প্রবন্ধ

সমাজসভ্যতা ও মানব জনমের অভিনব বিবরণ

লেখক:আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.
৩০ নভেম্বর, ২০২২
৩৩৯০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

মুহতারাম ভাই ও বোনেরা আমার! আপনারা আমার প্রতি যে আস্থা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন সেজন্য আমি শুকরিয়া জানাচ্ছি। আপনারা আমাকে এখানে আসার এবং কিছু বলার সুযোগ দিয়েছেন। আমাকে যে বিষয়ে কথা বলতে বলা হয়েছে তা জীবনঘনিষ্ঠ এবং খুবই জরুরি একটি বিষয়অবশ্য তা স্পর্শকাতরও বটে। এছাড়া আপনারা আমার জন্য প্রোগ্রামের সময়েও পরিবর্তন এনেছেন। আপনাদের এ সৌজন্য ও ভদ্রতায় আমি কৃতজ্ঞ।

আমি আপনাদের সামনে কুরআনে কারীম থেকে একটি আয়াত তিলাওয়াত করব। একটি সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলাম কী দৃষ্টিভঙ্গি রাখেইসলামের দৃষ্টিতে একটি সভ্য সমাজের রূপরেখা কেমন হতে পারেএ ব্যাপারে তা কতটা স্বচ্ছ এবং বাস্তবানুগ নীতি প্রদান করে- আয়াতটি থেকে তা অনুমিত হবেইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَ بَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِیْرًا وَّ نِسَآءً  وَ اتَّقُوا اللهَ الَّذِیْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَ الْاَرْحَامَ   اِنَّ اللهَ كَانَ عَلَیْكُمْ رَقِیْبًا.

হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করযিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি (হযরত আদম আ.) থেকে এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন। এবং আল্লাহকে ভয় করযার ওসিলা দিয়ে তোমরা একে-অন্যের কাছে নিজেদের হক চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা থেকে) ভয় কর। নিশ্চিত জেনআল্লাহ তোমাদের প্রতি লক্ষ্য রাখছেন। -সূরা নিসা (৪) : ১

এ আয়াতটি সূরা নিসার প্রথম আয়াত। নিসা মানে নারী। নারী নাম দিয়ে এ সূরার নামকরণের মাঝে রয়েছে বড় হেকমত এবং গভীর তাৎপর্য। ইসলাম নারী জাতিকে কতটা মূল্যায়ন করেছে! এভাবে নিসা তথা নারী নামে স্বতন্ত্র একটি দীর্ঘ সূরার অবতারণ কি প্রমাণ করে না- নারী কতটা গুরুত্বের পাত্র!

আমি মনে করিনারী জাতির প্রতি ইসলামের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিনারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন এবং তাদের উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যের স্বচ্ছ বিবরণ আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে দিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা শুরুতেই বলছেননারী-পুরুষ নির্বিশেষে গোটা মানবজাতির সৃষ্টি একভাবেই হয়েছে। এক ব্যক্তি থেকে তাদের সূচনা। সমাজজীবনে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এতটাই ওতপ্রোতযেন উভয়ে একটি দেহের দুটি অংশ। গোটা মানবজাতিকে যদি এক দেহের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে এর এক অংশ নরঅপর অংশ নারী। জীবন-সফরে তারা হাতে হাত রেখে পথ চলবে। আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষের দৈহিক গড়নে এবং রুচি-প্রকৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা রেখেছেনযাতে তাদের সে পথচলা সুন্দর ও সুখকর হয়।

তো সর্বপ্রথম মানবজাতির সৃষ্টির সূচনা হয়েছে এক সত্তা থেকে। ঐ এক সত্তাকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে (তিনি ও তাঁর স্ত্রী)। এই বিভাজনে তাদের মাঝে কোনো বৈরিতা তৈরি হয়নি। হয়নি কোনো শত্রুতাবরং সৃষ্টি হয়েছে পবিত্র ভালবাসা ও নিষ্কলুষ প্রেম। তারা উভয়ে মিলিত হয় এক বিন্দুতে। জীবন পথের সঙ্গিনী তো তারই শরীরের অংশ! এরপর তাদের থেকে সূচিত হয় মানব-প্রজন্মের ধারা- মানব জাতির জন্মপ্রতিপালন ও প্রজনন... চলতে থাকে অদ্যাবধি... এবং চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা বাবা-মার (বাবা আদম আ. এবং মা হাওয়া আ.-এর) সেই মহব্বত ও ভালবাসায় এবং তাঁদের জীবন-সফরে এত এত বরকত দিলেন যেসেই দুই জন থেকে হল হাজার হাজার। হাজার হাজার থেকে হল লক্ষ লক্ষ এবং এরপর কোটি কোটি। এখন কম্পিউটারও তার সঠিক হিসাব গণনা করতে অক্ষম। এর প্রকৃত সংখ্যা যিনি জানেনতিনি সেই মহান মালিকআল্লাহ।

وَ بَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِیْرًا وَّ نِسَآءً .

আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেনবলে আল্লাহ তাআলা এদিকেই ইঙ্গিত করছেন।

সবাই অন্যের মুখাপেক্ষী

আল্লাহ তাআলা এরপর বলছেন-

وَ اتَّقُوا اللهَ الَّذِیْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ.

এবং আল্লাহকে ভয় করযার নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে কোনো কিছু চেয়ে থাক।

কুরআন মাজীদের এটি একটি বৈপ্লবিক দর্শন- মানব সভ্যতায় কেউ কারো থেকে অমুখাপেক্ষী নয়সমাজের সবাই সবার কাছে ঠেকা। একই ব্যক্তি এক ক্ষেত্রে কেউ তার মুখাপেক্ষীকিন্তু বহু ক্ষেত্রে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সমাজে এমন কোনো বিভাজন নেই- এই শ্রেণির যারাসবাই এদের মুখাপেক্ষী। আর এরা যারা রয়েছেতারা কেবল অপরের উপর নির্ভরশীল। নাসবাই কোনো না কোনোভাবে একে-অন্যের মুখাপেক্ষী। কুরআনের শব্দ হচ্ছেতাসাউলএকে অপরের কাছে চাওয়া। এটি এমনই এক শেকলযাতে সবাই বাঁধা। আমাদের সমাজব্যবস্থা একটি জালের মতোযেখানে সবাইকে সবার প্রয়োজন হয়।

পুরুষ সক্ষম ও শক্তিশালী। তাই বলে নারী বিনে সে তার জীবনপথ পাড়ি দিতে পারে না। তেমনি সম্ভ্রান্ত  ও কুলীন নারী কি সফরসঙ্গী ব্যতীত জীবনতরি চালিয়ে নিতে পারে! আল্লাহ তাআলা ব্যবস্থাটাই এমন করে রেখেছেন- স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপনের জন্য নারী ও পুরুষ একে অপরের অস্তিত্ব ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।

আল্লাহর নাম : যা পরকে আপন করে দেয়

আল্লাহ তাআলা সাথে সাথে এ-ও বলে দিচ্ছেনযার নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে-অন্যের কাছে চাও তিনি কেতিনি তো সেই খোদামহান রাব্বুল আলামীন। তাঁকে তোমরা ভয় করে চল।

আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্বআল্লাহ তাআলার প্রতি ভয় ও আযমত এবং আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও একত্ববাদের আকীদার উপর ভিত্তি করে একটি ইসলামী সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে। অপরিচিত এক মুমিন পুরুষ এবং অপরিচিত এক মুমিন নারীতারা একে অপরের জীবনসঙ্গী বনে যায়। মহব্বত ও ভালবাসার বন্ধনে একে অপরকে বেঁধে নেয়। হাতে হাত রেখে যিন্দেগীর সফরে রওনা হয়। এটা কখনযখন তারা নিজেদের এ সম্পর্কের মাঝে আল্লাহ তাআলার নাম নিয়ে আসে। আল্লাহর নাম এমনই বরকতময় একটি অবলম্বনযা পরকে আপন করে দেয়। দূরকে কাছে এনে দেয়। অপরিচিতকে চির পরিচিত বানিয়ে দেয়। যার ছায়া পর্যন্ত মেনে নেওয়া সহজ ছিল নাসেই সত্তাটিই এখন এতটা আপন ও প্রিয় বনে গিয়েছে যেসে ব্যতীত জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। তারা এখন একে-অপরের জীবনসঙ্গী। একজন অপর জনের দায়িত্বশীল।

স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র ও মধুময় সম্পর্কের এ বন্ধনটা এতটাই মজবুত হয় যেবাবা মার সম্পর্কের পূর্বে তা বিবেচ্য হয়। সেই সম্পর্কে যে স্বচ্ছতাশুদ্ধতা ও পবিত্রতা এবং আস্থাঅনাড়ম্বরতা ও স্বাভাবিকতাআরো আগে বেড়ে যে স্বর্গীয় স্বাদ ও তৃপ্তি বিরাজ করে অন্য কোনো সম্পর্কের মাঝে তা পাওয়া যায় না। এমনকি আত্মীয়তার সম্পর্কের মাঝেও না। এটা কেনএটা সেই আল্লাহর নামের কারিশমা। দুইজনের মাঝে যখন এক আল্লাহর নামে সম্পর্ক কায়েম হয় তখন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

কিছুক্ষণ পূর্বেও যে পর ছিলছিল পর পুরুষ ও পর নারীআল্লাহর নামে এখন তারা এতটা আপন হয়ে গিয়েছে যেঅন্যান্য আপনজনেরা এখন পরে এসে গেছে। গায়রে মাহরাম একজন মুসলিম পুরুষ এবং একজন মুসলিম নারী কখনও একে অপরের আপন হতে পারে না। তাদের সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হতে পারে না। কেউ কারো সাথে সফর করতে পারে না। তারা একে-অপরের জন্য গায়রে মাহরাম এবং পরজন। কিন্তু এ দুই গায়রে মাহরামের মাঝেই যখন আল্লাহর নামে সম্পর্ক কায়েম হয় তখনই তা পবিত্র ও শুদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহর নাম ব্যতীত কিছুক্ষণ পূর্বেই যা বিলকুল হারাম ছিল।

এটা হল কুরআনের অলৌকিক ও অভিনব বর্ণনা শৈলী। এক শব্দ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ  (যার নামের ওসিলা দিয়ে তোমরা একে অপরের কাছে নিজেদের হক চেয়ে থাক।) দিয়ে মানবসমাজে পারস্পরিক সম্পর্কের দর্শন বর্ণনা করে দিয়েছে। একটি সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের সূচনা ও বন্ধন এবং এর রূপ ও স্বরূপ যে আঙ্গিকে কুরআন উপস্থাপন করেছে আপনি এর নজির আনতে পারবেন না। বড় বড় ম্যানিফেস্টো ও বিরাট বিরাট স্লোগানের দস্তাবেজ পাবেন কিন্তু এ দর্শন ও দর্শন-বিবরণ আপনি পাবেন না। সমাজইতিহাসদর্শন এবং সোশ্যালজিফিলোসফি ও সাইকোলজির গ্রন্থগুলো হাতে নিন। পাবেন না সেখানে এমন উপস্থাপন।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনযেই সত্তার নাম নিয়ে তোমরা হারামকে হালালে পরিণত করনাজায়েযকে জায়েযে রূপান্তর কর এবং তাঁর নামের বদৌলতে জীবনে অসাধারণ পরিবর্তন ও বিপ্লব নিয়ে আস সেই পাক পবিত্র বরকতময় মহান নামের লাজ ও মান রক্ষা করাও তোমার কর্তব্য।

স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক গভীর ও অটুট সম্পর্কের বিবরণ কুরআনে কারীম অন্য স্থানে ভিন্নভাবে দিয়েছে। কুরআন বলে-

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَ اَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ .

তারা (নারীগণ) তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা (পুরুষগণ) তাদের জন্য পরিচ্ছদ। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৭

অর্থাৎ তোমরা একে অপরের পোশাক-পরিচ্ছদ হয়ে যাও। এটাও কুরআনের অলৌকিক বিবরণের একটি নমুনা- কুরআন স্বামীকে স্ত্রীর জন্যে এবং স্ত্রীকে স্বামীর জন্যে পোশাক বলে আখ্যায়িত করেছে। পোশাক হচ্ছে মানবজীবনের এমনই এক অবিচ্ছিন্ন মৌলিক প্রয়োজনযা তাকে আবৃত করেতার লজ্জা রক্ষা করে এবং তার সৌন্দর্য বর্ধিত করে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আস্থা ও সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় রাখতে যে বিষয়গুলো আলোচনায় আসেকুরআনের লেবাস-পোশাক শব্দ চয়নের মাঝে সেগুলো সব চলে এসেছে। আবার লক্ষ্য করুনকুরআন কত চমৎকার ভঙ্গিমায় বলছে- তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। পোশাক ব্যতীত মানুষকে যেমন পশু পশু মনে হয়কেমন জঙলি-জানোয়ার মনে হয় তেমনি বৈবাহিক সম্পর্ক-বিহীন একটি মানবসমাজ পশু সমাজে পরিণত হয়। এমন সমাজ যত বড় সভ্যতারই দাবিদার হোক না কেন তাদেরকে অসভ্যই মনে করতে হবে। পোশাক-বিহীন মানুষ কি কল্পনা করা যায়!

বৈবাহিক জীবন একটি ইবাদত মুখর জীবন

ইসলাম মানুষের বৈবাহিক জীবনকে কেবল জৈবিক প্রয়োজন পূরণের মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি ইবাদত এবং নেক আমল। এর মাধ্যমে বান্দা তার রবের নিকটবর্তী হতে থাকে। বিষয়টি আরো খোলাসা করে বললে- আমাদের শরীয়তে বিবাহের ধারণা সীমিত নয়। জন্ম হয়েছে। বয়স হয়েছে। বয়সের প্রয়োজনে এখন বিবাহ করতে হবে। নতুবা জীবনের একটি শখএকটি স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে। নাবিবাহকে ইসলাম এভাবে বিশ্লেষণ করে না। আমাদের শরীয়ত মানুষের এ স্বাভাবিক প্রয়োজনকে দ্বীনের রঙে সাজিয়েছে। এজন্যই ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাস্তবিক জীবনে আদর্শ বৈবাহিক জীবনের প্রায়োগিক রূপ পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন-

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي.

তোমাদের মাঝে ভালো ওই ব্যক্তিযে তার ঘরের লোকদের কাছে ভালো। আর তোমাদের মাঝে আমি আমার পরিবারের নিকট সবচে উত্তম। -জামে তিরমিযীহাদীস ৩৮৯৫

আপনি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত অধ্যয়ন করতে থাকুন। দেখতে পাবেন- এই নাজুক শ্রেণির (নারীজাতির) প্রতি নবীজীর যে সম্মানবোধ ছিলতাদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি যে সদয় দৃষ্টি ছিলতাদের শখ-আহ্লাদের ক্ষেত্রে যে বিশেষ বিবেচনা ছিলবড় বড় নারীবাদি এবং নারী অধিকার কর্মী ও নেতাদের মাঝেএমনকি নারীদের সম্পদসম্ভ্রম ও অধিকার নিয়ে যারা বিরাট বিরাট দাবি-দাওয়া পেশ করেন এবং বড় বড় লেকচার ও স্লোগান শুনিয়ে থাকেনতাদের মাঝেও আপনি নবীজীর সেই আখলাক ও উদারতার নজির পাবেন না। পৃথিবীর বড় বড় পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীবড় বড় শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোঋষীসাধুসন্যাসী ও যাজকদের জীবনী ও কীর্তির প্রতি লক্ষ্য করুন- নববী আদর্শের দ্যুতি সেখানে নেই। আযওয়াজে মুতাহহারাতের (পবিত্র স্ত্রীগণের) সাথে নবীজীর যে মধুময় আচরণতাদের মনোরঞ্জনতাদের সাথে ক্রীড়া-কৌতুকবৈধ বিনোদনে তাদের সঙ্গ দানতাদের শখ-আহ্লাদ পূরণতাদের মান-অভিমানের মূল্যায়নতাদের মাঝে সমতা বিধানতাদের সাথে ইনসাফের আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোর কোনো নজির অন্য কোথাও কি পাওয়া যায়!

শুধু তাই নয়। শিশুদের ক্ষেত্রেও নবীজীর আচরণ লক্ষ্য করুন। নামাযের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নবীজী সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেনযাতে মায়েদের কষ্ট না হয়। এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। নবীজীর কাছে তো নামাযের চেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান আর কিছু ছিল না। সেই নামায সংক্ষিপ্ত করে ফেলা কি কম কথা! নবীজী কখনো নামায দীর্ঘ করতে চাইতেন। কিন্তু যখন কোনো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেতেন নামায সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেনযাতে নামাযে অংশগ্রহণকারী কোনো মায়ের মন বাচ্চার দিকে পড়ে না থাকে আর সে কষ্ট পেতে থাকে।

পশ্চিমা সভ্যতা এখন ধ্বংসের মুখে

তো আমি যা বলছিলামআল্লাহ তাআলা বলেনযেই নামের ওসিলায় তোমরা এত নিআমত লাভ কর সেই নামের মর্যাদা রক্ষা কর। এ বিধান নারী-পুরুষ সবার জন্যে। এমন নেমকহারামী যেন না হয়এ নামের কেবল সুবিধাই ভোগ করে গেলামকিন্তু এর হক আদায়ের দিকে খেয়াল করলাম না।

আপনারা এখানে আমেরিকান সোসাইটিতে আছেন। এখানে কেবল ইসলামী আকীদা পেশ করে গেলেই হবে না। ইসলামী পরিবার ও সমাজব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা করতে হবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এখন প্রবল গতিতে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আপনারাও হয়তো উপলব্ধি করতে পারছেনপশ্চিমা সভ্যতার পতন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। এটা এখন কোনো রাখঢাকের বিষয় নয়। এর একটি বড় কারণ হলপশ্চিমাদের পারিবারিক ব্যবস্থায় ঘুন ধরেছে। তাদের পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলোতে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে আস্থা ও ভালবাসার সম্পর্ক থাকা দরকার ছিলদিনদিন তা হারিয়ে যাচ্ছে। এই সময়কার দার্শনিক বুদ্ধিজীবীগণ হয়রান-পেরেশান। গবেষণার পর গবেষণা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। রচনার পর রচনা তৈরি হচ্ছে। সবাই চিন্তিত- কীভাবে পরিবার ব্যবস্থাকে ধ্বংসের গ্রাস থেকে উদ্ধার করা যায়। সমাজব্যবস্থা কীভাবে অটুট রাখা যায়।

স্বামী-স্ত্রীর  মাঝে মূল সম্পর্ক হচ্ছে প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্ক। এতেই প্রকৃত সুখ নিহিত। পরিবারের অভাব-অনটন এবং সংসারের টানাপোড়েন এখানে গৌণ বিষয়। আমাদের প্রাচ্য অঞ্চলগুলোতে এখনো এমন বহু পরিবার রয়েছেদুবেলা যারা ঠিকমত খেতে পায় না। কিন্তু তাদের পরিবারে স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করছে। কেনকারণ তাদের মাঝে প্রেম ও ভালবাসা আছে। একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে ক্ষুধার জ্বালা ভুলে যায়। কিন্তু এখানেএখানে কী নেই তা বলুন। বিলাসিতার উপকরণ রয়েছে। সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। জগতের বড় বড় শক্তিগুলো তাদের হস্তগত হয়েছে। তারা অনেক কিছুর উপরই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। পৃথিবীর দৃশ্যপট অনেক রাঙিয়েছে। কিন্তু রাঙাতে পারেনি নিজেদের অন্তর্জগৎ! অনেক জায়গায় তারা অনেক কিছু প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু নিজেদের ঘরে তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি! ইকবাল যথার্থ চিত্রায়ণ করেছেন-

ڈھونڈنے والاستاروں کی گذرگاہوں کا + اپنے افکارکی دنیا میں سفر کر نہ سکا

যারা নক্ষত্ররাজির কক্ষপথ পর্যন্ত আবিষ্কার করে চলেছে। অথচ চিন্তার দুনিয়া ও অন্তর্জগতে তারা হাঁটতেও শিখল না।

একটুখানি শান্তির খোঁজে...

যারা সূর্যের রশ্মি নিয়ে কথা বলে। প্রযুক্তিকে যারা হাতের মুঠোয় ধারণ করে। রাতের দুনিয়াটাকে যারা আলোয় আলোয় ভরে তোলে। জীবন রাতের প্রহর শেষেও তাদের সুবহে সাদিকের দেখা মেলে না! ইকবাল যদি থাকতেন বলতেনপশ্চিমের লোকেরা উন্নতি করতে করতে চাঁদ পর্যন্ত চলে গেল বটে। তবে নিজেদের চিন্তার দুনিয়ায় তারা হাঁটতেও শিখল না। যারা তারকারাজির চলার পথ তালাশ করে বেড়াচ্ছে তারা নিজের পরিবারের জন্য একটি ফুলের তোড়াও বানাতে পারল না! পরিবারে তারা ফোটাতে পারল না আনন্দের হাসি! যারা গোটা দুনিয়াটাকে বেহেশত বানাতে মরিয়াতাদের ঘরগুলো এখন নরকের খণ্ড! ইউরোপ-আমেরিকার এমন অনেক পরিবার আছেযাদের ঘরে সুখের উপকরণের অন্ত নেইতবুও নেই শান্তির কোনো সাক্ষাৎ। ফলে তারা আজ চিত্ত-বিনোদনের নামে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটুখানি শান্তির খোঁজে পার্কে-ক্লাবে ঢু মারছে। কারণ তাদের ঘরে শান্তি নেই। ঘরে ফিরলে মনে হয় না- আমি যেন জান্নাতে এলাম! নাএই স্বর্গীয় অনুভূতি থেকে তারা বঞ্চিত। তাই তারা ঘর থেকে পালিয়ে বেড়ায় এদিক ওদিক।

শেষ নিবেদন

আমি আমার উপলব্ধি থেকে বলছিযারা এখানে দশ বছর বিশ বছর যাবৎ আছেনতারা এই সংকটময় পরিস্থিতি আরো গভীর থেকে অনুধাবন করে থাকবেন। তাই বেশি কিছু বলার প্রয়োজনও নেই। শুরুতেই আমি যা বলে এসেছি- আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার প্রথম আয়াতে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার একটি মৌলিক নীতি বর্ণনা করেছেন। আর তা হচ্ছে- সমাজে সবাই সবার নিকট দায়বদ্ধ। এ দায়বদ্ধতার উপলব্ধি এবং এ কারণে একে অপরের প্রতি সম্মানবোধ যতদিন থাকবে ততদিন সমাজ সুশৃঙ্খল থাকবে। কিন্তু এ অনুভূতি কেউ ধারণ করেকেউ করে না। আমার কর্তব্য হচ্ছেঅন্তরে এ বোধ জাগ্রত করা। তখন মনে হবেযার মাধ্যমে আমার প্রয়োজন পুরা হচ্ছে সে আমার প্রতি অনুগ্রহ করছে। তখন আমার পক্ষ থেকে তার অনুগ্রহের স্বীকৃতি আসবে। আমি নিজেকে প্রয়োজনগ্রস্ত ভাবব এবং অন্যকে আমার উপকারকারী মনে করব। ফলে অন্যের প্রতি আমার অন্তরে সম্মানবোধ জাগ্রত থাকবে। এটা একটা মানসিকতার ব্যাপার। মানসিকতা তৈরি হলে তা সম্ভব। ইসলাম এ মানসিকতাটাই সৃষ্টি করতে চায়। আমরা যদি এভাবে মন-মানসিকতা তৈরি করি এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি তাহলে সমাজে আর সমস্যা থাকার কথা নয়।

আমি আল্লাহর দরবারে দুআ করিআল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আপনারা এ দেশে ইসলামী জীবনব্যবস্থা এবং ইসলামী রীতিনীতির এমন উৎকৃষ্ট নমুনা পেশ করুনএখানকার ভঙ্গুর সমাজ যেন তাতে আশা ফিরে পায়। তারা যেন এ থেকে ইসলাম ও ইসলামী সমাজের নিয়ম-কানুন জানতে এবং ইসলামী রীতিনীতি অনুযায়ী চলতে আগ্রহ বোধ করে। আপনাদের জীবনাচার দেখে যেন তাদের এ অনুভূতি জাগ্রত হয়- হায়আমাদের জীবনও যদি এমন হত! যদি আপনারা এমনটা করতে পারেন তাহলে কেবল এদেশের জন্যই তা ফলপ্রসূ সাব্যস্ত হবে নাএতে দ্বীন-ইসলামেরও অনেক বড় খেদমত হবে। এর মাধ্যমে তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবে।

[নায়ী দুনিয়া আমেরিকা মেঁ ছাফ ছাফ বাতেঁপৃ. ১১৭-১২৪ (ইসলাম মেঁ আওরাত কা দরজা আওর উসকে হুকূক ও ফারায়েযপৃ. ১৫২-১৫৯)]

ভাষান্তর : মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

নামায খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত

...

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৪৬৬৮ বার দেখা হয়েছে

আলকুরআনে ইহসান ও মুহসিন

...

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৮৮০ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →