মুফতী ইবরাহীম হাসান

বাংলাদেশে উলামা ও জনসাধারণ সর্বমহলে স্বীকৃত একটি নাম হযরত মাওলানা মুফতী ইবরাহীম হাসান দা. বা.। বাংলাদেশের প্রথিতযশা একজন আলেম। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ইসলামী শিক্ষাবিদ, সফল মুদাররিস, সচেতন ইমাম, খতীব ও দাঈ। মসজিদভিত্তিক তাফসীর মজলিস, হাদীসের দরস, কুরআনের দরস সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে দীনের সঠিক পথে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে তাঁর পদ্ধতিগুলো খুবই ফলপ্রসু ও অন্যান্যদের জন্যে অনুসরণীয়।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
মুফতী ইবরাহীম হাসান দা. বা. ১৯৬৪ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব থানাধীন পাঁচানী গ্রামের সরকার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার পাঁচানী গ্রামের অভিজাত পরিবার হিসেবে পরিচিত। পিতা জনাব মরহুম মাতলুবুর রহমান সাহেবও অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। তিনি একজন সাধারণ শিক্ষিত ও সরকারী চাকুরীজীবি হওয়া সত্ত্বেও নিজে দীনের উপর পরিপূর্ণভাবে চলেছেন এবং পরিবারকে সর্বোচ্চ দীনদার বানাবার চেষ্টা করেছেন। ফলে আজ তাঁর চারজন ছেলে সন্তানের সবাই যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে উঠেছেন এবং দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
তালীম ও তারবিয়াত
চার বছর বয়সেই মসজিদে সাবাহী মক্তবে কুরআনে মাজীদের পাঠের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সে সময়ে এর পাশাপাশি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক বছর পড়াশোনা করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকাস্থ মহাখালী হুসাইনিয়া মাদরাসায় হিফজ সম্পন্ন করেন। ১৯৭৮ সালে জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগে কিতাব বিভাগের প্রথম জামা‘আত তাইসীরে ভর্তি হন। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক জামা‘আত শরহে বেকায়া পর্যন্ত পড়েন। সে সময়ে লালবাগ জামি‘আয় ছিলেন মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ মুহাদ্দিস সাহেব রহ., মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেব রহ. ও মুফতী মনসূরুল হক দা. বা. এর মতো উস্তাদ। যারা ছিলেন নিভৃতচারী, খোদাভীরু ও ছাত্র গড়ার সাধক। এসকল উস্তাদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে তিনি এখানে শরহে বেকায়াহ (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
১৯৮৪ সালে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব করাচীর নিউ টাউন জামি‘আতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে গমন করেন। সে সময়ে করাচী নিউ টাউনে উস্তাদ হিসেবে ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ নুমানী, মাওলানা হাবীবুল্লাহ মুখতার ও মুফতী ইউসুফ লুধিয়ানবীর মতো খ্যাতিমান মাকবুল আলেমগণ। সেখানে তিনি জালালাইন, মেশকাত (স্নাতক) ও দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। এরপর সেখানেই মুফতী ওলী হাসান টুংকি ও মুফতী আব্দুস সালাম সাহেবের নিগরানীতে তাঁদের বিশেষ ছাত্র হিসেবে দুই বছরের তাখাসসুস ফিল ইফতা সম্পন্ন করেন।
চলমান কর্মজীবন
মুফতী ইবরাহীম হাসান দা. বা. এর কর্মজীবন শুরু হয় জামি‘আ মাদানিয়া নিউ করাচীতে তাফসীর, হাদীস ও আরবী আদবের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহের দরস দানের মাধ্যমে। সেখানে তিনি দু’ বছর জালালাইন, ত্বহাবী, মুয়াত্তাইন, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্ এর মতো উঁচু স্তরের কিতাবের দরস দান করেন। এরপর ১৯৯১ সাল মোতাবেক ১৪১১ হি. থেকে অদ্যাবধি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ায় তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। বর্তমানে তিনি জামি‘আর সিনিয়র মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান [তাফসীর]-এর পদ অলঙ্কৃত করছেন।
খেদমতের বিস্তৃতি
জামি‘আ রাহমানিয়ায় খেদমতের পাশাপাশি তিনি ১৪১৬ হি. থেকে দারুল উলুম মতিঝিলের মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৪৩২ হিজরীতে মুহাম্মদপুরের তাজমহল রোডস্থ বাইতুল আমান মিনার মসজিদ মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর মুবারক খেদমত দ্বারা আরো যেসব প্রতিষ্ঠান উপকৃত হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে মুহাম্মদপুরের আদাবরে মা’হাদু উলুমিল কুরআন, বসিলায় মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত অনেক প্রতিষ্ঠান মুফতী ইবরাহীম হাসান দা. বা. Ñএর সুদক্ষ নিগরানীতে পরিচালিত হচ্ছে।
ইসলাহী সম্পর্ক
মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব যখন লালবাগে কাফিয়া (মাধ্যমিক) জামা‘আতে পড়েন, তখন থেকেই করাচীর মাওলানা হাকীম আখতার সাহেব এদেশে এলে তাঁর বয়ানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। একবছর পরে হাকীম আখতার সাহেব নিজেই ডেকে তাকে বায়আত করান। পরবর্তীতে তিনি করাচী থাকাকালীন সুদীর্ঘ সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে হাকীম আখতার সাহেবের মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন। হাকীম আখতার সাহেব তাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। বলতেন, আমার নাতির নাম রাখবো ‘ইবরাহীম হাসান’। তিনি তাকে সাথে নিয়ে মুফতী রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী ও ড. আব্দুল হাই রহ. -এর মতো বড়দের কাছে সফর করেছেন। পরবর্তীতে ইবরাহীম হাসান সাহেব দেশে চলে এলেও হাকীম আখতার সাহেবের সাথে তার পত্র বিনিময় অব্যাহত থাকে। পত্রের মাধ্যমেই হাকীম আখতার সাহেব তাকে লিখিত ইজাযত প্রদান করেন।
বড়দের দু‘আ ও স্বীকৃতি
বাংলাদেশ এবং করাচী উভয় স্থানেই তিনি বড়দের দু‘আ ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। নিউটাউন করাচীর মাওলানা হাবীবুল্লাহ মুখতার সাহেব রহ. -এর সাথে তার সম্পর্ক খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ ছিলো। তিনি কখনো বাংলাদেশে এলে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবকে সফরসঙ্গী হিসেবে রাখতেন। আবরারুল হক রহ. -এর বিশিষ্ট খলীফা, জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস, মুফতী মনসুরুল হক দা. বা. শিক্ষাজীবন থেকেই ইবরাহীম হাসান সাহেবকে অত্যন্ত সুচারুরূপে তালীম-তারবিয়ত দান করেছেন। শিক্ষাজীবন থেকে কর্মজীবন সবসময়ই মুফতী মনসুরুল হক দা. বা. ইবরাহীম হাসান সাহেবের যোগ্যতার দুআসূচক স্বীকৃতির পাশাপাশি তাকে নিজের একান্ত শাগরেদ হিসেবে প্রকাশ করেছেন।
ওয়ারিসে নবীর পরম দায়িত্ব
একজন নায়েবে নবী হিসেবে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীতে সবসময়ই সজাগ। এ লক্ষ্যে তিনি জনগণের উপর কুরআন হাদীস থেকে আহরিত দাওয়াতের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকেন। পাশাপাশি বর্তমানে প্রচলিত দাওয়াত-তাবলীগের সহীহ মেহনতেও মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। তালীম-তাদরীসের অসংখ্য ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি এ মেহনতে এক সাল লাগিয়ে এলাকাবাসীকে নিয়ে মাকামী ও বেরুনী মেহনত জোরদার করে যাচ্ছেন । তার এ সকল মেহনতের ফল আজ দীনদার মুসলমানদের মধ্যে সুন্দরভাবে পরিস্ফূট হয়ে আছে।
জনগণের আত্মশুদ্ধি তথা তাযকিয়ায়ে নফসের ক্ষেত্রেও রয়েছে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবের সুচারু কার্যক্রম। এক্ষেত্রে তিনি প্রায় দুই যুগ ধরে মসজিদে নিয়মিত সাপ্তাহিক তাফসীর মাজলিস করে আসছেন। কয়েক বছর যাবৎ মাসিক ইসলাহী মাজলিসও চালু রয়েছে। জনগণকে দীনদার বনানোর মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চালু করেছেন কুরআন ও হাদীস শিক্ষার দরস। এসকল মাজলিসে নিয়মতান্ত্রিক আলোচনার পাশাপাশি থাকে দীনী মাসায়িলের প্রশ্নোত্তর পর্ব।
কিতাব ও প্রকাশনা
মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবের লিখিত ও সম্পাদিত বেশ কয়েকটি কিতাব রয়েছে। এর মধ্যে ‘সকাল সন্ধার আমল’, ‘সুন্নাহসম্মত দু‘আ ও যিকর’, ‘৫০০ ফতোয়া ও মাসায়িল’, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত দু’টি কিতাব প্রকাশ করেছে মা’হাদ প্রকাশনী’, মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, বসিলা গার্ডেন সিটি, বসিলা, ঢাকা।
উপর্যুক্ত বহুমুখী দীনী কার্যক্রম নিয়ে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নবীওয়ালা তিন দায়িত্ব তা’লীম, তাবলীগ ও তাযকিয়া এসব নিয়েই তার নিরন্তর পথচলা। আখেরাতে প্রাপ্তির আশায় বিরামহীন মুজাহাদা।