আল্লামা নূরুল ইসলাম আদীব দা.বা.

হাদীস-শাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র, উস্তাযুল আসাতিযা, কিংবদন্তী শাইখুল হাদিস, দারুল উলূম আল হোসাইনিয়া ওলামা বাজার মাদরাসার শাইখুল হাদিস ও মহাপরিচালক, আল্লামা নূরুল ইসলাম আদীব দা.বা.
হজরতের সংক্ষিপ্ত জীবনী
বাংলাদেশের ভূমিতে যে সকল ক্ষণজন্মা উলামায়ে কেরাম জন্ম গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদিস আল্লামা নূরুল ইসলাম আদীব সাহেব হুজুর দা.বা. একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। দ্বীনি ইলমের ময়দানের অসাধারণ পাণ্ডিত্যে, তাসাউফ ও সুলুকের লাইনে একজন মহান ব্যক্তিত্ব হওয়ার ক্ষেত্রে, বহু বিষয়ে তাঁর বিপুল রচনা গ্রন্থনায়- অধুনা কালে আদীব সাহেব হুজুর দা.বা. এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব। তাঁর গভীর জ্ঞান ও অতুলনীয় প্রজ্ঞায় যে কোনো ব্যক্তি অভিভূত না হয়ে পারবেনা। মোদ্দাকথা, তিনি হচ্ছেন আমাদের পূর্বসূরী আকাবির ও আসলাফের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং ইলমে জাহের ও ইলমে বাতেনের এক সুরভিত খনি।
জন্ম ও "নূরুল ইসলাম" নামকরণ :
মহান রাব্বুল আলামীন যখন কোন মানুষকে কল্যাণ ও হেদায়াতের জন্য নির্বাচন করেন, তখন তিনি তাঁর জন্মের পূর্বেই তাঁর মকবুল বান্দাদের মাধ্যমে উক্ত নির্বাচিত মহাত্মার শুভাগমনের সংবাদ প্রকাশ করেন। হযরতজী আদীব সাহেব দা.বা. এর ক্ষেত্রেও আল্লাহর এ বিধানের অপূর্ব প্রতিফলন ঘটেছিল। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন একবার তাঁর মাতামহ স্বপ্ন দেখেন যে, তাঁকে একজন বলছেন, হে আল্লাহর বান্দী! আল্লাহ তোমার মেয়েকে একটি সন্তান দান করবেন। ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম রাখবে "নূরুল ইসলাম" অর্থাৎ 'ইসলামের কীরণ'। স্বপ্ন দেখার কিছু দিনের মধ্যেই হযরতজী আদীব সাহেব দা.বা. জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর নানী উক্ত স্বপ্ন সকলের নিকট ব্যক্ত করে দৌহিত্রের নাম "নূরুল ইসলাম" রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
জন্মতারিখ ও জন্মস্থান:
ফেনী জেলার সোনাগাজী থানাধীন সোনাপুর এলাকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ২১ই যিলহজ্ব ১৩৫৪ হিজরী মোতাবেক ৫ই মার্চ ১৯৩৭ঈসায়ী রোজ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মুহাম্মদ ইউনুস, আর দাদার নাম সূফী আব্দুল মাজিদ।
শিক্ষা অর্জন:
বহুল প্রচলিত একটি প্রবচন রয়েছে যে, "দিনটি কেমন যাবে, সকাল বেলার সূর্যের উজ্জ্বলতা অবলোকন করেই তা অনুমান করা যায়"। ঠিক তদ্রুপ হযরতজী আদীব সাহেব হুজুরের শৈশব ও কৈশোর জীবনের অবস্থা থেকেও তাঁর আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্তশিষ্ট; চরিত্র ছিল ঈর্ষণীয়। তাছাড়াও জন্মের পর থেকেই তিনি পবিত্র, শালীন, মার্জিত এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছিলেন।
নিজ পরিবার থেকেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা। পরে ওলামাবাজার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম আল্লামা ফজলুল হক (রহ.) ও দ্বিতীয় মুহতামিম তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ ওলীয়ে কামেল আরেফ বিল্লাহ আল্লামা আব্দুল হালিম রাহিমাহুল্লাহ (ওলামাবাজারের বড় হুজুর নামে পরিচিত)-এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম আল-হোসাইনিয়া ওলামাবাজার মাদ্রাসায় শরহে বেকায়া পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা করেন। অতঃপর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য দারুল উলূম দেওবন্দ যাওয়ার ইচ্ছা করেন। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। যে কারণে তাঁকে মুরব্বীরা বাংলাদেশের প্রাচীনতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম জিরি মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন।
জিরি মাদরাসায় গমন ও উচ্চশিক্ষা অর্জন:
সে যুগে জিরি মাদরাসার সদর ও শায়খুল হাদীস ছিলেন বাহরুল উলুম আল্লামা শাহ আব্দুল ওয়াদূদ সন্ধিপী রহ.। তিনি শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. এর সরাসরি শাগরেদ ছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের কোন মাদরাসায় শায়খুল হিন্দের সরাসরি কোন ছাত্র ছিলেন না। তাছাড়া পটিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলুম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম কুতুবুল এরশাদ আল্লামা মুফতী আযীযুল হক রাহ. বুখারী শরীফ শাহ আব্দুল ওয়াদূদ সন্ধিপী রাহ. এর নিকট পড়েন। তাই এই মহান ব্যক্তিত্বের স্নেহধন্য হয়ে শায়খুল হিন্দের ইলমী ওয়ারাসাত তথা উত্তরাধিকারের মশাল হাতে নেয়ার মানসে চট্টগ্রাম জিরি মাদরাসাকেই নিজের উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য বেচে নিলেন। স্বীয় মেধা ও স্মৃতিশক্তির কারণে আদীব সাহেব এ দরবারেও শিক্ষকবৃন্দের বিশেষ কৃপাদৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি আরো দু'জন মহান মনীষীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
মুফতী শফী সাহেব রাহ. ও মাওলানা ইউসুফ বিননূরী রাহ. এর নিকট হতে ইলমে হাদীসের সনদ অর্জন:
হযরতের পরম সৌভাগ্য যে, তিনি ইলমে হাদীসের সনদ পাকিস্তান তথা উপমহাদেশের দুই মহান মনীষী- "মা'আরেফুল কুরআন" এর রচয়িতা এবং পাকিস্তানের সাবেক চিফ জাস্টিস মুফতী ত্বকী উসমানী দা. বা. এর ওয়ালিদে মুহতারাম মুফতী শফী সাহেব রাহ. এবং তিরমিযির বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ "মাআরেফুস সুনান"-এর লেখক মাওলানা ইউসুফ বিননূরী রাহ. এর নিকট থেকেও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। শেষোক্তজন উলামায়ে কেরামের দরবারে হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর 'তরজুমান' হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
'হযরতজী আদীব সাহেব'-এর বিখ্যাত শিক্ষকবৃন্দ :
হযরতজী আদীব সাহেব দা.বা. শিক্ষকবৃন্দের মধ্য হতে অনেকেই সুবিখ্যাত ও সুপ্রসিদ্ধ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হচ্ছেন,-
১. শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. এর শাগরেদে খাস, আল্লামা শাহ আব্দুল ওয়াদুদ সন্ধিপী রহ.।
২. জামেউল মাকুলাত ওয়াল মানকুলাত, আল্লামা মুফতী নুরুল হক রহ.।
এ মহান ব্যক্তি জিরি মাদরাসার দ্বিতীয় মুহতামিম ছিলেন।
৩. আল্লামা আব্দুর রহমান কামেলপুরী রহ. এর শাগরেদ শায়খুল ফুনূন আল্লামা সালেহ আহমাদ রহ.।
৪. হযরত খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রাহ এর শাগরেদে খাস আল্লামা আবুল খায়ের দৌলতপুরী রহ.।
৫. ওলামা বাজার মাদরাসার দ্বিতীয় মুহতামিম শায়খুল মাশায়েখ মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা শাহ আব্দুল হালীম রহ.।
'আদীব সাহেব' উপাধীতে ভূষিত হওয়া:
আল্লামা নুরুল ইসলাম (আদীব সাহেব) দা.বা. ইলমে জাহের ও ইলমে বাতেনের সম্পদে ঋদ্ধ বেশ ক'জন ব্যক্তিত্বের সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন। তাঁদের সাহচর্যের বরকতময় পরশ, দীক্ষার জাদুকরী প্রভাব অদ্যাবধি হযরতের স্বত্তায় স্বমহিমায় দৌদীপ্যমান। এ কারণেই বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে তিনি 'আকাবির' ও 'আসলাফ' এর সত্যিকার দৃষ্টান্ত ও উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা। তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বয়ং তাঁর শিক্ষকবৃন্দের নিকট থেকেই মিলেছিলো। মূলত 'আদীব' লকবটি তাঁর আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ থেকে দেওয়া উপাধি। পরবর্তীতে জনসাধারণ্যে এবং উপমহাদেশের ইলমী জগতে তাঁর এই উপাধিটিই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। হযরতজী এই নামেই সকলের নিকট প্রসিদ্ধি পান।
সুলুক, তাযকীয়াহ ও আত্মশুদ্ধির রূহানী সফর:
আদীব সাহেব হুজুর বেশ ভালোভাবেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন, বুজুর্গ কোন ব্যক্তির রূহানী ফুয়ুয ও বরকতময় সান্নিধ্য ব্যতিরেকে নিছক পুথিগত বিদ্যা মোটেও কার্যকরী নয়। তাই তিনি ইলমে জাহেরের পাশাপাশি ইলমে বাতেন অর্জনের পথেও তিনি বেশ যত্নবান হন। সে ধারাবাহিকতায় তিনি সর্বপ্রথম বাইয়াত হন তাঁর শায়খে বুখারী আল্লামা আব্দুল ওয়াদুদ সন্ধিপী রাহ. এর নিকট- যিনি তরিকতের খেলাফত লাভ করেছেন ওলীকূল শিরোমনী মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রাহ. এর পক্ষ থেকে। আর সাহারানপুরী রাহ. এর মুরশীদ ছিলেন ফকীহুন নফস মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.- যিনি হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ. এর খলীফা ছিলেন।
ইজাযত ও খেলাফত লাভ:
হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর নিজ শায়খের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে এতই আন্তরিক ও পুরখুলুস ছিলেন যে, হযরত আব্দুল ওয়াদুদ সন্ধিপী রহ. জিরি মাদরাসায় ১৩৭৮ হিজরীতে অনুষ্ঠিত দস্তারবন্দী মাহফিলে আপন স্নেহধন্য এই ছাত্র (আদীব সাহেব)-কে বুকে জড়িয়ে যেভাবে ফারাগাতের সনদ স্বরূপ পাগড়ি প্রদান করেছেন, অনুরূপ দস্তারে খেলাফতও দিয়েছিলেন। ঐ মাহফিলে সকল ছাত্রদের মধ্য হতে একমাত্র হযরতজী আদীব সাহেব হুজুরকেই হযরত আব্দুল ওয়াদূদ সন্ধিপী (রাহ.) খেলাফত প্রদান করেন। কিছুদিন পর চিঠির মারফতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে শাহ্ আব্দুল ওয়াদূদ রাহ. এর পক্ষ থেকে খেলাফত ও ইজাজত প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে পটিয়া কলেজ মাঠে নেজামে ইসলাম পার্টির ঐতিহাসিক সম্মেলনে আদীব সাহেব হুজুর সেকালের তাবৎ বুজুর্গানে দ্বীন ও উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে স্বরচিত এক সুদীর্ঘ 'আরবী ক্বাসীদাহ' (যা হযরতের রচিত 'কুল্লিয়াতে আদীব' এর মধ্যে রয়েছে) পাঠ করেন। ঘটনাক্রমে উক্ত মুবারক মজলিসে উপস্থিত ছিলেন মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.। তিনি আদীব সাহেব হুজুরের পাণ্ডিত্যে ও কাসীদাহ উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সেই মজলিসেই রূহানী সুলুকের ইজাযত প্রদান করেন। ঐ মজলিসে পটিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলূম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম কুতুবুল ইরশাদ মুফতী আযীযুল হক রাহ. স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তিনিও হযরতকে সস্নেহ নজরে দেখতেন এবং তাঁর কবুলিয়্যাতের জন্য বহুবার দু'আও করেছেন।
অবশ্য পরবর্তীতে শায়খ আব্দুল ওয়াদুদ স্বন্দীপী রহ. এর ইন্তেকালের পরে আদীব সাহেব হুজুর তাঁর বাল্যকালের শিক্ষক মুহিউস সুন্নাহ শাহ্ আব্দুল হালিম (ওলামা বাজারের বড় হুজুর) রহ. দিকে রুজু করেন এবং তাঁর নিকট হতেও ইজাজত ও খেলাফত লাভ করেন। তিনি তাঁর এই শাগরেদ ও মাজায আদীব সাহেব হুজুরকে মৃত্যু পর্যন্ত এই মাদ্রাসায় খেদমত করে যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে যান। যার কারণে নানা সময় দেশের প্রখ্যাত ও বড় দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ডাক আসা সত্ত্বেও ওলামা বাজার মাদরাসা ছেড়ে যাননি। বরং নিজ মুরশিদের নির্দেশ রক্ষার্থে অদ্যাবধি ওলামা বাজার মাদ্রাসায় খেদমত করে যাচ্ছেন।
তিনি মূলত তাসাউউফ ও মা'রেফতের লাইনে তিনজন মহান ব্যক্তিত্ব থেকে ইজাযত লাভ করেন। এভাবেই হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর সুলুকের লাইনেও একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
কর্মজীবন:
জামেয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের প্রস্তাব ও ওলামাবাজার মাদরাসায় খেদমত শুরু:
আল্লাহ প্রদত্ত অস্বাভাবিক মেধার অধিকারী হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর দা.বা.-এর সুখ্যাতি ছাত্র জীবনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তাঁর জ্ঞান-গরিমায় মুগ্ধ হয়ে ফেদায়ে মিল্লাত, মুজাহিদে ওয়াক্ত, খলীফায়ে থানভী, আল্লামা আতহার আলী রাহ.-এর মত মহান ব্যক্তিত্বও তাঁকে নিজ প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা, দেশের প্রখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, জামেয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের মুহাদ্দিস হওয়ার প্রস্তাব দেন। ঠিক একই সময়ে হযরতের বাল্যকালের মুরুব্বি ওলামাবাজারের বড় হুজুর আল্লামা শাহ আব্দুল হালিম রাহ.ও নিজ প্রতিষ্ঠান ওলামাবাজার মাদরাসার ব্যাপারে মনের আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
পরিশেষে তিনি তাঁর মুরশিদ ও শায়খে বুখারী আল্লামা আব্দুল ওয়াদূদ রহ. এর পরামর্শক্রমে স্বীয় ওস্তাদের প্রতি লক্ষ্য রেখে ওলামাবাজার মাদরাসাকেই কর্মজীবনের কেন্দ্ররূপে গ্রহণ করেন। এটা ১৩৭৮ হিজরীর ঘটনা। তারপর থেকে আজ অবধি প্রায় ৬৯ বছর যাবৎ হযরতজী অত্র জামিয়ার খেদমতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। এছাড়া জামিয়া ইসলামিয়া মুহাম্মাদী আশরাফুল মাদারিস (মোহাম্মদপুর) এর মুতাওয়াল্লী ও প্রধান শায়খুল হাদীসের খেদমত পালন করে আসছেন।
এই ৬৯ বছরের বিভিন্ন সময় হযরতজীকে দারুল উলূম করাচী, মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া, জামেয়া জিরিসহ দেশের প্রায় সকল বড় বড় মাদরাসাগুলোতে নেয়ার জন্য বিপুল প্রয়াস চালানো হয়। তারপরও তিনি স্বীয় শায়খের ইশারা ও রূহানী তাওয়াজ্জুহের দিকে লক্ষ্য রেখে কোন মাদরাসাতেই যাওয়াটা পছন্দ করেননি।
৪৬ বছরেরও অধিক সময় ধরে বুখারীর দরস প্রদান:
উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর 'শায়খুল আদব' নামে বিখ্যাত হলেও একাধারে তাফসীর শাস্ত্র, হাদীস শাস্ত্র, ফিকহ শাস্ত্রসহ দ্বীনি ইলমের প্রতিটি শাখায় তাঁর বিশেষ পাণ্ডিত্য রয়েছে। মা'কুলাতের মতো কঠিন বিষয়ের পাঠদানে তিনি স্বভাবজাত যোগ্যতার অধিকারী। যে কারণে শিক্ষাজীবনের সূচনাতেই যখন তিনি প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা একজন যুবক শিক্ষক, তখনই তিনি খ্যাতনামা শিক্ষক হিসেবে ইলমি পরিমগুলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। যে সুবাদে অতি অল্প সময়ে তিনি বুখারী শরীফের দরস প্রদানের জিম্মাদারী লাভ করেন। তারপর থেকে আজ অবধি প্রায় ৪৬ বছর যাবৎ হযরতজী অত্যন্ত সুনামের সাথে এই কিতাবের দরস দিয়ে আসছেন। হযরতজীর দরসে আভিধানিক ও ব্যাকরণগত তাহক্বিক্বাতের বেশ গুরুত্ব থাকে। যে কারণে তার তাক্বরীরকে 'চূড়ান্ত গবেষণা' বলে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে এবং ছাত্ররাও এর মাধ্যমে বিশেষ আত্মপ্রশান্তি ও ইলমি তৃপ্তি লাভ করে।
তার দরসের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় ওলামা বাজারের মত একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সারা দেশের ছেলেরা ভীড় জমায়। এখনতো তিনি শুধু ওলামাবাজার মাদ্রাসাই নয়, এর পাশাপাশি বহু মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস পদও অলঙ্কৃত করে আছেন।
আরবী, উর্দু ও ফারসী ভাষায় ক্বাসীদাহ রচনায় বিশেষ পারদর্শিতা :
বাংলাভাষী হওয়া স্বত্তেও হযরতজী অবলিলায় আরবি, ফার্সি ও উর্দুতে মানসম্পন্ন কাসীদাহ রচনা করতে পারেন। ইতিমধ্যেই তাঁর কাসীদাহ সমগ্র 'কুল্লিয়াতে আদীব' নামে প্রকাশিত হয়ে পণ্ডিত মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
বহুমুখী দ্বীনি খেদমত:
হযরতজী জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রখ্যাত ইসলামী গবেষণা পরিষদ 'মজলিসে বুহুছিল ইসলামিয়ার' অন্যতম সদস্য। এছাড়াও বর্তমানে হযতরজী বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যার সিনিয়র সহ-সভাপতি, আল হাইয়াতুল উলয়া বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান, তানজীমুল মাদারিসিল ক্বওমিয়া ফেনী জেলার সভাপতি, আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সিনিয়র সদস্য-পদ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করছেন। এছাড়াও দেশের প্রায় ১৫ টিরও অধিক মাদ্রাসায় প্রধান শায়খুল হাদীস হিসেবে হযরত দায়িত্ব পালন করছেন। একবার উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রহ. এর উপস্থিতিতে বুখারী শরীফের দরস প্রদান করেছিলেন। এই বিরল সৌভাগ্য অল্প সংখ্যক আলেমই অর্জন করেছেন।
এছাড়াও কায়েদে মিল্লাত আল্লামা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাঁর প্রতিষ্ঠিত নূরিয়া মাদরাসায় তাদরীবুল মুদাররিসীন কর্মশালায় হযরতজী আদীব সাহেবের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়াতেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীণ পূর্ণ সময় হাফেজ্জী হুজুর রহ. মজলিসেই বসে থাকতেন। এই ঘটনাও হযরতজী আদীব সাহেবের মাকবুলিয়্যাতের আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আদীব সাহেব হুজুর ২০১২ সালে নিজ বাড়ীতে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যা 'নূর নগর আনোয়ারুল উলুম ইসলামীয়া মাদরাসা' নামে প্রসিদ্ধ এবং এ যাবত তিনিই তা পরিচালনা করে আসছেন। দীর্ঘ ২০ বছর যাবত ফেনী কোর্ট মসজিদের ভূতপূর্ব খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রত্যেক ইংরেজি মাসের শেষ শুক্রবার আছর থেকে ইশা পর্যন্ত কোর্ট মসজিদে ইসলাহী মাহফিলে বয়ান করতেন। এছাড়াও বিশেষ করে বর্তমানে ওলামাবাজার মাদ্রাসায় প্রতি ইংরেজী মাসের শেষ শুক্রবার হযরতের বিশাল ইসলাহী মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ইসলাহী মাহফিলে দেশের বিভিন্ন জেলা হতে উলামায়ে কেরাম ও মারেফত পিপাসু ধর্মপ্রাণ মানুষের এক বিশাল জনসমাগম ঘটে।
বিভিন্ন দেশ সফর ও জামেয়াতুল আযহার গমন :
তাবলীগের নিসবতে হযরত বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তন্মধ্যে পাকিস্তানের সফরে তাবলীগের দ্বিতীয় হযরতজী হযরত মাওলানা ইউসুফ (র)-এর সফরসঙ্গী হিসেবে সেখানকার বিভিন্ন এলাকা সফর করেন। সে মুবারক জামাতে হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর নামাজের ইমামতী করতেন। এছাড়াও তাবলীগের নেসবতেই রাইবেন্ড, নেপাল, ভূটান, আফগানিস্তান, দিল্লী, কলকাতা, দেওবন্দ, সাহারানপুরসহ দেশ-বিদেশ সফর করেন। হজ্জ ও ওমরাহ'র উদ্দেশ্যে ১২ বারেরও অধিক সৌদি আরব সফর করেন এবং ১০ বারেরও অধিক নিজ শায়খ হযরত শাহ আব্দুল হালীম সাহেব রাহ. এর সাথে পাকিস্তান সফর করেন।
এছাড়াও হযরতজী যে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সফর করেছেন, তার মধ্যে মিশরের জামেয়াতুল আযহার বিশেষভাবে উল্যেখযোগ্য। এই সফরের মধ্যেই বুখারী শরীফের শেষ হাদীসের রাবী আহমাদ ইবনে আশক্বাব রহ. এর স্মৃতি বিজড়িত বাসস্থান ঘুরে আসেন। মূলত ইমাম বুখারী রাহ. এর প্রতি হযরতজীর অনিঃশেষ মুহাব্বাতের তাক্বাযায় শতো কষ্টের পরও এই সফরটি হয়েছিল।
এছাড়াও দারুল উলূম দেওবন্দের শতবার্ষিকী দস্তারবন্দী মাহফিলে হযরতজী আদীব সাহেব দা.বা. আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের মধ্যে ছিলেন। মূল স্টেজে যে সকল আলেমের জন্য আসন নির্ধারণ করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে হযরতজী আদীব সাহেবও অর্ন্তভূক্ত ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন দারুল উলুম দেওবন্দের দীর্ঘদিনের যশস্বী মুহতামিম হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তৈয়্যব সাহেব রাহ. এর ঠিক পেছনেই হযরতজী আদীব সাহেবের আসন ছিল।
মুফতী ত্বকী উসমানী দা.বা. এর সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ বিশেষ সম্পর্ক:
একবার আদীব সাহেব হুজুর মুফতী শফী সাহেব রহ. এর লিখিত 'মাআ'রেফুল কুরআন' মুতালা'আ করতে গিয়ে একটি ভুল আবিষ্কার করেন। সে সুবাদে তিনি মুফতী শফী সাহেব রাহ. এর সাহেবজাদা মুফতী ত্বাকী উসমানী দা.বা. এর নিকট চিঠি লেখেন। মুফতী ত্বকী উসমানী দা.বা. অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে চিঠিটি গ্রহণ করেন এবং ফিরতি চিঠিতে হযরতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করত: লিখে পাঠান, 'মাআ'রেফুল কুরআন'এর পরবর্তী সংস্করণে ভুলটি সংশোধন করে নেওয়া হবে। এর দ্বারা হযরতজীর সাথে মুফতী ত্বকী উসমানী দা.বা. এর সম্পর্কের গভীরতা উপলদ্ধি করা যায়।
এছাড়াও আদীব সাহেব হুজুর যখন পাকিস্তান সফর করেন, তখন দারুল উলূম করাচীতে প্রায় দিনেই বা'দ আসর মুফতী শফী সাহেব রাহ. এর দরবারে মুফতী ত্বাকী উসমানী দা.বা. সহ একসাথে বসতেন। সে মজলিসে কি বহু ইলমী ও ফিক্বহী বিষয়ে তাঁরা উভয়েই মুফতী শফী সাহেব রাহ. এর নিকট প্রশ্ন করতেন এবং সেগুলো মুফতী ত্বকী উসমানী দা.বা. লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। বয়সে আদীব সাহেব হুজুর খানিকটা বড় হলেও তাঁরা ছিলেন প্রায় সমবয়সী। তাই তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণেই মুফতী ত্বাকী উসমানী দা.বা. যখনই বাংলাদেশ সফর করেন, হুজুরের বিষয়ে বিশেষভাবে খোঁজ-খবর নেন।
ঈর্ষণীয় বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য:
সময়ের মুল্য দেওয়া তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। কখনোই তাঁকে অনর্থক সময় নষ্ট করতে দেখা যায়না। এমনকি বহুমুখী কাজের মধ্যকার বিরতির সময়টুকুও তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত বা সহজ কোনো আমলে মগ্ন হতে দেখা যায়। সর্বদাই হাতে বা সামনে কোনো না কোনো কিতাব বিদ্যমান থাকে।
তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো অবস্থাতেই তাঁকে নির্ধারিত তসবীহ, নফলিয়্যাতসহ ছোট্ট কোন মামুলাতও ত্যাগ করতে দেখা যায়না। এ ক্ষেত্রে তাঁর সফর ও ইকামত- উভয় অবস্থাই বরাবর। প্রত্যেক নামাযের পনের-বিশ মিনিট পূর্বেই মসজিদের প্রথম কাতারে হাজির হওয়া তাঁর সারা জীবনের নিয়মিত আমল। যত গুরুতর পরিস্থিতিই তৈরী হোক না কেন, এক্ষেত্রে কিছুই তাঁকে পিছিয়ে রাখতে পারে না। অন্যান্য কাজ ফেলে রেখে হলেও এ আমল তিনি যেকোনো মূল্যে আদায় করতে সদা তৎপর থাকেন।
'মুতালা'আ' বা সুগভীর অধ্যয়ন; এটাও হযরতজীর একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে তাঁর প্রথম জীবনের ছাত্র হযরত মাওলানা আব্দুল হামিদ (পীর সাহের মধুপুর) বলেন যে, 'আদীব সাহেব হুজুরের জীবনের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি শুধু জিরি মাদ্রাসায় পড়াশুনার সময়ই দরসী কিতাবাদি ছাড়া অতিরিক্ত আরও আড়াই হাজার কিতাব অধ্যয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ বয়োবৃদ্ধ বয়সেও তাঁকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়নে সদা ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।'
আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এত্তেবায়ে সুন্নাত। এক্ষেত্রে তিনি বিন্দুমাত্র আপস করেন না। চুল পরিমাণ ছাড় দেন না। সারাটা জীবন তিনি এত্তেবায়ে সুন্নাতের বিশেষ এহতেমাম করে গেছেন। রাসূল সা. এর হাদীসের দরসে যখনই বসেন, নামাজের বৈঠকের হালতে দোজানু হয়ে বসেন। যতক্ষণ দরসে থাকেন, এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। বার্ধক্যের এই অশীতিপর অবস্থায়ও তাঁর অভ্যাসের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি।
জামেয়া ইসলামিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলুম (পটিয়া মাদরাসা) এর প্রতিষ্ঠাতা মুফতী আজীজুল হক রাহ. একদা হযরতজীর শায়খ ও মুরশিদ হযরত আব্দুল ওয়াদূদ সন্দীপী রহ.কে নিয়ে একটি অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে তিনি দেখেন, জিরি মাদরাসার পুরাতন মসজিদে রাসূলে আকরাম সা. হেঁটে হেঁটে প্রবেশ করছেন। ঠিক তাঁর পিছনে রাসূলের পদচাপ অনুসরণ করে, রাসূলের পদচাপের উপর পা রেখে রেখে মসজিদে প্রবেশ করছেন হযরত আব্দুল ওয়াদূদ স্বন্দীপী রহ.। পরবর্তীতে এ স্বপ্নের তা'বীর করা হয়েছিল, হযরত আব্দুল ওয়াদুদ স্বন্দীপী রহ. ইত্তেবায়ে সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করবেন, তারই ইঙ্গিত এই স্বপ্নে করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, হযরত আব্দুল ওয়াদূদ স্বন্দীপী রহ.-এর সেই ইত্তেবায়ে সুন্নাতের অনুপম ধারাবাহিকতা হচ্ছেন হযরতজী আদীব সাহেব দা.বা.।
হযরতজী আদীব সাহেব দা.বা. এর শাগরেদদের মধ্যে অসংখ্য জ্বীন শাগরেদও আছেন। একদা এক আশ্চর্য ঘটনার অবতারণা ঘটে। ঢাকার মালিবাগে এক ছেলে জ্বীনে আক্রান্ত হয়। বহু চেষ্টা-তদবীরের পরেও যখন জ্বীন যাচ্ছিলো না, তখন মুদাব্বিরের উদ্দেশ্যে জ্বীন হঠাৎ বলে উঠে, যদি ওলামাবাজার মাদ্রাসার আদীব সাহেব হুজুর বলেন, তবে আমি এই ছেলেকে ছেড়ে চলে যাবো। তখন ঐ ছেলেকে নিয়ে ওলামাবাজার মাদ্রাসায় হযরতজীর দরবারে ছেলের বাবা উপস্থিত হন। হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর জ্বীনকে জিজ্ঞেস করেন, কেন তুমি এই ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছো? এই ছেলেকে ছেড়ে কেন তুমি যাচ্ছো না? তখন জ্বীনটি বিনীত স্বরে জানায়, হযরতজী! বেয়াদবী নিবেন না। আমি আপনার একজন শাগরেদ। এই ছেলেটি মূলত আমার গায়ে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। তাই আমি রাগ করে ওর উপর চড়ে বসি। এখন আপনি বললে, আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব। হুজুর বললেন, চলে যাও। তাৎক্ষণিক জ্বীনটি চলে গেল। এই ঘটনাও হযরতজী আদীব সাহেব হুজুরের অসংখ্য কারামতের মধ্যে অন্যতম একটি কারামত।
হযরতজীর রচিত উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ:
হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর দা.বা. একজন বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও আরবী, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য রয়েছে। আর তা ঐ সব ভাষায় তাঁর লিখিত কিতাবের তালিকা দেখেই অনুমান করা যায়। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হযরতের ইলমী গভীরতার সব্যসাচী রূপ। ধর্মীয় জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ রয়েছে। তাদরীস ও তা'লীমের সদা ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি যে বিপুল পরিমাণ রচনা করেছেন, তা সকলকেই অবাক করবে। কয়েকটি গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা হল।
১. 'মিছবাহুন নূরী'; উর্দু ভাষায় লিখিত মুখতাসারুল কুদূরীর একটি প্রামাণ্য তথ্যবহুল ব্যাখ্যাগ্রন্থ যা বাংলা ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়েছে।
২. 'নুরুল হাওয়াশী'; উসূলুশ শাশী কিতাবের উর্দু শরাহ।
৩. 'আনওয়ারে মাহমুদা'; মালাবুদ্দা মিনহুর উর্দু শরাহ।
৪ . 'নূরুন নুজূম'; মানতিক শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ 'সুল্লামুল উলূমে'র শরাহ।
৫. 'বাহরুল ইফাযাত ফি শারহিল মাক্বামাত'; মাকামাতে হারীরীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
৬. 'আসফালুল মানাহিল ফি শারহিশ শামায়েল'; উর্দু ভাষায় রচিত শামায়েলে তিরমিজির প্রামাণ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
৭. 'নুরুস সারী আলা খাতমিল বুখারী'; এ গ্রন্থটি মূলতঃ তাঁর বুখারীর শেষ অধ্যায় ও শেষ হাদিসের ব্যাখ্যা।
৮. 'মিসবাহুল হাদিস'; হাদিস ও ইলমে হাদিসের পরিচয়, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সংকলন ও তদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়াদি যথা সিহাহ সিত্তার পরিচয়, লেখকগণের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জীসহ নানা রকম তথ্যের সমাহার। এ গ্রন্থটি দাওরায়ে হাদিসের ছাত্র ও ওস্তাদদের জন্য বেশ উপকারী।
৯. 'সাহলুল উসূল ইলা হাদিয়ির রাসূল (সা)'; যা নবী চরিত্রের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্য পুস্তিকা। এই কিতাবটি বহু মাদরাসায় পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে এবং 'মহানবীর মহান চরিত' নামে বাংলায় অনুবাদও হয়েছে।
১০. 'কুল্লিয়াতে আদিব'; এ গ্রন্থটিতে তাঁর স্বরচিত আরবি, উর্দু ও ফার্সি কাসীদাসমূহ একসাথে সংকলিত হয়েছে।
১১. 'আল লাতায়েফুল আদাবিয়্যাহ'; উর্দু ভাষায় রচিত ইলমে বালাগাতের উপর লিখিত একটি চমৎকার গ্রন্থ।
১২. 'মুখতাসারুল কালাম ফি ইলমিল কালাম'। উর্দু ভাষায় লিখিত ইমে আকায়েদ ও ইলমে কালামের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক কিতাব।
১৩. 'হাকিকাতুস তাসাউফ'; ইলমে তাসাউফের গূঢ় তত্ত্ব, তার উপর আপত্তি ও জবাব নিয়ে গবেষণাধর্মী উর্দু ভাষায় রচিত একটি গ্রন্থ। আত্মশুদ্ধির ত্বত্ত্বকথা' নামে বইটির একটি বাংলা অনুবাদও সদ্য বের হয়েছে।
১৪. 'রুমুযুল কুরআন'; কুরআনের জ্ঞানকোষ।
১৫. 'উসূলে তা'লীম' বা পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে উর্দুতে লিখিত কিতাব। এই বইটিও বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
১৬. 'তাহসিনুল হিলইয়াহ-ফি তাহকিকীল লিহইয়াহ'।
১৭. পরপারের যাত্রী।
১৮. 'শরাবে তাহুর ফি কালামে মাসরুর'।
১৯. 'আন নূরুস শারাহ ফি আসানিদিস সিহাহ'।
২০. 'মাহজারে দারুল উলূম'।
২১. 'কাশফুছ ছুতুর আন আসানিদিন নূর'; সিহাহ সিত্তার সনদ সম্পর্কিত স্বতন্ত্র আরবি পুস্তিকা।
২২. 'আল লাআলিল হারিয়্যাহ আলা মাকামাতিল হারিরিয়্যাহ'; যা মাকামাতে হারিরী কিতাবের আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
২৩. 'দাফউল ইলতেবাস আন তালবিসে ইলিয়াছ'।
২৪. 'চল্লিশ হাদিস'।
২৫. 'ওসিয়তনামা'।
২৬. 'তালেবে ইলমের পথ ও পাথেয়'।
২৭. 'তাশাহহুদ পাঠকালে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করার হুকুম'।
২৮. 'কুরবানী'; কুরবানীর মাসায়েল সম্পর্কিত একটি পুস্তিকা।
২৯. তুহফাতুস সালেকীন।
হযরতজী আদীব সাহেব হুজুর দা.বা. এর খলীফাগণের তালিকা: [খেলাফত-প্রদান ক্রমানুসারে।
১. হযরত মাও. জামাল উদ্দিন দা.বা.
সিনিয়র মুহাদ্দিস ও নায়েবে মুহতামিম, হামীদিয়া মাদ্রাসা বটগ্রাম, কুমিল্লা।
২. হযরত মাও. মুফতী শহিদুল্লাহ দা.বা. প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মাদরাসাতুল বানাত, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
৩. হযরত মাও. আব্দুল মালেক রহ.
সাবেক মুহতামিম, বসিকপুর দারুল কুরআন মাদ্রাসা, ফুলগাজী, ফেনী।
৪. হযরত মাও. মুফতী মাহবুবুর রহমান দা.বা. নাযেমে তা'লীমাত ও প্রধান মুফতী, মারকাযুল ফিকর ওয়াল ইরশাদ ফরিদাবাদ, ঢাকা
৫. হযরত নূর মুহাম্মাদ নোয়াপুরী দা.বা.
মুহতামিম, হাবীবিয়া দারুচ্ছুন্নাহ মাদরাসা, ফতেহপুর, মুন্সীরহটি, ফুলগাজী, ফেনী।
৬. হযরত মাও. মোস্তফা কাসেমী দা.বা.
মুহতামিম নলচিরা ইসলামিয়া মাদরাসা, খতীব, আফাজিয়া বাজার জামে মসজিদ, হাতিয়া, নোয়াখালী।
৭. হযরত মাও. হাফেজ নূরুল্লাহ নূরী দা.বা.
(সাহেবজাদায়ে শায়েখ)
উস্তাযুল হাদীস, দারুল উলুম আল-হোসাইনিয়া ওলামাবাজার, সোনাগাজী, ফেনী ও সাবেক মুহাদ্দিস, জামিয়া সোলতানিয়া লালপোল, ফেনী।
৮. হযরত মাও. নূরুল আলম দা.বা. (সাহেবজাদায়ে শায়েখ)
সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলূম ধন্যপুর, সদর, নোয়াখালী ও সংকলক মাওয়ায়েযে আদীব।
৯. হযরত মাও. মোজ্জাম্মেলুল হক দা.বা.
মুঈনে মুহতামিম ও মুহাদ্দিস, দারুল উলুম আল-হোসাইনিয়া ওলামাবাজার, সোনাগাজী, ফেনী।
১০. হযরত মাও. আবু তাহের দা.বা.
মুহতামিম, মাদরাসা ইসলামিয়া আরাবিয়া মুছাপুর, বাংলাবাজার, নোয়াখালী।
১১. হযরত মাও. মুজিবুল হক্ব দা.বা.
মুহতামিম, বিথার মাদরাসা, সাবেক মুহাদ্দিস রগুনাথপুর মাদরাসা দাগনভূঞা।
১২. হযরত মাও. ক্বারী ইবরাহীম দা.বা.
সিনিয়র মুহাদ্দিস, দারুল উলূম আল-হোসাইনিয়া, ওলামাবাজার, সোনাগাজী, ফেনী ও সাবেক শাইখুল হাদীস খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা, ঢাকা।
১৩. হযরত মাও. ইয়াকুব আল জামীল দা.বা.
মুহতামিম, জামিয়া মিফতাহুল উলূম ধন্যপুর, সদর, নোয়াখালী।
১৪. হযরত মাও. মুফতী সালাহ উদ্দিন দা.বা.
মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস, দিলু রোড মাদরাসা, ঢাকা।
১৫. হযরত মাও. মুফতী আতা উল্লাহ দা.বা.
মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস, মুঈনুল ইসলাম, গুলশান, ঢাকা।
১৬. হযরত মাও. মুফতী মাহমূদুল হাসান দা.বা.
সহকারী নাযেমে তা'লীমাত ও সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া মুহাম্মাদী আশরাফুল মাদারিস, মোহাম্মদপুর, ঢাকা, ও উস্তাযুল ইফতা, শাইখ আবূ সাঈদ ইসলামিক রিচার্স সেন্টার, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা।
১৭. হযরত মাও. শাব্বীর আহমদ দা.বা.
সিনিয়র মুহাদ্দিস ও নাজেমে দারুল ইকামাহ, দারুল উলূম আল- হোসাইনিয়া ওলামাবাজার, সোনাগাজী, ফেনী।
১৮. হযরত মাও. জয়নুল আবেদীন দা.বা. সাবেক মুহতামিম; ওয়াসেকপুর আযীযিয়া মাদরাসা, নোয়াখালী।
১৯. হযরত মাও. ইউসুফ কাসেমী দা. বা. মুহতামিম; আশ্রাফুল উলূম মাদরাসা, দাগনভূঞা, ফেনী।
২০. হযরত মাও. মুহিউদ্দিন হাতিয়ুভী দা.বা. সিনিয়র মুহাদ্দিস; জামিয়া ইসলামিয়া মাইজদী, নোয়াখালী ও সাবেক মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলূম ধন্যপুর, সদর, নোয়াখালী।
২১. হযরত মাও. আব্দুল হক দা. বা.
নাজেমে তা'লীমাত কাশিপুর আশ্রাফিয়া মাদরাসা, ছাগলনাইয়া, ফেনী।
২২. হযরত মাও. মুফতী মাহমুদুল হাসান দা. বা.
মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া আনোয়ারুর-রহমানিয়া, কোনাপাড়া, ডেমরা, ঢাকা।
২৩. হযরত মাও. মুফতী কেফায়েত উল্লাহ দা. বা.
সিনিয়র শিক্ষক, দারুল উলূম আল হোসাইনিয়া ওলামা বাজার, সোনাগাজী, ফেনী।
২৪. হযরত মাও. আবু বকর দা. বা.
সিনিয়র শিক্ষক, জাহানাবাদ মাদরাসা, মাইজদী, সদর, নোয়াখালী।
২৫. হযরত মাও. মুফতী আনিছুর রহমান দা. বা.
সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিয়া আরাবিয়া আনোয়ারুর রহমানিয়া, কোনাপাড়া, ডেমরা, ঢাকা।
২৬. হযরত মাও. মুফতী ইসমাইল হোসেন দা. বা.
প্রিন্সিপাল ও উস্তাজুল হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া মুহাম্মদী আশরাফুল মাদারিস, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা। প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, মুহাম্মদিয়া ইসলামিয়া মাদরাসা, কমলনগর, লক্ষীপুর।
২৭. হযরত মাও. আব্দুল আযীয বিন আহমদ করীম দা. বা.
সিনিয়র শিক্ষক, দারুল উলূম আল- হোসাইনিয়া ওলামা বাজার, সোনাগাজী, ফেনী
২৮. হযরত মাও. হারুন সাহেব দা.বা.
মুহতামিম, ফেনী ইসলামিক সেন্টার, পশ্চিম সোনাপুর, ফেনী, সদর, ফেনী।
তথ্য সংগ্রহ:
মাও. হাফেজ নূরুল্লাহ বিন হযরতজী নূরুল ইসলাম (আদীব) দা.বা.
মাও. নূরুল আলম বিন হযরতজী নূরুল ইসলাম (আদীব) দা.বা
মাও. মুফতী মাহমুদুল হাসান বিন মাওলানা আবু তাহের দা.বা.
অনুলিখন:
মাও. আশরাফুদ্দীন বিন মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী দা.বা.