প্রবন্ধ

আ মা দে র স ফ র কাফেলা এবার ফেনীর পথে

লেখক:মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব
২২ জানুয়ারী, ২০২২
১০০৬ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

হঠাৎ গাড়ির তীব্র ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা উবে গেল। মাথা ঝাড়া দিয়ে দেখি, সবার চোখ বাঁ-দিকের জানালায়। তাদের দৃষ্টি লক্ষ্য করে আমিও তাকাই। দূরের সবুজাভ পাহাড়সারি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অস্পষ্ট রেখায় কাঁটাতারের বেড়া; ভিন্নতার প্রতীক দু-দেশের সীমানা-বেষ্টনী।

সেই ক-খ-ন আবছা আধারে ঢাকা ছেড়েছি। একটু পর কুমিল্লা পেরোব। সামনে ফেনীর সীমানা, কাক্সিক্ষত গন্তব্য। এতোক্ষণে মিষ্টি রোদ জানালার কাঁচ গলে শরীর ছুঁয়েছে। রোদের উষ্ণতায় ওম ধরেছে মনেরও আঙিনায়।

মাওলানা নজরুল ইসলামÑ সফরের স্থানীয় আয়োজকÑ ফেনীর প্রবেশপথে স্বাগত জানাতে অপেক্ষমাণ। একটু পরপর ফোন করে জিজ্ঞেস করেনÑ আপনারা কোথায়, কতদূর?। শেষবার ‘এই তো আরেকটু’ বলতে না বলতেই পথের পাশে দাঁড় করানো সাদা প্রাইভেটকারটি চোখে পড়ল; পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয় মাওলানা নজরুল ইসলাম। মূলত তাঁরই একান্ত আগ্রহ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় রাবেতা-কাফেলা এবার ফেনীর দোরগোড়ায় উপস্থিত। দেশব্যাপী সফর উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় এটা রাবেতার চতুর্থ সফর।

ফেনীর প্রথম মঞ্জিল

জামি‘আ ইসলামিয়া দত্তাসার মাদরাসা। ফেনীর প্রবেশ-পথে হাইওয়ে-সংলগ্ন অনেক পুরনো একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা। এ পর্যন্ত সাতজন মুহতামিম গত হয়েছেন। বর্তমান মুহতামিম মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেব। হালকা গড়ন, হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মধ্যবয়সী আলেমে দীন। ৩২জন উস্তাদ আর ৪৫০জন ছাত্র নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা মাদরাসা-ভবনের দ্বিতীয় তলায় অফিসকক্ষে বসেছি। একে একে উস্তাদগণও চলে এলেন। মাওলানা নজরুল ইসলাম সফররত সকলের পরিচয় তুলে ধরলেন। রাবেতার মজলিসে শূরার সদস্য ও রাহমানিয়ার নায়িবে মুহতামিম মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব সংক্ষেপে সফরের উদ্দেশ্য তুলে ধরলেনÑ জামি‘আ রাহমানিয়ার আসাতিযায়ে কেরাম তাদের ফাযেলদের সমন্বয়ে ‘রাবেতায়ে আবনায়ে রাহমানিয়া’ নামে একটি ফুযালা পরিষদ গঠন করেছেন। আসাতিযায়ে কেরামের সার্বিক তত্ত¡াবধানে আত্মসংশোধন, ব্যক্তিগঠন, দীনী সমাজ বিনির্মাণ ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি অক্ষুণœ রাখার লক্ষ্যে এর প্রতিষ্ঠা। রাহমানিয়ার দরস বন্ধ থাকাকালীন আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খিদমতরত ফুযালায়ে কেরামের খোঁজ-খবর নিয়ে তাদের হিম্মত বাড়ানোর চেষ্টা করে থাকি। পাশাপাশি কওমী মাদরাসাগুলোর হালাত সম্পর্কে অবগতি লাভ, বুযুর্গ উলামায়ে কেরামের নেক সোহবত, পারস্পরিক মতবিনিময় ও দু‘আ কামনাও আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের আজকের এ সফরও সে ধারাবাহিকতার একটি প্রয়াস।

উপস্থিত সকলেই হুযূরের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। কথা শেষে একজন প্রবীণ উস্তাদ মন্তব্য করলেন, চমৎকার উদ্যোগ; দেশের প্রতিটি জামি‘আর জন্য অনুসরণীয়।

হুযূরের বয়ান শেষে মাওলানা শফীক সালমান কাশিয়ানী অগ্রসর হলেন। রাহমানিয়ার নবীন উস্তাদ। রাবেতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তিনি উপস্থিতিদের হাতে দ্বি-মাসিক রাবেতার মে-জুন সংখ্যাটি তুলে দিলেন। আবেগময় ভাষায় সবাইকে রাবেতায় লিখতে উদ্বুদ্ধ করলেন। আসলে সবার হাতে হাতে রাবেতা পৌঁছে দেয়া এবং রাবেতায় লেখালেখির আহŸান জানানোও সফরের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। রাবেতা কর্মীগণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এসব কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। সবাই যখন পরম আগ্রহ নিয়ে রাবেতা দেখছে, আমরা তখন সদ্য পেড়ে আনা কচিডাবে হাবুডুবু খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ।

সোলতানিয়ার সুলতানের দরবারে

জামি‘আ হুসাইনিয়া মহীপাল মাদরাসা শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের একটি প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় দায়িত্বে আছেন আল্লামা যমীরুদ্দীন রহ. এর খলীফা মাওলানা ফযলুল হক সাহেব। তিনি হজ্জের সফরে থাকায় নায়িবে মুহতামিম সাহেব আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। এখানে তলাবাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত নসীহত হয়। অতঃপর আমরা লালপোল সোলতানিয়ার পথে বেরিয়ে পড়ি। দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিট। সোলতানিয়ার সুলতান হাকীমুল উলামা খ্যাত মুফতী সাঈদ আহমাদ দা.বা. তখন গভীর মুতালা‘আয় নিমগ্ন। হালকা পায়ে আমরা হযরতের দরবারে উপস্থিত হলাম। তার প্রভাবব্যঞ্জক স্বভাব-গাম্ভীর্যের কথা আগেই শুনেছি । ইলমী গভীরতাও সর্বজন সমাদৃত। ফেনীর প্রথম সারির প্রতাপশালী একজন বুযুর্গ আলেম। আমাদেরকে দেখে খাস কামরা থেকে সাক্ষাত-কামরায় চলে আসলেন। সকলকে মুসাফাহার বরকতে ধন্য করলেন। হযরতকে বার্ধক্য পেয়ে বসেছে। চলাফেরা, নামায ইত্যাদি সবই হুইল চেয়ারের সাহায্যে সম্পন্ন হয়। চেয়ারে বসেই কুশল-বিনিময় করলেন। প্রথমেই রাহমানিয়ার মুহতামিম হযরত মুমিনপুরী হুযূরের সিহ্হতের কথা জানতে চাইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন মুফতী মনসূরুল হক দা.বা. এর স্বাস্থ্যের অবস্থা। আমীরে সফর, রাহমানিয়ার শাইখে সানী মাওলানা আব্দুর রায্যাক মানিকগঞ্জী দা.বা. মুরুব্বীদ্বয়ের হালাত জানালেন এবং আগ্রহ থাকা সত্তে¡ও স্বাস্থ্যগত অপারগতায় তার আসতে পারেননি সে কথাও তুলে ধরলেন। কথাটি শুনে তিনি আফসোস করে বললেন, তাঁরা তাশরীফ আনলে খুবই ভালো হতো। আপনারা আমার সালাম পৌঁছে দিবেন। তারপর নিজের লিখিত কিতাবের সবগুলো কপি মুহতামিম সাহেবের জন্যে হাদিয়াও পাঠিয়ে দিলেন।

আমরা হযরতের যবান থেকেই জানতে পারলাম লালপোল মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। তার শাইখ ছিলেন কুতবুল আলম শাহ সোলতান আহমাদ নানুপুরী রহ.। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘ইফতা’ না পড়া সত্তে¡ও শাইখ তাকে ঐতিহ্যবাহী নানুপুর জামি‘আ ওবাইদিয়ার প্রধান মুফতীর দায়িত্ব প্রদান করেন এবং হযরতের হায়াত পর্যন্ত সেখানে থাকার আদেশ করেন। নানুপুর থাকা অবস্থায় তিনি লালপোলে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তিনি এসে উদ্বোধনও করে যান। সেই লালপোল মাদরাসা আজ একটি জামি‘আয় পরিণত হয়েছে। দীনের প্রায় সব লাইনের খিদমত যথার্থভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলছিলেন, হযরতের দু‘আর বরকতে আমি এতো বেশি পরিমাণ দীনী সফর করতে পেরেছি যে, বাংলার পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ কোন প্রান্তই আমার অদেখা নেই। এখন আমি বার্ধক্যের কাছে পরাজিত। শুধু দরস আর তাসনীফাতের কাজই করতে পারছি। তারপর পাশের কিতাবের তাকে ইশারা করে নিজের লেখা কিতাবগুলোর পরিচয় তুলে ধরেন। এ পর্যায়ে হযরতকে রাবেতায়ও কিছু লিখতে দরখাস্ত পেশ করা হয়। তিনি বললেন, রাবেতা তো রাবেতাই। এর মাধ্যমে সবার সঙ্গে রবত হবে; দৃঢ় বন্ধন তৈরি হবে, আমি আর কী লিখব? তারপর অনুরোধ করায় তিনি আমাদেরকে কিছু নসীহত করেন। দস্তরখানে তখন দুপুরের খাবার প্রস্তুত।

যোহরের নামায শেষ হল। ছাত্র উস্তাদগণের উদ্দেশ্যে হযরত মানিকগঞ্জী হুযূর গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করলেন। হুযূরের বয়ানে হাকীমুল উলামা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সকর তালিবে ইলমকে বললেন, হুযূরের প্রতিটি কথা ও নসীহত স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। তোমরা যদি এগুলো মেনে চলতে পারো, ইনশাআল্লাহ সফলতা তোমাদের পদচুম্বন করবেই।

ইলমী সওদার খোঁজে উলামাবাজারে

প্রচÐ উত্তাপ ছড়িয়ে দুপুরের সূর্য তখন পরিশ্রান্ত। আকাশের শান্ত ছায়া যমীনে নেমে এসেছে। প্রকৃতির নীরবতা ছাপিয়ে প্রায় পনের মাইল দূরে আমরা একটি নির্জন গ্রামে পৌঁছলাম। কদমতলা মাদীনাতুল উলূম মাদরাসা সোনাগাজীর ভোয়াগ গ্রামে অবস্থিত। দেড় একর জমিতে সবুজের সমারোহে সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান। মাদরাসার বারান্দায় পা রাখতেই একজন উস্তাদ দ্রæত এগিয়ে এলেন। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। চুপিসারে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই! মুফতী মনসূরুল হক সাহেব আসেননি? আমি না-সূচক উত্তর দিলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, তিনি আশাহত হলেন। বললেন, হুযূরের লেখার আমি একান্ত ভক্ত। হুযূরের কিতাব যতই পড়ি মুগ্ধ হই। অন্তরে হুযূরের মহব্বত জায়গা করে নিয়েছে। হুযূরকে দেখা আমার স্বপ্ন ছিল; আশা করেছিলাম, আজ তা পূরণ হবে। আফসোস! আজো আমি বঞ্চিত হলাম। জানি না, সে স্বপ্ন আমার কবে পূরণ হবে। ভাই! আপনি শুনলে অবাক হবেন, মুফতী সাহেব হুযূরের নামে আমার একমাত্র ভাগ্নের নাম ‘মনসূরুল হক’ রেখেছি। তার কথাগুলো আমার হৃদয় স্পর্শ করল। আমি বিস্মিত হলাম। এই দূরপ্রান্তের অচেনা ভক্তের না দেখা ভালোবাসা যদি এতোটা গভীর এবং স্বচ্ছ হয় তাহলে সর্বক্ষণ কাছে থাকা মানুষগুলো হুযূরের মহব্বতে না জানি কতোটা আপ্লুত হয়!

উস্তাদ আর ছাত্রদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাত ও নসীহতের মধ্য দিয়ে আমাদের এখানকার কার্যক্রম শেষ হল। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল আসরের নামায উলামাবাজার পৌঁছে আদায় করবো। আলহামদুলিল্লাহ, যথাসময়ে আমরা উলূমে নববীর সে ঈর্ষণীয় কাননে পৌঁছে যাই।

মাদরাসা ক্যাম্পাসের বাহির থেকেই আযানের সুমধুর ধ্বনি কানে বাজল। ছাত্ররা ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে মসজিদে আসছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সাদা লেবাসের শুভ্রতায় মসজিদমুখী গলিপথগুলো তখন ঝলমল করছে। যেন খÐ খÐ তুষার শুভ্রতা ছড়াচ্ছে। আমরা যখন মাদরাসা চত্বর পেরিয়ে সেই আলোকিত মিছিলে শরীক হলাম তখন নায়েবে নবীদের নিষ্পাপ চেহারাগুলো খুশির আভায় চকচক করছে আর ক্ষণেক্ষণে চারদিক থেকে পবিত্র কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছেÑ আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। সে সালামে শ্রদ্ধা আর আনন্দের তৃপ্তি ঝরে পড়ছে। স্বাগত আর অভ্যর্থনার ভালোবাসা ফুটে উঠছে। মনে হল, এ বাজারের সওদা খুবই কিমতী ও উমদা। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে এসব সওদা পরম আগ্রহে গৃহীত ও সমাদৃত হবে।

আসরের নামায শেষ হল। বাদ আসর উলামাবাজারের আসাতিযায়ে কেরাম, দুই হাজার ছাত্র ও মহল্লার কিছু মুসল্লিয়ানে কেরামের উপস্থিতিতে শাইখে সানী সংক্ষিপ্ত অথচ খুবই মূল্যবান আলোচনা পেশ করেন।

মসজিদের পাশেই মাকবারায়ে হালীমিয়া। পীরে কামেল মাওলানা আব্দুল হালীম রহ. সহ আরো কয়েকজন মহান বুযুর্গ এখানে শায়িত। সদ্য শায়িত হয়েছেন ফেনী জেলার এক ক্ষণজন্মা মনীষী মুহাদ্দিস হুযূর নামে প্রসিদ্ধ মাওলানা আহমাদ কারীম রহ.। এইতো গত ২৬ আগস্ট ২০১৬ইং থেকে আমরা তাকে ‘রহমাতুল্লাহি আলাইহি’ বলতে শুরু করেছি। তিনি একনাগাড়ে ৫৬ বছর সহীহ বুখারীর দরস দান করেছেন। জীবনের ৬০টি বসন্ত এখানেই তিনি জীবিতাবস্থায় কাটিয়েছেন। তাকে হারিয়ে গোটা ফেনীর উলামা সমাজে শোকাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষণজন্মা মনীষীর অন্তর্ধানে প্রতিটি তালিবে ইলম, নায়েবে নবী হারিয়েছেন একজন প্রকৃত সাধক, দক্ষ উস্তাদ ও দরদী অভিভাবক। মাত্র ৮৭ বছরের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি ইলমী জগতে রেখে গেছেন এক অবিস্মরণীয় অবদান। তিনি তার কারনামায় বেঁচে থাকবেন কাল হতে কালান্তরে লক্ষ মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে। আমরা মাকবারায়ে হালীমিয়াতে রূহের মাগফিরাত কামনায় কিছুক্ষণ অবস্থান করি। প্রভুর দরবারে মরহুম মুরব্বীগণের জান্নাতে উচ্চাসন কামনা করে মাদরাসা অফিসে চলে আসি।

উলামাবাজারের একটি প্রাচীন বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম আল-হুসাইনিয়া। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এর প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠাকালীন মুহতামিম মাওলানা ফযলুল হক বাকী রহ.। বর্তমান মুহতামিম হারদুঈ রহ. এর অন্যতম খলীফা হযরত সাইয়েদ আহমাদ দা.বা.। বয়োজ্যেষ্ঠ এই বুযুর্গ আলেম খাটিয়ায় শুয়ে তাসবীহ পড়ছিলেন। দেখে মনে হল সর্বদাই এ যবান রবের স্মরণে সতেজ ও তাজা থাকে। আমরা মুসাফাহার বরকত লাভ করে হযরতের হাতে ‘রাবেতা’ তুলে দিয়ে দু‘আর দরখাস্ত করলাম। তিনি আমরা চলে আসা পর্যন্ত খুব মনোযোগ দিয়ে রাবেতা খুলে খুলে দেখছিলেন। মনে হল এসব মহান ব্যক্তিগণের ক্ষণিকের এই শুভদৃষ্টির বরকতে রাবেতা টিকে থাকবে অনন্তকাল।

উল্লেখ্য, এই মহান বুযুর্গ এখন আর বেঁচে নেই। গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৬ইং রোজ রবিবার প্রিয়তম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকালীন সফর সমাপ্ত করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জান্নাতে হযরতের মাকাম বুলন্দ করে দিন। আমীন।

সময়ের স্বল্পতায় খানকা ও বিশাল ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা এবং তথ্য সংগ্রহ কিছুই সম্ভব হয়নি। বারবার অস্থিরতা প্রকাশ করছি। সফরসাথী মাওলানা ইমদাদুল্লাহ (মুদাররিস, বাইতুল আমান মিনার মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স) আরবীয় গড়নের এক খুবসূরত যুবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যিনি অত্র প্রতিষ্ঠানের মেহনতী উস্তাদ এবং বর্তমান মুহতামিম সাহেবের দৌহিত্র। দেখতেও যেমন ইলমেও তেমন। নাম মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। তাকে বলা মাত্রই আল-উলামা স্মারকসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পুস্তিকা আমাদের হাদিয়া করলেন। তার কাছেই জানতে পারি অত্র প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসচিব ‘আদীব সাহেব’ নামে খ্যাত মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেবের কথা। মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব আমাদেরকে নিয়ে গেলেন মেহমানখানায়। সেখানে তখন প্রস্তুত ছিল বৈকালিন নাস্তার শাহী দস্তরখান। ভিন্ন ভিন্ন পাত্রের বিশাল সমারোহে লোভনীয় আয়োজন। আনার, আঙ্গুর, পেস্তা, যাইতুন, আম, আপেল, দই, কফি কিছুই বাদ পড়েনি। বাহ্যত মনে হবে কোন আয়েশী পরিবেশন। মূলত এ ছিল উলামায়ে কেরামের সম্মানে উলামাবাজার মাদরাসার শ্রদ্ধা নিবেদন। আরবীয় আপ্যায়নের নমুনা প্রদর্শন। সে আন্তরিকতায় আমরা খুবই মুগ্ধ হই।

হালীমিয়া থেকে চৌমুহনী ইসলামিয়া

পরবর্তী মঞ্জিল সোনাগাজীর তা’লীমুদ্দীন হালীমিয়া মাদরাসা। বিশাল মাঠকেন্দ্রিক তিনদিক-ঘেরা দোতলা ভবনের চমৎকার একটি প্রতিষ্ঠান। ৩০জন উস্তাদ আর ৭৫০জন ছাত্রের দায়িত্ব নিয়ে মাওলানা আতাউল্লাহ দা.বা. বেশ সুনামের সাথেই মাদরাসাটি পরিচালনা করছেন। আমাদেরকে যথেষ্ট কদর ও সম্মান করলেন। রাবেতা সদস্যগণ এখানেও সারাদিনের ক্লান্তি মাথায় নিয়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করেছেন। নায়েবে মুহতামিম সাহেবের সংক্ষিপ্ত বয়ান শেষে আমরা ছুটে চলি বালুয়া চৌমুহনী ইসলামিয়া মাদরাসার পানে। মুহতামিম সাহেবের ভাষ্য অনুযায়ী ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে এর প্রতিষ্ঠা। তারপর সময়ের ব্যবধানে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ মিশকাত পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানের রূপ ধারণ করেছে। মুহতামিম মাওলানা আবূ তাহের সাহেব বেশ মিশুক প্রকৃতির। সামান্য সময়ে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। এখানে তিনি ১৮ বছর যাবত খিদমত করছেন। আমাদেরকে তিনি নিয়ে গেলেন একটি জলাশয়ের কাছে। বললেন, জায়গাটি মাদরাসার বেশ প্রয়োজন। দু‘আ করবেন, আল্লাহ যেন ব্যবস্থা করে দেন। বলার আন্তরিকতায় মনে হল আল্লাহ এ তামান্না অবশ্যই কবুল করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকলের নেক প্রয়োজনগুলো পূরণ করে দিন। বিশেষত আমাদের এ জাতীয় খোদায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর। আমীন।

পাহালিয়ার তীরে জীবন্ত রশীদিয়া

আমরা এখন ফেনী শহরের পাঁচ কিলো পূর্বে কালিদাস পাহালিয়া নদীর তীরে। আমাদের সামনে জামি‘আ রশীদিয়ার অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল ক্যাম্পাস। মাঠের পাশে আধুনিক স্থাপত্যে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন ছাত্রাবাস আর সৌন্দর্য্যরে প্রতীক আর-রশীদ জামে মসজিদ। চারপাশে বিচিত্র ফুলের সাজানো বাগান আর অজানা ফলের অসংখ্য বৃক্ষ। প্রত্যেক ভবন থেকে বেরিয়ে গেছে পিচঢালা ছোট ছোট পথ। একপাশে স্বচ্ছ জলাধার। অন্যদিকে বয়ে চলা পাহালিয়া নামের শান্ত নদী। প্রকৃতির অসাধারণ লীলা-বৈচিত্র্যের বর্ণিল সমাহার এখানে। বসন্তের প্রথম ফুলের চেয়েও বেশি সজীব ও প্রাণবন্ত। রাতের রশীদিয়া বড়ই চমৎকার।

ছাত্রাবাসের বেলকনি থেকে চোখে পড়ে আলো আঁধারির এক অপূর্ব পরিবেশ। আকাশের সন্ধ্যা যখন যমীনে নেমে আসে রশীদিয়া তখন হয়ে ওঠে হাজার হাজার মুখরিত পাখির অভয়াশ্রম। সন্ধ্যা যত গাঢ় হয় কিচিরমিচির তত স্তিমিত হতে থাকে। একসময় প্রতিটি পাখি শাখায় শাখায় পাতার ছাউনিতে ঘুমিয়ে পড়ে একেবারেই হাতের নাগালে। ইচ্ছা করলেই ধরা যাবে। কিন্তু বড় আজব ব্যাপার! জামি‘আ রশীদিয়ার চার হাজার ছাত্র প্রত্যেকেই নিজের চেয়ে সেসব পাখিদের বেশি ভালোবাসে। আপন করে হৃদয়ের মমতা মিশিয়ে ওরা কৃত্রিম বাসাও বানিয়ে রাখে। পাখিরাও সে ভালোবাসায় তৃপ্ত, মুগ্ধ হয়। হঠাৎ উড়ে আসা কোন ছোট্ট চড়–ইয়ের নিরাপত্তায় লাইট-ফ্যান বন্ধ রাখার দুর্লভ দৃশ্য কেবল রশীদিয়াতেই চোখে পড়বে। রশীদিয়ার অনেক কিছুই এমন অবিশ্বাস্য।

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ। মুহতামিম মুফতী শহীদুল্লাহ সাহেব দীনের খিদমতের জন্য নিজ দেশে ফিরে এসেছেন। নিজ বাসগৃহের ছোট্ট ছাপড়া মসজিদের বারান্দায় চার পাঁচজন ছাত্র নিয়ে রশীদিয়ার ভিত গড়েছেন। পরবর্তী বছর আরেকটু জায়গা নিয়ে। আজ সে রশীদিয়া পরিণত হয়েছে এক মহীরূহে। দশ একর জমিতে প্রায় চার সহ¯্র তালিবে ইলম আর ১১০জন উস্তাদ নিয়ে সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তা’লীম-তরবিয়াত, আমল-আখলাক আর শিষ্টতার পূর্ণতা যে কেউ দেখামাত্রই বুঝতে পারবে। উস্তাদগণের মেহনত-মুজাহাদা, বিনয়-ন¤্রতার বর্ণনাও শেষ করা যাবে না। নায়েবে মুহতামিম মুফতী ফয়যুল্লাহ সাহেব বেশ সুদর্শন, প্রাজ্ঞ একজন তরুণ আলেম। চেহারায় ইলম ও ন¤্রতার ছায়া স্পষ্ট। আমাদের সঙ্গে থেকে তিনি সারাটা সময় রশীদিয়ার সবকিছু দেখিয়েছেন। মুহতামিম হযরতসহ সিনিয়র উস্তাদগণ নিজহাতে আপ্যায়ন করেছেন। 

বড় ভাই শফীকুর রহমান ভাই নাযিমে দারুল ইকামা মামুন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দৃষ্টিতে রশীদিয়ার এতোটা তারাক্কীর বাহ্যিক কারণ কী মনে হয়? তিনি বললেন, মুহতামিম সাহেবের আকাবির ও আসলাফের যথার্থ অনুকরণ, বিনয়-ন¤্রতা আর স্বচ্ছ মু‘আমালাত-মু‘আশারাত এবং সমস্ত আসাতিযায়ে কেরামের একান্ত আন্তরিকতা ও সর্বাত্মক মুজাহাদায় লিপ্ত থাকাই এ জামি‘আর উন্নতির রহস্য। এ প্রসঙ্গে তিনি কিছু ঘটনাও তুলে ধরলেন যেখানে মুহতামিম সাহেবের তাকওয়া, খোদাভীতি ও স্বচ্ছ লেনদেনের পবিত্র চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানেও মানিকগঞ্জী হুযূর প্রাণ খুলে বয়ান করেছেন। এখানেও সমস্ত উস্তাদগণের হাতে রাবেতা তুলে দেয়া হয়েছে। পরম যতেœ তারা আমাদের রাবেতা গ্রহণ করেছেন। কেউ নিজেদের পত্রিকাও এতোটা আপন করে লুফে নেয় না। আমার মনে হল তাদের ছাত্ররা জীবনের মহা উপকারী হিসেবেই রাবেতাকে সংগ্রহ করবে এবং নিয়মিত উপকৃত হবে।

আমাদের পরবর্তী মঞ্জিল দারুল উলূম ফেনী। দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন মাওলানা ইবরাহীম রহ.। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে এর যাত্রা শুরু। বর্তমানে মাওলানা নূরুল্লাহ সাহেব মাদরাসাটি পরিচালনা করছেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে চার শতাধিক ছাত্রের জন্যে বেশ সাজানো-গোছানো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এখানে রাহমানিয়ার নায়েবে মুহতামিম সাহেবের বয়ান শেষে আমরা ফুলগাজী আশরাফিয়া মাদরাসা অভিমুখে যাত্রা করি। ফেনীর শেষ সীমান্তে ১৩৬২ হিজরীতে প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষাকেন্দ্র। এখানকার মুহতামিম প্রবীণ বুযুর্গ আল্লামা হাবীবুর রহমান সাহেব ফেনী জেলার আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ড তানযীমের সেক্রেটারী হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তিনি হজ্জের সফরে থাকায় তার সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। হযরতের সুযোগ্য পুত্র জামি‘আর শিক্ষা পরিচালক মুফতী যুবায়ের আহমাদ সাহেব আমাদের স্বাগত জানান। পূর্ব পরিচিতের ন্যায় সীমাহীন আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। রাহমানিয়ার শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ রাবেতার মুহতারাম কর্মকর্তা শ্রদ্ধেয় আনওয়ারুল হক সাহেব রাবেতার পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলকে লেখার জন্য আহŸান করেন এবং রাবেতার সৌজন্য কপি সকলকে হাদিয়া করেন।

ছাগলনাইয়ার পথে

গন্তব্য ছাগলনাইয়া। দিনের দ্বিতীয় প্রহর। রোদে ঝলমল করছে পথঘাট। যে পথ ধরে চলছি, একসময় এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হত। সচেতন যাত্রীরা ফেনী শহরের যানজট এড়াতে এখনো এ পথ বেছে নেন। পথের ধারে সারি সারি গাছ। দুপাশ থেকে ডালপালা নুয়ে এসে পথের ওপর সৃষ্টি হয়েছে ‘গাছতোরণ’; এমনই ঘন, রোদ গলবার জো নেই।

আমাদের গাড়ি ছাগলনাইয়ার মওলানা রূহুল আমীন সাহেবের জামি‘আ ইসলামিয়া আযীযিয়া কাসেমুল উলূম মাদরাসায় প্রবেশ করলো। কুতবে যামান হযরত শাহ মুফতী আযীযুল হক সাহেব ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে এর গোড়াপত্তন করেন। নানুপুরের হযরত সুলতান আহমাদ নানুপুরী রহ. এই মাদরাসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শহরের কেন্দ্রে বর্তমানে সহ¯্রাধিক তালিবে ইলমের এক উন্নয়নশীল প্রতিষ্ঠান। মাদরাসার কয়েকজন উস্তাদ বেশ বয়স্ক। যাদের চেহারায় গাম্ভীর্যের পাশাপাশি ইলমী প্রজ্ঞাও খুব জ্বলজ্বল করছে।

মাদরাসার শিক্ষা পরিচালক মাওলানা জাবের সাহেব জানালেন, ইন্ডিয়ার সীমান্ত একেবারে সন্নিকটে; মাত্র এক কিলোমিটার পথ। কিন্তু তাতে কী হবে! আমাদের গন্তব্যের পথ যে আরো অনেক দূরে; আকাশের প্রান্ত যেখানে যমীন ছুঁয়েছে। আমরা ছুটে চললাম ফেনীর চিলুনিয়া এলাকার জামি‘আ মাদানিয়ার পানে।

ছবির মত সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন অসাধারণ সুন্দর জামি‘আ মাদানিয়া। তা’লীম-তরবিয়াত, আখলাক ও যোগ্যতা বিবেচনায় ফেনী জেলার একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের একটি প্রতিষ্ঠান। মুহতামিম মুফতী সাইফুদ্দীন সাহেব নিজেই যোহরের ইকামত দিলেন। পূর্ণ সুন্নাহ মোতাবেক দাওয়াতুল হকের তরযে। তিনি কর্মতৎপর উদ্যমী একজন আলেম। সঙ্গে পেয়েছেন নায়েবে মুহতামিম পদে আরেক ইলমী ব্যক্তিত্ব মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেবকে। নামায শেষে উস্তাদ-ছাত্র সকলের উপস্থিতিতে সময়োপযোগী বেশ প্রয়োজনীয় আলোচনা করলেন মানিকগঞ্জী হুযূর। দেখলাম, মুফতী সাহেব হুযূরের লিখিত ‘কিতাবুস সুন্নাহ’ এখানে তা’লীমের জন্য নির্ধারিত। আমাদের মুমিনপুরী হুযূরের শূন্যতা এখানেও বেশ অনুভূত হল। কিন্তু কি করা যাবে! রব্বে পাকের কাছে আমাদের এ সফর হুযূরবিহীন মঞ্জুরী ছিল।

পরম আখলাক আর উন্নত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন মুহতামিম সাহেব। নিজ বাসার তৈরি খাবার স্বহস্তে পরিবেশন করেছেন। আমাদের নওজোয়ান কয়েকজনকেও যথার্থ ইজ্জত ও সম্মান করেছেন; যা ভোলার নয়।

জামি‘আ মাদানিয়া অধ্যায়ের ইতি টেনে উপস্থিত হলাম শর্শদি ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদরাসা চত্বরে। ফেনীর প্রাচীনতম একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি। হযরত থানবী রহ. এর অন্যতম খলীফা হযরত শাহ নূর বখশ রহ. ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। নূর বখশ রহ. এর উত্তরসূরী ও মাওলানা নজীর আহমাদ রহ. এর সাহেবযাদা মাওলানা হাফেয রশীদ আহমাদ দা.বা. মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম। জীবনের প্রায় শেষ সময় তিনি পার করছেন। অসুস্থতা সত্তে¡ও এই অশীতিপর বৃদ্ধ বুযুর্গ আমাদের আপ্যায়নের ত্রæটি করেননি। সশরীরে চলে এসেছেন মেহমানগণের অভ্যর্থনায়।

ফেনীর অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের ন্যায় এখানকার মুহতামিম সাহেবকেও মনে হল তিনি সর্বদাই মাদরাসায় অবস্থান করেন এ থেকে বিষয়টি সহজেই অনুমেয় যে, মাদরাসার জন্য তারা কতটা নিবেদিত প্রাণ।

মসজিদে বয়ান শেষে আমরা অফিস কক্ষে বসলাম। দেখলাম জামি‘আর সকল উস্তাদ উপস্থিত হয়েছেন। এখানে প্রায় সকলেই প্রবীণ উস্তাদ। প্রতিটা চেহারা থেকেই ইলমী নূর ও আভিজাত্য ঝরে পড়ছে। আমাদের মাওলানা নজরুল ইসলাম অন্যান্যদের তুলনায় এ প্রতিষ্ঠানের একেবারেই নবীন উস্তাদ। তবে বেশ সুনামের সাথে তাদরীসের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন। সফরের শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে থাকা তরুণ আলেম মাওলানা সাইফুল ইসলাম সাহেব এ প্রতিষ্ঠানের একজন যোগ্য উস্তাদ।

মাদরাসা চত্বরে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১১০০ হিজরীর দিকে নির্মিত প্রায় চারশত বছরের পুরনো একটি জামে মসজিদ। আমরা ভয়ে ভয়ে প্রাচীনতম এ মসজিদটিতে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করতেই ভয় জনিত শিহরণে কেঁপে উঠলাম। না জানি পবিত্র পেশানীর স্পর্শধন্য কোন জায়গা এ হতভাগার পদপিষ্ট হয়। ভয়ে ভয়ে ধীর পায়ে মেহরাবের ফলকটির কাছে পৌঁছলাম। সেখানে লেখা-

بسم الله الرحمن الرحيم

محمد على سودری مجاہد اعظم

১১০০ ھ

লেখাটি আমাকে অভিভূত করেছে। ফলকে লেখা মুজাহিদে আযম মুহাম্মাদ আলী চৌধুরী রহ. এর পরিচয় জানতে খুব ইচ্ছে হল। যা জানলাম তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে- ‘ঢাকার নায়েব নাযিম ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ আলী চৌধুরীকে ফেনী এলাকার ফৌজদার নিযুক্ত করেন। অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই সিংহশার্দুল গর্জে ওঠায় এবং বিদ্রোহ করায় ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে অবৈধ ইংরেজ সরকার তাকে পদচ্যুত করে।’ বাকি ইতিহাস জানতে পারিনি। তবুও কেন জানি এ বীর-সেনানীর প্রতি ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠলাম। ইচ্ছে করল হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা উজাড় করে দিই। সালাম তোমায় হে বীর মুজাহিদ! শত সহ¯্র সালাম।

শেষ বেলা

প্রিয় পাঠক! এ পর্যায়ে আমরা সফরের শেষ প্রান্তে। ফেনী জামি‘আর অফিস কক্ষে সফরের সর্বশেষ বৈঠক চলছে। রাবেতা মুরুব্বীগণ হৃদয় উৎসারিত দরদী গলায় জামি‘আর উস্তাদগণকে পরামর্শ দিচ্ছেন। সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরছেন। রাবেতা সদস্যগণ তাদের সর্বশেষ তোহফা প্রত্যেকের হাতে হাতে তুলে দিচ্ছেন। কেউ কেউ রাবেতায় নিয়মিত লিখতে জোরালো আবেদন করছেন। ফেনী জামি‘আর মুহতামিম মাওলানা মুমিনুল হক জাদীদ সাহেব আমাদর রাতের আপ্যায়ন নিয়ে ব্যস্ত।

মাওলানা মুমিনুল হক জাদীদ ফেনী জামি‘আর কাÐারীর ভূমিকায় আছেন। অত্যধিক কর্মঠ ও বিনয়ী একজন আলেম। সফরের শুরু থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন। রাবেতার আদর্শকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। তিনি সফর সফল করতে যথার্থ অবদান রেখেছেন। সে ঋণ শোধ হবার নয়। মাওলানা আব্দুল কাহের আলমাদানী দা.বা. ফেনী উলামাবাজার মাদরাসার একজন প্রবীণ মুহাদ্দিস। সদা হাস্যোজ্জ্বল অমায়িক সঙ্গী হয়ে সফরের আগাগোড়া আমাদের পাশে থেকেছেন। বয়স প্রৌঢ়ত্বের কাছাকাছি হলেও যৌবনের উচ্ছ¡লতা হারাননি। তার নিখাঁদ আন্তরিকতায় অনেকবার আমরা মুগ্ধ হয়েছি। হযরতের লোভনীয় পান-সুপারী থেকে আমাদের নাযেমে তা’লীমাত সাহেবও বেশ উপকৃত হয়েছেন।

আমরা ফেনীর উলামায়ে কেরামকে অত্যন্ত বিনয়ী ও সাদেগীর গুণে গুণান্বিত পেয়েছি। তাদের ইলমী গভীরতা ও আপ্যায়ন-আন্তরিকতাও যে কাউকে মুগ্ধ করবে আমাদের সফরের সূচনা লগ্নে, মধ্য মুহূর্তে, শেষ বেলায় সর্বত্র তারা এগিয়ে এসেছেন। রাবেতার পক্ষ থেকে তাদের সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করি।

ফিরে আসার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। একে একে সকলে গাড়িতে উঠে বসেছেন। এখানেই থেকে যাবে মাওলানা নজরুল ইসলাম। শুরু শেষ সব প্রান্তে সে ছায়ার মত লেগে ছিল। যতকিছু দরকার সবকিছুই করেছে নাওয়া-খাওয়া সবকিছু ভুলে। নায়েবে মুহতামিম সাহেব হুযূর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কোন্ দিকে যাবে? নজরুল ইসলাম নীরব দাঁড়িয়ে। হয়তো চেষ্টা করছিল নিজেকে সংযত রাখার। কিন্তু সাধ্যের বাঁধ ভেঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। দীর্ঘদিন পর উস্তাদগণকে আজ কিছু সময়ের জন্য সে কাছে পেয়েছে, যাদের ত্যাগে সে জীবনের সবকিছু পেয়েছে। যারা তাকে তিলেতিলে আজকের এই পূর্ণতায় এনে দিয়েছেন। এমন মহা মুহসিন পিতৃতুল্য আসাতিযায়ে কেরামের বিচ্ছেদে সে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। হুযূর তাকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন যতক্ষণ না শান্ত হল। অনেক অনেক দু‘আ দিলেন। বললেন, আমরা তোমার উপর সন্তুষ্ট। আল্লাহ পাকও তোমার উপর সন্তুষ্ট থাকবেন ইনশাআল্লাহ। মানিকগঞ্জী হুযূরসহ সকলেরই হৃদয় থেকে পরম তৃপ্তির দু‘আ বেরিয়ে এলো। অশ্রæসজল চোখে আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। তখনো সে জমাট শোকে ঠায় দাঁড়িয়ে।

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আতীকুল্লাহ

মাওলানা আইনুল হক ক্বাসেমি

মাওলানা মাসরূর বিন মনযূর

হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ.

শাইখুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী রহ.

আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহঃ

মাওলানা মীযান হারুন

আল্লামা আনওয়ার জুনদী রহঃ

মাওঃ আসজাদ কাসেমী

আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রহ.

ডঃ নজীব কাসেমী

আল্লামা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহঃ

মুহাদ্দিছুল আসর আল্লামা হাবীবুর রহমান আ'যমী রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আনওয়ার হুসাইন

মাওলানা মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

আল্লামা সাঈদ আহমাদ পালনপুরী রহঃ

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ

মুফতী শুআইবুল্লাহ খান দাঃ

আল্লামা আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহঃ

আল্লামা ডঃ মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ্‌ রহঃ