প্রবন্ধ

রাসূল প্রেম ও গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি

লেখক:মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব
৮ জানুয়ারী, ২০২৩
১৪৪৪০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

অগণন মানুষ। দৃষ্টি সীমার শেষ পর্যন্ত। প্রায় সকলেই শুভ-সফেদ পোশাকে আবৃত। তেজদীপ্ত এবং বিক্ষুব্ধ। নদী তরঙ্গের মতো  এগিয়ে চলছে সম্মুখে। যেন অবিরাম গতিতে ছুঠে চলা কোনো স্রোতধারা। এ এক বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার। থামাবার হিম্মত কারো নেই। ওরা নবী প্রেমিক। রাসূলের ভালোবাসায় সিক্ত। পৃথিবীর সব কিছুর ঊর্ধ্বে ওদের রাসূল ; যিনি পিতা-মাতা , স্ত্রী-পুত্র থেকেও দামী এবং প্রিয়। চোখের পলকে নিজেদের একমাত্র প্রাণটাও কুরবান করে দিতে পারে রাসূল প্রেমে। অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারে জীবনের সব কিছু এবং সমস্ত অর্জন। আজ ওরা রাসূলের জন্য লড়ছে। কাফের জালেমদের বিরুদ্ধে একসাথে। সর্বত্রই তেজদীপ্ত কন্ঠে ধ্বনি প্রতি:ধ্বনিত হচ্ছে” 

নারায়ে তাকবীর ; আল্লাহু আকবার।    

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।

বিশ্ব নবীর অপমান ; সইবেনারে মুসলমান।

বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধরো ; শাতিমে রাসূলের বিচার করো। 

আর সব চেয়ে বেশী যে ধ্বনি উচ্চকিত হচ্ছে তাহলো “ ফ্রান্সের পন্য ; বর্জন করো করতে হবে। 

ফ্রান্সের দূতাবাস ; বন্ধ করো করতে হবে ।

ম্যাক্রোঁর দুই গালে ; জুতা মারো তালে তালে। ইত্যাদি মুহুর্মুহু শ্লোগান চলছে তো চলছেই। 

ঘটনার সূত্রপাত:

গত ১৬ অক্টোবর ২০২১ ঈসায়ী। মধ্যে দুপুর কিংবা তারও কিছু আগে। ফ্রান্সের বিখ্যাত প্যারিসের শহরতলী এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় এক স্কুল শিক্ষককে। যে দুর্ভাগা মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ের স্পন্দন , সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মানব, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্লাসে কার্টুন দেখিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেছিল। প্রথমে ছোট ছোট শিক্ষার্থী তারপর অভিভাবক কর্তৃক নিষেধ সত্ত্বেও ওই দুর্ভাগা-রাসূলের শানে গোস্তাখী করতেই থাকে। এমনকি অভিযোগকরা সত্ত্বেও স্কুল কতৃপক্ষও বিষয়টি কোন আমলে নেয় নি। তারপর রাসূল প্রেমে দেওয়া হয়ে অজ্ঞাত এক মুসলিম তরুণ সেই স্কুল শিক্ষক কে হত্যা করে।

খবরে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁনের উপস্থিতিতে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের পর সেই দুর্ভাগা স্কুল শিক্ষককে সমাধিস্থ করা হয়। মত প্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীতার জন্য এই হত্যাকান্ড কে বড় হুমকি মনে করেছে দেশটির মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই বিতর্কিত কার্টুনটি সমানে প্রচার করতে শুরু করেছে তারা। 

খবরে আরও জানা যায়, ফ্রান্সের সরকারি বহুতল ভবনেও প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হচ্ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ব্যঙ্গ করা সেই কার্টুন। 

তাছাড়া আরও সাড়ে পাঁচ বছর আগে শার্লি এবদো নামের এক ফরাসী পত্রিকা হজরত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ব্যঙ্গ করে কার্টুনটি আবারও ছাপানোর ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও এর পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। প্রেসিডেন্ট জানিয়েছে, হজরত মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিতর্কিত কার্টুন ছাপানো নিয়ে নিন্দা জানাবে না। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও এসব হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।

এ ছিল মাত্র একটি দেশের চিত্র। বিশ্বের যাবতীয় মানব রচিত বিধানের বিরোধী হওয়ায় ইসলাম ও তার নবী পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই নিপীড়িত-নির্যাতিত। উপমহাদেশেও ইসলাম বিদ্বেষীদের কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। মুক্ত চিন্তার নামে বাংলাদেশেও নাস্তিকদের দৌরাত্মের কথা কারো অজানা নয়। কোনো এক রহস্যময় কারণে প্রায় বিরানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের সরকার নীরব সমর্থন যোগাচ্ছে ধর্মদ্রোহীদের। ইস্কনের প্ররোচনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রাসূল অবমাননার ভয়াবহ চিত্র প্রায় নিয়মিত। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় দমন-পীড়ন বর্তমানে পুঁজিবাদী সরকারগুলোর নীতিতে পরিণত হয়েছে।


আমাদের করণীয়:

ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাসূলের শানে বেআদবীর চিত্র বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে গোস্তাখে রাসূলের বিরুদ্ধে আমাদের করণীয় সম্পর্কে বর্তমান উলামায়ে কেরাম প্রাথমিকভাবে পণ্য বয়কটের নির্দেশনা দেন।

আরববিশ্বের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা ইউসুফ কারযবী লিখেছেন, মুসলিম উম্মাহর পক্ষে এটি কখনো সম্ভব নয় যে, তারা তাদের নবীর হক আদায়ে গড়িমসি করবে। হজরত মুহাম্মাদের আমাদের কাছে আমাদের সবকিছুর চেয়ে প্রিয়। আমি কিভাবে এমন জাতির পণ্য ক্রয় করবো, যারা আমার নবীকে অপমান করে ? কিভাবে আমরা আমাদের সম্পদ তাদেরকে দিয়ে দিবো এবং কিভাবে আমাদের সম্পদ দ্বারা তাদেরকে লাভবান হতে দিবো? না এটা কিছুতেই হতে পারে না। তাদের উৎপাদিত পণ্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে আমাদেরকে বিকল্প পণ্য ব্যবহার করতে হবে।

ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গোস্তাখে রাসূলকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত আলেম মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. এক টুইটবার্তায় লিখেছেন- দোজাহানের বাদশাহ হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে , তার পরেও কি কোনো  মুসলমানের  পক্ষে এটা সম্ভব যে, দেশটির (ফ্রান্সের) পণ্য কেনা-বেচা বা আমদানী-রপ্তানী করবে ! এই সম্পদ পূজারিদের তখনই উচিত শিক্ষা হবে যখন ইসলামি বিশ্ব তাদের পণ্য বয়কট করবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে এটা সর্বনিম্ন প্রতিক্রিয়া, যা আমরা এই মুহুর্তে  দেখাতে পারি।

বিশ্ব বিখ্যাত দাঈ ও আলেম  মাওলানা তারিক জামিল তার টুইটবার্তায় লিখেছেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে বেয়াদবী করায় সব মুসলিমদের হৃদয় ব্যথিত। আমি প্রত্যেক মুসলিম ভাইকে ফ্রান্সের পণ্য বর্জন করার আহবান জানাচ্ছি। পণ্যবয়কট আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে এই বস্তুপূজারীদের ভোগবিলাসে আপনি একটা হলেও আঘাত করতে পারেন । নিজের সাধ্যানুযায়ী প্রত্যেক মুসলমান ফ্রান্সের পণ্যবয়কটকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিন। এ ছাড়াও ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের আহবান জানিয়েছেন তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কুয়েত ও ইরানসহ মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও ইসলামিক স্কলারগণ।


পণ্যবর্জন এক সমুচিত জবাব:

পণ্যবর্জনকে অনেকে হালকাভাবে দেখে থাকে। বাস্তবে পণ্যবর্জন হালকা কিছু নয়; বরং এক মারাত্মক হাতিয়ার। এর মাধ্যমে বস্তুবাদীদের অর্থনৈতিক প্রাসাদ ধ্বসিয়ে দেওয়া সম্ভব। উদাহরণত, ২০০৪ সালে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে মুসলিমবিশ্বের পণ্যবয়কট তাদের অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আরবদেশগুলোর পণ্যবয়কটের প্রথম সপ্তাহে ফ্রান্সের শেয়ার বাজারে বিপর্যয় নামে; লোকসান হয় ২৮ বিলিয়ন ডলার।


ইসলামে পণ্যবয়কট:

পণ্যবয়কট ও এর কার্যকারিতার ইতিহাসও অনেক পুরনো। হযরত ছুমামা ইবনে উসাল রাযি. ইসলামের ইতিহাসে ‘পণ্যবয়কটের জনক’ নামে পরিচিত। ইয়ামামা অঞ্চলের হানীফা গোত্রের সর্দার ছিলেন তিনি। যুদ্ধবন্দী হয়ে মদীনায় আসেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নবীজীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উমরা সম্পন্ন করতে মক্কা গমন করেন। মক্কাবাসীরা তাকে দেখে হৈ-হৈ করে ওঠে, আরে তুমি তো বে-দ্বীন হয়ে গেছো! তিনি বললেন, না; বরং আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহর কসম! এখন থেকে ইয়ামামা হতে তোমাদের কাছে যবের একটা দানাও পৌঁছবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর রাসূল অনুমতি দেন! [সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৩৭২] 

ইয়ামামা মক্কাবাসীদের খাদ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। হযরত ছুমামা রাযি. তাদের সঙ্গে বয়কটের ঘোষণা দিলেন। ইয়ামামা থেকে খাদ্যপণ্য আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমদানী-নির্ভর মক্কায় খাদ্যদ্রব্যের প্রচন্ড অভাব দেখা দিলো। বাধ্য হয়ে মক্কার প্রতিনিধিদল মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রতিকার কামনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছুমামাকে বয়কট প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। ইসলামের সূচনালগ্নে হযরত ছুমামার এই পণ্যবয়কট কুরাইশ কাফেরদের ঝাঁঝ কমিয়ে দিয়েছিল।


ব্যক্তিগত পর্যায়ে গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদন্ড:

কেউ যদি কোন রাষ্ট্র বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে তাহলে তার শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড । রাষ্ট্র তার প্রজার উপর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে পারে কোনো আপত্তি হয় না। অথচ একজন প্রজার উপর একটি রাষ্ট্রের অধিকার সামান্যই। রাষ্ট্র তাকে সৃষ্টি করতে পারে না। পিতার ঔরস থেকে মাতৃ-উদরে প্রজনন, গর্ভধারণ ও ভূমিষ্ঠ থেকে জীবনের শেষ অবধি যখন যেমন আহার্য, যখন যেমন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিমিত হয়ে বেড়ে ওঠা প্রয়োজন- এর কোনোটাই রাষ্ট্র দিতে পারে না। মৌলিক বিচারে রাষ্ট্রের তেমন অবদান না থাকা সত্তে¡ও রাষ্ট্রের বিদ্রোহীদের শাস্তি যদি মৃত্যুদন্ড হতে পারে, এবং সেটা যদি নৃশংসতা বা অমানবিকতা না হয়, তাহলে যে রব তাকে সৃষ্টি করল, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান করল, শুরু-শেষ জীবনের সবকিছুই যিনি সর্বোত্তম উপায়ে প্রস্তুত করলেন, সেই মহান রবের বিরুদ্ধাচারণের শাস্তি কেন মৃত্যুদন্ড হবেনা? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণের দ্বারা যেমন রাষ্ট্রদ্রোহি হয়, ঠিক তেমনি আল্লাহ, রাসূল ও ধর্মের বিরুদ্ধাচারণের দ্বারাও ধর্মদ্রোহিতে পরিণত হয়। আল্লাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ধর্মের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিরুদ্ধাচারণ যেমন ধর্মদ্রোহিতা ঠিক তেমনি আল্লাহর রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ধর্মের বিরুদ্ধে বলা-লিখা ও আচরণে অসম্মান, কটুক্তি প্রদর্শন করাও ধর্মদ্রোহিতা। সে ধর্মদ্রোহি। সমগ্র জাহানের কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত ও অভিশপ্ত। মানবতার দুশমন সে পাক্কা বেঈমান। আর এ ধর্মদ্রোহিতা জঘন্য এবং মারাত্মক অপরাধ। 

নাস্তিকতা এক বিষয় আর ধর্মকে কটাক্ষ করা, প্রিয় রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে গালি দেয়া, কটুক্তি করা, অশ্লিলভাবে  উপস্থাপন করা ভিন্ন বিষয়। রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যারা গালি দেয়, অপমানিত করে, অসম্মানজনক কথা বলে বা লিখে, সে মুরতাদ। সে তওবা না করলে হত্যার মাধ্যমে তার শাস্তি নিশ্চিত করা ইসলামের বিধান। পবিত্রতম রাসূলের যে কুৎসা রটায় এমন নাফরমানের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না।


কুরআনুল কারীমে ধর্মদ্রোহীর শাস্তি:

কুরআনুল কারীম ধর্মদ্রোহীর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন ভাবে উল্লেখ হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য অভিশম্পাত করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানজনক শাস্তি।’ [সূরা আহযাব; আয়াত ৫৭]

তার পরবর্তী আয়াতে এসব অভিশপ্তদের শাস্তি বর্ণনা করা হচ্ছে, ‘অভিশপ্ত অবস্থায় তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে গ্রেফতার করা হবে এবং হত্যা করা হবে। যারা পূর্বে অতীত হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারেও এটাই ছিল আল্লাহর রীতি। আপনি আল্লাহর রীতিতে কখনও পরিবর্তন পাবেন না।’ [সূরা আহযাব; আয়াত ৬১ -৬২]

‘এছাড়াও যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে দেওয়া হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। এটাতো হলো তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।’ [সূরা মায়েদা আয়াত ৩৩] এক্ষেত্রে তারা যদি যথার্থ তওবা করে নেয়, তাহলে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। অন্যথায় তাদের উপযুক্ত শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড।

কুরআনের আরও একটি আয়াত, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘সুতরাং তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হয়ে যাবে। যারা জানতে আগ্রহী তাদের জন্য বিধানাবলী এভাবেই বিশদ বর্ণনা করি। আর তারা যদি চুক্তি সম্পন্ন করার পর নিজেদের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীনের নিন্দা করে তবে কুফরের এসকল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ করবে। বস্তুত এরা এমন লোক যাদের প্রতিশ্রæতির কোন মূল্য নেই।’ [সুরা তওবা; আয়াত ১১-১২]

আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ এ আয়াত দলিলরুপে বর্ণনা করে বলেন, যে ব্যক্তি ইসলাম বা কুরআনের বিরুদ্ধে খারাপ মন্তব্য করে,অথবা রাসূল সাঃ এর ব্যাপারে মন্দ কথা বলে ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে। [মাহাসিনুত তাওয়ীল -৫/১৪২]


হাদীসে বর্ণিত গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি:

অসংখ্য হাদীসও বিবৃত হয়েছে এসব ধর্মদ্রোহী গোস্তাখদের শাস্তি বর্ণনায়। হযরত ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হযরত আলী রাঃ এর কাছে ধর্মত্যাগীদের উপস্থিত করা হল। তখন তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেললেন। এ সংবাদ হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, যদি আমি হতাম, তাহলে আমি তাদের পুড়িয়ে ফেলতাম না রাসূল সাঃ এর এ নিষেধাজ্ঞার  কারণে যে, তোমরা আল্লাহর শাস্তি দিয়ে শাস্তি দিওনা। বরং আমি তাদের হত্যা করতাম। কারণ, আল্লাহর নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ধর্ম পাল্টায় তাকে হত্যা কর। [সহীহ বুখারী ৬৫২১]  

হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, ওহুদ যুদ্ধে এক মহিলা মুরতাদ হয়ে যায়। তখন রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তাকে তওবা করানো হোক। আর যদি তওবা না করে তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। [সুনানে দারা কুতনী হাদীস নং ১২১]

জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, উম্মে মারওয়ান নামের এক মহিলা মুরতাদ হয়ে গেলে রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দেন, তার কাছে ইসলাম পেশ করা হোক। যদি সে ফিরে আসে তাহলে ভাল, নতুবা তাকে হত্যা করা হবে। [সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং ১৬৬৪৩]

হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নবীকে গালি দেয়, তাকে হত্যা কর, আর যে সাহাবীকে গালি দেয় , তাকে বেত্রাঘাত কর।’ [জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-২২৩৬৬]

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন বলেন, ‘কাব বিন আশরাফের ব্যাপারে কে আছো ? কেননা, সে আল্লাহর রাসূল কে কষ্ট দেয়।’ তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামা দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি চান আমি তাকে হত্যা করি ? তিনি বললেন হ্যাঁ। [সহীহ বুখারী , হাদীস নং ৩৮১১]

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা বিজয়ের বছর মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ।

তিনি মাথা থেকে তা খুললেন। সে সময় একজন এসে বলল যে, ইবনে খাতাল কাবার গিলাফ ধরে বসে আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তাকে হত্যা কর।’ [সহীহ বুখারী; হাদীস নং ১৭৪৯]

ইবনে খাতালকে কেন কাবার গিলাফ ধরা অবস্থায়ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হত্যার নির্দেশ দিলেন? আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করে বলেন লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে গালাগালি করত। [ফাতহুল বারী ২/২৪৮]

ইবনে খাতালের দুই বাদি ছিল, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুৎসামূলক গান গাইতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন তাদেরকেও হত্যা করার নির্দেশ দেন। [আসাহহুস্ সিয়ার-২৬৬]

হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত, এক ইহুদী মহিলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে গালাগাল করত, মন্দ কথা বলত। তখন এক ব্যক্তি তার গলা চেপে ধরে, ফলে সে মারা যায়। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার হত্যার বদলে হত্যাকে অগ্রহণীয় সাব্যস্ত করেছেন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৩৬৪]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পর ইয়ামেন ও নজদে মুরতাদ হওয়ার ফিতনা প্রবল আকার ধারণ করে। অনেক লোক মুসায়লামাতুল কাজ্জাব ও সাজ্জাহের নবুওয়ত মেনে মুরতাদ হতে থাকে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাঃ ইরতিদাদের এ ফিতনা খুবই কঠোর হস্তে দমন করলেন। হযরত ইকরিমা বিন আবী জাহাল রা. কে সেখানে পাঠানোর সময় আদেশ করলেন, আম¥ান থেকে হাজরামাওত এবং ইয়ামান পর্যন্ত যত মুরতাদ পাবে সবাইকে হত্যা কর। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া; ৫/৩৬৩]

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. এর খেলাফতকালে মুসাইলামাতুল কাজ্জাব, ধর্মদ্রোহী ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ধর্মান্তরের এই ফেতনাকে ধ্বংস করতে গিয়ে প্রায় বারশত সাহাবায়ে কেরাম শাহাদাত বরণ করেন। হযরত সাঈদ বিন আব্দুল আজীজ রহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. উম্মে কিরফাকে মুরতাদ হওয়ার অপরাধে হত্যা করেন। [সুনানে দারা কুতনী; হাদীস নং-১১০]


গোস্তাখে রাসূলের ব্যাপারে উলামায়ে ইসলামের ইজমা:

কুরআন হাদীস ও মুজতাহিদ ইমামগনের ইজমা তথা সর্বসম্মত মত অনুসারে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি কুরআন ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কটুক্তি করবে, গালাগালি করবে, অসম¥ান করবে এমন ধর্মদ্রোহী মুরতাদের শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড। এ ব্যাপারে উলামায়ে ইসলাম একমত। ইবনে আবেদীন শামী রহঃ ‘আসসাইফুল মাসলূল আলা মান সাব্বার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিতাব থেকে উদ্ধৃত করেন, কাজী ইয়াজ বলেন, ‘উম্মতের ইজমা একথার উপর যে, মুসলমানদের মাঝে যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শানে বেয়াদবী করবে, গালাগালি করবে তাকে হত্যা করা আবশ্যক’। আবূ র্বাক ইবনুল মুনজির বলেন, সমস্ত আহলে ইলম একথার উপর একমত যে, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে গালাগাল করবে, বা মন্দ বলবে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সুহ্নুন বলেন, উলামায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগালকারী ও তার কুৎসাকারীদের কে কাফের হওয়ার উপর ঐক্যমত ব্যক্ত করেছেন। এমন ব্যক্তির উপর আল্লাহর শাস্তি ও ধমকি রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এমন ব্যক্তির কাফের হওয়া এবং শাস্তিযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে সে ও কুফরীতে লিপ্ত। [রাসায়েলে ইবনে আবেদীন; ১/৪৮৬-৪৮৭]


বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থে ধর্মদ্রোহী মুরতাদের শাস্তি:

শুধু ইসলামে নয় ইয়াহুদী ও খ্রিস্টধর্মেও মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহীর রয়েছে মৃত্যুদন্ডের বিধান। নানা রকম হস্তক্ষেপ ও বিকৃতির পরও বর্তমানে তাওরাত, ইনজিল, বাইবেল ও কিতাবুল মোকাদ্দাস নামে যেসব গ্রন্থ পাওয়া যায়, সেগুলোতেও ধর্মদ্রোহীর কঠোর শাস্তি বিবৃত হয়েছে। 

‘যিনি তোমাকে মিসর দেশের গোলামী থেকে বের করে এনেছেন তোমার সেই মাবুদ আল্লাহর দিক থেকে যে তোমাকে ফিরাবার চেষ্টা করেছে তাকে তুমি পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে। যাতে বনি ইসরাঈলের সকলে সেই কথা শুনে ভয় পায় এবং তোমাদের মধ্যে কেউ আর এরকম খারাপ কাজ না করে।’ [বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দাস ২৪২, তাওরাত দ্বিতীয় বিবরণ ১৩:৬-১]


খ্রিষ্টধর্মেও মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মুরতাদ হওয়া ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হত্যা এবং যিনা কারীর স্থলাভিষিক্ত। (এনসাইক্লোপিডিয়া, রিলিজিওন অধ্যায়, ইন্ডিয়া এডিশন, ৬নং খন্ড)

মোটকথা: উপরোক্ত বর্ণনা ও হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এটাই প্রমাণিত হয় এবং আমাদের ঈমানও হলো, আল্লাহ তাআলার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা সর্বশীর্ষে। পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য রাসূলকে মা বাবা সন্তানাদী ও সকল মানুষ এমন কি নিজের জানের চেয়েও অধিক মুহাব্বত করা জরুরি। [সহীহ বুখারী; হাদিস নং ৬৬৩২] এতদসত্বেও যদি কেউ রাসূলকে নিয়ে কটূক্তি করে বা ব্যঙ্গ করে কিংবা তার চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে, তাহলে এটা মারাত্মক অন্যায় ও জঘন্য অপরাধ ।

‘যারা রাসূল নিয়ে কটুক্তি করবে বা ব্যঙ্গ করবে ইসলামী শরীয়াতে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।’ [সূরা আহযাব; ৬১]

কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস দ্বারা শাস্তির এ বিষয়টি সুস্পষ্ট প্রমাণিত। একারণে উলামায়ে কেরাম বলেন, যদি কোনো মুসলমান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিয়ে কটূক্তি করে বা ব্যঙ্গ করে, তাহলে হানাফী মাযহাবের মতানুসারে সঙ্গে সঙ্গে সে মুরতাদ (স্বধর্মত্যাগী) হয়ে যাবে। আর যদি মহিলা হয় তাহলে তাকে তাওবা করতে বাধ্য করা হবে। তারপরও তাওবা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু যদি সে পুরুষ হয় এবং তাওবা না করে তাহলে চার মাযহাবের সকল উলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে তার জন্য মৃত্যুদন্ড ওয়াজিব হবে। এতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে যদি তাওবা করে তথা পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে (পুরুষ হোক বা মহিলা), তাহলে তার তাওবা গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। অবশ্য হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য মত হলো তার তাওবা গ্রহণ করা হবে। আর যদি কোনো যিম্মী (ইসলামী রাষ্ট্রে বাসরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটূক্তি বা ব্যঙ্গ করে এবং তাওবা তথা নিজের ভুল স্বীকার না করে অথবা শুধু তাওবা করে কিন্তু ইসলাম গ্রহণ না করে থাকে, তাহলে হানাফী মাযহাবের মতানুসারে সে তা‘যীর স্বরুপ কঠোর শাস্তির উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে, চাই সে পুরুষ হোক বা মহিলা। কেননা, তার জন্য ইসলাম গ্রহণ ব্যতীত শুধু তাওবা করা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যদি তাওবা ( নিজের ভুল স্বীকার) করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তার তাওবা গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে চার মাযহাবের মাঝে কিছুটা বিরোধ পরিলক্ষিত হলেও হানাফী উলামায়ে কেরামের মত তার তাওবা গ্রহণ করার প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে। এমতাবস্থায় সে যিম্মীর চুক্তি ভঙ্গ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ থাকলেও হানাফী উলামায়ে কেরামের প্রসিদ্ধ মত হলো, তার চুক্তি ভঙ্গ হবে না। তাছাড়া যদি কেউ প্রকাশ্যে তথা জনসভায় কট‚ক্তি বা ব্যঙ্গ করে বা মিডিয়ার মাধ্যমে তা প্রচার-প্রসার করে অথবা একাধিকবার কট‚ক্তি বা ব্যঙ্গ কর্মে লিপ্ত হয় কিংবা তাতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে চার মাযহাবের সকল উলামায়ে কেরাম সর্ব সম্মতিক্রমে তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর যদি সে মুসলিম হয়; চাই পুরুষ বা মহিলা, তাহলে তার জন্য মৃত্যুদন্ড ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে যিম্মী হলে হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে তা‘যীর স্বরূপ হত্যার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে, পুরুষ হোক বা মহিলা।

প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় গোস্তাখে রাসূলের শাস্তি বাস্তবায়ন করবে কে? এব্যাপারে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের মত হলো; শরীয়ত কর্তৃক রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগের উপর ওয়াজিব হলো গোস্তাখে রাসূল বা রাসূলের কট‚ক্তিকারী কিংবা রাসূলের ব্যঙ্গকারীর শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করা। আর জনসাধারণের দায়িত্ব হলো গোস্তাখে রাসূলের শাস্তির বিধান বাস্তবায়নের জন্য বিচার বিভাগের নিকট আবেদন করা। প্রয়োজনে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা। তবে যদি কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইশ্ক ও মুহাব্বতে পাগলপারা হয়ে গোস্তাখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করে ফেলে তাহলে তার উপর কেনো হদ/কিসাস (দন্ডবিধি ) আসবেনা। শুধু এতটুকুই না, বরং তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে সাধারণ শাস্তি প্রদান করাও উচিত হবে না। কেননা, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য মুবাহুদ্দম (যাকে হত্যা করা হালাল) ব্যক্তি কে হত্যা করেছে। তবুও যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে জুলুম-পূর্বক তার কোন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় বা তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, তাহলে তাতে সে সওয়াবের অধিকারী হবে এবং শহীদ বলে গণ্য হবে।


শেষকথা

প্রিয় পাঠক! আমরা মুখে স্বীকার করি: পরমপ্রিয় মাতা-পিতা, কলিজার টুকরো সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং জানমাল, ইজ্জত আব্রæর চেয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত। কিন্তু আমাদের চলন-বলনে, আচরণ ও উচ্চারণে-এক কথায় যাপিত জীবনের সকল অঙ্গনে কি আমরা এর সত্যতা প্রমাণ করতে পারছি? আমরা কি পারছি জীবন পরিক্রমার প্রতিটি ধাপে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে রাসূলের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিতে? আমরা কি পারছি রাসূলের ভালোবাসায় তার মর্যাদা ও ইজ্জত রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করতে? যেমনটি করেছিলেন রাসূল প্রেমিক সাহাবায়ে কেরাম ও সাহাবা পরবর্তী উম্মাহর প্রকৃত রাসূল প্রেমিকগণ। আজ আমি শুধু রাসূল প্রেমে দেওয়ানা, প্রাণ উৎসর্গকারী সাহাবী হযরত সাদ ইবনে রবী’ রাযি.এর কথাই তুলে ধরছি। আশা করছি আমাদের জন্য এ কুরবানী আমৃত্যু প্রেরণা ও সবক হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

উহুদের রক্তাক্ত প্রান্তর। জায়গায় জায়গায় লাশের স্তূপ। আহতদের কাতর ধ্বনিতে বিষন্ন চারদিক। নবীজী ইরশাদ করলেন, সা‘দ ইবনে রবী’ কোথায়? তাকে পেলে আমার সালাম বলবে। এক সাহাবী জানালেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আল্লাহর রাসূল বললেন, শহীদানের স্তূপে খুঁজে দেখো। স্তূপীকৃত লাশগুলো একে একে সরানো হলো। নীচ থেকে বেরিয়ে আসল সা‘দ ইবনে রবী’র ক্ষতবিক্ষত দেহ। তিনি তখনো বেঁচে আছেন। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছেন। মুখে পানি দিয়ে বলা হল, আল্লাহর রাসূল তোমাকে সালাম বলেছেন, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। শোনামাত্রই হযরত সাদের যন্ত্রণামলিন চেহারা ঝলমলিয়ে উঠল। মনের শক্তিবলে উঠে বসতে চাইলেন, কিন্তু দেহটি জমীনে পড়ে গেল। ক্ষীণকন্ঠে বললেন, রাসূলুল্লাহকে আমার সালাম দিয়ে বলবে, সাদ মৃত্যুমুখে পতিত; তবে সে জান্নাতের খুশবু পাচ্ছে। আর আমার সম্প্রদায় আনসারদের সমবেত করে বলবে, তোমাদের সর্দার মৃত্যুকালে তোমাদের অসিয়্যত করেছেন, তোমরা বেঁচে থাকতে যেন আল্লাহর রাসূলের পবিত্র ইজ্জতের উপর ও শরীরে সামান্য আঁচড়ও না লাগে। নবীজি কে সা‘দ ইবনে রবী’র পয়গাম জানানো হল। নবীজীর চোখ তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।আবেগঘন কন্ঠে আল্লাহর রাসূল বললেন, আয় আল্লাহ! আমি সাদের প্রতি সন্তুষ্ট আছি, তুমিও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।

বর্ণনাকারী বলেন, উহুদ যুদ্ধের কিছুদিন পর একবার দেখি হযরত আবূ বকর রাযি. চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। তার বুকের উপর একটি শিশু খেলা করছে। তিনি বারবার শিশুটিকে চুমু খাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, এতো আদর করছেন, কার সন্তান এটি? হযরত আবূ বকর রাযি. চিৎকার করে বলে উঠলেন। তুমি জানো না! এটি সেই সাদ ইবনে রবী’র ইয়াতীম সন্তান! যে সা‘দ ইবনে রবী’ মৃত্যুর সময় একটি বারের জন্যও তার অসহায় প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মুখে আনেনি; বলেনি তার আপনজনের কথা। সে বলেছে, তোমরা বেঁচে থাকতে যেন আমার রাসূলের ইজ্জতে সামান্যও আঁচড় না লাগে! 

প্রিয় পাঠক! সা’দ ইবনে রবী’র উত্তরসূরী আমরাতো আজো বেঁচে আছি; স্বীকার করি রাসূল প্রেমের কথা। আমাদের কি মনে আছে তার সেই পবিত্রতম অসিয়্যতের কথা?


মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

کیا تورات و انجیل کی تلاوت بطور وظیفہ درست ہے؟

مولانا سید مناظر احسن گیلانی ( ۱ ) ( ۱۸۹۲ = ۱۹۵۶) نے ”تدوین قرآن“ کے موضوع کے روایتی ذخیرے پر جو شک...

আল্লামা ডঃ আব্দুল হালীম চিশতী রহঃ
৯ নভেম্বর, ২০২৪
৯১১ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ