আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

ইতিহাসবিদ, আরবি ভাষা বিজ্ঞানীর পাশাপাশি সীরাত গবেষক হিসেবে আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর খ্যাতি উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে আরব, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্য এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের হৃদয়ে বহুমাত্রিক প্রতিভার কারণে স্থায়ী আসন পেয়েছেন।তিনি বিভিন্ন ভাষায় ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। পরবর্তী সময়ে এসব গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বহুল প্রচলিত ভাষায় অনুদিত হয়ে ইসলামী সংস্কৃতি, দাওয়াত ও তাবলিগের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টিতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তার বই অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। আরব বিশ্বে আর কেউ তার মতো আরবি ভাষার দক্ষতা দিয়ে নজর কাড়তে সক্ষম হননি। তার একাধিক বই আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহপাঠ্য হিসেবে বরিত হয়েছে।
সায়্যিদ আবুল হাসান আলী। (ভারত উপমহাদেশে সবাই তাকে আদর করে এবং শ্রদ্ধাভরে ডাকত? আলী মিয়া, মাওলানা আলী মিয়াঁ) পিতা সায়্যিদ আবদুল হাই আল-হাসানী। দাদা সায়্যিদ ফখরুদ্দীন আল-হাসানী।মাতার নাম খায়রুন্নেসা। তারঁ পিতা-মাতা উভয়েই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাতি হাসান রাযিআল্লাহু আনহুর বংশধর ছিলেন। ১৩৩২ হিজরির মহররম মাসে তার জন্ম। লক্ষ্নৌ প্রদেশের রায়বেরেলি জেলার তাকিয়াকিলা গ্রামে। লক্ষ্নৌ থেকে রায়বেরেলির দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। শৈশবে মায়ের কাছেই আলী মিয়াঁ কোরআন, আরব ও উর্দূ ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
শৈশবে মায়ের কাছেই আলী মিয়াঁ কোরআন, আরবি ও উর্দূ ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।এছাড়া তিনি তাঁর দুই চাচা শায়খ আযীযুর রহমান এবং শায়খ মুহাম্মদ তালহার কাছেও আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়েন।পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে নদওয়াতুল উলামাতে ড: তাকীউদ্দীন হেলালীর কাছে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ শিক্ষা সমাপন করেন। ১৯২৬ সনে তিনি কানপুরের নদওয়াতুল উলামাতে ভর্তি হন। এ সময়ে আরবি ভাষায় পারদর্শীতার কারণে তিনি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। এবং আরবদেশ থেকে আগত মেহমানদের সাথে দোভাষী হিসেবে তিনি বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। ১৯২৭ সালে তিনি লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে উর্দূ ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।১৯২৮সাল থেকে ১৯৩০সাল পর্যন্ত তিনি ইংরেজি ভাষা অধ্যয়ন করেন। যা ইসলাম সম্পর্কে লিখিত ইংরেজি বই থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহে তাঁর সহায়ক হয়।১৯২৯সালে তিনি আবার নদওয়াতুল উলামায় ভির্তি হন এবং তিনি একনিষ্ঠভাবে আল্লামা মুহাদ্দিস হায়দার হোসেন খানের দরসে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর কাছেই সাহীহায়ন,সুনানে আবু দাউদ এবং তিরমীজী শরীফ সমাপ্ত করেন। তার কাছে আলী মিয়াঁ তাফসীরে বায়জাভীরও কিছু অংশ পড়েন। আলী মিয়াঁ তার শিক্ষক খলীল বিন মুহাম্মদের কাছেই নির্বাচিত কিছু সূরার তাফসীর পড়েন। এছাড়া আব্দুল হাই আল ফারুকীর কাছেও তিনি কোরআনের কিছু অংশের তাফসীর পড়েন। তবে মাদ্রাসার সুনির্দিষ্ট পাঠ্যসূচী অনুযায়ী তিনি সম্পূর্ণ কোরআনের তাফসীর অধ্যয়ন করেন ১৯৩২সালে লাহোরে আল্লামা মুফাসসির আহমাদ আলী লাহোরীর কাছে। এ বছরই তিনি দেওবন্দে শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানীর কাছে কয়েক মাস থাকেন এবং তার সহীহ বুখারী ও সুনানে তিরমীজীর দরসে উপস্থিত থাকেন। আলী মিয়াঁ তার কাছে উলুমুল কোরআন এবং তাফসীরও পড়েন। এছাড়া আলী মিয়াঁ শায়খ ইজাজ আলীর কাছে ফিকহ এবং ক্বারী আসগর আলীর কাছে তাজবীদ শেখেন।
১৯৩৪সালে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং তাফসীর,হাদীস,যুক্তিবিদ্যা,আরবি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষা দেন।তিনি মাওলানা শায়খ আবদুল কাদির রায়পুরী এবং বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধলভীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে নিজের কর্মজীবনের পরামর্শদাতারূপে গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে দীনি শিক্ষার জন্য তিনি “আন্জুমানে তা’লীমাতে দীন” নামক একটি এ্যসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন।১৯৫৪ সালে সুলাইমান নদভীর ইন্তেকালের পর তিনি শিক্ষা বিভাগের পরিচালক নির্বাচিত হন।পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে বড়ভাই আব্দুল আলী আল হাসানীর মৃত্যুর পর তিনি নদওয়াতুল উলামার মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালেই তিনি তাঁর বিখ্যাত আন্দোলন “পায়ামে ইনসানিয়্যাত” শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আরবি পত্রিকা “আল-বাস” এবং ১৯৫৯ সালে “আর-রায়ীদ”এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে আলী মিয়াঁ দামেশকে ‘আরবি ভাষা ইনস্টিটিউট’এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে তিনি লখনৌতে “ইসলামিক গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২ সালে মক্কায় সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীমের অনুপস্থিতিতে আলী মিয়াঁ “রাবেতাতুল ইসলাম”এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সৌদি আরবের শাসক সাউদ বিন আবদুল আজীজ,লিবিয়ার শাসক ইদরীস সেনুসীসহ আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিরেন। এই অনুষ্ঠানেই তিনি “ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ইসলাম” শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৬৮ সালে সৌদী শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়াহ বিভাগের পাঠ্যসূচী প্রণয়নে পরামর্শ দেয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৮০ সালে জর্দান আরবি একাডেমির একজন সদস্য নির্বাচিত হন। এই বছরই তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি "বিশ্ব ইসলামী সাহিত্য সংগঠন"এর মহাপরিচালক নির্বাচিত হন। [ ১৯৮৪ সালে এবং ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন।
তবে শায়খ এর সব থেকে অমর কৃ্তি সিরাতে নববীতে। তিনি ‘আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’ গ্রন্থটি নব প্রজন্মের মন মানসিকতা, যুগজিজ্ঞাসা, ও সমকালীন সমস্যার চাহিদা পূরণের উপযোগী করে তৈরি করেন। গ্রন্থনা, তত্ত্ব সমন্বয়, বর্ণনারীতি ও তথ্যসূত্র ব্যবহারে আধুনিক প্রচলিত গবেষণা পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়, ফলে এ গ্রন্থটি আরব বিশ্বের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স হিসাবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। এ গ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রাচীন ও আধুনিক তথ্যের অপূর্ব সমন্বয় ও সমাহার।
এতে সীরাতে রাসূলের ব্যাপকতা, আন্তর্জাতিকতা ও সর্বজনীনতার এক অনুপম মহিমান্বিত রূপ স্পষ্টতই ফুটে উঠে। লেখক তাঁর অতুলনীয় ভাষা শৈলী, যথার্থ শব্দ চয়ন, শব্দের নিপুন গাঁথুনি ও উপমা উৎপেক্ষার অভিনবত্ব দেখিয়ে রাহমাতুল লিল আলামীনের কালোত্তীর্ণ জীবন-দর্শন, আচার আচরণ, আখলাক আদাত, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, দাওয়াত-তাবলীগ, সমাজ পরিবর্তনের মৌলিক নীতিমালাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন পরিশীলিত আঙ্গিকে; এখানে তাঁর সার্থকতা নিহিত। মহানবী (সা.)-এর সীরাত বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে আল্লামা নদভী আবেগ ও যুক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেন। আবেগের আতিশয্যে যুক্তি যেমন নিষ্প্রভ হয়নি তেমনি যুক্তির অতিশয়োক্তির কাছে হৃদয় উৎসারিত আবেগও হারিয়ে যায়নি। জীবনীমূলক এ সীরাত গ্রন্থটি কেবল ঘটনা পরম্পরার নীরস ও নিষ্প্রাণ বিবরণের ভারে আকীর্ণ না হয়ে বরং বিশ্লেষণের প্রবহমান ফল্গুধারার সহজ, সাবলীল ও সুখপাঠ্য হয়েছে। আল্লামা নদভী (রহ.) এ গ্রন্থে পাশ্চাত্যের বিকারগ্রস্থ জীবন দর্শনের বীভৎসতার বিবরণী তুলে ধরে নবী জীবনের মহিমান্বিত আদর্শকে নানা জাতিগোষ্ঠীর ও মানব সম্প্রদায়ের হিদায়তের অতিমূল্যবান উপাদান হিসেবে চিত্রায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
‘আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’ গ্রন্থটির বৈচিত্র ও স্বাতন্ত্র্য হলো শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর রচনারীতির সাথে সমন্বিত করে এমন যৌক্তিক আঙ্গিকে পেশ করা হয়েছে যে, যা অধ্যয়ন করে যে কোন পক্ষপাতহীন ব্যক্তির অন্তরে মুহূর্তের মধ্যে মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি ধাবিত হয় আপনা আপনিই। আরবী ভাষায় রচিত এ সীরাত গ্রন্থটি ইতোমধ্যে উর্দূ, ইংরাজী, বাংলা, তুর্কী ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি ‘নবীয়ে রহমত’ নামে বাংলায় ভাষান্তর করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালনাধীন ইসলামী বিশ্বকোষের সাবেক পরিচালক মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী (রহ.)।
কিন্তু শায়খ যে গ্রন্থের জন্য অমর সেটা হল ‘মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল’ (মা যা খাসিরাল আলাম বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন)ও সীরাতে রাসূলের আলোকে লিখিত। যা মোটামুটি সকল ভাষাতে অনূদিত আছে।