প্রবন্ধ

রক্তাক্ত টঙ্গীর ইজতেমার ময়দান; প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

লেখক:মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব
১০ জানুয়ারী, ২০২৩
১৩৬৯ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

রক্তাক্ত টঙ্গীর ইজতেমার ময়দান; ইতিহাসের কালো অধ্যায়


ইজতেমার প্রস্তুতি কাজে অনেক আগে থেকেই ময়দানে যেতাম। ছাত্র-উস্তাদ সকলেই যেতেন। ময়দানের এ খেদমতটা স্বতঃস্ফ‚র্ত হওয়ায় ‘যাওয়া-আসা-কাজ’ পুরো ব্যাপারটাই উৎসবমুখর হতো।  ফজর পড়েই সকাল সকাল ময়দানে যাওয়া, কাজে নেমে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লেগে যাওয়া, কাজ শেষে চোঁ-চোঁ পেটে হাপুস-হুপুস খাবার খাওয়া, গাড়ি আসতে বিলম্ব হলে দলবেঁধে কেনাকাটা করাÑ সব মিলিয়ে দিনটা যে কী আনন্দে কেটে যেতো বুঝতেই পারতাম না। দিনটিকে একপ্রকার ঈদ-ঈদ মনে হতো। এই দিনটির জন্য আমরা আলাদা করে প্রতীক্ষায় থাকতাম। আর কাজে শরীক হতে পারাকে তো মহা-সৌভাগ্যের মনে করতাম। উস্তাদ হয়েছি আজ আট বছর। বিভিন্ন রকম দায়িত্ব ও ব্যস্ততা সত্তে¡ও প্রায় প্রতি বছরই কাজে শরীক হয়েছি। এ বছরও ইজতেমার প্রস্তুতিমূলক কাজের সুবাদে ১লা ডিসেম্বর’১৮, শনিবার ময়দানে ছিলাম। আগের দিন জুমু‘আর দায়িত্ব পালন করে মসজিদ থেকেই সরাসরি ময়দানে চলে গিয়েছি। ময়দানে তখন উলামায়ে কেরামকে মুহাব্বত করেন, আলেম-উলামার পরামর্শে চলেন এমন সাথীরা ছিলেন। ময়দানে রীতিমত মশওয়ারা, তালীম, বয়ান, আমল সবকিছুই ইহতিমামের সাথে চলছিল। হালতের কারণে জোরদার পাহারাদারীও ছিলো। মুরুব্বীগণের পরামর্শে মাদরাসার তালেবে ইলম, আলেম-উলামাদের মাধ্যমে কুরআন তিলাওয়াত, সূরা ইয়াসীন ও দু‘আরও বিশেষ ইহতেমাম চলছিলো। আমি মুরুব্বীদের বলতে শুনেছি, ‘মাদরাসার উলামা-ত্বলাবার মাধ্যমে ময়দানের কাজ সম্পন্ন করার মাকসাদ আমাদের কখনোই ছিলো না বা থাকে না বরং তাদের পবিত্রতম ও বরকতময় যবান, কদম ও হাত যখন ময়দানের কাজে ব্যবহার হয় তখন আমাদের কাজে এতোটাই তারাক্কী ও গতি আসে যা বলে শেষ করার নয়। খোদ টঙ্গীর ময়দানে অবস্থিত আমাদের কাকরাইল কর্তৃক পরিচালিত কওমী মাদরাসাটাও এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখে কায়েম করা হয়েছে।’ 

এ কারণে বাংলাদেশে ইজতেমার সেই সূচনালগ্ন থেকে কওমী মাদারাসার উলামা-তলাবা বেশী থেকে বেশী ময়দানে শরীক হয়ে আসছেন। এবারই প্রথম ছাত্ররা কাজ করতে গিয়েছে বিষয়টি কখনই এমন নয়। আমার তো মনে হয়, আজকে যারা বড়, সমাজের সর্বদিকের দীনী জরুরত পুরা করছেন, হক্কানী এমন একজন আলেমও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা ছাত্র যামানায় ইজতেমার কাজে শরীক হননি; বরং তারা প্রত্যেকেই ময়দানের আমলে শরীক হওয়াকে নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করতেন এবং এখনো করেন।

শুক্রবার দিবাগত রাতটি আমি ময়দানে কাটিয়েছি। দেখেছি, গভীর রাতে সাথী ও ছাত্রভাইয়েরা তাহাজ্জুদ পড়ে কতোটা রোনাজারী ও হাউমাউ করে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ঝরিয়েছে। মকবূল মেহনতটি যেন কারো স্বার্থের জন্য শেষ না হয়ে যায় এজন্য তারা অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন! প্রত্যেকেই ময়দানে যতক্ষণ ছিলেন, কোন না কোন আমলে ফজর পর্যন্ত গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন।

শনিবার, বাদ ফজর। পুরো ময়দানে হূলস্থুল কাÐ। কে বা কারা সংবাদ রটিয়ে দিল, সারাদেশের এতায়াতিরা একযোগে ময়দানে প্রবেশ করবে; সুতরাং যে যা পাও, তা নিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তোলো। আর যাদের হোন্ডা আছে তারা ময়দানের বাইরে গিয়ে পাহারাদারী জোরদার করো। সংবাদটা আমার মতো অনেকের কাছেই সন্দেহজনক মনে হয়েছিলো। কারণ, আমাদের মুরুব্বীদের দিকনির্দেশনা ছিলোÑ ‘দুনিয়াতে আসবাব ইখতিয়ার করতে হয় তাই আমরা শুধু সুন্নাত পালনার্থে পাহারার আমল করছি, ময়দান তো আল্লাহ তা‘আলা হেফাযত করবেন।’ পরে দেখা গেলো, সত্যিই গোপনে একদল মুনাফেক ময়দানে ঢুকে হাঙ্গামার জন্য এসব গুজব ছড়াচ্ছিলো। আল্লাহর মেহেরবানী আমরা গুজবে প্রভাবিত হইনি। প্রত্যেকেই নিজেদের মামুলাত আদায় করছিলাম। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই সাথীরা দু’জন এতায়াতিকে ধরতেও পেরেছিল। তবে তাদেরকে কোন কিছুই বলা হয়নি। মশওয়ারার কামরায় সম্মানজনকভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো। তবে এতায়াতিরা ময়দান দখলের পর সেই দুই ব্যক্তি আমাদের সাথে কতোটা হিং¯্র আচরণ করেছিল সেটা বলার মতো নয়।

সকাল দশটা। মুহাম্মদপুরের সাথীগণ ও উলামা-ত্বলাবা ময়দানের উত্তর দিকের গেটগুলোতে সতর্কভাবে পাহারার আমল করছিলো। আমার ছাত্র ও মহল্লার সাথীদের নিয়ে আমি বিদেশী কামরার পার্শ্ববর্তী একটি গেটে পাহারায় ছিলাম। হামলার শেষ পর্যন্ত আমরা সেখানেই ছিলাম।

এতায়াতিরা শনিবার ফজর থেকেই ময়দানের চারপাশের রাস্তাগুলোতে মজবুত অবস্থান নিয়েছিলো। প্রতিটি গেটের সামনে জটলা করে হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে বাহ্যত বিভিন্ন বয়ান ও তালীম করছিলো। আসলে তখন ওরা প্রত্যেককে হামলা ‘দায়িত্ব’ বুঝিয়ে দিচ্ছিল এবং তালীমের ফাঁকে ফাঁকে ভেতরে অবস্থানরত উলামা-ত্বলাবাদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় এমনসব গালাগালি করছিলো যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। আমি নিজ কানে শুনেছি, আমাদেরকে লক্ষ্য করে  ওরা হ্যান্ডমাইকে চিৎকার করে বলছিলো, ‘ছাত্ররা তোমরা ময়দান থেকে বেরিয়ে যাও। উস্তাদরা তোমাদেরকে ভুল বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে। তোমাদের উস্তাদরা মুনাফিক। ইহুদীদের এজেন্ট। ইসলামের দুশমনী করার জন্য তারা তোমাদের এখানে এনেছে। তাদের কথা তোমরা শুনবে না। আমরাই তো তাদের বেতন দেই। আমাদের বেতন খেয়ে খেয়ে এসব আলেম-উলামাদের তেল বেড়ে গেছে... (নাঊযুবিল্লাহ)। এমন সব অবাস্তব, বাজে ও বেয়াদবীমূলক কথা বলে বলে ওরা আমাদেরকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছিলো এবং ক্রমাগত করেই যাচ্ছিল। রক্তে-মাংসে গড়া কোন মানুষের পক্ষে এসব বরদাশত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। আমারও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। আমি মুরুব্বীদের কামরায় এসে পরামর্শ দিলাম, হযরত! ওদের লাগামহীন হুমকি-ধামকি আর গালিগালাজ তো আমরা বরদাশত করতে পারছি না। ময়দানের ভেতরে তো ওদের হ্যান্ড মাইকের তুলনায় শক্তিশালী বহু মাইক রয়েছে, প্রতিটি গেটে যদি সেগুলো লাগিয়ে জোর আওয়াজে বয়ান করা হয় এবং কুরআন-হাদীসের ক্ষেত্রে মাওলানা সাদ সাহেবের ভুল ও অপব্যাখাগুলোর প্রকৃতরূপ তুলে ধরা হয় তাহলে গ্রাম-গঞ্জের যেসব সাধারণ মানুষকে এতায়াতিরা থেকে মিথ্যা বলে, ভুল বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে তারা সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। আমার কথা শুনে মুরুব্বীরা বললেন, সকল গেটে তালীম মজবূত করুন এবং প্রতিটি সাথীর তালীমে বসা নিশ্চিত করুন। ওদের মোকাবেলায় আমরাও যদি মাইক ব্যবহার করে কিছু বলতে থাকি তাহলে ওরা উত্তেজিত হয়ে উঠবে। হাঙ্গামা শুরু করে দিবে। এতে খায়ের না-ও হতে পারে। 

আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি, তারপর একেবারে শেষ প্রর্যন্ত প্রতিটি গেটে তালীম নিশ্চিত হয়েছিলো। গেটের সামনে আমাদের সাথীরা বসে বসে তালীম করছিলো আর বিভিন্ন দু‘আ-দুরূদ পড়ছিলো। যারা মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত তারা অবশ্যই দেখে থাকবেন, এতায়াতিরা যখন বাটা গেটে হামলা করেছিলো ভিতরে তখনও আমাদের সাথীরা পশ্চিমমুখী হয়ে তালীম করছিলো। তারপর এতায়াতিরা আমলরত এসব আলেম-উলামা, মাদরাসার ছাত্র ও সাধারণ সাথীদের উপর যে নৃশংস হামলা চালিয়েছে তা তাবলীগের নাম ব্যবহারকারী কারও দ্বারা কখনও হতে পারে, কেউ কল্পনাও করেনি।

ওরা ভেতরে যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই পিটিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। ময়দানের মাল-সামানার গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সামনে যা কিছু পেয়েছে সবকিছুই তছনছ করে দিয়েছে। শত শত হোন্ডা, প্রাইভেটকার, সাথীদের মাল সামানা, প্লেট, বাটি, বালতি, চুলা এমনকি মশওয়ারার কামরা কিছুই ওদের তাÐব থেকে রেহাই পায়নি। যা কিছু ধ্বংস থেকে রেহাই পেয়েছে সেগুলোর ভালো অংশও ‘গনীমতের মাল’ ফাতাওয়া দিয়ে হালাল করে ফেলেছে। 

দীনের লেবাসধারী কোন মানুষ এতোটা নীচে নামতে পারে, এতোটা নৃশংস ও হিং¯্র হয়ে উঠতে পারে, এতায়াতিদের সেদিনকার তাÐব স্বচক্ষে না দেখলে এর ধারণাও করতে পারতাম না। আক্রমণের হিং¯্রতা দেখে সাথীরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। কী করবে বুঝেই উঠতে পারছিলো না। আমরা তুলনামূলক বড়রাও ওদের তাÐব দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম। কতোটা নির্দয় ও পাষাণ হলে এসব নিরীহ ছাত্র, হাফেযে কুরআন, আলেম-উলামা, মুরুব্বী সাথীদের উপর এমন নির্বিচারে খুন-খারাবি শুরু করতে পারে? আক্রমণের তীব্রতায় কেউ কেউ হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলো। যারা ঘুমিয়ে ছিলো, যারা নামাযে দাঁড়িয়ে ছিলো যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে তাকে সেখানেই পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। হাতে-পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েও নিষ্পাপ হাফেয ও তরুণ আলেমরা ওদের হিং¯্রতা থেকে  রেহাই পায়নি। বয়োবৃদ্ধ পুরনো তাবলীগী সাথীরা কাকুতি-মিনতি করেও নিজের দুর্বল শরীরটিকে রক্ষা করতে পারেনি। একেকটি শরীর আঘাতে আঘাতে যতক্ষণ না নিথর হয়েছে কিংবা ওরা মনে করেছে মরে গিয়েছে ততক্ষণ ওরা থামেনি। খোঁজে খোঁজে আলেমদেরকে বিশেষ টার্গেট করে হামলা করেছে। কোন একজন আলেমকে পেয়েছে তো এমন উল্লাস করে পিটিয়েছে মনে হয়েছে শুত্রæপক্ষের কাফের কোন সেনাপতিকে বাগে পেয়েছে। নাবালেগ তালেবে ইলমদেরকেও ওরা রেহাই দেয়নি। ময়দানের ভিতর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় গিয়ে কুরআন পড়া অবস্থায় সেখানের নিষ্পাপ শিশুদেরকে মাথায় তুলে তুলে আছড়ে দিয়েছে। ফুটবলের মতো লাথি মেরে মেরে নিজেদের ক্ষোভ মিটিয়েছে। বাঁচার জন্য যারা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলো তাদেরকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেখান থেকে বের করে দলবদ্ধভাবে পিটিয়েছে। কাউকে কাউকে পালাক্রমে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছে কিংবা নদীতে নিক্ষেপ করেছে।

প্রিয় পাঠক! আপনাদের যদি ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটে তাহলে সেদিন ময়দানের রক্তাক্ত, নির্মম কিছু উপাখ্যান তুলে ধরতে চাই। জাতি দেখুক, এতায়াতিরা কতটা হিং¯্র ও পাষাণে পরিণত হয়েছে। 

হাফেয শহীদুল ইসলাম। 

পিতা: আমীনুল ইসলাম, গ্রাম: ওয়েস্টার্ন পাড়া, থানা: লালমোহন, জেলা: ভোলা।

অবস্থান ও অধ্যয়ন: মুহাম্মদপুর ঢাকা- ১২০৭

ছেলেটির বয়স ঊনিশ। হাফেযে কুরআন। কওমী মাদরাসার মাধ্যমিকের মেধাবী ছাত্র। একেবারেই নি¤œআয়ের অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। হালকা গড়নের রুগ্ন-ক্ষীণকায় একটি শরীর। চেহারায় স্পষ্ট ন¤্রতার ছাপ। প্রথম দেখাতে যে কোন পাষাণের মনেও মায়া উথলে উঠবে। ছেলেটি ময়দানে আমার সাথেই ছিলো। কিছুক্ষণ জোর আওয়াজে কিতাবের তালীমও করেছিলো। তারপর বসে বসে তালীম শুনছিলো। এতায়াতিরা প্রথম যখন ময়দানের উত্তর দিকে বিদেশী মেহমানদের নিকটবর্তী গেইটের দিক হতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেছিলো তখনি সে মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি যখন দেখেছি তখন ওর মাথার তাজা রক্তগুলো গাল বেয়ে বুকে নেমে এসেছে। অসহায় আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। নিজেকে কখনো অতোটা অসহায় মনে হয়নি। বারবার পেরেশান হয়ে যাচ্ছিলাম, কী হবে এখন? বা কী করবো এখন? চোখের সামনে একের পর এক ছাত্রদের তাজা রক্তে যমীন ভেসে যাচ্ছে। হতাহতদের নিয়ে কোথাও নিরাপদে বের হবো সেই সুযোগটাও নেই। চারদিক দিক দিয়েই ময়দান ওরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এতায়াতিগুলো এতোটাই হিং¯্র হয়ে ওঠেছে আহত মৃতপ্রায় ছেলেগুলোও হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছিল না। 

কয়েকজন ছাত্র দিয়ে আহত শহীদকে আমি মুরুব্বীদের মশওয়ারা কামরায় পাঠিয়ে দিলাম। আরো অনেক আহত সাথীরা সেখানে নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিয়েছিলো। তারপর কি হয়েছে, আমি বলতে পারবো না। ততক্ষণে আমরাও হামলার মুখে পড়ে গেছি। কোনমতে আল্লাহর মেহেরবানীতে আমরা শেষদিকের একটি গেট দিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমার সাথে যেসব ছাত্র ছিলো তারপর আর ওরা আক্রান্ত হয়নি। আল্লাহ রক্ষা করেছেন। বাকি, হামলার শুরুতেই আমার আরও আশি-নব্বই জন ছাত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। যাদের প্রত্যেকেই এতায়াতিদের কোন না কোন হামলার শিকার হয়েছিলো। মারাত্মভাবে যখমী হয়েছিলো।

বলছিলাম, শহীদুল ইসলামের কথা। ওকে পাঠিয়ে দিয়েছি মুরুব্বীদের কামরায়। সেখানে আমি যাইনি। তবে শুনেছি, মুরুব্বীদের মশওয়ারা কামরাতেও ওরা তাÐব চালিয়ে সব তছনছ করে দিয়েছিলো। আমার ছাত্র শহীদ তখনও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে সেখানেই যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো। তার মুখেই শুনুন, সেই নির্মমতার কথা-

আমরা অনেকেই আহত হয়ে মুরুব্বীদের মশওয়ারার কামরায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। যখন দেখলাম, ওরা সবকিছুই ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে। তখন কম আহত সাথীরা যে যার মত করে এদিক সেদিক পালিয়ে গিয়েছিলো। আমরা চারজন খুব আহত থাকায় বাইরে বেরোতে পারিনি। কোনরকমে একটি টয়লেটে ঢুকে পড়েছিলাম। চারদিক থেকে আক্রান্ত উলামা-ত্বলাবাদের আর্তনাদ শুনছিলাম। আর আসন্ন বিপদের কথা মনে করে আঁৎকে উঠছিলাম।

আমি আহত। পুরো শরীর রক্তে ভিজে  গেছে। পাঞ্জাবীটাও গায়ের সাথে লেপটে আছে। মাথাটা ব্যথায় চিন চিন করছে। আগে থেকেই আমি অসুস্থ। মরণব্যাধি টি.বি. আমাকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। চেহারায় তার আলামত স্পষ্ট। মনে করেছিলাম, হয়তো এসব দেখে ওদের একটু দয়া হবে। না, ওদের বিন্দুমাত্রও দয়া হয়নি। হঠাৎ ভারী কিছুর ক্রমাগত আঘাতে ওরা টয়লেটের দরজা ভেঙ্গে ফেললো। আমি তখনো প্যানের উপর পড়ে থেকে বাঁচার আকুতি করছিলাম। ষÐা মতো একলোক এসে আমাকে টয়লে থেকে বের করে বাইরে ছুঁড়ে মারলো। ক্ষুধার্ত নেকড়ে অসহায় শিকারের উপর যেভাবে হামলে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এতায়াতিগুলোও আমার উপর তেমনই উল্লাসে হামলে পড়লো। আমি একজনের পায়ে পড়ে প্রাণ-ভিক্ষা চাইছিলাম, দেখুন, আমার মাথাটা ফেটে কেমন হা হয়ে আছে, রক্তক্ষরণে নড়তে পারছি না, জিহবা-গলা সব শুকিয়ে গেছে। আমি মনে হয় বাঁচবো না, আমাকে বাঁচান। কিন্তু ওরা শুনেনি। একের পর এক আঘাত করেই যাচ্ছে, শরীরের কোন অংশই ওদের আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনে মনে কালিমা পড়ছিলাম।

ওদের নৃশংসতা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু হয়নি। একজন এসে আমার গলায় কোপ বসিয়ে দিলো। মনে করলাম, এই বুঝি আমি শেষ। হয়তো সেটাই ভালো হতো তখন আমার ‘শহীদুল ইসলাম’ নামের স্বার্থকতা অটুট থাকতো। তেমনটি হয়নি। কেন যেন তখন শেষবারের মতো দুমাস আগে দেখে আসা মায়ের মলিন মুখখানা চোখে ভেসে ওঠলোÑ মাকে হয়তো আর দেখতে পাবো না। জানি না, এই হিং¯্র খুনিগুলো আমার লাশটা অভাগী মাকে দেখতে দিবে কিনা? সেবার বাড়ি থেকে মাদরাসায় ফেরার সময় আদরের ছোট বোনটিকে ঢাকায় নিয়ে আসি। সে আমার পাশেই এক হিফয বিভাগে পড়ে। প্রতিদিন বিকেলে ও আমার অপেক্ষায় থাকে। কোন দিন যেতে একটু দেরি হলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ওই মুহূর্তে বার বার মাদরাসায় অপেক্ষায় থাকা বোনটির কথাও মনে পড়ছিলো। ভাবছিলাম, আমার সাদাসিধে প্যারালাইজ্ড বাবা এই শোক সইতে পারবেন তো? বলতে পারেন? এমন ভয়ংকর মুহূর্তে কারো কি এতোসব মনে পড়ে? হ্যাঁ, আমার মনে পড়ছিলো। আমি যে তখন জীবন শেষের মৃত্যু দেখছিলাম। কিন্তু আল্লাহ তা চাননি। কোপের আঘাতটি গলায় তেমন কোন ক্ষত করতে পারেনি। খুনিটা তারপরও থামেনি। আমার যে হাতগুলো দূর্বলভাবে নড়েচড়ে ওর কোপগুলো ঠেকানোর বৃথা চেষ্টা করছিলো সেটাতে সর্বশক্তি ব্যায় করে আর একটি কোপ বসিয়ে দিলো। তারপর কি হয়েছে আমি আর বলতে পারছি না। যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন নিজেকে মশওয়ারা কামরার বাইরে পড়ে থাকতে দেখি। মনে হচ্ছে, জ্ঞান হারানোর পর ওরা আমাকে কামরার বাইরে ফেলে দিয়েছিলো। বাঁচার জন্য এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম। পাশেই তখন মুহাম্মদপুরের আমাদের মসজিদের এক এতায়াতি সাথীকে দেখতে পেলাম। তাকে বললাম, ভাই! আমাকে একটু বাঁচান। সে আমাকে ফিরেও দেখেনি, তার আরেক সাথীর অজুহাত দেখিয়ে জলদি কেটে পড়েছিলো। বেশ অবাক হলাম, মানুষ এতোটা নির্দয়, নিষ্ঠুর হতে পারে? এতায়াতি হলেই কি এমন হিং¯্র হতে হয়?

আমি সেখানেই পড়ে ছিলাম। একসময় দুই ভদ্রলোকের বোধহয় আমার প্রতি দয়া হলো। তারা আমাকে যতœ করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। প্রাথমিক চিকিৎসার যাবতীয় খরচও বহন করলেন। সাথীরা যখন আমাকে নিয়ে আসার জন্য হাসপাতালে গেল, তখন তারা আমার সাথী ভাইদের হাত ধরে খুব কেঁদেছিলেন। বলছিলেন, আমরা বিভ্রান্তির শিকার। আমাদেরকে বলা হয়েছে, সাত ডিসেম্বরের ‘জোড়’ ত্রিশ নভেম্বর করার ফায়সালা হয়েছে। শুধু সেই দুই ভদ্রলোকই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন এমন নয়; বরং মিথ্যা বলে বলে এতায়াতিরা এমন অনেক সাধাসিধে ভাইদেরকে সেদিন বিভ্রান্ত করেছিলো এবং নৃশংস হামলায় শরীক করেছিলো। তারপর ভুল বুঝতে পেরে তারা তওবাও করেছিলেন। এখন তারা কেমন আছেন জানি না। আল্লাহ তাদেরকে কবুল করেন। 

আমি আজও বিছানা থেকে উঠতে পারি না। আগের দুরারোগ্য টি.বি নতুন করে দেখা দিয়েছে। মাথার দুুটি পাশই ফেটে যাওয়ায় এখনো ভীষণ যন্ত্রণা হতে থাকে। হাতের ক্ষতগুলোও ভালো করে শুকায়নি; পুঁজ হয়ে ফুলে আছে। এদিকে মাদরাসা ছেড়ে বাড়িতে একাকী পড়ে থাকাও যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাক্ষণ দরস আর সাথীদের কথা মনে পড়ে। কখন যে চোখের পানি বুকে নেমে আসে নিজেও বলতে পারি না। অভাগী মা তখন কপালে হাত বুলিয়ে সান্ত¦না দেন। হঠাৎ হঠাৎ ছোট বোনটি ঘরে ঢুকে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আমি ভাবতে থাকি। ভাবনাগুলো খুব এলোমেলো হয়ে যায় এখন। বারবার মনে হয়, আমি কী পারবো আগের মতো দরসে ফিরে যেতে? পারবো একজন যোগ্য হক্কানী আলেম হতে?

প্রিয় পাঠক! টঙ্গীর ময়দানের সেই নৃশংস হামলায় এমন শত-শত ‘শহীদুল ইসলাম’ দরসগাহের পরিবর্তে হাসপাতালের বেডে অথবা ঘরে শুয়ে কাতরাচ্ছে। তাদের ক’জনের খবরই-বা আমরা জানি!

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

দ্বীনের খেদমত ও দাওয়াত

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৬৮৪৪ বার দেখা হয়েছে

স্রষ্টা ও তাঁর অস্তিত্ব

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
৯ নভেম্বর, ২০২৪
১২৪৬ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →