প্রবন্ধ

হযরত মাওলানা মুফতী শহীদুল্লাহ দা.বা.

লেখক:মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব
২২ জানুয়ারী, ২০২২
৬৩২৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

ফেনী শহরের পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে কালিদাস পাহালিয়া নদীর তীর। পাশেই জামি‘আ রশীদিয়ার অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল ক্যাম্পাস। মাঠের পাশে আধুনিক স্থাপত্যে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন ছাত্রাবাস আর সৌন্দর্যের প্রতীক আর-রশীদ জামে মসজিদ। চারপাশে বিচিত্র ফুলের সাজানো বাগান আর ফলফলাদির সারি সারি বৃক্ষ। প্রতিটি ভবন থেকে বের হয়েছে পিচঢালা ছোট পথ। একপাশে স্বচ্ছ জলাধার। অন্যপাশে শান্ত পাহালিয়া নদী। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের বর্ণিল সমাহার এখানে। বৃষ্টিভেজা গোলাবের চেয়েও বেশি সজীব অধিক প্রাণবন্ত।

রাতের রশীদিয়া বড়ই চমৎকার। ছাত্রাবাসের বেলকনি থেকে চোখে পড়ে আলো আঁধারির অপূর্ব পরিবেশ। সন্ধ্যা যখন মাটিতে নেমে আসে রশীদিয়া তখন হাজার হাজার কাকলিমুখর পাখির অভয়াশ্রম। সন্ধ্যা যত গাঢ় হয় কিচিরমিচিরও স্তিমিত হতে থাকে। একসময় প্রতিটি পাখি শাখায় শাখায় পাতার ছাউনিতে ঘুমিয়ে পড়ে একেবারেই হাতের নাগালে। ইচ্ছা করলেই ধরা যাবে। কিন্তুআজব ব্যাপার! জামি‘আ রশীদিয়ার চার হাজার ছাত্র প্রত্যেকেই নিজের চেয়ে সেসব পাখিদের বেশি ভালোবাসে। আপন করে হৃদয়ের মমতা মিশিয়ে ওরা কৃত্রিম বাসাও বানিয়ে রাখে। পাখিরাও সে ভালোবাসায় তৃপ্ত, মুগ্ধ হয়। হঠাৎ কামরায় ঢুকে পড়া কোন ছোট্ট চড়–ইয়ের নিরাপত্তার খাতিরে...

বলছিলাম জীবন্ত রশীদিয়ার কথা। এতোক্ষণ যা বলেছি নিতান্তই কম বলেছি। অবশ্য আমরা অনেকেই সবিস্ময়ে উপভোগ করেছি রশীদিয়ার সে মনমোহিনী সৌন্দর্য। আবেগাপ্লুত হয়েছি রশীদিয়া কর্তৃপক্ষের নিরেট-নিখাঁদ আপ্যায়ন আন্তরিকতায়। 

সে বর্ণনায় আজ আর যাচ্ছি না। আজকে আমরা তুলে ধরছি রশীদিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টার কথা। যিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন আজকের এ রশীদিয়া। যার স্বপ্ন দেখা চিত্রটিই চিত্রিত হচ্ছে পরম সফলতায়। যাকে আমরা বলতে পারি রশীদিয়ার প্রাণপুরুষ ও রাহবার। 

আমরা মুহতারাম মুফতী শহীদুল্লাহ দা.বা.-এর কথা বলছি আর তাকেই বলছি স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্নদ্রষ্টা বলছি তারই একটি স্বপ্নের দরুণ, যা হতে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। সাহসী হয়ে এ মহান এদারার ভিত স্থাপন করেছেন এবং সম্মুখ পানে এগিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন ছিলো, হৃদয়ের গহীনে বড় প্রত্যাশা ছিলো আকাবিরে আসলাফের নমুনায় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবো। প্রতিষ্ঠানটি হবে দীনের এক দুর্ভেদ্য দূর্গ, আসহাবে        সুফ্ফার উৎকৃষ্ট নমুনা। কিন্তু কখনো মনে হয়নি আমার পক্ষে তা সম্ভব। একরাতের কথা। অন্য সব রাতের মতোই ঘুমিয়েছি। দেখি,  আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে ধানের জমিতে এক বিশাল জামাআতে নামায হচ্ছে। দু’চোখের সীমানা পেরিয়ে দূর অবধি মুসল্ল¬ীদের নূরানী কাফেলা। তাদের নূরে সবকিছু ঝলমল করছে। নামাযের প্রতিটি কাতার পরিপূর্ণ। কেন যেন কোথাও কোন জায়গা বাকি নেই। সর্বশেষ কাতারে মাত্র একজন মুসল্লী দাঁড়াতে পারবে। আমি তড়িঘড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে কিরাআত পড়ছেন মনের সবটুকু মাধুরী মিশিয়ে। চারদিকে এক জান্নাতী আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হল এ সুর আমার চেনা দুনিয়ায় নয়; অচেনা ঊর্ধ্ব জগতের। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তিলাওয়াত শুনছি। আমাকে বলা হলো, এই নামাযে ইমামতি করছেন দোজাহানের সরদার স্বয়ং রাসূলে কারীম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। স্বপ্নটি আমার প্রতিজ্ঞা পূরণে আমাকে দৃঢ় করে তুলল। আমার কর্ম উদ্দীপনা শতগুণে বাড়িয়ে দিল। এ স্বপ্ন আমার ভালোলাগা, আমার মহান প্রেরণা। 

জন্ম ও শিক্ষাকাল

আজ হতে ৫৪ বছর আগের কথা। ৩ শাওয়াল ১৩৮৩ হিজরী, ১২ জুলাই ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ। ফেনী সদর থানার কালীদহ ইউনিয়নের মৌলবী বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন মহান এ কর্মবীর মানুষটি। পারিবারিক ঐতিহ্য বেশ সমীহ করার মতো। পিতা মৌলবী আলী আকবর রহ. সময়ের বড় বুযুর্গ ও নামিদামী আলেম ছিলেন। যামানার কুতুব সূফী সদরুদ্দীন রহ.-এর খেলাফতও তিনি লাভ করেছিলেন। দাদা-নানা উভয়ে ছিলেন অত্যন্ত পরহেযগার ও সম্মানী ব্যক্তিত্ব। মরহুমা আম্মাজান আমেনা খাতুনও ছিলেন একজন দীনদার পরহেযগার মহিলা। পারিবারিকভাবে দীনি ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত থাকায় মায়ের কোল থেকেই শিক্ষার সূচনা হয়। লস্করহাট ইসলামিয়া ও ভালুকিয়া কাসেমুল উলূম কওমী মাদরাসায় শুরু হয় তার শিক্ষা জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা। 

তারপর শুরু হয় দীন অর্জনের এক মহাযাত্রা। উলূমে দীনের ঐতিহ্যের ধারক চট্টগ্রামের মেখল হামিউস সুন্নাহ মাদরাসায় অধ্যয়ন করেন দীর্ঘ ছয় বছর। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দীনী বিদ্যাপীঠ জামি‘আ আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী থেকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপন করেন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আহসানুল ফাতাওয়ার সংকলক, মুফতিয়ে আ’যম রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী রহ.-এর প্রতিষ্ঠিত দারুল ইফতা ওয়াল ইরশাদে ভর্তি হয়ে ইসলামী উচ্চতর আইন গবেষণায় উচ্চতর (মুফতী) ডিগ্রি অর্জন করেন। আর পাশাপাশি মুফতিয়ে আ’যম রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী রহ.-এর সোহবতে থেকে আধ্যাত্মিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করে খেলাফত লাভে ধন্য হন।

যিনি বড় হোন তিনি ছোট থেকেই থাকেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। মুফতী শহীদুল্লাহ সাহেবও তেমনই ছিলেন। লেখাপড়ায় শুরু থেকেই অত্যন্ত মেধাবী, মনোযোগী এবং কঠোর পরিশ্রমী। জায়গীর থেকে পড়েছেন মেখলের ছয়টি বছর। মাদরাসায় বহুদূর থেকে আসা-যাওয়া করতেন। তবে সময়ের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যতœশীল। জায়গীর বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথেই গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ পুরোটা মুখস্থ করেছেন। বাড়িতে যাতায়াতের সময় গাড়ি আর ট্রেনে বসে ফয়যুল কালাম, হিদায়াতুল ইবাদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব সম্পূর্ণ মুখস্থ করেছেন। পড়ালেখায় যেমন অনন্য ছিলেন বিনয়-ন¤্রতা, আখলাক-চরিত্রেও ছিলেন তেমনই ঈর্ষণীয়। আল্লাহ পাক তাকে অনন্য গুণের অধিকারী করেছেন। 

বড়দের চোখে যেমন

হযরতের প্রিয় ছাত্র মুফতী ফয়যুল্লাহ। সুদর্শন প্রাজ্ঞ তরুণ আলেমে দীন। চেহারায় ইলম ও ন¤্রতার স্পষ্ট নিদর্শন। হযরতের অনুপস্থিতিতে জামি‘আ রশীদিয়ার সুযোগ্য দায়িত্বশীল। অন্যান্য উস্তাদগণের সহযোগিতায় তখন পরিচালনার সকল দিক অত্যন্ত সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। হযরত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাটহাজারী মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস বর্তমানে নানুপুর মাদরাসার শাইখুল হাদীস আল্লামা শেখ আহমাদ সাহেব একবার দরস চলাকালীন আমাকে বলছিলেন, ফয়যুল্লাহ! আমি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে হাটহাজারী মাদরাসায় খেদমত করছি। এ দীর্ঘ সময়ে মেধা, বুদ্ধি, পড়ালেখা ও আদব-আখলাকে নানা রকম ছাত্র পেয়েছি। তাদের একেকজনের একেক গুণ, একেকজন একেক বিষয়ে দক্ষ। কিন্তু তোমাদের ফেনীর শহীদুল্লাহর মতো আর কারও মধ্যে এই সব গুণের সমাবেশ দেখিনি। আল্লাহ পাক তাকে যেমন মেধা, প্রতিভা ও প্রজ্ঞা দান করেছেন; উন্নত চরিত্র, বিনয় ও ন¤্রতাও দান করেছেন মনে রাখার মতো। 

ধন্য সেই ছাত্র, সার্থক তার জীবনÑ উস্তাদ যাকে এভাবে মূল্যায়ন করেন। 

মুফতী ফয়যুল্লাহ সাহেব আরো বলেন, হযরতের সাথী মাওলানা যমীরুদ্দীন সাহেব আমাদেরকে একবার শুনিয়েছেন, মুফতী শহীদুল্লাহ সাহেবের ইলমী মাহারাত ও মুতালা‘আর একসূয়ী (জ্ঞান-দক্ষতা ও অধ্যয়ন একাগ্রতা) আমরা সেই নাহবেমীর জামাআত (কওমী সিলেবাসের তৃতীয় ক্লাস) থেকেই উপলব্ধি করেছি। তখন আমরা মেখল মাদরাসায় নাহবেমীর পড়ি। মাওলানা আযীযুল্লাহ সাহেব রহ. বড় হুযূর ছিলেন আমাদের জামাআতের নেগরান (তত্ত¡াবধায়ক)। পূর্বনির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী নাহবেমীর এবং দু’বছর পরবর্তী কাফিয়া ক্লাসের মধ্যে মুবাহাসা (বিতর্ক অনুষ্ঠান)-এর ঘোষণা দেয়া হল। মুবাহাসার বিষয় নির্ধারণ হল, ইলমে নাহব বা আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র। ঘোষণার দিন থেকেই সবার মধ্যে একধরনের আনন্দ বিরাজ করছিল। সেই সাথে চলছিল ধুম প্রস্তুতিও। সাজসাজ রব পড়ে গিয়েছিল। আমাদের ছোটদেরও আগ্রহ-উত্তেজনার কমতি ছিলো না। আমরাও সাধ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন আমাদের পক্ষের সবচেয়ে  মেধাবী, ক্লাসের ‘ফার্স্টবয়’ শহীদুল্লাহ ভাই অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেলেন। আমাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল। উস্তাদরাও চিন্তায় পড়ে গেলেন। সবাই আমরা দু‘আ করছিলাম যেন শহীদুল্লাহ ভাই যথাসময়ে মাদরাসায় উপস্থিত হতে পারেন। আল্লাহর মেহেরবানীতে তিনি মুবাহাসার আগ মুহূর্তে মাদরাসায় চলে এলেন। যথাসময়ে বিতর্ক শুরু হলো। কাফিয়া জামাআতের বড় ভাইয়েরা আমাদেরকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আর আমাদের পক্ষ থেকে উওর দিয়ে যাচ্ছেন শহীদুল্লাহ ভাই। তারপর যখন আমাদের প্রশ্ন করার পর্ব এলো, শহীদুল্লাহ ভাই ওদেরকে এমন এমন প্রশ্ন করতে লাগলেন যে, ওরা  বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উওর দিতে পারল না। 

উস্তাদগণ আমাদের বিজয়ী ঘোষণা করলেন। বড় হুযূর ভীষণ খুশি হলেন। সবাইকে বিশেষ দু‘আ দিলেন। আর শহীদুল্লাহ ভাইকে বললে¬ন, আজ তুমি আমার সম্মান রক্ষা করেছো, আল্লাহ তোমার সম্মান বৃদ্ধি করুন!

আমরা দেখতাম, তিনি সব সময় ক্লাসে প্রথম হতেন। উস্তাদের পাশাপাশি তিনি তার শাইখেরও খাস দু‘আ পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী রহ. একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় বলতেন, শহীদুল্লাহ কা তো উস দিন কাম বন গায়া (শহীদুল্লাহ তো সে দিনই কামিয়াব হয়ে গেছে) তিনি মাঝে মাঝে আরো বলতেন, মেরে শহীদুল্লাহ মুখবিতীন মে সে হ্যায় (আমার শহীদুল্লাহ বিনয়ীদের অন্তর্ভুক্ত)। এগুলো ছিলো একজন ছাত্রের প্রতি তার শাইখের মূল্যায়ন ও আন্তরিক ¯েœহ-মায়া। 

আসলে আল্লাহওয়ালাদের সোহবত মানুষকে যেমন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয় তেমন তার মধ্যে এনে দেয় স্বভাবজাত উৎকর্ষ ও বিনয়। তিনি করাচিতে তার শাইখের সান্নিধ্যে আট বছর কাটিয়েছেন। শাইখ তাকে নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েছিলেন; কিন্তু সেখানে তিনি নিজেকে সবসময় খাদেমই মনে করতেন। জানতে পেরেছি, তিনি সেখানে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন এমনকি যে দিন তিনি দেশে চলে আসবেন সেদিনও প্রতিদিনের ন্যায় দু’হাতে ময়লার বালতি নিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে ডাস্টবিনে রেখে আসেন। 

বড়দের দু‘আ আর সোহবত পেলে মানুষের জীবনে এমনই পবিত্র রং আর নূরানিয়্যাত চলে আসে। আর তিনি সেই ছেলেবেলা থেকেই বড়দের দু‘আ কুড়িয়েছেন। মেখল মাদরাসায় পড়াকালীন মুফতিয়ে আ’যম ফয়যুল্লাহ রহ. এর দু‘আ পেয়েছেন বহুবার। আর পরিণত বয়সে করাচিতে পেয়েছেন যামানার এক মহামনীষী হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী রহ. এর মহান সান্নিধ্য। তাছাড়া তিনি হাতিয়ার হযরত মুফতী সাইফুল ইসলাম রহ. এর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেছেন। নাহ্ব, সরফ, ফারসী, উর্দূ অনেক কিতাব তিনি হযরতের কাছে পড়েছেন।

হাটহাজারী মাদরাসার আসাতিযায়ে কেরাম অনেকেই হযরতের উস্তাদ। তাদের বিশেষ কয়েকজন হলেনÑ 

(ক) শাহ আব্দুল আজিজ রহ.; শাইখুল হাদীস, হাটহাজারী মাদরাসা, 

(খ) শাহ আহমাদুল হক রহ.; মুফতিয়ে আযম, হাটহাজারী মাদরাসা, 

(গ) আল্লামা শাহ আহমাদ শফী দা.বা.; বর্তমান শাইখুল হাদীস ও মুহতামিম, হাটহাজারী মাদরাসা।

পাকিস্তানের বর্তমান জামিয়াতুর রশীদের পৃষ্ঠপোষক হযরতুল আল্লাম মুফতী আব্দুর রহিম (বারাকাল্লাহু ফি হায়াতিহ্)-সম্পর্কে হযরত প্রায়ই বলেন, আমি পাকিস্তানের হযরতের পর সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি আমার উস্তাদে মুহতারাম ও বর্তমান শাইখ মুফতী আব্দুর রহীম সাহেব দা.বা. থেকে। দরসে নেযামীর  বেশিরভাগ জটিল কিতাবগুলো আমি হযরতের নিকট দ্বিতীয়বার পড়েছি। এতে আমার অনেক ফায়দা হয়েছে। বিশেষ করে নাহ্ব-সরফের কিতাবসমূহে ও ফিকহী বিভিন্ন তাহকীকাতে আল্লাহ হযরতকে এমন মেধা ও তীক্ষèতা দান করেছেন যার নজির মেলা ভার।

কর্মজীবন ও অধ্যাপনা

হযরতর কর্মজীবনের সূচনাও হয়েছে বড় বিস্ময়করভাবে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের কোন একসময়। সবেমাত্র পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরেছেন। প্রথমে নিজ বাড়ির দরজায় ছোট্ট একটি মসজিদে কিছুদিন অবস্থান করেন। তখন উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসাসহ দেশের অনেক বড় বড় মাদরাসা থেকে খিদমতের প্রস্তাব আসতে থাকে। হযরত নিজে কোন সিদ্বান্ত না নিয়ে নিজ শাইখের নিকট চিঠি লেখেন। এদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু তালিবে ইলম এসে ঐ মসজিদে হযরতের নিকট পড়া-লেখার জন্য জড়ো হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তবে হযরত স্থায়ীভাবে তাদেরকে থাকার সিদ্বান্ত না দিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে প্রেরিত চিঠির উত্তর এসে পৌঁছলÑ যাতে উল্লেখ রয়েছেÑ যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো। অর্থ্যাৎ অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যে মসজিদে আছো সেখানেই খিদমত শুরু করে দাও। এজন্যই বলা হয়, 

‘কলন্দর হর-চে গো-য়্যাদ, দীদাঃ গো-য়্যাদ।’ অর্থাৎ আল্লাহওয়ালারা যা  বলেন দেখে-শোনেই বলেন।  তো হযরত শাইখের নির্দেশ পেয়ে ছাত্রদের স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দিয়ে দেন। আলহামদুলিল্লাহ, অল্প সময়ের মধ্যে হযরতের তা’লীম, তরবিয়ত ও যোগ্যতার কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে ছাত্রসংখ্যাও দিনদিন বাড়তে থাকে। একসময় মসজিদও ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়।

বাড়ির পাশের এক মুখলিস হাজী সাহেব। মক্কাপ্রবাসী। আলহাজ্জ মুহাম্মাদ আলী সাহেব। অত্যন্ত দীনদার ও হৃদয়বান। পূর্ব থেকেই ছাত্রদের মসজিদে থাকার কথা শুনে দেশে এসে স্বচক্ষে দেখেন এবং নিজ উদ্যোগে একটি জায়গা খরিদ করে নিজ তহবিল থেকে একটি ঘর নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তারপর পাকিস্তানের হযরতের অনুমতি পেয়ে ভিত গড়ে তোলেন দেশনন্দিত বিদ্যাপীঠ জামি‘আ রশীদিয়ার। আজ রশীদিয়া একটি প্রেরণা, একটি ইতিহাস।

বর্তমানে রশীদিয়া ছাড়াও দেশের বহু প্রতিষ্ঠান হযরতের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হচ্ছে। বহু প্রতিষ্ঠান থেকে হযরতকে দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন করা হয়; কিন্তু তিনি হক আদায় না হওয়ার অজুহাতে এড়িয়ে যান। 

তা’লীম-তরবিয়াতের ক্ষেত্রে হযরতের দৃষ্টিভঙ্গি বড় চমৎকার। তিনি মনে করেন, সাধারণত মাদরাসাগুলোতে তা’লীম, তরবিয়াত উভয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ মাদরাসা হচ্ছে তা’লীম, তরবিয়ত উভয়টিরই কেন্দ্র। কোন কোন মাদরাসায় তো তা’লীমের মানও তেমন নেই। আর কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে তা’লীমের গুরুত্ব যদিও কিছুটা রয়েছে, কিন্তু তরবিয়তের বিষয়টি একেবারেই গুরুত্বহীন। অথচ ছাত্রদের তরবিয়তের বিষয়গুলো অর্থাৎ আমলী বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। না হয় এই ইলম আসহাবে সুফফার মীরাস হবে না। বর্তমানে শিক্ষার প্রতি যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে যদি তরবিয়ত বা দীক্ষার প্রতিও সমান গুরুত্ব দেয়া হতো তাহলে মাদরাসাগুলোর অবস্থা আরো উন্নত হতো।

জামি‘আর আসাতিযায়ে কেরামকে হযরত প্রায়ই বলেন, ছাত্রদের কোন ত্রæটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে সাথে সাথেই সকলের ইসলাহের উদ্দেশ্যে কিছু কথা যেন অবশ্যই বলা হয়। প্রয়োজনে সবকের মাঝেও ইসলাহী এবং তরবিয়তী কথা-বার্তা বলতে থাকা। 

ছাত্রদের তরবিয়তের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বাদ আসর মাসজিদে রশীদে সকল ছাত্রের উদ্দেশ্যে হযরত সংক্ষিপ্ত নসীহত করেন। এতে ছাত্রদের যারপরনাই উপকার হয়। অনেকের জীবনের মোড়ও পরিবর্তন হয়ে যায়।

উলামায়ে কেরাম ও জনসাধারণের মাঝে দীনী খিদমত

প্রতি রবিবার বাদ মাগরিব হযরত জামি‘আর দারুল ইরশাদে (খানকাতে) উলামা ও আসাতিযায়ে কেরামের  উদ্দেশে বিশেষ নসীহত করেন। এ সময় উস্তাদদের ত্রæটিগুলো মহব্বতের সাথে পর্যালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাদরাসা তো আসলে উস্তাদদেরই নাম। যে মাদরাসার উস্তাদগণ তরবিয়তওয়ালা হবেন সে মাদরাসার ছাত্রদের হালতও ভিন্ন রকম হবে। কারণ উস্তাদের গুণাবলী সহজাতভাবেই তার ছাত্রদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে।

কিছুদিন থেকে জামি‘আর উস্তাদদের জন্য প্রতি মঙ্গলবার বাদ মাগরিব হযরত গুরুত্বপূর্ণ একটি মজলিস শুরু করেছেন। এতে উস্তাদদের মা’মূলাতের খোঁজ-খবর নেয়াসহ বিভিন্ন জরুরী ইলমী তাহকীকাত করানো হয়। এছাড়াও তিনি দেশের বহু উলামায়ে কেরামকে বিভিন্নভাবে ইলমী রাহনুমায়ী করে থকেন। উল্লেখ্য, জামি‘আর সকল আসাতিযা হযরতের সঙ্গে ইসলাহী তা‘আল্লুক রাখেন।

জনসাধারণের মাঝেও দীনী কার্যক্রম আঞ্জাম দেয়ার প্রতি তিনি ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। জামি‘আর চারপাশে ৪/৫ কি.মি. পর্যন্ত প্রায় সকল মসজিদ জামি‘আর বিশেষ তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হয়। বর্তমানে পরিচালিত মসজিদ ৪৬টি ও মকতব ৪৩টিÑ যার ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বর্তমানে ১,৩১৮ জন। জামি‘আর ৩১ জন উস্তাদকে জুমুআর নামায পড়ানোর যিম্মাদারী দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে জনগণ তাদের মাধ্যমে সহীহ দীন পেয়ে যায়। এছাড়া এলাকায় প্রায় ১৫০টিরও বেশি জায়গির রয়েছে। জায়গির, মকতব ও মসজিদ মিলে সর্বমোট ৫৮টি পয়েন্টে ২২৭জন ছাত্র মাদরাসা এলাকাতে অবস্থান করছে। ছাত্রদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ও অবস্থানের ফলে সমাজ ও জনসাধারণের দীনী অনেক উপকার হচ্ছে। প্রতি বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টার ৫/৭টি জামাআত এলাকার মসজিদগুলোতে দাওয়াত ও তাবলীগের নিসবতে পাঠানো হয় এবং এর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য জামি‘আর সাল-ওয়ালা কয়েকজন আসাতিযায়ে কেরামও বিশেষ দায়িত্বে রয়েছেন।

প্রতি শুক্রবার বাদ মাগরিব মসজিদে রশীদে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজন হযরতের ইসলাহী বয়ানে শরীক হন। এতে শ্রোতাদের মধ্যে আকীদার শুদ্ধি ও আমলের জযবা পয়দা হয়।

রশীদিয়ার তারাক্কী ও হযরতের তাকওয়া

জামি‘আ রশীদিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে। দুই যুগ পার হয়নি। অথচ আজ রশীদিয়া পরিণত হয়েছে এক বিশাল মহীরূহে। দশ একর জমিতে ১১০ জন উস্তাদ নিয়ে চার সহ¯্রাধিক তালিবে ইলম। তা’লীম-তরবিয়াত, আমল-আখলাক আর শিষ্টাচারের পূর্ণাঙ্গতা যে কেউ দেখামাত্র উপলব্ধি করতে পারবে।

উস্তাদগণের বিনয়-ন¤্রতা, মেহনত-মুজাহাদার বর্ণনাও শেষ করা যাবে না। জিজ্ঞেস করেছিলাম নায়িবে মুহতামিম মুফতী ফয়যুল্লাহ সাহেবকে রশীদিয়ার তা’লীমী নেযাম সম্পর্কে। তিনি হযরতের তা’লীমী নেযামের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কথা সবিশেষ তুলে ধরে বলেন, হযরত তামরীন অর্থাৎ অনুশীলনের মাধ্যমে পড়ানোর জন্য আসাতিযায়ে কেরামকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন এবং ছাত্রদের থেকে সবক আদায় করার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকেন। এ ব্যাপারে হযরত বলে থাকেন, মেধাবী ছাত্র তো উস্তাদের বিশেষ মেহনত ছাড়াও নিজ প্রচেষ্টায় সফলকাম হতে পারে। উস্তাদের বাহাদুরী হচ্ছে দুর্বল ছাত্রদেরকে ওঠানো। যোগ্য উস্তাদ তো সেই, যে দুর্বল ছাত্রদের ওপর মেহনত করে তাদেরকে উঠিয়ে নিতে পারে।

যে জামাআতগুলোতে ছাত্র সংখ্যা বেশি, সবক আদায় ও তামরীনের মাধ্যমে পড়ানোর সুবিধার্থে সেগুলোকে একাধিক গ্রæপে ভাগ করে পড়ানো হয়। যেমন, বর্তমানে কাফিয়া জামাআত তিন গ্রæপে, হিদায়াতুন্নাহু জামাআত আট গ্রæপে, নাহবেমীর জামাআত দশ গ্রæপে, সরফ জামাআত দশ গ্রæপে, ফার্সী জামাআত ছয় গ্রæপে, উর্দূ জামাআত চৌদ্দ গ্রæপে পড়ানো হচ্ছে। প্রত্যেক গ্রæপের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যিম্মাদার উস্তাদ রয়েছেন। যাতে ২৪ ঘণ্টা ছাত্রদের সার্বিক চিত্র উস্তাদদের সামনে থাকে। কেননা ইলমী যোগ্যতায় পূর্ণতার লক্ষ্যে প্রাথমিক জামাআতগুলোর পড়ালেখার তদারকিতে সবিশেষ গুরুত্ব রাখে।

জামি‘আর সিনিয়র উস্তাদ মাওলানা মামুন সাহেব। একজন আদর্শ উস্তাদ। হযরতের ছাত্র থেকে এখন জামি‘আর আত্মত্যাগী উস্তাদ। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার দৃষ্টিতে রশীদিয়ার এতোটা তারাক্কির বাহ্যিক কারণ কী? তিনি বললেন, মুহতামিম সাহেবের আকাবির-আসলাফের যথার্থ অনুকরণ, বিনয়, ন¤্রতা আর স্বচ্ছ মু‘আমালাত-মু‘আশারাত।

অবশ্য দেশের এতো বড় একজন প্রাজ্ঞ আলেমে দীন, বহু প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী কর্ণধার হওয়া সত্তে¡ও তিনি কতোটা স্বভাবজাত বিনয় ও উন্নত চরিত্র-মাধুর্যের অধিকারী তা সামান্য সময়ের সাক্ষাত লাভেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি আপ্লুত হয়েছি যখন তিনি নিজে দস্তরখানে উপস্থিত থেকে আমাদেরকে সময় দিয়েছেন। স্বহস্তে মেহমানদের আপ্যায়ন করেছিলেন। মুগ্ধ হয়েছি হযরতের নির্মোহ রূপ আর চলন-বলনের স্বাভাবিকতা দেখে।

মামুন সাহেব বলছিলেন, আমরা দেখেছি হযরতের তাকওয়া, খোদাভীতি ও লেনদেনের স্বচ্ছতার চিত্র।  কোন কারণে বাসার মোবাইলটি মাদরাসায় চার্জ দেয়া হলে এর ব্যয় পরিশোধ করা যিনি নিজের জন্য ফরয মনে করেন, সেখানে অন্যান্য লেনদেনে কতোটা স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হবেন তা সহজেই অনুমেয়। আমরা হযরতের সার্বিক বিষয়ে গর্ব করে বলতে পারি, জনসাধারণ, উলামায়ে কেরাম ও তলাবায়ে ইযামের মাঝে দীনী আমানত পৌঁছে দেয়ার হযরত যে ফিকির করেন তা ইতিহাস হওয়ার মতো। আমরা ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে তার যে উন্নত চরিত্রের পরিচয় পেয়েছি তা সত্যিই অনুসরণীয়।

আমরা মনে করি, হযরত জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ। তলাবা-উলামা সকলের জন্য তিনি এক স্বপ্নপুরুষ। রাব্বে পাক হযরতের নেক হায়াতকে আমাদের সকলের উপরে দীর্ঘায়িত করুন। আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

মহৎ মানুষ, আদর্শ পুরুষ

...

আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.)
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১৫৫১ বার দেখা হয়েছে

সালাফে সালিহিনদের আমল

...

মাওলানা আইনুল হক ক্বাসেমি
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৩৫৮৪ বার দেখা হয়েছে

হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নোমানী রাহ.; সংক্ষিপ্ত জীবনী

...

শাঈখুল ইসলাম হযরত আব্দুল মালেক
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২২৭৩ বার দেখা হয়েছে

এমন মানুষ মিলবে না আর...... মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. স্মরণে

...

মুফতী সালমান মানসুরপুরী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৪১২১ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →