প্রবন্ধ
বিশ্বব্যাপী এক মাযহাব প্রবর্তনের দাবী: বাস্তবতা বিশ্লেষণ
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সকল ইসলামী জ্ঞানের আধার। তার থেকেই সাহাবায়ে কেরাম হাদীস, তাফসীর, কেরাআত, ফিকহসহ সব ধরণের ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর সাহাবায়ে কেরাম সেসব ইলম পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছেন। এভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে পাওয়া ইলম এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে।
প্রত্যেক মানুষের স্বভাব-রুচি সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সাহাবায়ে কেরামও এর ব্যাতিক্রম ছিলেন না। ফলে তাদের ইলম চর্চাতেও এর প্রভাব পড়েছিল। যিনি তাফসীর বিষয়ে বেশি আগ্রহী তিনি ইলমে তাফসীরের চর্চা বেশি করেছেন। ফলে এই শাস্ত্রে তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনিভাবে অন্য আরেকজন হয়তো ফিকহের প্রতি বেশি আগ্রহবোধ করতেন। এটা নিয়েই তিনি বেশি চর্চা করতেন। ফলে ফিকহ শাস্ত্রে তার নামধাম ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। কেউ কেউ আবার নিজেকে সম্পূর্ণরূপে জিহাদের পথে সপে দিয়েছিলেন। জিহাদের ময়দানেই নিজের পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। এভাবে যার যেদিকে বেশি ঝোঁক ও পাণ্ডিত্য ছিল তিনি সে বিষয়ে খ্যাতি লাভ করেন। এর মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানের চর্চাও বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
সাহাবিদের যুগেই অন্যান্য জ্ঞান চর্চার মতো ফিকহ চর্চারও একটা আলাদা ধারা গড়ে উঠে। সব সাহাবি ফিকহ নিয়ে গবেষণা করতেন না। বরং নির্দিষ্ট কিছু সাহাবি, যারা ফতোয়া প্রদানের উপযুক্ত ছিলেন, তারাই ফিকহ নিয়ে গবেষণা করতেন। নিত্যনতুন সমস্যার সমাধান পেশ করতেন। অন্য সাহাবিরা তা তাদের থেকে জেনে নিয়ে নিজেরা আমল করতেন। এভাবে সাহাবিদের পরেও মুসলিম সমাজের অবস্থা এমনই ছিল। দ্বীনের গভীর ইলম রাখেন এমন আলেমরা ফিকহ চর্চা করতেন। ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দিতেন। উদ্ভুত সমস্যার সমাধান দিতেন।
সাহাবীরা যেহেতু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ্য সহায়তায় ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামী আইন নিয়ে গবেষণা হতে থাকে। তাদের পরে সেসময়কার বড় বড় আলেমদেরকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠে ফিকহচর্চা-কেন্দ্র। পরবর্তীতে যেগুলো একেকটি ইসলামি আইন শাস্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই ধারাগুলোকেই আমরা বর্তমানে 'মাযহাব' বলে আখ্যায়িত করে থাকি। এই মাযহাব মূলত কুরআন-সুন্নাহর বাইরের কোন কিছু নয়। বরং কুরআন-সুন্নাহ থেকে গবেষণা করে বের করা ইসলামী আইনেরই স্বতন্ত্র ধারা।
একসময় যখন মুসলিম বিশ্বের নানা প্রান্তে ফিকহের চর্চা জোরেশোরে শুরু হয় তখন অনেকগুলো ইসলামী আইন শাস্ত্রের ধারা বা 'মাযহাব' অস্তিত্ব লাভ করে। সাধারণত যে আলেমের হাত ধরে সে ধারাটা চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছিল তার নামেই সে ধারার নামকরণ হয়ে যায়। এর মধ্যে ইমাম আবু হানিফা রাহ.কে কেন্দ্র করে 'হানাফি মাযহাব', ইমাম সুফিয়ান সাওরী রাহ.কে কেন্দ্র করে 'সাওরী মাযহাব', ইমাম মালেক রাহ.কে কেন্দ্র করে 'মালেকী মাযহাব', ইমাম শাফেয়ী রাহ.কে কেন্দ্র করে 'শাফেয়ী মাযহাব', ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.কে কেন্দ্র করে 'হাম্বলী মাযহাব', ইমাম লাইস ইবনে সাদ রাহ. এর নামে 'লাইসি মাযহাব', ইমাম যায়েদ রাহ.কে কেন্দ্র করে 'যায়দী মাযহাব', ইমাম আওযায়ী রাহ.কে কেন্দ্র করে 'আওযায়ী মাযহাব' ইত্যাদি ছিল বিখ্যাত।
এরপর একসময় কালের বিবর্তনে কিছু কিছু মাযহাবের বিলুপ্তি ঘটে। কারণ সেসব মাযহাব অতোটা সুগঠিত ও সংরক্ষিত ছিল না। ফলে যাকে কেন্দ্র করে ইসলামী আইন শাস্ত্রের ধারাটা গড়ে উঠেছিল তার তিরোধানের পর সেই মাযহাবটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কারণ যে কোন জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকার জন্য তা প্রজন্ম পরম্পরায় সংরক্ষিত থাকা হল অন্যতম জরুরি শর্ত। এই শর্তটা পূরণ না হলে তা কালের গর্ভে বিলীন হতে বাধ্য। উল্লেখিত মাযহাবগুলোর কয়েকটিতে এই শর্ত বিদ্যমান না থাকায় সেগুলোকে হারিয়ে যাবার পরিণতি বরণ করে নিতে হয়।
এখানে উদাহরণস্বরূপ লাইস রাহ. এর কথা বলা যেতে পারে। তাকে কেন্দ্র করে মিশরে 'লাইসী মাযহাব' ছিল। তাঁর ফিকহী গবেষণা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে সে অঞ্চলের মানুষ দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সমাধান গ্রহণ করতেন। ইমাম শাফেয়ী রাহ.কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল'
ইমাম মালেক বড় আলেম না ইমাম? তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, লাইস ইবনে সাদ রাহ. ছিলেন ইমাম মালেক রাহ. থেকে আরো বড় ফকীহ। কিন্তু তাঁর ছাত্ররা তাকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি। (যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/৪৫২; দারুল ফিকর প্রকাশনী)
অন্যান্য অনেক ইমামদের ক্ষেত্রেও এটা ছিল সমান সত্য। তাদের অনেকের যোগ্য ছাত্রবৃন্দ ছিল না। যারা তাঁর পরে তাঁর ফিকহী সিদ্ধান্ত ও গবেষণাগুলোকে লিখিত আকারে সংরক্ষিত রাখবেন। সেগুলোর ব্যাপক চর্চা করবেন এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তা ছড়িয়ে দিবেন। যাতে তা কালের স্রোতে হারিয়ে না যায়।
কিন্তু ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদ রাহ. ছিলেন এর ব্যাতিক্রম। তাদের প্রত্যেকেরই যোগ্য ছাত্রের বড়সড় একটা জামাত ছিলো। যারা তাদের ফিকহ বা ইসলামী আইনের ব্যাখ্যাগুলোকে সংকলিত করেছিলেন। ফলে সেগুলো ওভাবে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আরেকটা কারণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, প্রথম থেকেই ইসলামী দুনিয়ায় ফিকহ চর্চার দুইটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। একটা হিজাযে। অপরটি ইরাকে। ইতিহাসে যা মাদরাসাতুল হিজায ও মাদরাসাতুল ইরাক নামে পরিচিত। হিজাযের ফিকহচর্চা কেন্দ্রটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ইমাম মালেক রাহ. এর হাত ধরে। ফলে একে তার দিকেই সম্বন্ধিত করে 'মালেকী মাযহাব' বলা হয়। ইমাম মালেক রাহ. এর আগে আরো বহু ফকীহ এই কেন্দ্রে ইলমে ফিকহের চর্চা করেছেন। এর শুরুটা হয়েছিল বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর হাত ধরে।
অপরদিকে ইরাকের ফিকহচর্চা কেন্দ্র চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর হাত ধরে। ফলে তাঁর দিকে সম্বন্ধিত করে একে 'হানাফী মাযহাব' বলা হয়। এই মাযহাব ইমাম আবু হানীফার একক গবেষণালব্ধ কোন মাযহাব নয়। বরং এটি ইবনে মাসউদ রা. ও তাঁর ছাত্রবৃন্দ এবং তাদের ছাত্রবৃন্দের ধারাবাহিক জ্ঞান-গবেষণার সুসংগঠিত চূড়ান্ত রূপ। ইমাম আবু হানীফা রাহ. এর আগে আরো বহু ফকীহ এই কেন্দ্রে ইলমে ফিকহের চর্চা করেছেন। যাদের মধ্যে আলকামা, আসওয়াদ, ইবরাহীম নাখয়ী, হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর শুরুটা হয়েছিল বিশিষ্ট ফকীহ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর হাত ধরে।
এই দুই কেন্দ্ররই ছিল ফিকহ চর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য। ফলে উভয় কেন্দ্রেই ছাত্রদের উপস্থিতি সব যুগেই ছিল উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে আগমন করা ইমাম শাফেয়ী রাহ. ছিলেন দুই কেন্দ্রেরই শিক্ষার্থী। তিনি প্রথমে হিজাযে ইমাম মালেক রাহ. এর কাছে জ্ঞানার্জন করেন। পরে ইরাকে এসে ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর বিশিষ্ট সাগরেদ ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. এর থেকে ফিকহের জ্ঞান আহোরন করেন। ফলে বলা যায় তার মধ্যে উভয় ধারার সম্মিলন ঘটেছিল। এরপর ইমাম আহমাদ রাহ. আগমন ঘটে। তিনি ছিলেন ইমাম শাফেয়ী রাহ. বিশিষ্ট ছাত্রদের অন্যতম। মোটকথা হল, বর্তমানে যে চার মাযহাব এখনো টিকে আছে সবগুলোই হিজায-ইরাকের ফিকহচর্চা কেন্দ্রের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত। আর ইরাক-হিজাযের এই দুই কেন্দ্রের সুদীর্ঘ ফিকহ চর্চার ঐতিহ্য থাকার ফলে এই চার ইমামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ইসলামী আইন শাস্ত্রের ধারাগুলো আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান আছে। পৃথিবীর কোন না কোন প্রন্তের মানুষ সেগুলো অনুসরণ করে দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম পালন করে যাচ্ছে। বাকি মাযহাবগুলোর সেরকম শক্তিশালী সংকলন-ব্যাবস্থা না থাকায় তা একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মুসলিম উম্মাহ দীর্ঘ বহু শতাব্দী ধরেই সারা বিশ্বে ইসলামী আইনের এই চারটি ধারাকে সমর্থন করে আসছে। যেখানে যে ধারাটি সচল রয়েছে সেখানে সেই ধারা মোতাবেক ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করার কথা বলে আসছে। চার মাযহাবের এই স্বীকৃতির পক্ষে অনেক বড় বড় আলেমদের বক্তব্য উপস্থাপন করা যাবে। সেদিকে না গিয়ে আমি এখানে সর্বজনমান্য আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. এর একটা বক্তব্য শুধু উদ্ধৃত করবো। তিনি বলেন, 'পরিচ্ছন্নরূপে সংকলিত এই চার মাযহাবের অনুসরণের ব্যাপারে মুসলিম উস্মাহ ঐক্যমত্য পোষণ করেছে। এতে যে কল্যাণ রয়েছে তা কারো কাছে অজানা নয়। বিশেষত বর্তমান সময়ে। যেখানে মানুষের মনোবল অনেক কম, তারা নফসের গোলামীর স্বীকার এবং প্রত্যেকে নিজের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট'
(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/৫০৬, দারু ইবনি কাসীর প্রকাশনী)
বর্তমান সময়ে এসে আমাদের অনেক ভাই এই চার মাযহাবকে অস্বীকার করতে চান। তারা চার মাযহাবের পরিবর্তে সারা বিশ্বে এক মাযহাব প্রবর্তনের দাবীতে সোচ্চার। তাদের এই দাবীটা কতোটা যৌক্তিক সেটাই এখন আমরা বিশ্লেশণ করে দেখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
সারা বিশ্বের সকল মুসলিমরা ইসলামী আইন শাস্ত্রের একটি মাত্র ধারার অধীনে চলে আসুক এমন দাবী আজকে নতুন না। ইমাম মালেক রাহ. এর যুগেও একবার খলীফা হারুনুর রশীদ এই দাবী উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক রাহ. তার সেই দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পুরো ঘটনাটা খুলে বলছি।
মুসলিম যুগের তৎকালীন খলীফা হারুনুর রশীদ একবার ইমাম মালেক রাহ. এর সাথে আলোচনা করছিলেন। তখন তিনি তাকে বললেন, 'হে আবু আবদুল্লাহ (ইমাম মালেক রাহ. এর উপনাম) মুসলিম উম্মাহ আপনার রচনাবলী অনুযায়ী আমল করার জন্য আমরা সেগুলো লিখে ইসলামী রাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছি! ইমাম মালেক রাহ. এমন প্রস্তাব শুনে সাথেসাথে তা প্রত্যাখ্যান করে বলে দিলেন, 'হে আমীরুল মুমিনীন! উলামাদের মতানৈক্য এই উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে রহমত স্বরূপ। প্রত্যেকেই তার কাছে যা সহীহ সে অনুযায়ী আমল করুক। তারা প্রত্যেকেই হেদায়াতের উপর আছে। সবারই উদ্দেশ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। (কাশফুল খফা: নং-১৫৩)
অন্য আরেক বর্ণনায় এসেছে, খলীফা হারুনুর রশীদ ইমাম মালেক রাহ. এর সাথে তিনটি বিষয়ে পরামর্শ করেন। শেষ বিষয়টা ছিল এই যে, ইমাম মালেক রাহ. এর লিখিত মুআত্তা মালেক গ্রন্থটির উপর আমল করার জন্য সবাইকে বলা হবে। তখন তিনি খলীফাকে বলেছিলেন, 'রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা ফিকহি মাসআলা নিয়ে মতানৈক্য করেছেন। তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রত্যেকেই তারা নিজেদের কাছে পৌঁছা ইলম গ্রহণ করে নিয়েছেন।" (হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/৩২২; ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া ৩০/৭৯)
ইবনে আবি হাতিমের বর্ণনায় এসেছে,
'যদি আপনি লোকদেরকে তাদের পরিচিত পদ্ধতি থেকে সরিয়ে নিয়ে অপরিচিত পদ্ধতি চাপিয়ে দিতে চান তবে তারা এটাকে কুফুরি মনে করবে। ( আদাবুল ইলম- ৪৪, ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. ও ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। দেখুন, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/৪৮১, দারু ইবনি কাসীর প্রকাশনী)
প্রিয় পাঠক, এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলেই আমরা সেসব ভাইদের বিশ্বব্যাপী এক মাযহাব প্রবর্তনের দাবীর বাস্তবতা বুঝতে পারবো। তাই চলুন, এবার আমরা এই ঘটনাটিকে একে একে বিশ্লেষণ করে দেখি।
ক. খলীফা হারুনুর রশীদের সময়ে মুসলিম বিশ্ব এখনকার মতো বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল না। বরং সবাই এক খলীফার অধীনে ছিলেন। ফলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যে কোন বিধান কর্যকর করার জন্য খলীফার একটি আদেশই যথেষ্ট ছিল। যা বর্তমানে কোন ভাবেই সম্ভব নয়। কারণ এখন মুসলিম রাষ্ট্রগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বিভক্ত। এক রাষ্ট্রের আদেশ অন্য রাষ্ট্রে কর্যকর হয় না। ফলে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একসাথে কোন এক বিধানকে বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। এতো সুন্দর ও সহজ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইমাম মালেক রাহ. যে বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন বর্তমান সময়ের শতধা বিভক্ত মুসলিম বিশ্বে নতুন করে তার দাবী তোলাটা যে কতোটা অযৌক্তিক তা সহজেই অনুমেয়।
খ. প্রস্তাবটা দেওয়া হয়েছিল ইমাম মালেক রাহ.কে। যাতে করে তাঁর নিজের ফিকহ অনুযায়ী সারা বিশ্বের মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করে। স্বাভাবিকভাবেই সবাই চায় তার নিজের বিষয়টি প্রচার-প্রসার পাক। সেটা যদি হয় ইলমী বিষয় তবে তো সেই চাওয়াটা আরো তেজদীপ্ত হয়। এতদসত্ত্বেও ইমাম মালেক রাহ. তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যা এই দাবীর অযৌক্তিকতাকেই আরো শক্তিশালীভাবে প্রমাণ করে।
গ. যে ভূখণ্ডের মানুষদের সাহাবীরা যেভাবে ফিকহ শিক্ষাদান করেছেন সেভাবেই তাদের আমল করতে দেওয়া উচিত। অন্য কিছু তাদের উপর চাপিয়ে দিতে গেলে এটাকে তারা ভালোভাবে নিবে না। ইমাম মালেক রাহ. একে 'কুফুরি' শব্দে ব্যাখ্যা করেছেন। যার বাস্তবতা আমরা বর্তমান সময়ে দেখতে পাচ্ছি। অন্য অঞ্চলে প্রচলিত ইবাদাতের কোন পদ্ধতি আমাদের অঞ্চলের মানুষদের পালিত সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতির উপর যারা চাপিয়ে দিতে চান তাদের এই প্রচেষ্টাকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয় না। এমনকি অনেক সময় তারা বুঝের কমতির কারণে কোন কোন সুন্নাহকে কটু কথাও বলে ফেলে। যার একটা দায় অবশ্যই সেসব ভাইদের উপরও কিছুটা বর্তায়।
ঘ. প্রত্যেক মাযহাব যে হকের উপর রয়েছে তারও স্বীকোরক্তি পাওয়া যায় ইমাম মালেক রাহ. এর বক্তব্য থেকে। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, 'প্রত্যেকেই হেদায়াতের উপর রয়েছে।' সুতরাং যারা এই বিষয়ে আপত্তি করেন তারা এটি নিয়ে আরো ভাবতে পারেন।
ঙ. মাসআলাগত মতানৈক্য মনগড়া কারণে তৈরি হয় নি। বরং প্রত্যেকেরই আন্তরিক ইচ্ছা থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কিন্তু কুরআন-হাদীস থেকে মাসআলা বুঝতে গিয়ে তাদের মধ্যে মতের অমিল দেখা দেয়। এখানে কোন ইমামেরই নিয়ত অশুদ্ধ থাকে না। সবাই বিশুদ্ধ নিয়তেই ইসলামী আইন নিয়ে গবেষণা করেন। সুতরাং একে মনগড়া বলার সুযোগ নেই।
চ. ফিকহী মতোভিন্নতা সাহাবা যুগ থেকে বিদ্যমান। তারা কখনো একে মিটিয়ে ফেলে সর্বক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী এক পদ্ধতি প্রচলন করার চেষ্টা চালান নি। অথচ বর্তমান যুগের তুলনায় সেসময় এটা আরো সহজতর ছিল। সুতরাং এই ধরণের দাবী তোলাটা সাহাবায়ে কেরামের মতাদর্শেরও খেলাফ।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
সরল পথ ও বাঁকা পথ
ক. আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, واعْتَصِمُوا يحبل الله جَمِيعًا এবং তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে ধর...
মাযহাবের মহান ইমামগণের উপর আরোপিত অপবাদের অপনোদন
মূল আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. কুরআন হাদীসের জটিল ও দ্বিমুখী অর্থবহ বিষয়াদির সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান ...
ইমাম আবু হানীফা রহ. সম্পর্কে ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ.-এর মনোভাব : একটি পর্যালোচনা
ইমাম আবু হানীফা রহ. সম্পর্কে ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ.-এর মনোভাব : একটি পর্যালোচনা মাওলানা মুহসিনুদ্দী...
امام شاہ ولی اللہ رحمۃ اللہ علیہ اور حنفیت
...