ان ترجیحات کے سلس...