আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানভী রহঃ

নাম ও উপাধি
পূর্ণ নাম: ইউসুফ বিন সুলাইমান বিন কাসিম লুধিয়ানভী।
তিনি ‘আল্লামা’, ‘মুহাদ্দিস’ ও ‘মুফাক্কিরে ইসলাম’ উপাধিতেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।
বিশেষ উপাধি: শাহীদে খাতমে নবুওয়াত — শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর নবুওয়াত রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ায় তাঁকে এই সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
জন্ম
তিনি ১৯৩২ সালে ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার ইসাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার জন্মের সময় ভারত উপমহাদেশে মুসলিমদের মধ্যে দীনী ইলম চর্চা ও মাদরাসা আন্দোলন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।
পৈত্রিক স্থান ও হিজরত
তিনি লুধিয়ানা জেলার এক সুপরিচিত ও দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগের পর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাঁর পরিবার পাকিস্তানে হিজরত করে করাচিতে বসবাস শুরু করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা
পাকিস্তান হিজরতের পর তিনি পিতার সান্নিধ্যে কুরআন মাজীদ হিফজ করেন।
তিনি ছোটবেলা থেকেই বুদ্ধিমত্তা, মনোযোগ ও পরিশ্রমের কারণে শিক্ষকদের নিকট প্রিয় ছিলেন।
দারুল উলুম ও দাওরায়ে হাদীস
তিনি দারুল উলুম করাচি, জামিয়াতুল উলুম ইসলামিয়া (বিনোরি টাউন) ও অন্যান্য বিখ্যাত মাদরাসায় ইলমে দীনের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তিনি দাওরায়ে হাদীস (দার্সে নিজামী) খুবই কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন।
শিক্ষক ও উস্তাদগণ
তিনি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.), মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরী (রহ.), মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী (রহ.) প্রমুখের কাছ থেকে ইলমের বিভিন্ন শাখা শিখেন।
উস্তাদরা তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন এবং বিশেষ খাস শাগরেদদের মধ্যে গণ্য করতেন।
খাস খিদমত
তিনি দীর্ঘদিন দারুল উলুম করাচিতে শিক্ষকতা করেন, পাশাপাশি ফতোয়া ও তালিমের কাজে যুক্ত ছিলেন।
তিনি বহু বড় উলামা, মুফতী ও দায়ী তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কার্যক্ষেত্র
তিনি শুধু শিক্ষক ও মুফতীই ছিলেন না, বরং তিনি একাধারে প্রখ্যাত লেখক, বক্তা, খতিব, ইসলামী চিন্তাবিদ এবং খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ছিলেন।
তিনি খতমে নবুওয়াত আন্দোলনকে সুসংগঠিত করেন এবং ভ্রান্ত মতবাদ (কাদিয়ানী, শিয়া, বাতিনী) বিরোধী কাজের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
লেখনী ও গ্রন্থাবলী
তিনি উর্দু ভাষায় অসংখ্য বই ও পুস্তিকা লিখেছেন।
তাঁর বইগুলো সাধারণ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় ইসলামী আকীদা, হাদীস, ফিকহ, সমকালীন ফিতনা ও নবউদিত মতবাদ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে।
তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে — আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, আহলেহাদীস কি ইসলা কিউন জরুরি হে, আদাবে মুআশরাত, ইসলামে দারুল হারব কি হিসিয়ত ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মাসিক সম্পাদনা
তিনি মাসিক আলবায়্যিনাহ এবং মাসিক খাতমে নবুওয়াত এর সম্পাদক ছিলেন।
এই পত্রিকাগুলো পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক মুসলমানের কাছে দাওয়াহ ও সংশোধনী চিন্তার উৎস হিসেবে সমাদৃত।
খাতমে নবুওয়াত তাহকীক
তিনি খাতমে নবুওয়াত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন।
কাদিয়ানী ও অন্যান্য ভ্রান্ত গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় তিনি বহু যুক্তিপূর্ণ লেখনী ও বক্তৃতা করেছেন।
তিনি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নবুওয়াতের শেষত্বের আকীদা রক্ষার প্রহরী হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
শাহাদত
২০০০ সালের ১৮ মে সকালে করাচিতে নামাজে যাওয়ার পথে এক আততায়ীর গুলিতে তিনি শাহাদত বরণ করেন।
তাঁর শাহাদতের খবরে পাকিস্তানসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব শোকাহত হয়।
তাঁর জানাজায় লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করেন — যা তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
জীবনদর্শন
তিনি ছিলেন সাদাসিধে জীবনযাপনকারী, বিনয়ী, নিরহঙ্কার এবং নির্ভীক।
তিনি কখনো দুনিয়াবী আড়ম্বর ও পদমর্যাদার দিকে ঝুঁকেননি, বরং দ্বীন ও উম্মাহর কল্যাণকেই সর্বাগ্রে রেখেছিলেন।
উপসংহার
তিনি তাঁর কর্ম, খিদমত ও শাহাদতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর অন্তরে অমর হয়ে আছেন।
তাঁর দাওয়াহ, লেখনী ও বক্তৃতা আজও মানুষকে জাগিয়ে তুলছে এবং বাতিলের মোকাবেলায় প্রেরণা জোগাচ্ছে।