মুফতি দিলওয়ার হুসাইন

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন ১৯৬৪ সালে কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জের বান্দুয়াইন গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। হযরত এর বাবা মাওলানা দ্বীন মোহাম্মদ ছিলেন তৎকালীন সময়ে মনোহরগঞ্জ তথা লাকসামের একজন প্রসিদ্ধ আলেম।
বংশ পরিচয়
মুফতি দিলাওয়ার হোসাইনের বংশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, ১২৫৪ সালে শাহ জালাল ইয়ামানীর সাথে ইয়ামান থেকে ৩৬০ জন আউলিয়ায়ে কিরাম বাংলাদেশে আসেন। সেই আউলিয়াদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোল্লা দিওয়ান শাহ। আর সেই মোল্লা দিওয়ান বংশের ১১তম উত্তরসূরি হলেন মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন।
শিক্ষাজীবন
দিলাওয়ার হোসাইন চার বছর বয়সে তাঁর মা,বাবা, বড় ভাই মৌলভী মুহিব্বুল্লাহ ও সেজ ভাই মাওলানা নুরুল্লাহর কাছে কুরআনে কারীম পড়া শেখেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর ১৯৭৩ সালে জামি‘আ হুসাইনিয়া মাদানিয়া মুনশিরহাট মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই হযরত উর্দূ ও দ্বিতীয় বছরে ফার্সী ভাষায় তাঁর আব্বার কাছে চিঠিপত্র লেখা আরম্ভ করেন। মাদ্রাসার প্রাথমিক এ পাঁচ বছরে তিনি উর্দু ও ফার্সী রচনাশৈলীতে ভাল দক্ষতা অর্জন করেন। এরপর মুফতি সাহেব হুজুর ১৯৭৮ সালে (আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ) শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত সপ্তম মারহালার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৮ সালে চাঁদপুর শাহরাস্তির জামি‘আ ইসলামিয়া আরাবিয়া খেড়ীহর মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং চার বছর লেখাপড়া করেন।
এখানেও কৃতিত্বের সাথে নাহু-সরফ, ফিকহ, উসূলে ফিকহ, বালাগাত, মানতিক ইত্যাদি শাস্ত্রে পারদর্শীতা অর্জন করেন। অতঃপর তিনি দ্বীনী ইলমের পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী বিদ্যাপিঠ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ ঢাকায় জামাতে জালালাইন-এ ভর্তি হন এবং ১৯৮৫ সালে দাওরা হাদীস (মাস্টার্স) শেষ করেন। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের করাচীতে গমন করেন। সেখানে পাকিস্তানের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম করাচীতে ভর্তি হন। এখানে তিনি উচ্চতর ইসলামি আইনের উপর পি.এইচ.ডি (তাখাচ্ছুছাত) সম্পন্ন করেন।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানির তত্ত্বাবধানে তিনি ফিকহে হানাফীর মূলনীতি বিষয়ক ‘আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ির’ গ্রন্থের প্রথম অংশের ৪র্থ কায়েদা হতে শেষ কায়েদা পর্যন্ত ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করে ছয় খন্ডের আঠারশ’ পৃষ্ঠার একটি থিসিসপত্র জমা দেন। যা ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ যাবত জমা হওয়া থিসিসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। ১৯৯১ সালে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানির কাছে তিনি (আধুনিক অর্থনীতি) কোর্স সম্পাদন করেন।
এর পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানের জেনারেল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ সালের এস.এস.সি. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। এরপর ১৯৮৯ সালে এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৯১ সালে ডিগ্রী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অর্জন করেন।
হযরত এর থিসিস পত্রটি পর্যবেক্ষণের পর মুফতি তাকী উসমানি তাঁকে জামিয়া দারুল উলুম করাচীতে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। ১৯৯০ সালে জামিয়া দারুল উলুম করাচী থেকে পাস করে তিনি মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের করেন। এরপর শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের পরামর্শে তিনি আবার পাকিস্তান ফিরে যান।
মুফতি তাকী উসমানি তাঁকে জামিয়ার দাুরুত তাসনীফের (রচনা বিভাগের) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। এখানে তিনি “আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ির” (الأشباه والنظائر) কিতাবের অবশিষ্টাংশের ব্যাখ্যার কাজ শেষ করেন। উক্ত কিতাবের শুরু হতে দ্বিতীয় কায়দার শেষ পযন্ত চার খন্ডের প্রায় ১২শ পৃষ্ঠার ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করেন। এর পাশাপাশি মুফতীয়ে আযম পাকিস্তান মুফতি রফী উসমানি ও শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানির বিভিন্ন মাকালা ও রচনাবলীতে সহযোগিতা করতেন।
কর্মজীবন
এখানে ছয় বছর কাটানোর পর তিনি তাঁর মায়ের সাথে সাক্ষাতের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে আসেন। অতঃপর তাঁর মা তাঁকে আর পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেননি। তাঁর সহপাঠী মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ও সহদর মুফতি আব্দুল মালেক করাচী থাকাকালে দেশে ফিরে এসে সুন্দর ও মান সম্পন্ন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতেন।
এই পরিকল্পনাকে সমনে রেখে মুরব্বীদের পরামর্শক্রমে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ১৯৯৫ সালে (মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা নামে একটি নবধারার প্রতিষ্ঠানের সূচনা করে তাদের পূর্বের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন।
তাঁরা সকলে একমত হন যে, এক বছর পর্যন্ত তাঁরা শিক্ষা দানের কোন বিনিময় গ্রহণ করবেন না। মুফতি দিলাওয়ার হোসেন এখানে দীর্ঘ ছয় বছর শিক্ষকতা করেন।এরপর ১৯৯৮ সাল মিরপুর ১সেকশনের সি ব্লকে ঐতিয্যবাহি মসজিদুল আকবার এ যোগদান করে অদ্যাবধি খতীব হিসাবে নিয়োজিত রয়েছেন।
এই প্রতিষ্ঠানটির বাউন্ডারির ভিতরস্থ তিনি ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বৃহৎ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার নাম রাখেন “জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা”। ২০০৭ সালে এখানে উচ্চতর গবেষণামূলক পাঁচটি বিভাগ চালু করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি এই জামিয়ার আচার্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
এবং ২০০৬ সালের রমযান মাসে (মারকাযুল বুহূস আল ইসলামিয়া ঢাকা) এর সূচনা করেন। ২০০০ সালে তিনি নিজ গ্রাম বান্দুয়াইনে (দারুল উলুম বান্দুয়াইন) নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন শুধুমাত্র মনোহরগঞ্জের কিংবদন্তি নয়, তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক রহমত।