আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

বার বার গুনাহ হয়ে যায়; কী করবো?

প্রশ্নঃ ২৯৩১৬. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, এই ফিতনার যুগে যদি বিভিন্ন কারণে বারবার যদি গুনাহ হতে থাকে আবার তওবা করি আবার গুনাহ হয়। এর জন্য যদি আল্লাহর থেকে বারবার দূরে সরে যেতে থাকি তখন করণীয় কী? কি করলে আল্লাহর প্রিয় হতে পারব? কী করলে আর গুনাহ হবে না?,

১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

মানিকগঞ্জ

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে এই বেড়াজাল থেকে অতি দ্রুত বের হওয়ার তাওফিক দান করুন। আপনার হৃদয়কে সকল পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করুন। নিশ্চয় আল্লাহ এ-বিষয়ে ক্ষমতাবান।
গুনাহয় অভ্যস্ত হওয়ার শাস্তি যে শুধু পরকালেই হবে তা নয়, বরং দুনিয়ার জীবনেও এ শাস্তির অংশবিশেষ ভোগ করতে হয়। এর কারণে সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা ও পেরেশানিমূখর জীবন অতিবাহিত করতে হয়। শাস্তি হিসেবে এটাও কম কিসের!
আর আপনার রোগের চিকিৎসা নিম্নবর্ণিতভাবে হতে পারে–
এক: আপনাকে সত্যিকার অর্থে তওবা করতে হবে। আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। অতীতে যা করেছেন তার জন্য লজ্জিত হতে হবে। বেশি-বেশি দোয়া করতে হবে এবং কায়মনোবাক্যে আকুতি করতে হবে আল্লাহ যেন আপনাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি যেন আপনাকে এই বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পেতে সহায়তা করেন। কারণ, যদি সীমালংঘনকারী সত্যিকার অর্থে দৃঢ়চিত্তে তাওবা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِلَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُوْلَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًارَّحِيمًا
তবে যে তাওবা করে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে। পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আল ফুরকান ৭০)

দুই: একটু ভেবে দেখুন, কোন্ কোন্ পথে গুনাহ হয়ে যাচ্ছে। কোন্ কোন্ দরজা দিয়ে গুনাহ প্রবেশ করছে। ঘরের দরজা বন্ধ না করলে যেমন চোর ঢুকবে, তেমনি গুনাহের দরজা বন্ধ না করলেও অনিচ্ছায় আপনি গুনাহয় জড়িয়ে পড়বেন। সুতরাং গুনাহর দরজা যদি বন্ধ করতে পারেন, তাহলে গুনাহ থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যাবে। আর যে সমস্ত পথে গুনাহ হয়ে যায় সেগুলো নিয়ে ভাবলে দেখবেন, তালিকার প্রথমেই আসবে অসৎ সঙ্গ বা খারাপ বন্ধু। সুতরাং যে কোনো মূল্যে আপনাকে অসৎ সঙ্গ থেকে বাঁচতে হবে। নইলে তারা আপনাকে গোনাহে জড়িয়েই ছাড়বে। এজন্যই তো প্রবাদ আছে, সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
মানুষ তার বন্ধুর দীনের উপর থাকে, অতঃপর কার সাথে বন্ধুত্ব করছ তা বিবেচনা করে নাও। (তিরমিযি ২৩৭৮)
গুনাহর আরেকটি দরজা হল, মোবাইল ও কম্পিউটার। এর সাথে সাথে ইন্টারনেট। এগুলো ভাল কাজেও ব্যবহার করা যায়, আবার এগুলো দিয়ে গুনাহও হয়ে যায়। প্রয়োজনের কথা বলে এগুলো হাতে আসে, আর তা দিয়ে প্রযুক্তির তুলনায় গুনাহই বেশি প্রবেশ করে। সুতরাং বাস্তবেই যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এগুলোর নিরাপদ ব্যবহার করবেন। বিশেষ করে কম্পিউটারের বাস্তব প্রয়োজন হলে সেটা বাড়ির এমন স্থানে স্থাপন করবেন যেন সকলের নযরে পড়ে, আর আপনি গুনাহ থেকে বাঁচতে পারেন।

তিন: আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহন করুন। তাদের মজলিসে আসা যাওয়া করুন। এতে নফস নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাওবার উপর অটল থাকা আপনার জন্য সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবাহ ১১৯)

চার: গুনাহ যদি যৌবনতাড়িত হয় তাহলে বিবাহের ব্যাপারে সিরিয়াসলি চিন্তা করুন। প্রয়োজনে আপনার গার্জিয়ানকে এ ব্যাপারে খোলাখুলি বলে বিবাহের আগ্রহ ব্যক্ত করতেও কোনো সমস্যা নেই। এ ব্যাপারে দারিদ্র্যকে ভয় পাবেন না; আল্লাহ তার করুণায় অভাবমুক্ত করে দেবেন। কেননা আল্লাহ বলেছেন,
وَأَنكِحُوا الْأَيَامَى مِنكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِن يَكُونُوا فُقَرَاء يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস-দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যবান ও মহাজ্ঞানী। (সূরা আন-নূর ৩২)

পাঁচ: যদি বিবাহ সম্ভব না হয় তাহলে আরেকটি সমাধান হল রোজা রাখা। মাসে অন্তত তিনদিন অর্থাৎ আরবি মাসের ১৩,১৪,১৫ রোজা রাখার চিন্তা করতে পারেন। অথবা প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার। কেননা, রোজার মধ্যে প্রবৃত্তির টানে ছুটে যাওয়া থেকে যেমন সুরক্ষা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আল্লাহর কাছে বড় প্রতিদান। মানুষের ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় করা, ধৈর্য, সহনশীলতা, নফসের খাহেশ ও আনন্দদায়ক বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দীক্ষাও রয়েছে রোজায়। তাই রোজা রাখার ব্যাপার মনস্থির করুন। আশা করা যায়, আল্লাহ আপনার বোঝা হালকা করবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ ، مَنِ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ
হে যুবক সম্প্রদায় ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে এবং যাদের বিবাহ করার সামর্থ্য নাই, সে যেন রোযা পালন করে। কেননা, রোযা তার যৌনতাকে দমন করে। (বুখারী ৪৯৯৬)

ছয়: যখন গুনাহ করার মনস্কামনা সৃষ্টি হবে অথবা এই পাপে লিপ্ত হওয়ার জন্য শয়তানের ওয়াসওয়াসা অনুভূত হবে, তখন স্মরণ করবেন যে, আপনার এইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাল কিয়ামতের মাঠে আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ তাআলা বলেন\,
حَتَّى إِذَا مَا جَاؤُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدتُّمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنطَقَ كُلَّ شَيْءٍ
অবশেষে যখন তারা জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে, তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের চামড়া তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তখন তারা তাদের চামড়াকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ কেন? উত্তর দিবে,আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। (সূরা হা-মীম আসসাজদাহ্ ২০,২১)

সাত: কখনো একাকী নিভৃতে থাকবেন না। কেননা একাকীত্ব গুনাহর চিন্তা করার কারণ হতে পারে। আর আপনার সময়কে উপকারী বিষয়ে ব্যয় করতে সচেষ্ট হোন। যেমন- সৎকাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, নামাজ ইত্যাদি।

আট: পরকালের মুরাকাবা করুন। অর্থাৎ প্রতিদিন চোখ বন্ধ করে এই কথার ধ্যান করুন যে, এ দুনিয়ায় আমি চিরকাল থাকার জন্য আসিনি। অনেক বড় বড় রাজা-বাদশাহ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন, কিন্তু তারা আজ কবর জগতের বাসিন্দা। কেউ তাদের আজ খোঁজখবরটুকু নেয় না। যেই শরীর ও দেহ নিয়ে তারা গর্ব করেছিল মাটি ও পোকামাকড় তা খেয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। আমাকেও একদিন তাদের মতো হতে হবে। অতএব কী হবে এই দুনিয়ায় অহংকারী ও আত্মবিলাসী হয়ে অকারণে জুলুম-নির্যাতন করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে, সর্বোপরি ঈমান-আমলকে ঠিক না করে সে পথের অভিযাত্রী হয়ে। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَاتَعْمَلُونَ
হে ঈমানদাররা তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত আগামীকালের জন্য (পরকালের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে। (সূরা হাশর ১৯)

প্রিয় দীনি ভাই! আল্লাহর বাণী: أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى ‘সে কি জানে না যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন।’ আমাদের কেউ যদি বুঝে যে, অমুক আমার গুনাহর কথা জেনে গেছে বা আমাকে গুনাহর কাজে দেখে ফেলেছে, তাহলে তার লজ্জার আর শেষ থাকে না। বন্ধু! লজ্জা করা উচিত তো আল্লাহকে! যিনি ‘আলীম’ সর্বজ্ঞ; অন্তরের কল্পনাও জানেন। তিনি ‘সামী’ সর্বশ্রোতা; যিনি পিঁপড়ার পদধ্বনিও শুনতে পান। তিনি ‘বাসীর’ সর্বদ্রষ্টা। তিনি ‘খাবীর’ যিনি সবকিছুর খবর রাখেন। তিনি ‘মুহীত’ সবকিছু তাঁর আয়ত্বাধীন, কোনো কিছু তাঁর পরিধির বাইরে নয়। সুতরাং স্মরণ রাখুন, আল্লাহ আমাকে দেখছেন। হারাম বস্তুর দিকে তাকিয়ে সুখ অনুভব করছি? একটু ভাবি, যিনি আমাকে এই চোখ দান করেছেন, যিনি আমার কাছে এই চোখ আমানত হিসেবে দিয়েছেন, তিনি কি আমাকে দেখছেন না? নির্জনে কোনো বেগানা নারীর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছি, অথবা মিছে সুখের ফাঁদে ফোনে কাটিয়ে দিচ্ছি সারারাত। একটু স্মরণ করি, কেউ দেখছে না, আল্লাহ্ও কি দেখছেন না?
সুতরাং হে বন্ধু! কোনো পাপের পথে পা বাড়াবার আগে একটু ভাবুন, 'আল্লাহ আমাকে দেখছেন'।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী
সিনিয়র মুহাদ্দিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর
খতীব, বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদ, মিরপুর

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩৫৯১৭

মানুষের হক নষ্ট করলে মুক্তির উপায় কী?


৯ জুলাই, ২০২৩

Bandar Seri Begawan

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৩৪০১৭

নিজের হক আদায়ে জন্য মিথ্যা বলার হুকুম।


৯ জুন, ২০২৩

ত্রিশাল

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আবু সাঈদ

৩৯৭৫৩

স্বামীর পকেট থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে ইসলাম কি বলে??


১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আরিফুর রহমান

৯৪৯১৯

মোবাইলের ব্লুটুথে মাগরিবের আজান চালিয়ে দিয়ে ইফতার করতে চাওয়া


১১ মার্চ, ২০২৫

সিন্দুর পুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ ইসহাক মাহমুদ

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy