প্রবন্ধ

কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীসের আলোকে রমাযানুল মুবারক

লেখক:মাসিক আলকাউসার
২১ মার্চ, ২০২৩
২৬৫৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

হিজরীবর্ষের নবম মাসটির নাম রমাযানুল মুবারক।  মাসের মর্যাদা  মাহাত্ম্য বলার অপেক্ষা রাখে না।  মাস আল্লাহ তাআলার অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্য লাভের উত্তম সময়পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎকৃষ্ট মৌসুম। ইবাদত-বন্দেগীযিকির-আযকার এবং তাযকিয়া  আত্মশুদ্ধির ভরা বসন্ত। মুমিন বান্দার জন্য রমযান মাস আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। তিনি এই মাসের প্রতিটি দিবস-রজনীতে দান করেছেন মুষলধারা বৃষ্টির মত অশেষ খায়ের-বরকত এবং অফুরন্ত কল্যাণ। মুমিনের কর্তব্যএই মহা নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ  আনন্দিত হওয়া। ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

 (তরজমা) (হে নবীআপনি বলুনএটা আল্লাহর অনুগ্রহ  তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতে তারা যেন আনন্দিত হয়। তারা যা কিছু সঞ্চয় করেএটা তার চেয়ে উত্তম।-সূরা ইউনুস (১০)-৫৮

 মাসে বান্দা পার্থিব সকল চাহিদা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দয়া  রহমত লাভ করবেঅতীতের সকল পাপাচার থেকে ক্ষমা চেয়ে নতুনভাবে ঈমানী জিন্দেগীর উত্তাপ গ্রহণ করবেতাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে পুরো বছরের ইবাদত  ইতাআতের শক্তি সঞ্চয় করবেচিন্তা-চেতনা  কর্ম-সাধনায় আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পিত করবে-এই হচ্ছে মুমিনের আনন্দ।

আল্লাহ তাআলা এই পবিত্র মাসকে যেসব গুণ  মর্যাদা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেনযত রহমতবরকত এবং দয়া  অনুগ্রহ দ্বারা একে মহিমান্বিত করেছেন মাসের নেক আমলগুলোর যত সওয়াব  প্রতিদান নির্ধারিত করেছেন তার হিসাব-নিকাশ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদীস শরীফের বিস্তৃত বর্ণনায় যে গুরুত্ব  বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছেতার কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উপকৃত করুন। আমীন।

সিয়াম  কিয়ামের মাস

মুসলিম উম্মাহর নিকট রমযান মাসের আগমন ঘটে প্রধানত রোযা  তারাবীহ বার্তা নিয়ে। এটি রমযান মাসের বিশেষ আমল। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্যপূর্ণ নিষ্ঠা 

আন্তরিকতার সাথে  দুই বিষয়ে যত্নবান হওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে মুমিনগণতোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছেযেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতিযাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বনকারী (মুত্তাকীহতে পার।-সূরা বাকারা (১৮৩অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন,

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি  মাস (রমযানপাবেসে যেন অবশ্যই তার রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকেতবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।-সূরা বাকারা-১৮৫

হযরত আবু হুরায়রা রা বলেন,

لما حضر رمضان، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : قد جاءكم رمضان، شهر مبارك، افترض الله عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب الجنة، وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتغل فيه الشياطين، فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم. قال الشيخ شعيب الارنؤوط فى تعليقه على المسند : هذا حديث صحيح، وإسناد رجاله رجال الشيخين.

যখন রমযান মাসের আগন ঘটলোতখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনতোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমযান এসেছে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য  মাসের রোযা ফরয করেছেন।  মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শিকলে বন্দী করা হয়।  মাসে এমন একটি রাত আছেযা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যান থেকে বঞ্চিত হলসে তো প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত।-মুসনাদে আহমদহাদীস-৭১৪৮ সুনানে নাসায়ী-হাদীস-২৪১৬মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকহাদীস ৮৩৮৩ মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহাদীস ৮৯৫৯

কুরআন নাযিলের মাস

রমাযানুল মুবারকের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল তা কুরআন নাযিলের মাস। এই পবিত্র মাসেই আল্লাহ তাআলা পূর্ণ কুরআন মজীদ লওহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ করেন। অতপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কুরআনের সর্বপ্রথম অহীও  মাসেই নাযিল হয়। রমযান মাসের অন্য কোনো ফযীলত যদি উল্লেখিত না হততবে এই এক ফযীলতই তার মর্যাদা  বিশেষত্বের জন্য যথেষ্ট হতো। রমযান মাসের পরিচয়  গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম এই বৈশিষ্ট্যের কথাই উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

(তরজমারমযান মাসযাতে কুরআন নাযিল হয়েছেযা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক্ব-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ  মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোযা রাখে।-সূরা বাকারা () : ১৮৫

শুধু কুরআন মজীদ নয়হযরত ইবরাহীম এর সহীফাতাওরাতযবুরইঞ্জিলসহ সকল আসমানী কিতাব  মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবারানী বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে এই বৈশিষ্ট্যও উল্লেখিত হয়েছে।

মুসলমানদের জন্য সর্বোত্তম মাস।

হযরত আবু হুরায়রা রাহতে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

ما اتى على المسلمين شهر خير لهم من رمضان ولا اتى على المنافقين شهر شرلهم من رمضان، وذلك لما يعد المؤمنون فيه من القوة للعبادة وما يعد فيه المنافقون من عفلات الناس وعوراتهم هو غنم المؤمن يغتنمه الفاجر.

قال الشيخ احمد شاكر فى تعليقه على المسند (8350) اسناده صحيح وفى (8856) اسناده حسن لغيره.

আল্লাহ তাআলার কসমমুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমযান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনগণ  মাসে (গোটা বছরের জন্যইবাদতের শক্তি  পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা  দোষত্রুটি অন্বেষণ করে।  মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।-মুসনাদে আহমদহাদীস ৮৩৬৮মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহাদীস-৮৯৬৮সহীহ ইবনে খুযাইমাহাদীস-১৮৮৪তাবারানী হাদীস-৯০০৪বাইহাকী শুয়াবুল ঈমানহাদীস-৩৩৩৫

রহমতের মাস।  মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।

ইতিপূর্বে উল্লেখিত একটি হাদীসে  বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।  ছাড়া আরো হাদীসে তা আছে। হযরত আবু হুরায়রা রাহতে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة، وغلقت أبواب النار، وصفدت الشياطين.

যখন রমযান মাসের আগমন ঘটেতখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।-সহীহ বুখারীহাদীস-১৮৯৮সহীহ মুসলিমহাদীস-১০৭৯ (), মুসনাদে আহমদ হাদীস-৮৬৮৪সুনানে দারেমীহাদীস-১৭৭৫

হযরত আবু হুরায়রা রাহতে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إذا كان رمضان فتحت أبواب الرحمة، وغلقت أبواب جهنم، وسلسلت الشياطين.

وفي رواية البخاري : إذا دخل شهر رمضان، فتحت أبواب السماء ...

রমযান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়।-সহীহ মুসলিম হাদীস-১০৭৯-

সহীহ বুখারী বর্ণনায় রয়েছেরমযান আরম্ভ হলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, ... হাদীস-১৮৯৯

মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেনমুমিন বান্দাগণ যাতে রমযান মাসের অতি মূল্যবান  বরকতপূর্ণ সময় নেক কাজে ব্যয় করতে পারে এবং মুনাফিকদের মত খায়ের  বরকত থেকে বঞ্চিত না থাকেতাই আল্লাহ তাআলা  মাসের শুরু থেকেই সৃষ্টিজগতে এমন আবহ সৃষ্টি করেনযা পুরো পরিবেশকেই রহমত-বরকত দ্বারা আচ্ছাদিত করে দেয় এবং মুমিনদেরকে ইবাদত-বন্দেগী  নেক আমলের উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাবে। তাদের পূণ্য  প্রতিদানের সুসংবাদ দিতে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং পাপাচার  খারাপ কাজ হতে বিরত রাখতে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সব ধরনের ফিতনা-ফাসাদ  অনিষ্ট হতে রক্ষা করতে কুমন্ত্রণাদাতা দুষ্ট জ্বিন  শয়তানদেরকে শিকল লাগিয়ে আবদ্ধ করা হয়। তারপর কল্যাণের পথে অগ্রগামী হওয়ার  অন্যায় থেকে নিবৃত্ত থাকার আহবান জানানো হয়। যেমন আবু হুরায়রা রাথেকেই বর্ণিত এক হাদীসে আছেআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن، وغلقت أبواب النار، فلم يفتح منها باب، وفتحت أبواب الجنة، فلم يغلق منها باب، وينادي منادٍ : يا باغي الخيرأقبل، ويا باغي الشراقصر، ولله عتقاء من النار، وذلك كل ليلة.

যখন রমযান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটেতখন দুষ্ট জ্বিন  শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়তার একটি দরজাও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়তার একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে-হে কল্যাণের প্রত্যাশীঅগ্রসর হওহে অকল্যাণের প্রার্থীথেমে যাও। আর আল্লাহ তাআলা  মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন।-মুসনাদে আহমদহাদীস ১৮৭৯৪বাইহাকী শুয়াবুল ঈমানহাদীস-৩৬০১সুনানে তিরমিযীহাদীস-৬৮২সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস-১৬৪২ মুসতাদরাকে হাকেমহাদীস-১৫৭২ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহাদীস-৮৯৬০

জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস এবং দুআ কবুলের মাস

পূর্বের হাদীসেই বর্ণিত হয়েছেআল্লাহ তাআলা  মাসের প্রতি রাত্রে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্যবেশি বেশি নেক আমল এবং তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেদেরকে এই শাহী ফরমানের অন্তর্ভুক্ত করা।

 প্রসঙ্গে অন্য হাদীসে হযরত জাবির রাথেকে বর্ণিত হয়েছেআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إن لله عند كل فطر عتقاء، وذلك في كل ليلة.

وقال البوصيري : رجال إسناده ثقات

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে।-সুনানে ইবনে  মাজাহহাদীস-১৬৪৩মুসনাদে আহমদহাদীস-২২২০২তবারানী হাদীস-৮০৮৮বায়হাকী-৩৬০৫

হযরত আবু হুরায়রা রাঅথবা আবু সাঈদ খুদরী রাবর্ণনা করেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إن لله عتقاء في كل يوم وليلة (يعني في رمضانلكل عبد منهم دعوة مستجابة.

قال الشيخ شعيب الارنؤوط : وإسناده صحيح على شرط الشيخين.

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসের প্রত্যেক দিবস  রাত্রিতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দুআ কবুল করেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস ৭৪৫০মুসনাদে বাযযারহাদীস-৯৬২

হযরত জাবির রাথেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إن لله في كل يوم وليلة عتقاء من النار في شهر رمضان، وإن لكل مسلم دعوة يدعو بها فيستجاب له.

وقال الهيثمى فى المجمع : رواه البزار، ورجاله ثقات.

রমযান মাসের প্রতিটি দিবস  রজনীতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম  থেকে মুক্তি দান করেন। প্রত্যেক মুসলিমের একটি দুআযা সে করেকবুল করা হয়।-মুসনাদে বায্যারহাদীস ৩১৪১মাযমাউয যাওয়াইদ১৭২১৫

দানশীলতার মাস

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাবলেন,

كان رسول الله صلى الله عيله وسلم أجود الناس، وكان أجود ما يكون في رمضان، حين يلقاه جبريل، وكان يلقاه في كل ليلة من رمضان فيدارسه القرآن، فلرسول الله صلى الله عليه وسلم أجود بالخير من الريح المرسلة.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তাঁর দানশীলতা (অন্য সময় হতেঅধিকতর বৃদ্ধি পেত রমযান মাসেযখন জিব্রীল তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জিব্রীল রমযানের প্রতি রাত্রে আগমন করতেন এবং তাঁরা পরস্পর  কুরআন শুনাতেন। তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল।-সহীহ বুখারীহাদীস-সহীহ মুসলিম হাদীস-২৩০৮মুসনাদে আহমদ২৬১৬

হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ আলজুহানী রাহতে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من فطر صائما كان له مثل أجره، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئًا.

قال الترمذى : هذا حديث حسن صحيح.

যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবেসে তার (রোযাদারেরঅনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোযাদারের প্রতিদান হতে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।-সুনানে তিরমিযীহাদীস-৮০৭মুসনাদে আহমদহাদীস-১৭০৩৩সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস-১৭৪৬সহীহ ইবনে হিববানহাদীস-৩৪২৯সহীহ ইবনে খুযাইমাহাদীস-২০৬৪

হযরত আবু হুরায়রা রাহতে বর্ণিততিনি বলেন-

من فطر صائما أطعمه وسقاه كان له مثل أجره.

رواه عبد الرزاق في مصنفه : وهو في حكم المرفوع، فمثله لا يعرف بالرأي،

যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে পানাহার করিয়ে ইফতার করাবেসে তার অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস-৭৯০৬

আমলের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধির মাস

রমযান মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে মাস মুমিনের নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধির মাস এবং আখেরাতের সওদা করার শ্রেষ্ঠ সময়। দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের যেমন বিশেষ বিশেষ মৌসুম থাকেযখন খুব জমজমাট ব্যবসা হয় এবং বছরের অন্য সময়ের তুলনায় আয়-উপার্জন  মুনাফা বেশি হয়তেমনি আখেরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার শ্রেষ্ঠ মওসুম হচ্ছে রমযান মাস।  মাসে আমলের দ্বারা অনেক বেশি মুনাফা লাভ করা যায়।  প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

عن ابن عباس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لامرأة من الأنصار، سماها ابن عباس فنسيت اسمها (وفي الرواية الأخرى : يقال لها أم سنان)، ما منعك أن تحجي معنا؟ قالت : لم يكن لنا إلا ناضحان، فحج أبو ولدها وابنها على ناضح وترك لنا ناضحا ننضح عليه، قال : إذا جاء رمضان فاعتمري، فإن عمرة فيه تعدل حجة.

وفي رواية أخرى لمسلم : فعمرة في رمضان تقضي حجة أو حجة معي.

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাবলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে বললেনবর্ণনাকারী বলেনতার নাম ইবনে আববাস রাউল্লেখ করেছিলেন কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি-(অন্য বর্ণনায় তার নাম উম্মে সিনান উল্লেখ করা হয়েছেতুমি কেন আমাদের সাথে হজ্ব করতে যাওনিতিনি বললেনআমাদের পানি বহনকারী দুটি মাত্র উট রয়েছে। একটিতে আমার ছেলের বাবা (স্বামী তাঁর ছেলে হজ্ব করতে গিয়েছেনঅন্যটি পানি বহনের জন্য আমাদের কাছে রেখে গিয়েছেন। তিনি বলেনরমযান মাস এলে তুমি উমরা করবে। কেননা  মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য। সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনরমযান মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য। অথবা বলেছেনআমার সাথে একটি হজ্বের সমতুল্য (সওয়াবের হিসাবে)-সহীহ বুখারীহাদীস১৭৮২সহীহ মুসলিম-১২৫৬মুসনাদে আহমদহাদীস-২০২৫

হযরত উম্মে মাকিল রাহতে বর্ণিতনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

عمرة في رمضان تعدل حجة.

رواه الترمذي في سننه، وقال حديث أم معقل حديث حسن غريب، ورواه أبو داود، وفي رواية أحمد عن أم معقل الأسدية، أنها قالت : يا رسول الله صلى الله عليه وسلمإني أريد الحج وجملي أَعْجَفُ، فما تأمرني، قال : اعتمري في رمضان، فإن عمرة في رمضان تعدل حجة.

রমযান মাসে উমরা হজ্বের সমতুল্য। -সুনানে তিরমিযীহাদীস-৯৩৯সুনানে আবু দাউদহাদীস ১৯৮৬।

অন্য বর্ণনায় রয়েছেউম্মে মাকিল রাবলেন-ইয়া রাসূলাল্লাহআমি তো হজ্ব করতে ইচ্ছুক। কিন্তু আমার উটটি দুর্বল। তিনি বললেনতুমি রমযান মাসে উমরা করো। কেননা রমযান মাসে উমরা (সওয়াব হিসেবেহজ্বের সমতুল্য। মুসনাদে আহমদহাদীস ২৭২৮৫

পাপ মোচন  গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস

হযরত আবু হুরায়রা রাবর্ণনা করেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة ورمضان إلى رمضان مكفرات ما بينهن، إذا اجتنب الكبائر.

পাঁচ ওয়াক্ত নামাযএক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।-সহীহ মুসলিমহাদীস ২৩৩ ()

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যেরমযান মাস হল মাগফিরাত লাভের মাসযে মাসে সকলের জন্য ক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ক্ষমা লাভের এমন সূবর্ণ সুযোগ পেয়ে যে ব্যক্তি নিজের পাপসমূহ ক্ষমা করাতে পারে না সে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত। হাদীস শরীফে তার জন্য বদ দুআ করা হয়েছে।

হযরত কা ইবনে উজরা রাহতে ©র্ণততিনি বলেন-

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : احضروا المنبر، فحضرنا، فلما ارتقى درجة قال آمين، فلما ارتقى الدرجة الثانية قال آمين، فلما ارتقى الدرجة الثالثة قال آمين، فلما نزل، قلنا : يا رسول اللهلقد سمعنا منك اليوم ما كنا نسمعه، قال : إن جبريل عرض لي فقال بعد من أدرك رمضان فلم يغفر له، قلت أمين، فلما رقيت الثانية، قال : بعد من ذكرت عنده فلم يصل عليك، قلت : آمين، فلما رقيت الثالثة، قال بعد من أدرك أبويه الكبير أو أحدهما فلم يدخلا الجنة، قلت : آمين.

رواه الحاكم، وقال : صحيح الإسناد، واورده الهيثمى فى المجمع وقال : رواه الطبرانى ورجاله ثقات.

একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেনতোমরা মিম্বরের নিকট সমবেত হও। আমরা সকলেই তথায় উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম সিড়িতে পা রাখলেনতখন বললেনআমীনযখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেনআমীনযখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেনআমীন।

হযরত কা ইবনে উজরা রাবলেনযখন তিনি (মিম্বর থেকেঅবতরণ করলেনআমরা জিজ্ঞেস করলামইয়া রাসূলাল্লাহআজ আমরা (মিম্বরে উঠার সময়আপনাকে এমন কিছু কথা বলতে শুনেছিযা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। উত্তরে তিনি বললেনজিব্রীল আমার নিকট আগমন করেছিলেনযখন আমি প্রথম সিড়িতে পা রাখলামতখন তিনি বললেনধ্বংস হোক  ব্যক্তি যে রমযান মাস পেলতবুও তার গুনাহ মাফ হল না। আমি বললামআমীন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম তখন বললেনধ্বংস হোক  ব্যক্তি যার নিকট আপনার নাম উচ্চারিত হল অথচ সে আপনার প্রতি দরূদ পড়ল না। আমি বললাম আমীন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলামতখন বললেনধ্বংস হোক  ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তারা উভয়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। অর্থাৎ তাদের খেদমতের মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না। আমি বললামআমীন। মুসতাদরাকে হাকেমহাদীস - ৭৩৩৮মাযমাউয যাওয়াইদহাদীস-১৭৩১৭

হযরত আবু হুরায়রা রাথেকেও  হাদীস বর্ণিত হয়েছে। দেখুন : আলআদাবুল মুফরাদহাদীস ৬৪৬মুসনাদে আহমদহাদীস-৭৪৫১সহীহ ইবনে খুযায়মাহাদীস-১৮৮৮সুনানে তিরমিযীহাদীস-৩৫৪৫সহীহ মুসলিমহাদীস-২৫৫১

হযরত আবু হুরায়রা রাবলেন,

أول ما يصيب صاحب رمضان الذي يحسن قيامه وصيامه أن يفرغ منه وهو كيوم ولدته من الذنوب.

রমযান মাস লাভকারী ব্যক্তি-যে উত্তমরূপে সিয়াম  কিয়াম (রোযাতারাবী  অন্যান্য আমলপালন করে-তার প্রথম পুরস্কার এই যেসে রমযান শেষে গুনাহ থেকে  দিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।-মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহাদীস-৮৯৬৬

লাইলাতুল কদরের মাস

আল্লাহ রাববুল আলামীনের পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহর জন্য আরেকটি বিশেষ দান হল এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম লাইলাতুল কদর। এই রাত এত মর্যাদাশীল  বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যেএক হাজার রাত ইবাদত করলে যে সওয়াব হতে পারেএই এক রাতের ইবাদতে তার চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।

আল্লাহ তাআলা  রাত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ  تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ  سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

 (তরজমালাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।  রাতে ফেরেশতাগণ  রূহ (জিব্রীল .) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্ত্ত নিয়ে পৃথিবীতে অবতরন করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তিযা ফযর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।-সূরা কদর (৯৭) : -

এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়।

হযরত আনাস ইবনে মালেক রাবর্ণনা করেন-

دخل رمضان، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن هذا الشهر قد حضركم، وفيه ليلة خير من ألف شهر، من حرمها فقد حرم الخير كله، ولا يحرم خيرها إلا محروم.

قال المنذري : إسناده حسن، إن شاء الله، وكذا قاله البوصيري.

রমযান মাসের আগমন ঘটলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশে বললেনতোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছেতাতে এমন একটি রাত রয়েছেযা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি  রাতের কল্যান থেকে বঞ্চিত হলসে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। একমাত্র (সর্বহারাদুর্ভাগাই  রাতের কল্যান থেকে বঞ্চিত হয়।-সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস-১৬৪৪

তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিতইবাদত-বন্দেগীযিকির-আযকারতাসবীহ-তাহলীল  অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে  রাতের খায়ের-বরকত লাভে সচেষ্ট থাকা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

কুরআন তিলাওয়াত ও তারাবীর তিলাওয়াত : আমাদের অসতর্কতা

...

মাওলানা মাসরূর বিন মনযূর
৯ নভেম্বর, ২০২৪
৩৬৭৫ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →