প্রিয় পাঠক/পাঠিকা!
ঈমানী দুর্বলতার একটি লক্ষণ হলো গুনাহ ও হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া। এর
প্রতিকার হিসেবে আমরা আপনাকে দশটি পরামর্শ দিচ্ছি। আশা করি, আমাদের পরামর্শ
গুরুত্বসহ গ্রহণ করবেন এবং এক্ষেত্রে গড়িমসি ও অলসতা পরিহার করবেন। মনে
রাখবেন, ঈমান হলো বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার ব্যাপার। তাই ঈমানী দুর্বলতা
কাটাতে নিজ গরজেই এগোতে হবে। অন্য কেউ মুখে তুলে খাইয়ে দিবে না।
এক. আমরা আপনাকে বেশি পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করার ও শোনার পরামর্শ দিচ্ছি। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। (সূরা আনফাল ২)
দুই. অনুরূপভাবে আমরা আপনাকে বুঝে বুঝে নবীদের কাহিনী, সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি। কেননা, নবী ﷺ ও
তাঁর সাহাবায়ে কেরামের অন্তরকে প্রশান্ত করার জন্য আল্লাহ তাআলা কোরআনে
নবীদের কাহিনীগুলো উল্লেখ করেছেন। আর তিনি সাহাবায়ে কেরামের ঈমানকে আমাদের
ঈমানের জন্য আদর্শ বানিয়েছেন। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,
آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ
অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন…। (সূরা বাকারা ১৩)
এর তাফসিরে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন,
صدِّقوا كما صدَّق أصحاب محمدﷺ
মুহাম্মদ ﷺ -এর সাহাবারা যেভাবে ঈমান এনেছে, তোমরাও সেভাবে ঈমান আন…। (তাফসিরে তাবারী, সংশ্লিষ্ট আয়াত)
তিন. অধিকহারে
আল্লাহর যিকির করুন। কেননা, দুর্বল ঈমানের সুস্থতার জন্য যিকির খুবই
উপকারী। আল্লাহর যিকির অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করে। মুমিনের অন্তর যিকিরের
মাধ্যমে প্রশান্ত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে
এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর
যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। (সূরা রা’দ ২৮)
চার. ইসলামের সৌন্দর্য সৌহার্দ্য ও সম্প্র্রীতি সম্পর্কে জানুন। কেননা, ইসলামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য যুগে যুগে মানুষকে মুগ্ধ করেছে এবং ঈমানের প্রতি ধাবিত করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَكِنَّ
اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ
وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ
هُمُ الرَّاشِدُونَ
আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত
সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর,
পাপাচার ও নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই সৎপথ
অবলম্বনকারী। (সূরা হুজুরাত ৭)
পাঁচ. প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শনগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করুন। আকাশে মেঘ দেখলে আরবরা খুশি হতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহﷺ -এর চেহারা মলিন হয়ে যেতো আযাবের ভয়ে। কারণ সামূদ জাতি আযাব বহনকারী মেঘ দেখে রহমতের বৃষ্টি ভেবে ফূর্তিতে মেতে ছিলো। (মুসলিম, ৮৯৯)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ
নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে। (সূরা আলি ইমরান ১৯০)
ছয়. আল্লাহ
ও তাঁর রাসুল -কে সবচেয়ে বেশি মহব্বত করুন এবং তাঁদের হুকুমগুলোকে সব
কিছুর চাইতে বেশি প্রাধান্য দিন। আনাস ইবন মালিক রাযি. বলেন, রাসূল্লাহ ﷺ বলেছেন,
ثَلَاثٌ
مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ مَنْ أَحَبَّ الْمَرْءَ لَا
يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَمَنْ كَانَ اللَّهُ عَزَّ
وَجَلَّ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَمَنْ كَانَ أَنْ
يُقْذَفَ فِي النَّارِ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى
الْكُفْرِ بَعْدَ أَنْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ مِنْهُ
যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে সে ঈমানের মিষ্টতা পাবে; ১. যে কাউকে
ভালবাসলে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তাকে ভালবাসবে; ২. আল্লাহ্ এবং
আল্লাহর রাসূল তার কাছে অন্য সবকিছুর চাইতে বেশি প্রিয় হবে এবং ৩. আল্লাহ্
তাকে কুফর হতে পরিত্রাণ করার পর পুনঃ কুফরীতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে অগ্নিতে
নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট পছন্দনীয় হবে। (বুখারী ৪৯৮৭)
সাত. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার সামান্যতার কথা চিন্তা করুন। এর দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا
مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ
فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ
وَالْأَنْعَامُ حَتَّىٰ إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا
وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا
أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَن لَّمْ
تَغْنَ بِالْأَمْسِ ۚ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ
يَتَفَكَّرُونَ
পার্থিব জীবনের উদাহরণ তেমনি, যেমনি আমি আসমান থেকে পানি বর্ষন করলাম,
পরে তা মিলিত সংমিশ্রিত হয়ে তা থেকে যমীনের শ্যামল উদ্ভিদ বেরিয়ে এল যা
মানুষ ও জীব-জন্তুরা খেয়ে থাকে। এমনকি যমীন যখন সৌন্দর্য সুষমায় ভরে উঠলো
আর যমীনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল, এগুলো আমাদের হাতে আসবে, হঠাৎ করে তার
উপর আমার নির্দেশ এল রাত্রে কিংবা দিনে, তখন সেগুলোকে কেটে স্তুপাকার করে
দিল যেন কাল ও এখানে কোন আবাদ ছিল না। এমনিভাবে আমি খোলাখুলি বর্ণনা করে
থাকি নিদর্শণসমূহ সে সমস্ত লোকদের জন্য যারা লক্ষ্য করে। (সূরা ইউনুস ২৪)
আট. আল-ওয়ালা
ওয়াল-বারা ঠিক রাখুন। অর্থাৎ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা উভয়টিই আল্লাহর জন্য।
সুতরাং মুমিনদের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব রাখুন। আর কাফিরদের সাথে শত্রুতা
রাখুন ও সম্পর্কচ্ছেদ করুন। কেননা, দ্বীনের শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখলে
ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا
وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ
يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
নিঃসন্দেহ তোমাদের বন্ধু হচ্ছেন কেবলমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল, আর
যারা ঈমান এনেছে, আর যারা নামায কায়েম করে, আর যাকাত আদায় করে, আর তারা
রুকুকারী। (সূরা মায়িদা ৫৫)
রাসূল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَن أحبَّ للَّهِ وأبغضَ للَّهِ ، وأعطى للَّهِ ومنعَ للَّهِ فقدِ استَكْملَ الإيمانَ
যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য প্রদান
করে এবং আল্লাহর জন্য প্রদান থেকে বিরত থাকে সে ঈমান পরিপূর্ণ করেছে। (আবু
দাউদ ৪৬৮১)
নয়. ঈমানী দুর্বলতার চিকিৎসায় বিনয়
ও লজ্জাশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এটি আল্লাহভীতির সূচক। লজ্জা
ঈমানের অঙ্গ। সাধ্য থাকার পরও অহংকার ও নির্লজ্জতার পোশাক না পরলে
কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তাকে ঈমানের পোশাক পরাবেন বলে তিরমিযির একটি হাদীসে
এসেছে।
দশ. সর্বোপরি আপনাকে বিভিন্ন
রকমের নেক আমল করা এবং গুনাহ বর্জনের পরামর্শ দিচ্ছি। কেননা, যেকোনো নেক
আমল ঈমানকে বৃদ্ধি করে। এজন্য কোরআন মজিদে যত জায়গায় ঈমানের কথা এসেছে তত
জায়গায় পাশাপাশি নেক আমল করার কথাও এসেছে।
পরিশেষে দোয়া করি, হে আল্লাহ! আপনি ঈমানকে
আমাদের নিকট প্রিয় করে দিন এবং ঈমানকে আমাদের অন্তরে সুশোভিত করে দিন।
কুফর, পাপাচার ও আপনার অবাধ্যতাকে আমাদের নিকট অপছন্দনীয় করে দিন এবং
আমাদেরকে সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।