প্রবন্ধ

সন্তানের শিক্ষা ভাবনাঃ অতি উৎসাহ যেন বিপরীত ফল বয়ে না আনে!

লেখক:আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ
২০ জানুয়ারী, ২০২২
২০২২ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

কেউ যখন বাবা বা মা হয়ে যায়, তখন যেন তার এক নতুন জন্মও সাধিত হয়। তখন সে মনে মনে এক নতুন ভুবনের বাসিন্দা হয়ে ওঠে এবং দেখতে শুরু করে সেই জীবনের যত রোমাঞ্চকর স্বপ্ন। সবটারই কেন্দ্রস্থলে থাকে তার প্রাণের ধন ওই নবজাতক। আয়-রোজগার করে, তো ওই কুসুমকলিই হয় তার একমাত্র লক্ষবস্তু। আর পরকিল্পনা করে, তো ওই চাঁদকণাই হয় তার দিগ্নিরূপক। ওই একরত্তি নরপুত্তল বিপুলবিক্রমে তার অন্তর্জগৎ শাসন করতে শুরু করে। সেই শাসনে অনেক পিতামাতাই টাল খেয়ে যায়। এক রকম ঘোরের মধ্যে তারা চলে যায়। কেমন অব্যবস্থচিত্ত ও অপরিণামদর্শী হয়ে ওঠে।

বলছি সেই স্বপ্নবিভোর মা-বাবার কথা। নিজ সন্তানকে নিয়ে যাদের উৎসাহ বড় বেশামাল। যত রকমের ভালো ভালো স্বপ্ন আছে, তার সবটাই তারা নিজ আদরের দুলাল-দুলালীর প্রতি স্থাপিত করে। গুণে, যোগ্যতায়, অর্থবিত্তে, প্রতিভায়-প্রতিষ্ঠায় সবকিছুতে তাদের জীবন ভরে উঠবে, তারা সকলের উপরে চলে যাবে, সকলের জন্য ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠবে- এরকম কল্পনাই তারা করে। তাই বিপুল উৎসাহে তারা সন্তানকে গড়ে তোলার সংগ্রামে নেমে পড়ে। তাদের দেরি সয় না। রঙীন ভবিষ্যত রচনার আশায় বর্তমানকে নিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। পরিণাম কী দাঁড়াবে তা চিন্তাই করতে পারে না। ফলে তাদের সেই অতি-উৎসাহের উচ্ছ্বাসে সন্তানের বর্তমান বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, আর যেই ভবিষ্যতের জন্য এত আকুলি-বিকুলি তা চির অধরাই থেকে যায়।

উচ্চাভিলাষকাতর পিতামাতার কামনা, তাদের সন্তান অতি অল্পসময়ে অনেক বড় হয়ে উঠুক। সন্তানের ক্ষমতা কতটুকু সেদিকে তাদের লক্ষ থাকে না। বয়স হয়েছে কি না সে চিন্তাও করে না। তাই বোল ফুটতে না ফুটতেই তারা শিশুকে বিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত করে। যে বয়সটা কেবলই বায়না-আবদার ও খেলাধুলার, সে বয়সের শিশুকেই আজ দেখি বইখাতার ভারে ন্যুব্জ।

হয়ত বা কিন্ডার গার্টেনের শিশুশিক্ষা দেখেই দ্বীনী মাদরাসায় পড়াতে ইচ্ছুক অভিভাবকদের অনেকেও আজকাল এই বল্গাহীন উৎসাহের শিকার হয়ে পড়েছে। শিশুর বয়স তিন-চার হতে না হতেই তারা মক্তব-মাদরাসায় ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে আসে। যতই বোঝানো হোক না কেন, তাদের এক কথা- ছেলেকে বা মেয়েকে আলেম-হাফেয বানাতে হবে এবং তার শুরুটা করতে হবে এখনই। যথারীতি পড়াশুনা করার বয়স ও বুঝ হয়েছে কি না তা ভাবতেই নারাজ। উচ্ছ¡সিত উদ্দীপনার তোড়ে সেই বোধ-ভাবনা ভেসে গেছে। অগত্যা মক্তব-মাদরাসার পরিচালক-মুহতামিম তাকে ভর্তি করে নেন এবং ওই শিশু তার শৈশবের ভোগ-উপভোগ বিসর্জন দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিদ্যাভ্যাস শুরু করে দেয়। এই শ্রেণীর অভিভাবকদের আগ্রহেই বোধ করি কোথাও কোথাও এরকম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে অবোধ শিশুরা রীতিমত ছাত্র হয়ে লেখাপড়া করছে।

আগ্রহের এই বাড়াবাড়ি শিশুর দৈহিক ও মানসিক গঠনের পক্ষে কত ক্ষতিকর তা বলাই বাহুল্য। সেই সংগে যে লক্ষে এত অল্প বয়সে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নিয়োজিত করা হচ্ছে তাও কি কাক্সিক্ষতরূপে অর্জিত হয়? বহুলাংশেই হয় না। অধিকন্তু অনেক শিশু গোড়াতেই বা মাঝপথেই ঝড়ে যায়।

ঝড়ে যাওয়ার কারণ যেমন শিশুর দৈহিক অপুষ্টি ও মানসিক অপ্রস্তুতি, যা কি না তার মাতৃকোল থেকে দূরে থাকার পরিণাম। তেমনি এর এক কারণ বয়সের অনুপযুক্ততাও। খেলার বয়সে পাঠচর্চার বাধ্যবাধকতা তার পক্ষে সুখকর হওয়ার কথা নয়। অস্বাদু বস্তু কতকাল চর্বণ করা যায়! তার মন টানে মায়ের কোল, ডাকে বাড়ির আঙিনা, খোঁজে খেলার সাথীরা। এই নিরানন্দ চর্চার অঙ্গন সে কতক্ষণ মেনে নেবে! তাই পড়ায় মন বসে না। অপেক্ষায় থাকে কখন ছুটি হবে আর পরমানন্দের শৈশব উপভোগে ছুটে যাবে। মা-বাবার আশা ছিল অল্প বয়সে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কিন্তু অনেক দূর তো দূরস্ত, খুব কাছের ধাপটিও এগোয় না। নিরুদ্যম চলা তো এগোনোর কথা নয়। কিন্তু তারা সে কথা বুঝতে চায় না। তাই চাপ বাড়ে। চাপ দেয় শিশুর উপর, তাড়া দেয় শিক্ষককেও। শিক্ষক ও অভিভাবকের যৌথ চাপে বেচারা নাজেহাল। তাই দমবন্ধ পরিবেশে সে আর থাকতেই চায় না। শুরু হয় পালানোর পালা। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় একটা সম্ভাবনা। কে এর জন্য দায়ী? দায়ী ওই অতি উৎসাহ ও আকাক্সক্ষার বাড়াবাড়ি।

সন্তান অনেক বড় কিছু হোক এ আশা যে কোনও পিতামাতারই থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এর জন্য তাড়াহুড়ার অবকাশ নেই। ধৈর্য ধরতে হবে। থাকতে হবে হজমশক্তি। অর্থাৎ আশা-আকাক্সক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সঠিক বয়সের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিশুর নিয়মিত শিক্ষা কত বছর বয়স থেকে শুরু করা যায়? আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, সাত বছর বয়স থেকে। তাঁরা এটা বলেন একটি হাদীসের ভিত্তিতে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ.

তোমরা তোমাদের সন্তানরদেরকে সাত বছর বয়সে নামাযের হুকুম দাও, আর দশ বছর বয়স হলে নামাযের জন্য (প্রয়োজনে) মার এবং তখন তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫

শিশুর উপর নামায ফরয নয়। তা ফরয হয় বালেগ হলে। তাহলে সাত বছর বয়সে কেন নামাযের হুকুম দিতে বলা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে এর উদ্দেশ্য নামাযের শিক্ষা দান করা। এই বয়সে বড়দের সাথে নামায পড়লে সে দেখে দেখে শিখতে পারবে নামায কীভাবে পড়তে হয়। পূর্ণাঙ্গ নামাযের জন্য শেখার আছে অনেক কিছুই। সাত বছর বয়সে শুরু করলে দশ বছর হতে হতে তা শেখা হয়ে যায়। এর ভেতর দিয়ে তার প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান, কুরআন পাঠ এবং দুআ কালাম ও কিছু মাসাইলও আয়ত্তে এসে যায়। মোটামুটি মেধা থাকলে ও মেহনত করলে কুরআন মাজীদের হিফজও হয়ে যায়। কাজেই যথারীতি শিক্ষাদানের জন্য সাত বছর বয়সই উপযুক্ত সময়। এরপর দেরি করা যেমন ঠিক নয়। তেমনি এর আগে তাড়াহুড়া করাও উচিত নয়। হাঁ, এর আগে যা হতে পারে তা হচ্ছে খেলাধুলার ভেতর দিয়ে অনিয়মিত শিক্ষা। সে দায়িত্ব মা-বাবার হাতে থাকাই শ্রেয়। দাদা-দাদী থাকলে তারাও মা-বাবাতুল্য। তারা খেলাচ্ছলে শিশুকে অক্ষরজ্ঞানের সাথে পরিচিত করতে পারেন এবং দিতে পারেন দ্বীনের একদম বুনিয়াদী শিক্ষা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা, ধর্ম, নবী, কিতাব প্রভৃতির নাম, ইসলামী আদব-কায়দা যথা সালাম দেওয়া, ডান হাতে খাওয়া, বিভিন্ন কাজকর্মের ছোট ছোট দুআ এবং শিশু বয়সের উপযোগী নৈতিক জরুরি শিক্ষা। মোটকথা সাত বছর বয়সের আগে কোনও রকম ভারী তালিম কিছুতেই নয়। সেজন্য সাত বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

উপরিউক্ত হাদীসে নামাযের জন্য মার ও বিছানা আলাদা করার জন্য দশ বছর বয়সের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা আমরা বুঝে নিতে পারি, দশ বছর বয়সের আগে শিশুর উপর কোনো দৈহিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি সমীচীন নয়। এর দাবি হচ্ছে, সাত বছর বয়সে তার যে নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা শুরু হবে, তা অনাবাসিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ কেবল পড়াশুনার সময়টুকুই প্রতিষ্ঠানে থাকবে। খাওয়া-দাওয়া, গোসল, ঘুম ইত্যাদি হবে মায়ের পরিচর্যায়। পড়াশুনার বাইরে সময়টা কাটাবে পরিবারের সদস্যদের সাথে। তার শারীরিক পুষ্টি ও মানসিক গঠনের জন্য এটা খুবই জরুরি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণভাবে আমাদের দেশের আবাসিক প্রতিষ্ঠানের থাকা-খাওয়া ও পরিবেশ-পরিমণ্ডলের যা অবস্থা, এককথায় তাকে স্বাস্থ্যকর বলা চলে না। দশ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে সেই পরিবেশে সমর্পণ করা যায় না। করা উচিত নয়। সেজন্য অন্ততপক্ষে তার দশ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করা চাই।

একথা ঠিক যে, আধুনিক শিক্ষার মত দ্বীনী শিক্ষার অনাবাসিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। তাই অপারগ হয়েই দূরের আবাসিক প্রতিষ্ঠানসমূহে শিশুদের সমর্পণ করতে হয়। কিন্তু আমরা মনে করি হিম্মতের সাথে চেষ্টা করলে ধারে কাছে অনাবাসিক ব্যবস্থা করে নেওয়া সম্ভব। আমরা এমন অনেক ত্যাগী পরিবারকে দেখেছি, যারা তাদের শিশুদেরকে অনাবাসিকভাবে দ্বীনী শিক্ষাদানের জন্য নিজ নিজ বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোনো দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। এছাড়াও বিভিন্ন উপায় রয়েছে, বিজ্ঞজনদের সাথে পরামর্শ করে তার যে কোনও একটা অবলম্বন করা যেতে পারে। আসল কথা হচ্ছে প্রয়োজন উপলব্ধি করা। যদি আমরা বুঝতে পারি, দৈহিক ও মানসিক অপুষ্টির স্থায়ী ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য শিশুকে অন্তত দশ বছর বয়স পর্যন্ত পারিবারিক পরিমণ্ডলে রাখা জরুরি, তবে আল্লাহ চাহেন তো ব্যবস্থা একটা না একটা হয়েই যাবে। এর জন্য পরিবারের দ্বীনী ও তালিমী পরিবেশের নির্মাণ-সংস্কার প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই করে নিতে হবে। সেই পরিবেশ না থাকাকে কিছুতেই অজুহাত বানানোর সুযোগ নেই।

অনেককে বলতে শোনা যায়, ঘরে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন নেই এবং দ্বীনী শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। এখানে থাকলে শিশু নষ্ট হয়ে যাবে। তারা চিন্তা করে না, সেই নষ্ট হওয়াটাই তো সে যখন ছুটিতে বাড়ি আসবে তখনও হবে। তা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হলে ঘরের পরিবেশকে সুষ্ঠুরূপে গড়ে তুলতেই হবে, যদিও শিশু আবাসিক প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। সেই দিকে নজর না দিয়ে শিশুকে আবাসিক প্রতিষ্ঠানে পড়তে দিলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং তাতে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়বে। একদিকে আবাসিক প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে তার কচি মন ও কাঁচা দেহ পারিবারিক স্নেহরস থেকে বঞ্চিত হল। শরীর ছাপিয়ে যার ক্ষতিকরতা মন-মানসিকতাকেও আক্রান্ত করবে। ফলে সুকুমারবৃত্তির স্থলে তার ভেতর রূঢ় নির্মম প্রবৃত্তি দানা বাঁধবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, পরিণত বয়সের বিভিন্ন অশুভতার জন্য শৈশবের পারিবারিক বঞ্চনাই দায়ী।

অন্যদিকে ছুটি-ছাটায় যখন বাড়ি আসবে আর সকলকে বিপরীত পরিবেশে পরিতুষ্ট দেখবে, তখন সে কেবল হোঁচটই খাবে না দমেও যাবে এবং ক্রমে তার ভেতর জন্ম নেবে হীনম্মন্যতাবোধ। একবার তা জন্ম নিয়ে ফেললে তাকে গড়ে তোলার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। বস্তুত হীনম্মন্যতাবোধের কুফল বহুমাত্রিক ও অতি দূরপ্রসারী।

আর কিছুই না হোক ঘরের পরিবেশ দ্বীনসম্মত না হলে ঘরের বাসিন্দারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঘরে আগুন জ্বলছে বলে শিশুকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিলাম আর নিজেরা সেই আগুনে নিশ্চিন্তে জ্বলতে থাকলাম এটা কেমন বুদ্ধির কথা!

যা হোক বলছিলাম, উৎসাহকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বয়স দশ না হওয়া পর্যন্ত শিশুকে কিছুতেই আবাসিক প্রতিষ্ঠানে দেওয়া সমীচীন নয়। তা দেওয়া যাবে কেবল দশ বছর পূর্ণ হওয়ার পরই। সেক্ষেত্রে অনেক কিছু করার আছে। সবগুলো নিয়ে আলোচনা করা এখানে উদ্দেশ্য নয়। উৎসাহের বাড়াবাড়িটাই এস্থলে আমাদের নির্দেশ্য।

কোনও কোনও অভিভাবক এবং কোনও কোনও শিক্ষকও শিশুর উপর বাড়তি ভার আরোপ করে থাকেন। তাদের লক্ষ অতি অল্প সময়ে অনেক বেশি শিখিয়ে ফেলা। শিশু কতটা ভার বইতে পারছে এবং কতটুকু তার সক্ষমতা সেদিকে তাদের নজর থাকে না। দৃষ্টি কেবলই নিজ অভিলাষ ও নিজের স্বপ্নের দিকে। অনেক শিশুর শিক্ষাজীবনের পাট এ কারণেও চুকে যায়। শিক্ষা তার কাছে এক সাক্ষাৎ নির্যাতন। কিছুকাল সে তা সয়ে যায়, কিন্তু কাহাঁতক। এক সময় সে এ জীবনের হাল ছেড়ে দেয়। তাকে হতাশায় পেয়ে বসে। ভাবে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না। তার কোনও ক্ষমতাই নেই।

ক্ষমতা না থাকবে কেন? হয়ত অন্য আরেকজনের মত নেই। যেটুকু আছে তার তো সদ্ব্যবহার করা যেত এবং রয়ে সয়ে কাজে লাগালে তার ধার বাড়তেও পারত। সেই সুযোগ তাকে দেওয়া হয়নি। তুলনামূলক যে বেশি মেধাবী তার সাথে তাকে সমানতালে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ভুলটা এখানেই। তার গতিবেগ বুঝে সেই অনুযায়ী চালাতে থাকলে তার মধ্যে সাহস সঞ্চার হত এবং নিজ সক্ষমতার উপর আস্থা তৈরি হত। অগ্রগামিতার জন্য আত্মবিশ্বাস অতি জরুরি। এর দ্বারা প্রখর মেধাবীকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। ‘আমি পারব’ এই বোধ অনেক মূল্যবান।

একবার জনৈক শিক্ষক তার এক ছাত্র সম্পর্কে অভিযোগ করছিল, তিন দিন হয়ে গেল সে এক পৃষ্ঠা মুখস্থ করতে পারছে না। আমি বললাম, এক পৃষ্ঠা সবক না দিয়ে যদি আধা পৃষ্ঠা দিতেন পারত কি না? তিনি বললেন, তা হয়ত পারত। বললাম, পাঁচ লাইন দিলে? বলল, তা অবশ্যই পারত। আমি বললাম, সেটাই উচিত ছিল। তাতে এই তিন দিনে তার এক পৃষ্ঠা মুখস্থ হয়ে যেত। এক পৃষ্ঠা দেওয়ার ফলে তার তিনটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। সেই সংগে জন্ম নিল ‘না পারার’ বোধ। এখন এই বোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। তা থেকে বাঁচাতে চাইলে সবক কমিয়ে দিন। রোজ যতটুকু পারে সেই মাত্রায়। অবশেষে সে ছাত্র একজন ভালো হাফেজ হয়েছে।

এটা একটা উদাহরণ। শিশুশিক্ষার যে কোনও বিভাগ ও যে কোনও স্তরেই এটা প্রযোজ্য। শিশুকে যে শিক্ষাতেই নিয়োজিত করা হোক না কেন, অভিভাবক ও শিক্ষককে তার সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতেই হবে। বাড়তি চাপ কেবল তার অগ্রগতিকেই ব্যাহত করবে। কোনও সুফল বয়ে আনবে না। বাড়তি চাপের উদ্দেশ্য তো থাকে বেশি শেখানো ও তাড়াতাড়িতে গন্তব্যে পৌঁছানো। কিন্তু ফল হয় উল্টো। ক্ষমতার বেশি চাপ দিলে শিশুর পাঠ কখনই লক্ষমাত্রায় পৌঁছায় না এবং সময়ও অনেক বেশি লেগে যায়। যেমনটা আমরা উদাহরণটিতে দেখলাম।

উৎসাহের বাড়াবাড়ি হয় বিষয় নির্বাচনেও। হিফজের ক্ষেত্রেই এটা বেশি লক্ষ করা যায়। কুরআন মাজীদের হিফজ যে অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর ফযীলতও বিশাল। তাই অনেকেই তাদের সন্তানকে হাফেজ বানানোর আশা করে। এ আশা প্রশংসনীয়। আমরা একে মুবারকবাদ জানাই। কিন্তু এ আশা বাড়াবাড়িতে পরিণত হয়, যখন দেখা যায় ছেলে বা মেয়ে এগোতো পারছে না, ওদিকে বয়সও হয়ে যাচ্ছে। তা সত্তে¡ও অভিভাবকের জিদ তাকে হাফেজ হতেই হবে। এ জিদ অসংগত। এর ফলে সেইসব ছেলেমেয়ের জীবনে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। সবচে বড় ক্ষতি তো এটাই যে, কোনওমতে তারা হাফেজ হয়ে গেলেও ইতোমধ্যে তাদের বয়স অনেকখানি গড়িয়ে যায়। এরপর আর তাদের অন্য কিছু শেখার সুযোগ থাকে না। হাফেজ হয়েছে অনেক ভালো কথা, কিন্তু ইসলামী জিন্দেগীর জরুরি তালিম গ্রহণ তো ফরয। এমন বহু হাফেজ ছেলেমেয়ে আছে যারা সেই ফরয পরিমাণ ইলম না শিখেই শিক্ষা জীবন সাংগ করে। অতপর আয়-রোজগার ও ঘর-সংসারের কাজে লেগে যায় এবং তাতে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে যে, সারাটা জীবন জাহালাতের অন্ধকারের মধ্যেই থেকে যায়।

সুতরাং জিদ না ধরে বাস্তবতাকে মেনে নেয়াই শ্রেয়। যখন দেখা যাচ্ছে ছেলেমেয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে হিফজও আশানুরূপ এগোচ্ছে না, তখন হিফজ মওকুফ করে জরুরি তালিমেই নিয়োজিত করা কর্তব্য। অর্থাৎ এক রোখা উৎসাহ দ্বারা তাড়িত না হয়ে ‘আলআহাম ফাল আহাম’ তথা গুরুত্বের পর্যায়ক্রমকে বিবেচনায় রাখা চাই।

সারকথা, সন্তানের শিক্ষাদানে তাড়াহুড়ার অবকাশ নেই। ধীরস্থিরভাবে অগ্রসর হতে হবে। যে কোনও নির্মাণকার্যেই ধীরস্থিরতা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষাদান ও ব্যক্তিগঠনের ব্যাপারটাও তার ব্যতিক্রম নয়; বরং এক্ষেত্রে তা আরও বেশি জরুরি। এটা মানব প্রকৃতিরও দাবি। মানুষের জন্ম ও বর্ধনপ্রক্রিয়ার ধীরতা থেকে আমরা সে শিক্ষাই পাই। বিভিন্ন হাদীসেও এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কাজেই অতি উৎসাহকে প্রশ্রয় না দিয়ে অভিজ্ঞজনদের পরামর্শমত ধীরস্থিরভাবে সামনে চলতে হবে। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত রচনা কেবল এ পথেই সম্ভব।

উল্লেখ্য, ধীরস্থিরতার মানে সময় নষ্ট করা নয়; বরং উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকা এবং সময়ের ধারণক্ষমতাকে বিবেচনায় রাখা। সেইসংগে শিক্ষার্থীর সক্ষমতার বিষয়টাও। উপযুক্ত সময়ে তার পক্ষে যে পরিমাণ পড়াশুনা সম্ভব তাতে যাতে তার দ্বারা কোনও গাফলতি না ঘটে সে ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এর বাইরের উৎসাহ নিয়েই আমাদের কথা। তা পরিত্যাজ্য। মনে রাখতে হবে হাদীসের বাণী-

الأَنَاةُ مِنَ اللهِ وَالعَجَلَةُ مِنَ الشَّيْطَانِ.

ধীরস্থিরতা আল্লাহর পক্ষ হতে আর তাড়াহুড়া শয়তানের কাজ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০১২

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

والدین اور اولاد کے باہمی حقوق

بچوں کی مناسب نشوونما کے لیے تربیت و پرورش کی مناسب تدبیر والدین کا فرض ہے۔ ان کی جسمانی صحت کو درست...

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৩৭৩৯ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ