আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

প্রশ্নঃ ৮২০৮. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আখেরি চাহার শোম্বা পালন করা জায়েয আছে ? এর ফযিলত কি ?,

১৪ নভেম্বর, ২০২১

গৌরনদী

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


السلام عليكم ورحمة الله وبركاته



আখেরি চাহার শোম্বা পালন এটি কোন ফযীলতপূর্ণ আমল নয় বরং সমাজে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন রসম মাত্র এবং দ্বীনের নামে মারাত্মক বিদআত।

মুমিনের প্রতিটি কাজ হওয়া চাই সুন্নাহসম্মত পন্থায়। নবীজীর পবিত্র সীরাত হওয়া উচিত তার কাজের আদর্শ। যে কাজে থাকে আদ্যোপান্ত নববী সুন্নাহ ও আদর্শের উপস্থিতি তা রূপে-রসে হয়ে ওঠে অপূর্ব। তার নূর ও খায়ের-বরকত হয় অনন্য। আর যে কাজ করা হয় মনগড়া ও নবউদ্ভাবিত পন্থায় এবং যার অনুপ্রেরণা হয় প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ সেটা হয় নিষ্প্রাণ। তাতে কোনো খায়ের ও বরকত থাকে না। তদুপরি তা বহু রকমের উদ্বেগ, জটিলতা ও সংকীর্ণতার কারণ হয়। এজন্য হাদীস শরীফে সুন্নাহ্র অনুসরণ আর নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে-
فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة، وإن كل بدعة ضلالة.
তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহকে মজবুতভাবে ধরে রেখো। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থেকো। কারণ সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদআত আর সকল বিদআত গোমরাহী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৪৫

আখেরি চাহার শোম্বা কি উদযাপনের দিবস?

উস্তাযে মুহতারাম হযরতুল আল্লাম মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক দাঃ বাঃ এর যবানীতেঃ

সর্বপ্রথম একটি দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, বহু মানুষ সফর মাসের শেষ বুধবারকে একটি বিশেষ দিবস গণ্য করে এবং এতে বিশেষ আমল রয়েছে বলে মনে করে। পরে মনে হল, এ ধরনের ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজের উল্লেখ ‘মকসুদুল মোমেনীন’ জাতীয় পুস্তক-পুস্তিকায় থাকতে পারে। দেখলাম, ‘মকসুদুল মোমেনীন’ ও বার চাঁদের ফযীলতবিষয়ক যেসব অনির্ভরযোগ্য পুস্তক-পুস্তিকা এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রচলিত তাতে এই বিষয়টি রয়েছে। যদি ওই দৈনিকে দিবসটি সম্পর্কে এভাবে মাহাত্ম্য ও করণীয়ের বয়ান না থাকত তবে সম্ভবত প্রচলিত ভুল শিরোনামেও তা উল্লেখ করার উপযুক্ত মনে করতাম না।

খাইরুল কুরূনের হাজার বছরেরও বহু পরে উদ্ভাবিত এই রসমের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারীদের মতামতও এ ভিত্তিহীন বিষয়ের ভিত্তি অন্বেষণে বিভিন্নমুখী।

উপরোক্ত দৈনিকটির ২৩ সফর ১৪২৮ হিজরি বুধবারের সংখ্যায় লেখা হয়েছে-

‘‘আজ চান্দ্রমাস সফরের শেষ বুধবার। অর্থাৎ আখেরি চাহার শোম্বা। এদিন দু’জাহানের সর্দার মহানবী সাল্লল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগমুক্তির দিন। আর এ কারণেই এদিন মুসলমানদের জন্য আনন্দময় ও পবিত্র দিন। হাদীসে বর্ণিত আছে, এক ইহুদি কবিরাজ রাসূল [সা.]-এর চুল মোবারক নিয়ে জাদুটোনা করেছিল। ফলে মহানবী [সা.] অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি কিছুদিন মসজিদে নববীতে যেতে পারেননি। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি সুস্থতা বোধ করে গোছল করেন এবং দুজন সাহাবীর কাঁধে ভর করে মসজিদে নববীতে গিয়ে জামাআতে নামায আদায় করেন। আলহামদু লিল্লাহ।

রাসূল [সা.]-এর রোগমুক্তির সংবাদে খুশি হয়েছিল মুসলিম জাহান। খুশি হয়ে হযরত ওসমান [রা.] তাঁর নিজ খামারের ৭০টি উট জবাই করে গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। খুশিতে আত্মহারা সাহাবীগণ আনন্দ প্রকাশ ও শুকরিয়া আদায় করেছিলেন রোযা রেখে, নফল নামায পড়ে এবং হামদ-নাত গেয়ে। পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বার দিনে আজিমপুর দায়রা শরীফে ঐতিহ্যগতভাবে রোগমুক্তি ও মছিবত দূরের জন্য এক বিশেষ আংটি তৈরি করে থাকে। এছাড়াও এদিনে বিভিন্ন খানকা দরবারে রোগমুক্তির জন্য বিশেষ দুআ ও মোনাজাত করা হয়। অনেকে এদিনে রোগমুক্তির জন্য মান্নত করে গোছল করে থাকেন। অনেকে এদিনে গরিব-দুঃখীদের মাঝে তৈরি খাদ্য বিতরণ করে থাকেন। এ বিশেষ দিনটি সরকারি ঐচ্ছিক ছুটির দিন। এদিনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে।’’

অন্যদিকে মকসুদুল মোমেনীনে বলা হয়েছে-

‘‘এই মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শোম্বাহ বলা হয়। [আখেরি শব্দের অর্থ শেষ এবং চাহার শোম্বাহ শব্দের অর্থ বুধবার]। হিজরি একাদশ সনের সফর মাসের শেষভাগে নবী করীম [দা.] অত্যন্ত অসুস্থ এবং পীড়িত হয়ে পড়েন। তারপর এই মাসের শেষ বুধবার দিন তিনি শরীর একটু সুস্থ বোধ করায় গোছলাদি করে কিছুটা শান্তি লাভ করেন। এই গোছলই হুজুরের জীবনের শেষ গোছল ছিল। এর পর তাঁর জীবনে আর গোছল করার ভাগ্য হয় নাই। অতএব এই দিন মুসলমানদের বিশেষভাবে গোছলাদি করে নফল নামায এবং রোযা ইত্যাদি আদায় করে নবী করীম [দা.]-এর রূহের উপর সওয়াব বখশেষ করা উচিত।’’

এরপর এ দিন সম্পর্কে বিভিন্ন করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। যেমনটি ভিত্তিহীন উপরোক্ত উভয় বিবরণ।

১. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা ছিল হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এ জাদুর প্রভাব কতদিন ছিল সে সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে চল্লিশ দিনের কথা। কিন্তু এ দুই বিবরণে কোনো সংঘর্ষ নেই। এক বর্ণনায় পুরো সময়ের কথা এসেছে আর অপর বর্ণনায় এসেছে শুধু ওই সময়টুকুর কথা যাতে জাদুর প্রতিক্রিয়া বেশি ছিল। তবে যাইহোক সুস্থতার তারিখ কোনো হিসাব অনুযায়ীই সফরের আখেরি চাহারশোম্বাহ হতে পারে না। -ফাতহুল বারী ১০/২৩৭ : আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ২/১৫৪; শরহুয যুরকানী ৯/৪৪৬-৪৪৭

২. জাদুর ঘটনা হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে এসেছে। কিন্তু সেখানে না একথা আছে যে, সে সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে জামাআতে শরীক হতে পারেননি; আর না আছে মুআওয়াযাতাইন [সূরা ফালাক ও নাস] দ্বারা জাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার গোসলের বয়ান।

৩. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তার সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য, কিন্তু একথা দাবি করা যে, সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের মনীষীগণ সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন, জাহালাত ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোনো দলিলও বিদ্যমান নেই।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অনেক মসিবত এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও ওহুদে আহত হয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এই সব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে দিবস উদযাপনের কোনো নিয়ম আছে কি? তাহলে আখেরি চাহারশোম্বাহ, যার কোনো ভিত্তিই নেই, তা কীভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?

৪. কোনো দিনকে বিশেষ ফযীলতের দিবস মনে করা কিংবা বিশেষ কোনো আমল তাতে বিধিবদ্ধ রয়েছে এমন কথা বলা কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা-এই সবগুলো হচ্ছে মুসলমানদের জন্য শরীয়তের বিধানের অন্তর্ভু&ক্ত। অতএব এগুলো শরয়ী দলিল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা যায় না। এটা শরীয়তের একটি অবিসংবাদিত মূলনীতি। এজন্য উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওইসব রসম-রেওয়াজ জারি করার কোনো বৈধতা হয় না।

৫. মকসুদুল মোমেনীন পুস্তিকায় যা বলা হয়েছে তা-ও সঠিক নয়। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়েছে সোমবারে। এর চার পাঁচ দিন আগে তাঁর সুস্থতার জন্য যে সাত কুঁয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তার দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাছীর একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। -ফাতহুল বারী ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাযী ৪৪৪২; আলবিদায়া ওয়ান্নিহায়া ৪/১৯৩; সীরাতুন নবী, শিবলী নুমানী ২/১১৩

যদি বুধবারের ঘটনা হয়ে থাকে তবে সফর মাসের শেষ বুধবার কীভাবে হচ্ছে? রসমের পৃষ্ঠপোষকতাকারীগণ সকলে ইন্তেকালের তারিখ বারো রবীউল আওয়াল বলে থাকেন। সোমবার যদি বারো রবীউল আওয়াল হয়ে থাকে তাহলে এর আগের বুধবার তো সফর নয়, রবীউল আওয়ালেই হচ্ছে।

তাছাড়া এ তথ্যও সঠিক নয় যে, বুধবারের পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসল করেননি। কেননা, এরপর একরাত ইশার নামাযের আগে গোসল করার কথা সহীহ হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। -সহীহ মুসলিম হাদীস ৪১৮ [সহীহ বুখারী হাদীস নং ৬৮১-এর সাথে মিলিয়ে পড়ুন- আররাহীকুল মাখতূম, সফীউদ্দীন মোবারকপূরী পৃ. ৫২৫]।

আর একথাও ঠিক নয় যে, বুধবারের পর অসুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেকদিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং যোহরের নামাযে শরীক হয়েছিলেন-একথা সহীহ হাদীসে রয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৪, ৬৮০ ও ৬৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪১৮, আররাহীকুল মাখতূম পৃ. ৫২৬; রাহমাতুল্লিল আলামীন, মানসূরপূরী

সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন, যার কারণে হযরত আবু বকর সিদ্দীক [রা.] অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। -সীরাতে ইবনে ইসহাক পৃ. ৭১১-৭১২; আররাওযুল উনুফ ৭/৫৪৭-৫৪৮

৬. সারকথা এই যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এবং তাঁর পবিত্র সীরাত ও সুন্নতের অনুসরণ, তাঁর জীবনাদর্শে আপন জীবন গঠন, তাঁর শরীয়তের প্রচার-প্রসার ইত্যাদি হকসমূহ, যা উম্মতের জন্য অবশ্যপালনীয়-এগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং গাফলতির এই প্রকৃত ব্যাধি সম্পর্কে অসচেতন রাখার জন্য এসব ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজের উৎপত্তি। আল্লাহ তাআলা উম্মতকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং রসম ও মুনকারাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করুন। আমীন।

৭. ইসলামী শরীয়তে ছুটির যে নীতিমালা রয়েছে সে আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ তারিখের ছুটি থাকা ঠিক নয়। (মাসিক আলকাউসার)

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৮৫৯৭৬

স্ত্রীর সাথে কথা বন্ধ রাখা


২২ জানুয়ারী, ২০২৫

১৭০২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আবু সাঈদ

৪৫৯২০

একটি “নকল বিবাহ”


১৬ নভেম্বর, ২০২৩

৮VPC+৫P৩

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৮৮৪৩৯

ভাড়াটিয়ার দায়


৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

ফুলতলা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৪৩৭৫১

আরবি শব্দকে বাংলা বানানে প্রকাশ করা....


২৩ অক্টোবর, ২০২৩

রাজপাড়া

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy