প্রবন্ধ

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনই একমাত্র বিশ্বজনীন ও চিরন্তন আদর্শ

লেখক:আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রহ.
২২ জানুয়ারী, ২০২২
১০২০৩ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

সী রা ত বি ষ য় ক গ বে ষ ণা প্র ব ন্ধ

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনই

একমাত্র বিশ্বজনীন ও চিরন্তন আদর্শ


আর পৃথিবীর ইতিহাসে এমন লক্ষাধিক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায় যারা পরবর্তীগণের জন্যে তাঁদের জীবনকে আদর্শ হিসেবে পেশ করেছেন। জীবন-যাত্রার বিভিন্ন ধারা-প্রকৃতির মাধ্যমে প্রত্যেকটি আদম সন্তানকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। কার্থেজের হেবল, ম্যাসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার, রোমের জুলিয়াস সিজার, ইরানের দারা, ফ্রান্সের নেপোলিয়ানÑ প্রত্যেকের জীবনেরই একটি আকর্ষণ রয়েছে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল ও গ্রীসের অন্যান্য জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের জীবনও একটি বিশেষ ধারায় ধাবমান। নমরুদ ও ফেরাউন এবং আবূ জাহল ও আবূ লাহাবের জীবন-যাত্রায়ও রয়েছে অপর একটি ভিন্ন ধারা। কারূনের জীবন আর একটি পৃথক দৃষ্টান্ত। মোটকথা, দুনিয়ার ক্যানভাসে সহস্র প্রকারের জীবনাদর্শ চিত্রিত হয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই আদম সন্তানের হৃদয়রাজ্যে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ও সকল জীবনের অনুসরণীয় আদর্শরূপে গৃহীত হওয়ার জন্য নিজেদেরকে উপস্থাপন করে রেখেছে। কিন্তু এসব বিভিন্ন মানুষের মধ্যে কার জীবনধারা মানব জাতির কল্যাণ, উন্নতি ও মুক্তিপথের নিশ্চয়তা দানকারী এবং বাস্তব জীবনে অনুসরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে গৃহীত হতে পারে?

তাঁদের মধ্যে অনেক জগদ্বিখ্যাত দিগি¦জয়ী সেনাপতি আছেন, যাঁরা তরবারির আঘাতে পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু মানবজাতির মুক্তি, কল্যাণ ও হিদায়াতের জন্যে তাঁরা কি কোন আদর্শ রেখে গেছেন? তাঁদের তরবারি কি যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে মানব সমাজের ভ্রান্ত মতাদর্শের প্রতিরোধ করতে পেরেছে? আমাদের আধ্যাত্মিক নৈরাশ্য ও হতাশার কোন প্রতিকার তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়েছে কি? তাঁরা আমাদের অন্তরের কলুষতা ও মরচে দূর করতে পেরেছেন কি? আমাদের কর্মপ্রণালী ও নৈতিকতার অবকাঠামো তৈরী করা কি তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়েছে? এর প্রতিউত্তরে পার্থিব জগতের এসব শাহানশাহ বাস্তব জগতে সম্পূর্ণই অকেজো প্রমাণিত হয়েছেন। বিশ্বময় কর্তৃত্ব চালিয়েছেন, বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, সাময়িকভাবে মানুষের দেহের রাজ্যে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত করেছেন সত্য কিন্তু রূহের জগতে আইন ও শৃঙ্খলা তাঁদের দ্বারা কায়েম হয়নি; বরং আধ্যাত্মিক ধ্বংসের সকল উপাদান তাঁদেরই দরবার থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ তাঁরা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য কোন কার্যকর নকশা, পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ উপস্থাপন করতে পারেননি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সর্বোচ্চ শ্রেণীর এসব মহান ব্যক্তিবর্গ যাদের জীবনাদর্শ দ্বারা মানব জাতির উপকার ও সংশোধনের আশা করা যেতে পারতো তাঁদের প্রত্যেকের জীবনাবস্থা পরিপূর্ণ ও যথার্থতার সামগ্রিক বিচারে কতোটা অপর্যাপ্ত, অপূর্ণাঙ্গ এবং ব্যর্থ। তাই নিরপেক্ষ দৃষ্টির অনুসন্ধানে দেখা যাবে পৃথিবীর যেখানেই সুকৃতির আলোকরশ্মি ও সততার কিরণ দ্বীপ্তিমানরূপে প্রতিবিম্বিত হয়েছে, যেখানেই পরিশুদ্ধতা ও ঈমানিয়াতের দৃপ্তশিখা প্রজ্জ্বলিত, সেখানেই তা কেবলমাত্র সেইসব মহামনীষীর জীবনদ্যুতির আলোকরশ্মি ও হিদায়াতের ফলশ্রæতি যাঁদের সঙ্গে আমরা নবী ও রাসূল নামের পরিচয়ে পরিচিত। কুরআনের শিক্ষানুযায়ী “এমন কোন জাতি নেই যার মধ্যে কোন সতর্ককারীর আবির্ভাব ঘটেনি এবং প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছেন এক একজন পথ প্রদর্শক।” প্রত্যেক দেশ ও প্রত্যেক জাতির মধ্যে আজ কেবলমাত্র তাঁদেরই কথা ও কর্মের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এবং দিকে দিকে তাঁদের বাণীর প্রতিধ্বনিই শোনা যাচ্ছে। নবীগণ পূর্বে আলোচিত সর্বোচ্চ শ্রেণী রাজা-বাদশাহের ন্যায় দেহের উপর নয় বরং হৃদয়ের উপর কর্তৃত্ব চালান। তাঁদের শাসনব্যবস্থা দুনিয়ার রাজ্যে নয় বরং মানবের হৃদয়ের রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত। যদিও সেনাপতির শানিত তরবারি তাঁদের হাতে নেই তবুও তাঁরা গুনাহর স্তুপ ও অসৎকর্মের সারি মুহূর্তের মধ্যে উল্টিয়ে দেন। তাঁরা কল্পনা রাজ্যে বিচরণকারী কবি দার্শনিক না হলেও আজও মানুষের কান তাঁদের সুমিষ্ট ভাষণের স্বাদ গ্রহণ করছে। তাঁরা যদিও বাহ্যত আইন পরিষদের সিনেটর ছিলেন না তবুও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর পরও তাঁদেরই আইন আজও পূর্ববৎ জীবিত আছে এবং তা শাসক ও আদালত উভয়ের উপর কর্তৃত্ব চালাচ্ছে। তাঁদেরই আইন আজও বাদশাহ-ফকীর, রাজা-প্রজা নির্বিশেষে সবার উপর সমানভাবে প্রযোজ্য রয়েছে। এ পবিত্র দলটি আল্লাহর সৃষ্ট লোকালয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যুগে যুগে তাঁদের শিক্ষা হিদায়াতের প্রদীপ উজ্জ্বল করে তুলে ধরেছেন। আজ মানুষের জীবনে কল্যাণ, সৌভাগ্য, নৈতিকতা, সৎকর্ম ও উন্নত জীবনের যা কিছু প্রভাব ও চিহ্ন বর্তমান তার সবকিছু এ মনীষীগণেরই বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে তাঁদের পদচিহ্ন রেখে গেছেন। দুনিয়ার সচেতন ও বিবেকবান বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী ব্যক্তিবর্গরাই তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে সর্বাত্মক চেষ্টা ও বিসর্জনের মাধ্যমে সাফল্যের অনুসন্ধান করছে।

মোটকথা, আমাদের হিদায়াত ও পথনির্দেশের জন্যে আমরা নিষ্কলুষ মানুষ, নিষ্পাপ সত্তা ও সকল দিক দিয়ে পরিপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী ও মনীষীবৃন্দের মুখাপেক্ষী। আর তাঁরা হলেন আল্লাহর নবী। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ যুগে নিজেদের জাতির সামনে সমকালীন অবস্থা অনুসারে উন্নত নৈতিক বৃত্তির ও পূর্ণাঙ্গ মানবিক গুণাবলীর কোন না কোন কুরবানী পেশ করেছেন। কেউ তাওহীদের আবেগ, কেউ হকের প্রেরণা, কেউ আনুগত্য, কেউ নিষ্কলুষ মনোবৃত্তি, কেউ আল্লাহ-ভীতি প্রভৃতির উন্নত আদর্শ উপস্থাপন করে দুনিয়ার মানুষের জটিল জীবনপথে এক একটি সুউচ্চ মিনার কায়েম করেছেন। যেন তা দেখে মানুষ সোজা ও সরল পথের সন্ধান লাভ করতে পারে। কিন্তু তবু এমন একজন পথপ্রদর্শক ও নেতার প্রয়োজন ছিল যিনি নিজের হিদায়াত ও বাস্তব কার্যাবলীর দ্বারা সমগ্র পথের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আলোকিত করতে পারেন। অর্থাৎ তিনি যেন আমাদের হাতে হিদায়াতের একটি পূর্ণাঙ্গ ‘গাইড বুক’ প্রদান করেন। আর এ গাইড বুকটি নিয়ে প্রত্যেকটি মুসাফির যেন অনায়াসে গন্তব্যস্থানের সন্ধান লাভ করতে পারে। এহেন নেতৃত্বের ও পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এ বিশ্বে আল্লাহর শিক্ষা ও হিদায়াতের সাক্ষ্য দানকারী, সৎকর্মশীলদের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের সুসংবাদ দানকারী। আর যারা এখনও সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ তাদেরকে সতর্ক ও সাবধানকারী, ভীতি প্রদর্শক, পথভ্রষ্ট লোকদেরকে আল্লাহর দিকে আহŸানকারী এবং তিনি নিজে মূর্তিমান আলোক ও প্রদীপ। এমনি তো সকল নবী-রাসূলই আল্লাহর বাণীর সাক্ষ্যদানকারী, তৎপ্রতি আহŸানকারী, সুসংবাদ দানকারী, ভীতি প্রদর্শনকারী প্রভৃতি হিসেবে এ দুনিয়ায় এসেছেন। কিন্তু এসব গুণ তাদের সকলের জীবনে কার্যত সমানভাবে বিকাশ লাভ করেনি। অনেক নবী ছিলেন যারা বিশেষভাবে সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব পালন করেছেন। যেমন, হযরত ইয়াকুব, হযরত ইসহাক, হযরত ইসমাঈল আলাইহিমুস সালাম প্রমূখ। অনেক নবীর বিশেষ গুণ ছিল ভীতি প্রদর্শন। যেমন, হযরত নূহ, হযরত মূসা, হযরত হূদ, হযরত শু‘আইব আলাইহিমুস সালাম প্রমূখ নবী। আবার অনেক নবীর বৈশিষ্ট্য ছিল সত্যের আওয়াজ দান। যেমন, হযরত ইউসুফ, হযরত ইউনুস প্রমূখ নবী। কিন্তু যিনি একই সঙ্গে সাক্ষ্য দানকারী, সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী, হকের আহŸায়ক ও উজ্জ্বল প্রদীপ ছিলেন এবং যার জীবনপটে এসব গুণ স্পষ্টভাবে খোদিত ছিল তিনি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কারণ তাঁকে দুনিয়ার সর্বশেষ পয়গম্বর হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে একটি পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত প্রদান করা হয়েছিল। তাই একে পূর্ণতা দানের জন্য আর কোন নবী আসার প্রয়োজনই রইল না। তার প্রদত্ত শিক্ষা চিরন্তন স্থায়িত্বের অধিকারী। অর্থাৎ তাঁর জীবনাদর্শই বিশ্ব মানবের জন্য একমাত্র বিশ্বজনীন ও চিরন্তন আদর্শ রূপে কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। তাই তাঁর সত্তাকে যাবতীয় দিক থেকে পূর্ণতা প্রদান করে অমূল্য অক্ষয় সম্পদে ভূষিত করা হয়েছিল। আর যে চরিত্র বা জীবনাদর্শ মানুষের জন্য একটি আদর্শ জীবনের কাজ করে তাকে গ্রহণ করার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। জীবনাদর্শের ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা, জীবনাচারের পূর্ণাঙ্গ ব্যাপকতা এবং ব্যক্তির গুণ ও বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা ও বাস্তবতা।

জীবনাদর্শের ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা

ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা বা ভিত্তির অর্থ হচ্ছে একজন আদর্শ মানবের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে যা কিছু পেশ করা হবে তা ইতিহাস ও বর্ণনা পরম্পরার দিক থেকে নির্ভরযোগ্য হতে হবে। কেননা ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত মানব প্রকৃতির উপর যে প্রভাব বিস্তার করে ভিত্তিহীন কাল্পনিক গল্প-কাহিনীর দ্বারা তা কখনো সম্ভব নয়। তাই প্রভাব বিস্তারকারী বাস্তবে কার্যকর ও অনুসরণযোগ্য হবার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হচ্ছে ঐ পূর্ণাঙ্গ ও আদর্শ মানুষটির জীবন চরিত ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমরা সকল নবীকেই শ্রদ্ধা ও সম্মান করি এবং তাদের নবুওয়াতের সত্যতায়ও বিশ্বাসী। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা “এ নবীগণের মধ্যে অনেককে আমি অনেকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি” স্বীকার করি। বস্তুত আদর্শের স্থায়িত্ব, নবুওয়াতের সমাপ্তি এবং সর্বশেষে পূর্ণাঙ্গ ও আদর্শ মানবচরিত্র হওয়ার কারণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছেন, তা অন্য কোন নবী লাভ করেননি। কারণ অন্য নবীগণকে স্থায়ী, শেষ ও খতমে নবুওয়াতের মর্যাদা দান করা হয়নি। তাঁদের জীবনচরিতের উদ্দেশ্য ছিল কোন একটি বিশেষ জাতির নিকট একটি বিশেষ যুগ পর্যন্ত আদর্শ পেশ করা। তাই সে যুগের পর তাঁদের সে আদর্শ ধীরে ধীরে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভেবে দেখুন! প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক জাতির মধ্যে প্রত্যেক যুগে কত মানুষ আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এসেছেন। আজ তাঁদের ক’জনের নাম আমরা জানি? হিন্দু স¤প্রদায় দাবী করে যে, তারা দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন জাতি। যদিও প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। তবুও লক্ষ্য করলে তাদের ধর্মে শত শত মনীষীর নাম পাবেন। কিন্তু এসব মনীষীর একজনের জীবনও ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত নয়। ইরানের প্রাচীন পারশী ধর্মের প্রবর্তক যরথুস্ত্র আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বও প্রাচীন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে আছে। প্রাচ্যবিদগণের মধ্যে যারা তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব স্বীকার করেন তারা বহু ধারণা ও অনুমানের উপর নির্ভর করে তার জীবন বৃত্তান্তের কিছু কিছু বিষয় নির্ধারণ করেন। কিন্তু তাও বিভিন্ন পন্ডিতের পরস্পর বিরোধী মতের সংঘর্ষে এতই সন্দেহপূর্ণ যে, কোন ব্যক্তি তার উপর নির্ভর করে নিজের কর্মজীবনের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে না।

প্রাচীন এশিয়ার সবচাইতে ব্যাপক প্রচারিত ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। যা এক সময় ভারতবর্ষ, চীন, সমগ্র মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং আজও বার্মা, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, চীন, জাপান ও তিব্বতে এ ধর্ম বর্তমান আছে এবং সমগ্র দূর প্রাচ্যে তার রাষ্ট্র সভ্যতা ও ধর্ম অস্ত্রবলে প্রতিষ্ঠিত আছে এবং এখনো অজেয় রয়ে গেছে। কিন্তু এসব কিছু সত্তে¡ও কি তারা বুদ্ধের জীবন ও চরিত্রকে ইতিহাসের আলোকে স্থায়িত্ব দান করেছে? এবং কোন ঐতিহাসিক কি ঐ জীবন চরিতের সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দানের ক্ষমতা অর্জন করেছেন? জৈন ধর্মের প্রবর্তকের জীবন বৃত্তান্ত আরো অধিক অনিশ্চিত। অনুরূপ চীনের কনফুসিয়াস সম্পর্কে আমরা বুদ্ধের চেয়েও অনেক কম তথ্য জানি। অথচ তার অনুসারীদের সংখ্যা কোটি কোটি। সেমেটিক জাতির মধ্যে শত শত পয়গম্বর এসেছেন। কিন্তু কেবল নাম ছাড়া ইতিহাসে তাদের আর কোন চিহ্নই নেই। হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীম, হযরত হূদ, হযরত সালিহ, হযরত ইসমাঈল, হযরত ইসহাক, হযরত ইয়াকূব এবং হযরত ইয়াহইয়ার (আলাইহিমুস সালাম) জীবন ও চরিত্রের এক একটি বিশেষ অংশ ছাড়া আর কিছুই কি কেউ আমাদের জানাতে পারবে? তাঁদের জীবনের অনেক অংশ ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় তাদের পবিত্র জীবনের অপলুপ্ত ও অসংলগ্ন অংশ কি কোন পূর্ণাঙ্গ মানব জীবনের জন্য অনুসরণযোগ্য হতে পারে? কুরআনে মাজীদ বাদ দিলে ইহুদীদের যেসব কিতাবে তাদের জীবনের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ আছে তার মধ্যে প্রত্যেকের সম্পর্কে ধর্মীয় পণ্ডিতগণ বিভিন্ন ধরণের সন্দেহ পোষণ করেছেন। এ সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বাদ দিলেও যা অবশিষ্ট থাকে তা তাঁদের জীবন সম্পর্কে এক অসম্পূর্ণ চিত্রই আমাদের নিকট পেশ করে।

হযরত মূসা আ. এর অবস্থা আমরা তাওরাত থেকে জানতে পারি। কিন্তু যে তাওরাত আজ আমাদের কাছে সে সম্পর্কে অনুসন্ধানকারীদের অভিমত এই যে, হযরত মূসা আ. এর শত শত বছর পর তা রচিত হয়েছে। এ জন্যই তাওরাতের জীবন কথা ও ঘটনাবলীতে আমরা প্রতি পদে পদে বিপরীতমুখী বর্ণনার সম্মুখীন হই। এ অবস্থায় হযরত মূসা আ. এবং হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে হযরত মূসা আ. পর্যন্ত সকল নবীর জীবন বৃত্তান্তের ঐতিহাসিক ভিত্তি কতটুকু মজবুত থাকে?

হযরত ঈসা আ. এর জীবনের ঘটনাবলী ইঞ্জিলে লেখা আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে লিখিত অসংখ্য ইঞ্জিলের মধ্যে বর্তমান খ্রিস্টান জগতের বিরাট অংশ মাত্র চারটি ইঞ্জিলকে স্বীকার করে। অবশিষ্ট ইঞ্জিলগুলো(?) নির্ভরযোগ্য নয় বলে সাব্যস্ত হয়েছে। ঐ চারটি ইঞ্জিলের মধ্যে কোন একটির লেখকও স্বচক্ষে হযরত ঈসা আ. কে দেখেননি। তারা কার মুখ থেকে শুনে এ ঘটনাবলী লিখেছেন এ কথাও জানা যায়নি। বরং যে চার ব্যক্তির সাথে ঐ চারটি কিতাবকে সম্পর্কিত করা হয় তাদের সঙ্গে এ কিতাবগুলোর সম্পর্ক সঠিক কি না এ বিষয়েও বর্তমানে সন্দেহ পোষণ করা হচ্ছে। ঐ কিতাবগুলো কোন ভাষায় ও কোন যুগে লেখা হয়েছিল তা-ও স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়নি। ঈসায়ী ৬৭ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইঞ্জিল ব্যাখ্যাতা উল্লেখিত কিতাবগুলোর রচনাকাল উল্লেখ করেছেন। তো এ থেকে বুঝা যায় যে, খ্রিস্টানদের বর্ণনা থেকে হযরত ঈসা আ. এর জীবনের যেসব বিবরণ পাওয়া যায় তার ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। কোন মানব চরিত্র একমাত্র তখনই কর্মজীবনের জন্য চিরস্থায়ী আদর্শরূপে পরিগণিত হতে পারে যখন তার জীবনী গ্রন্থের প্রত্যেকটি পাতা আমাদের চোখের সামনে থাকে এবং তার জীবনের কোন একটি ঘটনা ও রহস্যও অজানার অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। বরং তার সমগ্র জীবন বৃত্তান্ত ও অবস্থা মানুষের সম্মুখে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট থাকে। এরূপ হলেই উক্ত জীবন মানব সমাজের জন্য একটি আদর্শরূপে গৃহীত হওয়ার যোগ্য কি না তা যাচাই করা যেতে পারে। এই মানদন্ডের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধর্ম প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতার জীবন ও চরিত্র যাচাই করলে দেখা যাবে যে, একমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর কেউ এ মানদন্ডে টিকে না এবং টিকবেও না।

জীবনাচারের পূর্ণাঙ্গ ব্যাপকতা

তাছাড়া হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ নবীর মধ্যে শুধুমাত্র তিন বা চারজন নবীর জীবন চরিতকে ঐতিহাসিক বলা যেতে পারে। কিন্তু কোন জীবন চরিত বাস্তব আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হবার জন্য প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় শর্ত জীবনাচারের পূর্ণাঙ্গ ব্যাপকতা সেটার পূর্ণতার দিক দিয়েও তাঁরা যথেষ্ট নন! চিন্তা করুন, জনসংখ্যার বিচারে দুনিয়ার অধিবাসীদের এক চতুর্থাংশ বুদ্ধের অনুসারী। তা সত্তে¡ও ঐতিহাসিক মানদন্ডের বিচারে বুদ্ধের জীবন মাত্র কিছু কিস্সা-কাহিনীর সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু আমরা যদি সেগুলোকে ইতিহাসের মর্যাদা দান করে বুদ্ধের জীবনের অতি প্রয়োজনীয় ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশের অনুসন্ধান করি তাহলে সেখানেও আমাদের ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা সেসব কিসসা-কাহিনী থেকে কেবল এতটুকু জানা যায় যে, কোন এক যুগে নেপালের রাজপুত্র ছিল গৌতম বুদ্ধ। যিনি স্বভাবত চিন্তাশীল ছিলেন। যৌবনে এক সন্তানের পিতা হবার পর এক সময় কিছু মানুষের দুর্দশা দেখে অত্যাধিক প্রভাবিত হন। স্ত্রী-পুত্র ছেড়ে রাতের আঁধারে বাড়ী থেকে কাশী এবং পর্যায়ক্রমে পাটনা, বিহার ইত্যাদি এলাকার নগরে, বনে, পাহাড়ে, পর্বতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তারপর এভাবে কতদিন কাটালেন, কিভাবে গয়ার বৃক্ষতলে সত্যের সন্ধান লাভ করলেন, কতকাল নিজ ধর্ম প্রচার করে বেড়ালেন কত তারিখ ইহজগত থেকে চির বিদায় গ্রহণ করলেন তা কিছুই জানা যায়নি। যেমন জানা যায়নি যরথুস্ত্র ধর্মের প্রবর্তক যরথুস্ত্রের জীবন সমগ্র। তো এহেন অজ্ঞাত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন পূর্ণতার ধারণাও বা কেমন করে করা যেতে পারে এবং তার জীবনই বা কেমন করে মানুষকে পথের সন্ধান দিতে পারে? অপরদিকে পূর্ববর্তী নবীগণের মধ্যে হযরত মূসা আ. এর জীবনই সর্বাধিক পরিচিত। বর্তমান তাওরাত নির্ভরযোগ্য কি অনির্ভরযোগ্য সে প্রশ্ন বাদ দিয়ে পুরোপুরি নির্ভুল মেনে নেয়া সত্তে¡ও তাওরাতের পাঁচটি গ্রন্থ থেকে আমরা হযরত মূসা আ. এর জীবন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানতে পারি? “হযরত মূসা আ. জন্মগ্রহণ করার পর ফেরাউনের গৃহে লালিত-পালিত হন। বয়স্ক হয়ে ফেরাউনের যুলুমের বিরুদ্ধে বনী ইসরাঈলদের সাহায্য করেন। মিসর ছেড়ে মাদায়েন আসেন। পুনরায় মিসর ফিরে ফেরাউনের অগোচরে নিজের জাতিকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন। ফেরাউন তার সেনাদলসহ সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর তিনি কাফের জাতির সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং একশ বিশ বছর বয়সে কোন এক পাহাড়ে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন! তাঁর এ সুদীর্ঘ জীবনের ক’টি ঘটনাই বা আমরা জানতে পেরেছি? জীবনের প্রয়োজনীয় ক’টি অংশ আমাদের হাতে আছে? অবশ্য তাঁর জন্ম, যৌবনকালে হিজরত, বিবাহ ও নবুওয়াতের কিছু ঘটনাবলী আমরা জানি। তবে এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে এ বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। যা জানা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু মানব সমাজের বাস্তব আদর্শের জন্য যেসব বিষয়ের প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে চরিত্র, স্বভাব ও জীবন যাপন পদ্ধতি। আর এ অংশগুলোই হযরত মূসার জীবনে অনুপস্থিত।

তেমনি ভাবে ইসলামের সর্বাধিক নিকটতম যুগের পয়গম্বর হচ্ছেন খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তক ঈসা আলাইহিস সালাম। ইউরোপীয় হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে তাঁর অনুসারী বিশ্বে সংখ্যাগুরু। কিন্তু বড় আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এ ধর্মের পয়গম্বরের জীবন চরিত অন্যান্য পরিচিত ধর্মসমূহের প্রবর্তক ও পয়গম্বরের জীবন চরিতের তুলনায় সর্বসাধারণের নিকট সবচেয়ে কম প্রকাশিত। ইঞ্জিলের বর্ণনা মতে হযরত ঈসা আ. তেত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। বর্তমান ইঞ্জিলসমূহের বর্ণনা প্রথমত অনির্ভরযোগ্য। তারপরও সেখানে কেবলমাত্র তার জীবনের শেষ তিন বছরের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি জন্মগ্রহণ করলেন। জন্মের পর মিশরে আনা হল। শৈশবে দু’ একটি অলৌকিক কার্য সম্পাদন করলেন। তারপর আর তাঁর সাক্ষাৎ নেই। অকস্মাৎ ত্রিশ বছর বয়সে তাকে পাহাড় ও নদীর ধারে মৎস্যজীবীদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করতে দেখা গেল। ইহুদীদের সঙ্গে কিছু বিতর্ক অনুষ্ঠিত হল। ইহুদীরা তাকে গ্রেফতার করে রাজ দরবারে নিয়ে গেল। সেখানে রোমীয় গভর্ণরের আদালতে মৃত্যুদন্ড দেয়া হল। মৃত্যুর তৃতীয় দিন কবরে আর লাশ পাওয়া গেল না। কিন্তু ত্রিশ বছর এবং কমপক্ষে পঁচিশ বছর তিনি কোথায় এবং কিভাবে জীবন যাপন করলেন এর খবর বিশ্ববাসী জানে না এবং কোনদিন জানবেও না। এই শেষ তিন বছরের ঘটনাবলীর মধ্যেও বা কী আছে? কতিপয় অলৌকিক কার্য, বয়ান-বক্তৃতা ও সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড। তো পূর্ণ জীবন ধারার পূর্ণতার মানদন্ডেও কেবলমাত্র নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের বাস্তব চিত্রই পরিপূর্ণ চিরন্তন ও বিশ্বজনীন। তাছাড়া ব্যাপকতার মানদন্ডেও শ্রেষ্ঠ হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

চরিত্রের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা ও বাস্তবতা

কোন জীবন চরিতের পক্ষে বাস্তব আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হবার জন্য তৃতীয় প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে তার চরিত্রের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা ও বাস্তবতা। পরিপূর্ণতা ও বাস্তবতার অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন মানব শ্রেণীর পথ নির্দেশ ও আলোক লাভের জন্য যেসব আদর্শের প্রয়োজন অথবা প্রত্যেক ব্যক্তির বিভিন্ন প্রকার সম্পর্ক রক্ষা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য আদায় করার জন্য যেসব দৃষ্টান্ত ও নমুনার প্রয়োজন তার সম্পূর্ণই সেই আদর্শ জীবনের ভান্ডারে মওজুদ থাকতে হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও দেখা যাবে যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর কেউই সেই পূর্ণতায় পূর্ণ হতে পারেননি। আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায় করার নাম ধর্ম। ধর্ম দু’ প্রকার। এক প্রকার ধর্মে আল্লাহকে স্বীকার করা হয়নি, যেমন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম। তাই তাদের প্রবর্তকগণের মধ্যে আল্লাহ প্রেম, আন্তরিকতা, তাওহীদ প্রভৃতির অনুসন্ধানই অর্থহীন। দ্বিতীয় প্রকার ধর্ম আল্লাহকে কোন না কোন পর্যায়ে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত এ ধর্মগুলোর প্রবর্তক ও পয়গম্বরগণের জীবনেও আল্লাহর আনুগত্য সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ঘটনাবলী অনুপস্থিত। আল্লাহ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসের স্বরূপ কি হওয়া উচিৎ এবং তাঁদের বিশ্বাসের পরিমাণ কি ছিল? উপরন্তু ঐ বিশ্বাসের উপর তাঁরা কতটুকু দৃঢ় ছিলেন? তাঁদের জীবনীতে এ সম্পর্কিত আলোচনা বর্ণিত হয়নি যা সর্বকালে মানব সমাজের জন্য সার্বজনীন ও চিরন্তন আদর্শ হবে। আল্লাহর তাওহীদ ও তার বিশেষ কিছু নির্দেশাবলী এবং কুরবানীর শর্তসমূহ ছাড়া তাওরাতের পাঁচটি গ্রন্থে এমন একটি বাক্যও নেই যা থেকে জানা যেতে পারে যে, আল্লাহর সঙ্গে হযরত মূসা আ. এর আন্তরিক সম্পর্ক আনুগত্য ও বন্দেগী আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা ও বিশ্বাস, পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী ও আল্লাহর শক্তি বিকাশ তাঁর হৃদয়ে কোন পর্যায়ে ছিল। অথচ মূসার ধর্ম যদি চিরস্থায়ী ও সর্বশেষ ধর্ম হিসেবে এসে থাকে তাহলে ওসব জরুরী বিষয়গুলো লিখে তাঁর অনুসারীদেরই কর্তব্য ছিল কিন্তু আল্লাহর উদ্দেশ্য এরূপ ছিল না। তাই তারা এ কাজ করতে পারেননি।

হযরত ঈসা আ. এর জীবন বৃত্তান্ত হচ্ছে ‘ইঞ্জিল শরীফ’। “আল্লাহ তা‘আলা হযরত ঈসার পিতা” এই একটিমাত্র বিষয় ছাড়া এমন আর কিছু পাই না, যার সাহায্যে এ পবিত্র পিতা ও পুত্রের মধ্যস্থিত সম্পর্কের ধরণ স্থির করা যায়। পুত্রের (ঈসার) স্বীকারোক্তি থেকে বুঝা যায় যে, পিতা (আল্লাহ) পুত্রকে অনেক ভালবাসতেন। কিন্তু পুত্র পিতাকে কি পরিমাণ ভালবাসতেন, আনুগত্য ও নির্দেশ পালনে কতটুকু তৎপর ছিলেন, দিবা-রাত্রের কখন ইবাদতে মগ্ন হতেন? এর কিছুই পাওয়া যায় না এবং পাওয়া সম্ভবও নয়। এমতাবস্থায় এ ধরণের জীবন চরিত থেকে আমরা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে কী পরিমাণ লাভবান হতে পারি? বান্দার হকের বিবরণ সম্পর্কেও শেষ নবী ছাড়া আর সকল নবীর জীবনই প্রায় শূণ্য। হযরত মূসা আ. এর জীবনের একটি দিক অত্যন্ত সুস্পষ্ট, তা হচ্ছে, যুদ্ধ ও সৈন্য পরিচালনা। এছাড়া তাঁর আদর্শ অনুসারীদের জন্য পার্থিব অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে তাঁর চরিত্রে কোন পথ নির্দেশ নেই। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, বন্ধু-বান্ধবদের সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে তার নীতি কী ছিল, সন্ধি ও চুক্তির দায়িত্ব তিনি কিভাবে সম্পাদন করতেন, তিনি কী ধরণের কল্যাণকর কাজে ধন-সম্পদ ব্যয় করেছিলেন, পীড়িত, ইয়াতীম, মুসাফির ও দরিদ্রদের সাথে তার ব্যবহার কিরূপ ছিল? এসব তথ্যের অভাবে হযরত মূসা আ. এর অনুসারীরা তাঁর জীবন চরিত থেকে কী ফায়দা হাসিল করতে পারে? হযরত মূসার স্ত্রী ছিল, ভাই ছিল এবং অন্যান্য আত্মীয় পরিজনও ছিল। আমাদের আকীদা হচ্ছে, তাদের সবার ব্যাপারে তাঁর নবীসুলভ ব্যবহার সকল প্রকার ত্রæটিমুক্ত ছিল। কিন্তু তাঁর বর্তমান জীবনী গ্রন্থগুলোতে আমরা এসব বিষয়ে অনুসরণযোগ্য কোন তথ্য খুঁজে পাই না। হযরত ঈসা আ. এর মা ছিলেন এবং ইঞ্জিলের বর্ণনামতে ভাই-বোনও ছিল। কিন্তু তাঁর জীবনের ঘটনাবলী থেকে ঐসব আত্মীয় পরিজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ও ব্যবহারের ধরণ প্রকাশ পায় না। অথচ দুনিয়া চিরকাল ঐসব সম্পর্কের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ধর্মের বৃহত্তর অংশ ঐসব দায়িত্ব পালন করার উপরই নির্ভরশীল। এছাড়া হযরত ঈসা শাসিতের জীবন-যাপন করেছিলেন। তাই তাঁর জীবন চরিত শাসকসূলভ দায়িত্ব পালনের নযীরশূণ্য। তিনি বিয়ে করেননি। অথচ দুনিয়ার অধিকাংশ লোকই বিবাহিত এবং সংসার জীবন যাপন করে। তাই দুনিয়ার অধিকাংশ অধিবাসী হযরত ঈসার জীবন থেকে পারিবারিক জীবনের কোন পথ-নির্দেশ পেতে পারে না। যিনি কোনদিন গৃহ-সংসার, পুত্র-পরিজন, ধন-সম্পদ, যুদ্ধ-সন্ধি ও বন্ধু-শত্রæর মধ্যকার সম্পর্কের সাথে কোন সংস্রব রাখেননি, তিনি ঐসব বিষয়ে সমগ্র দুনিয়ার জন্য কিভাবে আদর্শ হতে পারেন? আজ যদি দুনিয়া তাঁর জীবনাদর্শ গ্রহণ করে তাহলে কালই সমগ্র দুনিয়ায় কবরের নির্জনতা নেমে আসবে, সমস্ত উন্নতি ও প্রগতির তৎপরতা নিমেষেই স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং খ্রিস্টীয় ইউরোপ সম্ভবত এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারবে না।

এ আলোচনা থেকে এটা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাস্তব কর্মজীবন সর্ব সমক্ষে প্রকাশিত না হলে কোন জীবনকে কখনো “আদর্শ জীবন” ও অনুসরণযোগ্য আখ্যা দেয়া যায় না। কেননা মানুষ উক্ত জীবনে কিসের অনুসরণ করবে? তার কোন কর্ম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? আমাদের তো যুদ্ধ-সন্ধি, দারিদ্র-ঐশ্বর্য, বিবাহিত-অবিবাহিত, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, বান্দার সাথে সম্পর্ক, শাসক-শাসিত, শান্তি-বিপর্যয়, কোলাহল-নির্জনতা তথা জীবনের প্রত্যেকটি দিক সম্পর্কে বাস্তব দৃষ্টান্তের প্রয়োজন। এমন দৃষ্টান্ত যা সমগ্র গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় বাস্তব সম্মত এবং পরিপূর্ণতার অধিকারী ও বাস্তবায়িত। কিন্তু এ কথা বললে মোটেই বাগ্মিতা বা কবিত্ব করা হবে না যে, এ মানদন্ডেও একমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কোন জীবন চরিতই টিকবে না। কেননা এ জীবনাদর্শে আপনি একই সঙ্গে খুঁজে পাবেন ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা, জীবনাচারের পূর্ণাঙ্গ ব্যাপকতা। ব্যক্তির গুণ ও বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা এবং সমাদৃত সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনের বাস্তবতা। যাতে অত্যন্ত নির্ভরশীল, স্বচ্ছ, বিশুদ্ধ ও নিখূঁত, নির্ভুলভাবে মানব সমাজের সকল গোষ্ঠি ও শ্রেণীর বিভিন্ন ধরণের জীবন যাত্রার প্রকাশ ঘটেছে এবং যেখানে সকল বিষয়ে সঠিক মনোভাব ও পূর্ণাঙ্গ নৈতিকতা ও সমর্পিত সর্বোত্তম জীবনাদর্শের প্রতিটি ধারার সর্বাধিক আস্থাশীল চিত্র ফুটে উঠেছে।

আপনি যদি শিশু হোন তাহলে হালীমা সা’দিয়ার আদরের দুলালকে দেখুন, ইয়াতীম হলে আব্দুল্লাহ ও আমেনার কলিজার টুকরা মুহাম্মাদকে দেখুন, যুবক হলে মক্কার উপত্যাকায় আরবী মেষপালকের জীবনী পাঠ করুন। গরীব হলে আবূ তালেবের গিরি সংকটের কয়েদী ও মদীনা প্রবাসীর অবস্থা শ্রবণ করুন। আর ধণী হলে মক্কার ব্যবসায়ী ও বাহরাইনের অর্থশালীর অনুগামী হয়ে যান। ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ী হলে বসরা সফরকারী দলের অধিনায়কের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করুন। আপনি যদি স্বামী হোন তাহলে খাদীজা রা. ও আয়েশা রা. এর মহান স্বামীর পবিত্র জীবন অধ্যায়ন করুন। সন্তানের পিতা হলে ফাতেমার পিতা এবং হাসান ও হুসাইনের নানার অবস্থা জিজ্ঞেস করুন। আপনি যদি শিক্ষক হোন তাহলে ‘সুফফার’ শিক্ষালয়ে মহান শিক্ষকের সফলতা অর্জন করুন আর ছাত্র হলে জিবরীলের সম্মুখে উপবেশনকারী আগ্রহী ছাত্রের একাগ্রতা দেখুন। আপনি যদি নিঃসঙ্গ অসহায় অবস্থায় সত্যের প্রতি আহŸানকারী হোন তাহলে মক্কার সহায় সম্বলহীন নবীর আদর্শ চিত্র উপলব্ধি করুন। আপনি যদি রাজ্য-জয়ী বিজয়ী বীর হোন তাহলে মক্কা বিজয়ী সিপাহসালারের মহানুভবতা দেখুন। আপনি যদি প্রজা হোন তাহলে কুরাইশ রাজ্যের অনুগত প্রজার শৃঙ্খলা লক্ষ্য করুন। আর যদি রাজা হোন তাহলে আরব সুলতানের ইতিবৃত্ত পাঠ করুন।

মোটকথা, আপনি যা-ই হোন না কেন এবং যে অবস্থাতেই থাকেন না কেন, আপনার জীবনের জন্যে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনই একমাত্র বিশ্বজনীন ও চিরন্তন আদর্শ। যাতে সদা-সর্বদা ইহকালীন সমগ্রজীবনের সমগ্র চিত্রের সর্বজনীনতা ও চিরন্তন পরিপূর্ণতা অন্ধকার গৃহের সমুজ্জল আলোকবর্তীকারূপে রাহনুমায়ী করে। তাই ঈমানী আলোকবর্তীকার অনুসন্ধানরত প্রতিটি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য একমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনই হিদায়াতের উৎস ও চির সফলতার একমাত্র মাধ্যম।


হযরত সায়্যিদ সুলাইমান নদবী রহ. এর অনবদ্য ভাষণ-সমগ্র খুতুবাতে মাদরাস -এর বাংলা অনুবাদ

অনুবাদেঃ মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুহাদ্দিস, জামি‘আ বাইতুল আমান মিনার মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।  খতীব, মুহাম্মদিয়া জামে মসজিদ, রামপুরা, ঢাকা

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

রাসূল করীম (সা.)-এর জন্মতারিখঃ বিচার-বিশ্লেষণ-সংশয়-সন্দেহের অপনোদন

...

মুফতী রেজাউল হক
৯ নভেম্বর, ২০২৪
২১৩৭ বার দেখা হয়েছে

প্রথম আলো

...

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৪৪২ বার দেখা হয়েছে

عصمتِ انبیاءؑ کے بارے میں اہلِ اسلام کا عقیدہ

یہ ظاہر ہے کہ کوئی کسی کا مقرب جبھی ہو سکتا ہے جبکہ اس کی موافق مرضی ہو۔ جو لوگ مخالف مزاج ہوتے ہیں ...

শাইখুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতুবী রহঃ
৯ নভেম্বর, ২০২৪
২৯৯৭ বার দেখা হয়েছে

রাসূলুল্লাহর সম্মানে অতিরঞ্জন বিদআত

...

মাওলানা মীযান হারুন
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২১১৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহঃ

শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রহঃ

শাইখুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতুবী রহঃ

মাওঃ উবাইদুল্লাহ সিন্ধী রহঃ

সায়্যিদ সাবেক রহঃ

আল্লামা আব্দুল মজীদ নাদীম রহঃ

মাওলানা আসলাম শাইখুপুরী

শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ

মাওঃ আবু আম্মার যাহেদ রাশেদী

মাওঃ নুরুল হাসান রাশেদ কান্ধলভী

মুফতী হাবীবুর রহমান খাইরাবাদী

আল্লামা আবুল কালাম আযাদ রহঃ

মাওলানা সাঈদ আহমদ

মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন দাঃ

হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহঃ

মাওলানা হাবীবুর রহমান খান

মাওলানা সাঈদ আহমাদ বিন গিয়াসুদ্দীন

মাওঃ আবু বকর সিরাজী

শায়েখ আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে উমার [রহ.]

মাওঃ এনামুল হাসান