বিতিরের রাকাত সংখ্যা: একটি দালিলিক পর্যালোচনা
প্রশ্নঃ ১৪৪১০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমার প্রশ্নটা একাটু বড় হবে। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিই।একটু ধৈর্য ধরে মনযোগ দিয়ে পরবেন আহলে হাদিস রা এক বইঠকে তিন রাকাত বিতির সালাত পড়ে। এবং এর দলিল হিসেবে তারা মুস্তাদরাক আল হাকিম থেকে জেই হাদিস টা দলিল হিসেবে উল্লেখ করে হানাফিরা সেই হাদিস টাকে জাল বলে। এর উত্তরে আহলে হাদিস রা বলেছে যে মুস্তাদরাক হাকিমের হাদিসে একজন রাবি আছে যার নাম হাসান বিন ফযল তার কারনেই হাদিস টাকে জাল বলা হয়। কিন্তু এটা নাকি প্রিন্টিং মিস্টেক। এটা আসলে হুসাইন বিন ফযল হওয়ার কথা ছিল।সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি তে নাকি একই সনদ অ মতনে হাদিসটি হুসাইন বিন ফযল দিয়ে উল্লেখ আছে।আবার হাদিসে ( লা ইয়া কু'দু ) আর ( লা ইয়ু সাল্লিমু ) নিয়ে যে দন্দ সেই বিষয়ে তারা উত্তর দেয় যে তাদের কাছে বহু পুরনো নুসখা আছে তাতে ল ইয়া কু'দু শব্দে হাদিসটি উল্লেখ আছে। আর বর্তমানে যেসব হাদিসে লা ইয়ু সাল্লিমু শব্দটা আছে এটা কোনো ভাবে ইইচ্ছাকৃতভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে অথবা ভুলে এরকম হয়েছে কারন তাদের পুরনো নুসখাতে লা ইয়া ক'দু ইল্লা ফি আখিরিহিন্না আছে।এখনো পর্যন্ত আমি কোনো হানাফি আলেম কে এই কথার জবাব দিতে শুনিনিতাই আপনার কাছে জানতে চাই বিষয়টা। প্রশ্নটা অনেক বড় হওয়ার জন্য মাফ চাই,
২৯ জুন, ২০২৪
কালীগঞ্জ
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
মুহতারাম,
আপনি যে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন সে বিষয়ে উস্তাযুল আসাতিযা আল্লামা আব্দুল মতীন দাঃ এর নিম্নোক্ত লেখাটি পড়লে আপনার প্রশ্নের উত্তরটি পেয়ে যাবেন।
উত্তর একটু বড় হবে।
ধৈর্য সহকারে মনযোগ দিয়ে পড়ুন, বুঝে আসবে।
আল্লামা আব্দুল মতীন দাঃ এর পর্যালোচনাঃ
সমাজের কিছু ভাই এক বৈঠকে তিন রাকআত বিতর পড়ার স্বপক্ষে নিম্নোক্ত বর্ণনা দ্বারা দলীল দিয়ে থাকেন :
عن عائشة قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث لا يقعد إلا في آخرهن.
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। তিনি শেষের রাক্‘আতে ব্যতীত বসতেন না।” [টীকা:১২৮১. মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪০; বায়হাক্বী হা/৪৮০৩, তয় খ-, পৃঃ৪১; সনদ ছহীহ, তা‘সীসুল আহকাম ২/২২৬ -(২/২৯৭] (পৃ. ৩৩১)
পর্যালোচনাঃ
(ক) গ্রন্থকার উল্লিখিত হাদীসের যে বরাত দিয়েছেন তন্মধ্যে আমি প্রথমটিতে (অর্থাৎ মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪০) হাদিসটি এ শব্দে পাইনি। তিনি বলেছেন- “ لا يقْعُد (বসতেন না)” আর মুস্তাদরাকের মুদ্রিত কপিতে আছে- “ لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না)”। আর (সালাম ফিরাতেন না) শব্দ দিয়ে দুই রাকাতের পর তাশাহহুদ পড়তেন না এর পক্ষে দলিল হয় না। বরং এ হাদীস থেকেত একথাই প্রমাণিত হয় যে, বিতরের দুই রাকাতে বসতে হয়, কিন্তু সালাম ফিরাতে হয় তিন রাকাত পূর্ণ করে। কেননা এর অর্থ যদি দুই রাকাতে না বসা হত, তাহলে “ لا يُسَلم (শেষ না করে সালাম ফিরাতেন না)”- এ কথার কোন অর্থই হয় না। কারণ সালামত আর দাড়ানো অবস্থায় হয় না যে, ‘সালাম ফিরাতেন না’ বলে দিতে হবে।
মোট কথা বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে মুদ্রিত মুসতাদরাকের মোট পাঁচটি কপিতে আমি হাদীসটি (সালাম ফিরাতেন না) শব্দে এভাবেই পেয়েছি। দেখুন-
১. আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, ১/৪৪৭ হা.১১৪০ তাহক্বীক- আব্দুল ক্বাদের আতা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বাইরুত, লেবানন।
২.আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন- ১/৪৩৭ হা.১১৪১, প্রকাশক- দারুল হারামাইন, মিশর, প্রথম প্রকাশ -১৯৯৭।
৩. আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, ১/৩০৪ তাহক্বীক- ইউসুফ আব্দুর রহমান, বাইরুত, লেবানন।
৪. আল-মুসতাদরাক, হা. ১/৪১৪ দারুল ফিকর, বাইরুত, লেবানন।
৫. আল-মুসতাদরাক, ১/৩০৪ দাইরাতুল মা‘আরিফিল উসমানিয়া, হায়দারাবাদ, ভারত, প্রকাশকাল-১৩৩৪ হি.) এমনকি নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেবও ইরওয়াউল গালিলে (১/১৫১) এ শব্দেই উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু গ্রন্থকার মুস্তাদরাকের কোন কপিতে “ لا يقْعُد (বসতেন না)” পেলেন তা বলেননি। পরবর্তীতে তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তিনিও কোন মুদ্রিত কপিতে “ لا يقْعُد (বসতেন না)” শব্দটি পাননি। কারণ তিনি বলেছেন- “মুস্তাদরাকে হাকেমে বর্ণিত لا يقْعُد (বসতেন না) শব্দকে পরিবর্তন করে পরবর্তী ছাপাতে لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না) করা হয়েছে।” আবার কোন মাখতূতা বা পাণ্ডুলিপিতে এ শব্দটি তিনি দেখেছেন তাও বলেননি। তার কথা ‘পরবর্তী ছাপা’ দ্বারা বুঝা যায় পূর্ববর্তী ছাপাতে لا يقْعُد (বসতেন না) শব্দ ছিল। কিন্তু সেটি পূর্ববর্তী কোন ছাপা তা তিনি কিছুই বলেননি!
তবুও কেন তিনি হাদীসটি “لا يقْعُد “বসতেন না” শব্দে এনে মুস্তাদরাকের বরাত উল্লেখ করলেন আমার বুঝে আসে না? যদি তার কাছে এ শব্দটি ভুল মনে হয়ে থাকে, তাহলে তিনি কিতাবের মূল শব্দটি উল্লেখ করার পর তা ভুল প্রমাণ করে দেখানোর চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে নিজ থেকে হাদীসের শব্দ পরিবর্তন করে দিলেন। পরে জোড়াতালি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত দলিল না দিয়ে কতগুলো অযৌক্তিক কথা বলে শাস্ত্রীয় লোকদের জন্য কিছু হাসির যোগান দিলেন।
গ্রন্থকারের সমচিন্তার লেখক আব্দুল্লাহ আল-কাফি এখানে তারচেয়েও মারাত্মক অন্যায় কাজ করেছেন। তিনি বিতর ছালাত বইয়ে (পৃ.৩১) লেখেন- “এর মধ্যে তাশাহুদের জন্যে বসতেন না”। অর্থাৎ তিনি বসতেন না শব্দের সাথে ‘তাশাহুদের জন্যে’ কথাটি নিজের থেকে জুড়ে দিলেন, যার আরবী হবে- (للتشهد)। টীকায় বলেন- “হাদীছটি বর্ণনা করেন ইমাম হাকেম, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেন।” এতে তিনি কোন খণ্ড ও পৃষ্ঠার উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া আর কোন বরাতও উল্লেখ করেননি। তাহলে কোথায় পেলেন তিনি এ শব্দ? এভাবেই তাহলে নবীজীর নামাযকে জাল হাদীস থেকে মুক্ত করতে গিয়ে জাল হাদীস যুক্ত করে দেওয়া হয়!
(খ) কোন শব্দটি সহীহ- “ لا يقْعُد” নাকি “ لا يُسَلم”?
এখানে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার-
এক. মুস্তাদরাকে হাকেমে এ হাদীসটি কোন শব্দে এসেছে?
দুই. এ হাদীসের অন্যান্য সকল সনদ বিবেচনায় কোন শব্দটি বিশুদ্ধ-“ لا يقْعُد (বসতেন না)” নাকি “ لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না) ”?
তিন. “ لا يقْعُد (বসতেন না)” শব্দের অর্থের মধ্যে কি- ‘তাশাহুদের জন্য’ বসতেন না, এটি নির্দিষ্ট? নাকি ‘সালাম ফিরানোর জন্য বসতেন না, এ অর্থেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে?
চার. হাদীস বর্ণনাকারী ইমাম বাইহাকী (রহ.) নিজে এ হাদীস থেকে কোন তরীকার বিতর বুঝেছেন?
পাঁচ. হাদীসটি বর্ণনাকারী ইমাম বাইহাকী (রহ.) বর্ণনাটির কি মান উল্লেখ করেছেন?
(এক) হাদীসের শব্দ “ لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না)” ই সঠিক
আমার অনুসন্ধানে মনে হয়, মুসতাদরাকে হাকেমে মূলত “ لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না)” শব্দটিই ছিল, এখনও আছে। অর্থাৎ হাকেম এ শব্দেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর “ لا يقْعُد (বসতেন না)” শব্দটি সঠিক নয়। হাকেম এ শব্দে বর্ণনা করেননি। কারণ-
১. আমার দেখা ‘মুসতাদরাকের’ পাঁচটি মুদ্রিত কপিতেই হাদীসটি “ لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না)” শব্দে এসেছে - যা বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রকাশকদের কাছে এ কিতাবের যে কটি পাণ্ডুলিপি ছিল তাতে হাদীসটি এ শব্দেই এসেছে।
২. কিতাবটি মুদ্রিত হয়ে আসার বহু আগে, যখন হস্তলিখিত কপি পচলিত ছিল তখনও বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের অনেক মুহাদ্দিস ‘মুসতাদরাক’ থেকে হাদীসটি এ শব্দে উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা যায় তাদের কাছে থাকা মুসতারাকের কপিগুলোতেও হাদীসটি এ শব্দেই ছিল। যেমন:
● হাফেজ জামালুদ্দীন যাইলাঈ (মৃত.৭৬১) নছবুর রায়া গ্রন্থে
● হাফেজ শামসুদ্দীন ইবনে আব্দিল হাদী (মৃ.৭৪৪) তানক্বীহুত তাহক্বীক গ্রন্থে (২/৪২১)
● হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃ.৮৫২) ‘আদদিরায়া’ গ্রন্থে (১/১৯১ হা.২৪২)
● হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী রহ. (মৃ.৮৫৫) উমদাতুলকারী, শরহু আবিদাউদ ও আল বিনায়া গ্রন্থে
● ইবনুল হুমাম (মৃ.৮৬১) ফতহুল কাদীর গ্রন্থে,
● হাফেজ ক্বাসেম ইবনে কুতলুবুগা (মৃ.৮৭৯) ‘আততা‘রীফ ওয়াল ইখবার ফি তাখরীজুল ইখতিয়ার’ (১/৩৭৯ হা.২১৭) গ্রন্থে
● মোল্লা আলী ক্বারী রহ. (মৃ.১০১৪) শরহু মুসনাদি আবিহানীফা গ্রন্থে
● মুরতাজা যাবীদী (মৃ.১২০৫) উকূদুল জাওয়াহিরিল মুনীফা গ্রন্থে।
● এমনকি গাইরে মুকাল্লিদ আলেম শাওকানী রহ. নিজেও ‘নাইলুল আওতারে’ (৩/৪২) হযরত আয়শা (রা.) এর হাদীসটিতে মুসনাদের আহমদের পাশাপাশি মুসতাদরাকের বরাতও উল্লেখ করেছেন। মুসনাদে আহমদের বর্ণনার শব্দ হল- (لا يفصل بينهن) ‘তিনি রাকাতসমূহকে (সালামের মাধ্যমে) বিভক্ত করতেন না’। এটি উল্লেখের পর শাওকানী বলেন- (أما حديث عائشة فأخرجه أيضا البيهقي والحاكم بلفظ أحمد) : “আয়শার হাদীসটি বাইহাকী ও হাকেম (মুসনাদে) আহমদের (অনুরূপ) শব্দেই উল্লেখ করেছেন”। আর আহমদের অনুরূপ শব্দ হল- “সালাম ফিরাতেন না” - অর্থাৎ সালামের মাধ্যমে বিভক্ত করতেন না।
উপরোল্লিখিত পৃথিবী বিখ্যাত হাফেজে হাদীসগণ বিভিন্ন যুগে মুসতাদরাকের বিভিন্ন হস্তলিখিত কপি থেকে হাদীসটি এ শব্দেই উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এ নয় অঞ্চলের নয় জন হাফেজে হাদীস ও মুহাদ্দিসের কাছে মুস্তাদরাকের যে কপিগুলো ছিল, তাতে এ শব্দটিই ছিল। বলাবাহুল্য তখন মুদ্রণের যুগ ছিল না যে, একজন ভুল ছেপে দিলে সবার কাছেই ভুলটা চলে যাবে। বরং সবগুলোই ছিল হস্তলিখিত কপি। আর এতগুলো কপিতে এক সাথে ভুল শব্দ থাকবে এটা হওয়ার কথা নয়।
অবশ্য ইবনে হাজার আসকালানীর ফাতহুল বারী মুদ্রিত কপিতে, হাদীসটি “বসতেন না” শব্দে এসেছে। হতে পারে তিনি অন্য কোন কপিতে এ শব্দেই পেয়েছেন। আবার এও হতে পারে যে, এটি ফাতহুল বারী কিতাবের মুদ্রণের ভুল। কিন্তু ইবনে রজব ফাতহুল বারীতে, ইবনুল মুলাক্কিন আল বাদরুল মুনীরে এবং ইবনু আব্দিল হাদী তানকীহুত তাহকীকে (لا يقعد) শব্দে উল্লেখ করেছেন। তাই এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, হয়ত মুসতাদরাকের কোন পাণ্ডুলিপিতেই لا يقْعُد শব্দ রয়েছে। কিন্তু যেমনটি আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. বলেছেন-
“আমার প্রবল ধারণা (لا يسلم) শব্দটি মুসতাদরাকে হাকেমের পাণ্ডুলিপিতেও থাকবে। কেননা যাইলাঈ কারো উদ্ধৃতি উল্লেখ করার ক্ষেত্রে এতটা (মুতাসাব্বিত) নিশ্চিত্র্র্র ও নির্ভুলভাবে উল্লেখ করে থাকেন যে, হাফেজ (ইবনে হাজার আসকালানী)ও অতটা করেন না। তাঁর একটি রীতি হল, তিনি যখন কারো বক্তব্য কোন মাধ্যমে পেয়ে থাকেন তখন মাধ্যম উল্লেখ করে দেন। নতুনা নিজ চোখে দেখেই সেখান থেকে হুবহু বক্তব্যটি উল্লেখ করেন। আর এখানে (لا يسلم) বলেছেন। সুত্ররাং (لا يسلم) শব্দটি মুসতাদরাকের পাণ্ডুলিপিতে অবশ্যই থাকবে।”( ) [আরফুশ শাযী- তিরমিযীর সাথে যুক্ত পৃ. ১০৪-১০৫]
৩. বিশেষত হাকেম এ হাদীসটি উল্লেখের পূর্বে একই সনদে আরেকটি হাদীস এনেছেন (নং ১১৩৯), যার শব্দ হল- (لا يسلم في ركعتي الوتر) সালাম ফিরাতেন না”। অতঃপর বলেন- “এ হাদীসের আরো শাওয়াহেদ তথা সমর্থক হাদীস আছে”। এবং সমর্থক হিসেবেই আলোচ্য হাদীসটি (হা.১১৪০) এনেছেন। তাই দ্বিতীয় হাদীসটি প্রথম হাদীসের সমর্থক হওয়ার জন্য প্রথম হাদীসের মত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
৪. মুসতাদরাকের এ বর্ণনার সাথেই উল্লেখ আছে, “এটিই উমর রা. এর বিতর। তাঁর কাছ থেকেই মদীনাবাসী এ পদ্ধতির বিতর শিখেছে”।
● বলাবাহুল্য ইমাম মালেক রহ. মদীনাবাসীর বিতরকে অনুসরণ করতেন, কিন্তু কোন মদীনাবাসী থেকে তিনি দুই রাকাতে বৈঠক ছাড়া তিন রাকাত বিতরের কোন বিবরণ উল্লেখ করেনওনি এবং তিনি নিজেও এভাবে বিতর পড়ার কথা বলেননি।
আবার হাফেজ ইবনুল মুলাক্কিন (মৃ.৮০৪) রহ. হাকেমের এ বিবরণ উল্লেখ করেছেন, “তাঁর কাছ থেকেই (মদীনাবাসী- এর স্থলে) ‘কুফাবাসী’ এ পদ্ধতির বিতর শিখেছে”। (আল-বাদরুল মুনীর ৪/৩০৮ দারুল হিজরাহ)। যদি ‘মদীনাবাসী’র পরিবর্তে ‘কুফাবাসী’ শব্দটি সহীহ হয় তাহলে, এ থেকে বুঝা যায় মুসতাদরাক সঙ্কলক হাকেম আবু আব্দুল্লাহ এ হাদীস থেকে দুই তাশাহহুদ ও এক সালামের বিতরই বুঝেছেন। বিশেষত হাকেমের সূত্র্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, ইমাম বাইহাকী রহ.। তিনিও হাদীসটির শিরোনাম দিয়েছেন- ‘দুই তাশাহ্হুদ ও এক সালামে তিন রাকাত বিতর’।
(দুই) হাদীসের সবগুলো সূত্র সামনে রাখলে- দুই রাকাতে ‘বসতেন না’ কথার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না-
হযরত আয়শা রা. এর সূত্র্রে হাকেম ও বাইহাকী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদ- শাইবান ইবনে ফাররুখ আবান ইবনে ইয়াযিদ থেকে এবং আবান ইবনে ইয়াযিদ কাতাদা থেকে। অতঃপর সনদটি এরূপ- যুরারাহ-সা‘দ ইবনে হিশাম-হযরত আয়শা রা.।
কাতাদাসূত্র্রে হযরত আয়শা রা. এর বর্ণনাটি হাদীসের বহু কিতাবে বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে (কাশফুস সিতর পৃ.৮৯-৯০)। যেমন-
১. (يوتر بثلاث لا يسلم /لا يقعد إلا في آخرهن - رواه الحاكم والبيهقي)
২. (كان لا يسلم في ركعتي الوتر- رواه النسائي)
৩. (أوتر بثلاث لا يفصل فيهن - رواه أحمد في المسند)
৪. (الوتر بتسع أو بسبع - رواه مسلم (৭৪৬) وغيره)
নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম মনে করেন- সবগুলো মূলত একই হাদীসের বিভিন্ন শব্দ। বর্ণনাকারী বিভিন্ন সময়ে হাদীসের মূল বক্তব্য ঠিক রেখে বিভিন্ন শব্দে ব্যক্ত করেছেন। কখনো সংক্ষেপে আবার কখনো বিস্তারিত। সুত্ররাং এ হাদীস থেকে বিতর নামাযের পদ্ধতি বের করতে হলে, সবগুলো বর্ণনাকে সামনে রেখেই করতে হবে। যে সকল মুহাদ্দিস শব্দের সামান্য ভিন্নতা সত্ত্বেও সবগুলোকে একই হাদীস বলে গণ্য করেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন-
১. এ হাদীসের বর্ণনাকারী হাকেম স্বয়ং- তার মুসতাদরাকে উপরোক্ত দ্বিতীয় নম্বরে উল্লিখিত শব্দের সমর্থক হিসেবে প্রথম নম্বরে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। (মুসতাদরাক হা.১১৪০, ১১৪১)
২. এ হাদীসে অপর বর্ণনাকারী বাইহাকী রহ. স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সা‘দ ইবনে হিশাম সূত্র্রে হযরত আয়শা রা. থেকে বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত বিতর বিষয়ক হাদীস মূলত একটি হাদীসেরই বিভিন্ন চিত্র্র্র। (وَفِي رِوَايَةِ عَبْدِ الْوَهَّابِ يُشْبِهُ أَنْ يَكُونَ اخْتِصَارًا مِنَ الْحَدِيثِ) [আসসুনানুল কুবরা ৩/৩১] অবশ্য বাইহাকী রহ. এর মত হল, সাদ ইবনে হিশামের আলোচ্য বর্ণনায় রাকাত সংখ্যা ছিল নয়। এ কথা মারওয়াযী ও তার অনুসরণে আলবানীও বলতে চেয়েছেন। কিন্তু এ মতের পক্ষে যথাযথ কোন দলিল পাওয়া যায় না।
৩. ইমাম নববী বাইহাকীর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। (আল-মাজমূ-৪/১৮)
৪. হাফেজ ইবনুল মুলাক্কিন (মৃ.৮০৪)। (আল-বদরুল মুনীল ৪/৩০৮)
৫. হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। (ইতহাফুল মাহারা বিল ফাওয়াইদিল মুবতাকারাহ ১৬/১০৮৬ হা. ২১৬৭১ )
৬. ইবনে তাইমিয়া আল-জাদ্দ ও শাওকানী রহ.। (নাইলুল আওতার ৩/৩৫)
৭. আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. (কাশফুস সিতর পৃ.৮৯-৯০)
৮. খোদ গাইরে মুকাল্লিদ আলেম আব্দুর রহমান মুবারকপুরীও স্পষ্ট ভাষায় দুটি হাদীসকে এক গণ্য করে বলেন- (قلت لا مخالفة بين قوله لا يسلم في الركعتين الأوليين من الوتر وقوله لا يقعد إلا في آخرهن) - দুই হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। [তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৪৫৩]
এ ছাড়াও আরো অনেকেই এ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। বিশেষত প্রথমোক্ত দুটি শব্দ হযরত কাতাদা সূত্র্রে একই সনদে বর্ণিত হয়েছে। সুত্ররাং সবগুলো বর্ণনাকে সামনে রাখলে স্পষ্ট যে, আলোচ্য হাদীসের শব্দ অন্যগুলোর মতই - “لا يقْعُد (বসতেন না)” না হয়ে “ لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না)” হওয়াটাই যক্তিযুক্ত।
আর যদি এ হাদীসে বর্ণিত শব্দগুলির মধ্যে কোনটি প্রাধান্য পাবে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা হয় তাহলে প্রথমোক্ত মুসতাদরাকে হাকেম ও বাইহাকীর (لا يقعد) শব্দ সম্বলিত বর্ণনাটিই অধিকতর দূর্বল প্রমাণিত হয়। এর তুলনায় দ্বিতীয় নাম্বারে উল্লিখিত (لا يسلم في ركعتي الوتر) - শব্দটিই প্রাধান্য প্রায়, যার সুস্পষ্ট অর্থ হল, বিতরের দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক করতেন, কিন্তু সালাম ফিরাতেন না। কারণ, প্রথমোক্ত শব্দটি কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন শাইবান ইবনে ফাররুখ আবান সূত্র্রে। আর দ্বিতীয়টি বর্ণনা করেছেন, আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে আতা সাঈদ ইবনে আবী আরুবা সূত্র্রে। তন্মধ্যে শাইবান সত্যবাদী হওয়া সত্ত্বেও বর্ণনায় ভুল করতেন, ( صدوق يهم- تقريب التهذيب)। তাই কারো বর্ণনার সাথে বিরোধ লাগলে তার বর্ণনা যাচাই করা জরুরী। বিপরীতে আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে আতা সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন- (كان عبد الوهاب بن عطاء من أعلم الناس بحديث سَعِيد بن أَبي عَرُوبَة) : আব্দুল ওয়াহহাব সাঈদের হাদীস সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন (তাহযীবুল কামাল)। তাই সাঈদের বর্ণনায় তার ভুল হবার কথা নয়। আর ইমাম আবু হাতিম, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন ও আবু দাউদ তায়ালিসী প্রমুখ বলেন- “(كان سعيد أحفظ أصحاب قتادة/ أعلم الناس بحديث قتادة) : অর্থাৎ কাতাদার হাদীস সম্পর্কে কাতাদার শিষ্যদের মধ্যে সাঈদ সবচেয়ে বেশি জানেন।” (সিয়ারু আলামিন নুবালা) সুত্ররাং স্বভাবতই তার বর্ণনা শাইবানের বর্ণনার উপর অগ্রগণ্য হবে। [আরো দেখুন- নছবুর রায়াহ টীকা, তাহক্বীক শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ ২/১১৮]
(তিন) “ لا يقْعُد” অর্থ ‘সালাম ফেরানোর জন্য বসতেন না’
যদি ধরে নেয়া যায় এ হাদীসে “ لا يقْعُد (বসতেন না)” শব্দটিই সঠিক। তাহলে প্রশ্ন হয়- শব্দের অর্থের মধ্যে কি ‘তাশাহুদের জন্য’ বসতেন না এটি নির্দিষ্ট; নাকি ‘সালাম ফিরানোর জন্য’ বসতেন না এ অর্থেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যায়, দুটো অর্থের সম্ভাবনা আছে বটে কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে ‘সালাম ফিরানোর জন্য বসতেন না’ অর্থটিই এখানে যথোপযুক্ত মনে হয়। কারণ একই হাদীসের অন্য বর্ণনায়- " لا يفصل فيهن" -“নামায বিভক্ত করতেন না”। (মুসনাদে আহমদ হা. ২৫২২৩ ) আরেক বর্ণনায় - (لا يسلم في ركعتي الوتر) “বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না” বলা হয়েছে। (সুনানে নাসায়ী হা.২৫২২৩)
যারা সা‘দ ইবনে হিশাম সূত্র্রে হযরত আয়শা থেকে বর্ণিত এ হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনাগুলোকে এক হাদীস গণ্য করেন তারা সকলেই হাদীসের এ ব্যাখ্যাই করে থাকবেন। এবং (لايسلم) বা (لا يقْعُد) যে শব্দই হোক তারা এ হাদীস থেকে এক সালাম ও দুই বৈঠকের তিন রাকাত বিতরই বুঝেছেন।
উদাহারণ স্বরূপ বলা যায়, ইমাম ইবনুল জাওযী (মৃ.৫৯৭), ইমাম শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল হাদী (মৃ.৭৪৪) ও ইমাম যাহাবী (মৃ.৭৪৮) প্রত্যেকেই কাতাদাসূত্র্রে হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেন- এ হাদীস থেকে এক সালামে তিন রাকাত বিতর পড়া প্রমাণিত হয়। তবে দুই রাকাতে বৈঠক অবশ্যই করতে হবে। তাঁদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তাঁরা দুই রাকাতে বৈঠক না করার সম্ভাবনাটাকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন দৃঢ়তার সাথে। তাদের তিনজনেরই ভাষ্য প্রায় কাছাকাছি এবং তিনজনের কেউই ফিকহে হানাফীর অনুসরণ করতেন না। তন্মধ্যে ইমাম যাহাবী রহ. ভাষ্য হল- (قلْنَا : يجوزُ هذا أن يوتر بسلامٍ واحدٍ لكنْ يتشهد بينهم كالمغرب) - ‘আমরা বলি, এ পদ্ধতিতে এক সালামেও (তিন রাকাত) বিতর পড়া সম্ভাবনা আছে। তবে মাগরিবের নামাযের মত মাঝে তাশাহহুদ পড়বে।’ [দেখুন-তানকীহু কিতাবিত তাহকীক, ইমাম যাহাবী ১/২১৬, আত্তাহকীক ফি মাসায়িলিল খিলাফ ১/৪৫৬ তানকীহুত তাহক্বীক, ইবনু আব্দিল হাদী ২/৪২১]
বরং তারও পূর্বে ইমাম ইবনে হাযম জাহেরী (মৃ.৪৫৬) বিতর নামাযের বিভিন্ন পদ্ধতি আলোচনায় বলেন- (والثاني عشر: أن يصلي ثلاث ركعات، يجلس في الثانية، ثم يقوم دون تسليم ويأتي بالثالثة، ثم يجلس ويتشهد ويسلم، كصلاة المغرب وهو اخْتِيَارُ أبي حَنِيفَةَ.) : ‘দ্বাদশ পদ্ধতি: তিন রাকাত নামায পড়বে। তাতে দুই রাকাত শেষে বসে সালাম না ফিরিয়েই আবার দাড়িয়ে যাবে এবং তৃতীয় রাকাত পড়বে। অতঃপর মাগরিবের নামাযের মতই বসে তাশাহহুদ পড়ে সালাম ফিরাবে। আর এ মতটাই গ্রহণ করেছেন আবু হানীফা”। অতঃপর তিনি দলিল হিসেবে সা‘দ ইবনে হিশামের এ বর্ণনাটিই উল্লেখ করেছেন, (لا يسلم في ركعتي الوتر)। (আল-মুহাল্লা বিল আসার ৩/৪৭)
আলোচ্য হাদীসের এ অর্থটা খুব স্বাভাবিক। এ কারণেই গায়রে মুকাল্লিদ আলেম শাওকানী (রহ.) ও শামসুল হক আজীমাবাদী রহ. উভয়েই সাদ ইবনে হিশাম সূত্র্রে হযরত আয়শার এ হাদীসের একটি বর্ণনায়- “لا يقْعُد (বসতেন না)” শব্দের ঠিক একই ব্যাখ্যা করেছেন। শাওকানী রহ. নবীজী থেকে বর্ণিত হাদীস- (صلى سبع ركعات لا يقعد إلا في آخرهن ) ‘সাত রাকাত পূর্ণ করার আগে বসতেন না’ এর ব্যাখ্যায় বলেন- (الرواية الأولى تدل على إثبات القعود في السادسة والرواية الثانية تدل على نفيه ويمكن الجمع بحمل النفي للقعود في الرواية الثانية على القعود الذي يكون فيه التسليم) - “প্রথম বর্ণনা থেকে বুঝা যায় ষষ্ট রাকাতে ‘বসতেন’। আর দ্বিতীয় বর্ণনা থেকে বুঝা যায় ‘বসতেন না’। এ দুয়ের মাঝে এভাবে সামঞ্জস্য হবে যে, তিনি ‘বসতেন না’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে - ‘সালাম ফেরানোর জন্য বসতেন না’।” [নাইলুল আওতার ৩/৪৭ ছালাতুল বিতরি ওয়াল কিরাআতি ওয়াল কুনূত অধ্যায়, আওনুল মা‘বুদ শারহু সুনানি আবি দাউদ ৪/২২১]
(চার) ইমাম বাইহাকী রহ. নিজেই এ হাদীস থেকে ‘এক সালাম ও দুই তাশাহুহুদে তিন রাকাত বিতর’ বুঝেছেন।
আলোচ্য বর্ণনাটি এ শব্দে বর্ণিত হয়েছে মৌলিকভাবে কেবল হাকেমের মুসতাদরাক কিতাবে। ইমাম বাইহাকী হাদীসটি হাকেমের সূত্র্রেই ‘আস-সুনানুল কুবরা’ ও ‘মা‘রিফাতুস সুনান’ গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণনা করেছেন। আর বর্ণনাকারী ইমাম বাইহাকী নিজেই এ হাদীস থেকে ‘এক সালাম ও দুই তাশাহহুদে তিন রাকাত বিতর’ বুঝেছেন। তিনি ‘আসসুনানুল কুবরায়’ (৩/৩১) যে অধ্যায়ে হাদীসটি উল্লেখ করে এর শিরোনাম দিয়েছেন- (باب من أوتر بثلاث موصولات بتشهدين وتسليم ) -“অধ্যায় ঃ যারা দুই তাশাহহুদ ও এক সালামে একতে মিলিয়ে তিন রাকাত বিতর পড়েন”। আর ‘মা‘রিফাতুসসুনান’ গ্রন্থে (৪/৭১) আরো স্পষ্ট বলেছেন- (الوتر بثلاث ركعات موصولات بتشهدين ويسلم من الثالثة) -“বিতর নামায দুই তাশাহ্হুদে একতে তিন রাকাত এবং তৃতীয় রাকাত পূর্ণ করে সালাম ফেরাবে”। এখানে বাইহাকী রহ. হাদীসটি থেকে কি বুঝে আসে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তদ্রুপ হাকেম নিজেও এ হাদীস পূর্ববর্তী হাদীসের সমর্থক বলে দিয়েছেন। যাতে ‘বসতেন না’ কথাটি নেই।
গ্রন্থকার বলেন, “বিশেষ সতর্কতা: মুস্তাদরাকে হাকেমে বর্ণিত لا يقْعُد (বসতেন না) শব্দকে পরিবর্তন করে পরবর্তী ছাপাতে لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না) করা হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী সকল মুহাদ্দিছ لا يقْعُد দ্বারাই উল্লেখ করেছেন। টীকায় বরাত দিয়েছেন- “হাকেম হা/১১৪০ ফৎহুল বারী হা/৯৯৮ আল-আরফুশ শাযী ২/১৪” (পৃ.৩৩১)
পর্যালোচনাঃ
এক. গ্রন্থকারের দাবি মুসতাদরাকের মুদ্রিত কপিতে হাদীসের শব্দ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে পরিবর্তন করেছে তিনি তা বলেননি! যদি কোন প্রমাণ নাই থাকে তাহলে অনুমান ভিত্তিক এমন অপবাদ কারো উপর দেয়া ঠিক কি? পূর্বে বলা হয়েছে কিতাবটি ছাপার বহুকাল আগেই হাদীসটি এ শব্দে বিভিন্ন জনের কিতাবে ছিল। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব যে বলেছেন, পরবর্তী ছাপ্রায় পরিবর্তন করা হয়েছে; তিনি কি দেখাতে পারবেন যে পূর্ববর্তী কোন ছাপ্রায় তা لا يقْعُد শব্দে ছিল?
দুই. তিনি পরিবর্তনের দলিল হিসেবে যা উল্লেখ করেছেন তা একদিকে যেমন ভিত্তিহীন অপরদিকে হাস্যকরও বটে। কেননা
● তিনি বলেন- “কারণ পূর্ববর্তী সকল মুহাদ্দিছ لا يقْعُد দ্বারাই উল্লেখ করেছেন”। কিন্তু এ দাবি যে সঠিক নয় পূর্বের আলোচনায় তা স্পষ্ট হয়েছে। কেননা কিতাব মুদ্রণের যুগ শুরু হওয়ার বহু যুগ আগেই অনেক সংখ্যক মুহাদ্দিস বর্ণনাটি- (لا يسلم) শব্দে উল্লেখ করেছেন। যদিও কোন কোন মুহাদ্দিস বর্ণনাটি দ্বিতীয় শব্দেও উল্লেখ করেছেন তবুও অনেকগুলো পার্শ্বকারণ সামনে রাখলে (لا يسلم) শব্দটিকেই প্রাধান্য দিতে হয়। সুত্ররাং মুদ্রণের বহু আগে থেকেই এ শব্দ ছিল।
● আর “পূর্ববর্তী সকল মুহাদ্দিস” কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। যা পূর্বে দেখানো হয়েছে।
তিন. গ্রন্থকার টীকায় বরাত দিয়েছেন, “হাকেম হা/১১৪০ ফৎহুল বারী হা/৯৯৮ আল-আরফুশ শাযী ২/১৪” এখানে হাকেমের বরাত দেয়াটা হাস্যকর। কারণ, মতপার্থক্যই হল হাকেমের শব্দ নিয়ে। হাকেমের কিতাব থেকে মুহাদ্দিসগণ দুই শব্দেই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তাই এক্ষেত্রে হাকেমের বরাত দেয়াটা সত্যিই হাস্যকর। আবার হাকেমের মুদ্রিত কপিতেতো রয়েছে- (لا يسلم) শব্দ। তিনি যে হাদীস নাম্বার দিয়েছেন (হা.১১৪০) মুসতাদরাকের কোন কপিতেতো এখানে (لا يقْعُد) শব্দে হাদীসটি নেই। আর ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার এ শব্দে আনলেও তাঁর আদদিরায় কিতাবে তিনি (لا يسلم) শব্দে এনেছেন।
অতঃপর গ্রন্থকার বলেন- “আরো দুঃখজনক হল, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) নিজে স্বীকার করেছেন যে, আমি মুস্তাদরাক হাকেমের তিনটি কপি দেখেছি কিন্তু কোথাও لا يُسَلم (সালাম ফিরাতেন না) পাইনি। তবে হেদায়ার হাদীছের বিশ্লেষক আল্লামা যায়লাঈ উক্ত শব্দ উল্লেখ করেছেন। আর যায়লাঈর কথাই সঠিক। সুধি পাঠক! ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫) নিজে হাদীছটি সংকলন করেছেন আর তিনিই সঠিকটা জানেন না! বহুদিন পরে এসে যায়লাঈ (মৃত.৭৬২) সঠিকটা জানলেন? অথচ ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮হিঃ) ও একই সনদে উক্ত হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সেখানে একই শব্দ আছে। অর্থাৎ لا يقْعُد (বসতেন না) আছে। একেই বলে মাযহাবী গোঁড়ামী। অন্ধ তাকলীদকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যই হাদীছের শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।”(পৃ.৩৩২)
গ্রন্থকারের বক্তব্যের খোলাসা কথা হল- ১.হাদীসটি বর্ণনা করেছেন হাকেম মুসতাদরাক গ্রন্থে (لا يقْعُد) ‘বসতেন না’ শব্দে। আর যাইলাঈ কয়েকশত বছর পর এসে বলছেন হাদীসের শব্দ হল- (لا يسلم) ‘সালাম ফিরাতেন না’। ২.কাশ্মীরী রহ. মাযহাবের গোঁড়ামির কারণে বলছেন- যাইলাঈর কথাই সঠিক।
পর্যালোচনাঃ
(ক) বক্তব্য বিকৃত করে অপবাদ আরূপ
গ্রন্থকার এখানে রীতিমত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর বক্তব্যকে কেটে ছেটে বিকৃত করে তার উপরে দোষ চাপ্রিয়ে দিলেন। দেখুন, গ্রন্থকার বলেছেন, “আর যায়লাঈর কথাই সঠিক”! তারপর বিস্ময়করভাবে যাইলাঈকে হাকেম ও বাইহাকীর মোকাবেলায় দাড় করালেন?!
বস্তুত গ্রন্থকারের দুটি কথাই সম্পূর্ণ অবাস্তব। দেখুন কাশ্মীরী রহ. বক্তব্য হল, “আমার প্রবল ধারণা (لا يسلم) শব্দটি মুসতাদরাকে হাকেমের পাণ্ডুলিপিতেও থাকবে। কেননা যাইলাঈ কারো উদ্ধৃতি উল্লেখ করার সময় এতটা (মুতাসাব্বিত) নিশ্চিত্র্র্র ও নির্ভুলভাবে উল্লেখ করেন, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানীও অতটা করেন না। তাঁর একটি আদত হল, তিনি যখন কারো বক্তব্য কোন মাধ্যমে পেয়ে থাকেন তখন তার বরাত উল্লেখ করে দেন। নতুবা নিজ চোখে দেখেই সেখান থেকে হুবহু বক্তব্যটিই উল্লেখ করেন। আর এখানে শব্দ পরিবর্তন করে। অর্থাৎ (لا يقْعُد) না বলে (لا يسلم) বলেছেন। (এবং এর কোন বরাতও উল্লেখ করেননি। তাই বুঝা যায় তিনি মুসতাদরাকে (لا يسلم) শব্দটি নিজ চোখে দেখেই তবে উল্লেখ করেছেন।) সুত্ররাং (لا يسلم) শব্দটি মুসতাদরাকের পাণ্ডুলিপিতে অবশ্যই থাকবে।
অর্থাৎ যাইলাঈ রহ. হাকেম রহ এর মুসতাদরাক গ্রন্থ থেকে হাদীসটি لا يقْعُد শব্দে নয় বরং لا يسلم শব্দেই উল্লেখ করেছেন। কাশ্মীরির কথা হল, মুসতাদরাকের কোন পাণ্ডুলিপিতে যদি হাদীসটি لا يسلم শব্দে আমি না পাই, তবুও প্রবল ধারণা হয় যে, এটি মুসতাদরাকের কোন না কোন কপিতে থাকবেই। কারণ, যাইলাঈ নিজের চোখে না দেখে কোন বরাত দেন না। সুত্ররাং হাকেম মুসতাদরাক গ্রন্থে হাদীসটি কোন শব্দে বর্ণনা করেছেন, তাতো আর আমরা হাকেমকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারব না। বরং মুসতারাকের কপিতে যা পাই তাই বিশ্বাস করতে হবে। তাছাড়া যাইলাঈ ছাড়াও আরো অনেকেই মুসতাদরাকের বরাতে হাদীসটি لا يسلم শব্দে উল্লেখ করেছেন। এতেও কাশ্মীরী রহ. এর বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়।
সাধারণ পাঠকও এখান থেকে একথা বুঝবে না যে, হাকেম বলছেন, হাদীসের শব্দ হল- (لا يقْعُد) ‘বসতেন না’, আর যাইলাঈ এটা অস্বীকার করে বলছেন হাদীসের শব্দ - (لا يسلم) ‘সালাম ফিরাতেন না’।
বরং এখানে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব মুসতাদরাকের কপিতে হাদীসটি (لا يقْعُد) ‘বসতেন না’ শব্দে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। যদিও কোন কপিতে পেয়েছেন তার কোন উল্লেখ তিনি করেননি। বিপরীতে যাইলাঈ মুসতাদরাকের বরাতে হাদীসটি (لا يسلم) ‘সালাম ফিরাতেন না’ শব্দে উল্লেখ করেছেন। আমরাও বহু সংখ্যক মুদ্রিত কপিতে হাদীসটি এ শব্দেই পেয়েছি। তাই একথা বলা যায়, মুসতাদরাকে হাদীসটি কোন শব্দে রয়েছে এ বিষয়ে জনাব মুযাফ্ফর সাহেব এর কথা বিশ্বাস করব, নাকি ইমাম যাইলাঈর কথা?! সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে মুযাফফর সাহেব কোন মুদ্রিত ও অমুদ্রিত প-ুলিপিতেই (لا يقْعُد) ‘বসতেন না’ শব্দটি দেখেছেন বলে প্রমাণ হয়নি। তবুওকি যাইলাঈর কথাকে সঠিক বললে দোষ হবে?
বরং মুযাফফর সাহেব কোন কপিতে সরাসরি না দেখে ‘সালাম ফিরাতেন না’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘বসতেন না’ উল্লেখ করে মহা অন্যায় করেছেন।
বিষয়টি বুঝে থাকলে এবার গ্রন্থকারের পরবর্তী কথাগুলো পড়ে হাসিও আসবে, আবার কান্নারও জোগাড় হবে যে, এমন লোক এভাবে ইমামদের ও উলামাদের উপরে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছেন কত দুঃসাহসিকাতার সাথে! দেখুন তিনি বলেন- “সুধি পাঠক! ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫) নিজে হাদীছটি সংকলন করেছেন আর তিনিই সঠিকটা জানেন না! বহুদিন পরে এসে যায়লাঈ (মৃত.৭৬২) সঠিকটা জানলেন? অথচ ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮হিঃ)ও একই সনদে উক্ত হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সেখানে একই শব্দ আছে। অর্থাৎ لا يقْعُد (বসতেন না) আছে।” আফসোস, গ্রন্থকার যে বোঝেন না একথাটা যদি তিনি বুঝতেন!
অথচ এমন পরিপক্ক! বুঝ নিয়েই গ্রন্থকার মুখস্ত করা গালি ছুড়ে মারলেন আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর মত একজন পাজ্ঞ হাদীস বিশারদকে বিনা অপরাধে অপরাধী ও প্রতিপক্ষ বানিয়ে, “একই বলে মাযহাবী গোঁড়ামী। অন্ধ তাকলীদকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যই হাদীছের শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।” ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন!
মোটকথা এ পদ্ধতির বিতরের সপক্ষে কোন সহীহ ও স্পষ্ট হাদীস নেই। তাই ইবনে হাযম জাহেরী রহ. বিতর বিষয়ক যত বর্ণনা পাওয়া যায় সবগুলোকেই বিতর নামাযের একেকটি তরীকা বলে মোট ১৩ পদ্ধতিতে বিতর পড়ার বৈধতা দিয়েছেন। আশ্চর্য, সেখানেও এ পদ্ধতির বিতরের কোন উল্লেখ নেই। আর তিনি ছাড়া যারাই বিতরের এমন একটি পদ্ধতির সম্ভাবনা ও বৈধতার কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের কেউ এ ভূল বর্ণনা দিয়ে দলিল পেশ করেননি। (আলোচনা শেষ হলো)
উল্লেখ্য, বিতরের দ্বিতীয় রাকাতে আত্তাহিয়্যাতুর জন্য বসা জরুরি। শরীয়তের যেসব উসূল ও আদিল্লা তথা মূলনীতি ও দলীল-প্রমাণ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত তা সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
এক. সকল নামাযে দুই রাকাতের পর বৈঠক অপরিহার্য। এই মূলনীতি বহু হাদীসে পাওয়া যায়। কিছু হাদীস হাওয়ালাসহ উল্লেখ করা হল।
১. উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘প্রতি দু’ রাকাতে রয়েছে ‘‘আত্তাহিয়্যাতু’’।’
وكان يقول في كل ركعتين التحية
সহীহ মুসলিম ১/১৯৪
২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘‘আমরা জানতাম না প্রতি দু’ রাকাতে কী বলা হবে। তবে আমরা আমাদের রবের তাসবীহ, তাকবীর ও হামদ করতাম। (আল্লাহর নবী হযরত) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দান করেছেন সকল কল্যাণের শিক্ষা। তিনি বললেন, ‘যখন তোমরা দুই রাকাতে বসবে তখন বলবে-আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহ ...’।’’
كنا لا ندري ما نقول في كل ركعتين، غير أن نسبح ونكبر ونحمد ربنا وأن محمدا صلى الله عليه وسلم علم فواتح الخير وخواتمه فقال : إذا قعدتم في كل ركعتين فقولوا التحيات لله.
মুসনাদে আহমদ ১/৪৩৭; সুনানে নাসায়ী ২/২৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫/২৮১; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ২/১৪৮
৩. আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান ও আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান বলেন, ‘‘আবু হুরায়রা রা. রমযানের ও রমযানের বাইরের, ফরয ও অন্য সকল নামাযে (যেভাবে) তাকবীর দিতেন (তার বিবরণ এই-) তিনি (নামাযে) দাড়ানোর পর তাকবীর দিতেন, রুকুর সময় তাকবীর দিতেন, সিজদার আগে ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ ও ‘রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ’ বলতেন, সিজদায় যাওয়ার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন, সেজদা থেকে মাথা ওঠানোর সময় তাকবীর দিতেন, (দ্বিতীয়) সেজদায় যাওয়ার সময় তাকবীর দিতেন, সেজদা থেকে মাথা ওঠানোর সময় তাকবীর দিতেন। অতপর দ্বিতীয় রাকাতের বৈঠক থেকে ওঠার সময় তাকবীর দিতেন। নামায সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাকাতে এভাবেই তিনি তাকবীর দিতেন। নামায শেষে বলতেন, ‘ঐ সত্ত্বার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামাযের সাথে তোমাদের মাঝে আমার সর্বাধিক নিকটসাদৃশ্য রয়েছে। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত (জীবনভর) এভাবেই নামায আদায় করেছেন’।’’
أن أبا هريرة كان يكبر في كل صلاة من المكتوبة وغيرها في رمضان وغيره فيكبر حين يقوم ثم يكبر حين يركع ثم يقول سمع الله لمن حمده ثم يقول ربنا ولك الحمد قبل ان يسجد ثم يقول الله اكبر حين يهوي ساجدا ثم يكبر حين يرفع رأسه من السجود ثم يكبر حين يقوم من الجلوس في الإثنتين ويفعل ذلك في كل ركعة حتى يفرغ من الصلاة ثم يقول حين ينصرف والذي يفسي بيده إني لأقربكم شبها بصلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم إن كانت هذه لصلاته حتى فارق الدنيا
মুসনাদে আহমদ ২/৪৫৪; মুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক ২/৬২; বুখারী ১/৩১৮; মুসলিম ২/২৬৬; আবু দাউদ ১/২২১; নাসায়ী ২/২৩৩)
৪. হযরত আলী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিবসের নামাযের বিবরণ সম্বলিত একটি হাদীসে আছে-‘‘তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি দু’ রাকাতের মাঝে ব্যবধান করতেন আল্লাহর নৈকট্যশীল ফেরেশতা এবং নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী মুমিন্তমুসলমানদের জন্য তাসলীম (রহমত ও সালামতের দোয়ার) দ্বারা।’
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا كانت الشمس من ههنا كهيئتها من ههنا عند العصر صلى ركعتين وإذا كانت الشمس من ههنا كهيئتها عند الظهر صلى أربعا وصلى أربعا قبل الظهر وبعدها ركعتين وقبل العصر أربعا يفصل بين كل ركعتين بالتسليم على الملائكة المقربين والنبيين والمرسلين ومن تبعهم من المؤمنين والمسلمين.
(মুসনাদে আহমদ ১/৮৫; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৮০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৬৩; তিরমিযী ২/২৯৪, ৪৯৪; নাসায়ী ২/১২০; ইবনে মাজাহ ১/৩৬৭)
উপরোক্ত হাদীসে ‘তাসলীম’ দ্বারা তাশাহহুদ পাঠ বোঝানো হয়েছে। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ বলেন, দুই রাকাতের মাঝে তাসলীম দ্বারা তাশাহহুদ পাঠ বোঝানো হয়েছে ।
ومعنى أنه يفصل بينهن بالتسليم يعني التشهد
জামে তিরমিযী ২/২৯৪
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘প্রতি দু’ রাকাতে রয়েছে আত্তাহিয়্যাতু।’ তদ্রূপ উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রতি দু’ রাকাতে আছে (তাওহীদ ও রিসালাতের) সাক্ষ্যদান এবং (সকল) নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী আল্লাহর বান্দাদের জন্য সালাম।’
إن النبي صلى الله عليه وسلم قال : في كل ركعتين تشهد وتسليم على المرسلين وعلى من تبعهم من عباد الله الصالحين. وفيه : علي بن زيد، واختلف في الاحتجاج به، وقد وثق.
মুজামে কাবীর তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৩২
৫. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নামাযের মাঝে ও নামাযের শেষে তাশাহহুদ পাঠ করতে শিখিয়েছেন। তিনি বলতেন, ‘যখন (নামাযী) নামাযের মাঝে ও নামাযের শেষে নিতম্বের উপর বসবে তখন ...’।’’
علمني رسول الله صلى الله عليه وسلم التشهد في وسط الصلاة وفي آخرها فكان يقول إذا جلس في وسط الصلاة وفي آخرها على وركه.
মুসনাদে আহমদ ১/৪৫৯
৬. উম্মে সালামা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রতি দু’ রাকাতে রয়েছে তাশাহহুদ এবং রাসূল-নবী ও তাঁদের অনুসারী আল্লাহর নেকবান্দাদের প্রতি সালাম।’’
في كل ركعتين تشهد وتسليم على المرسلين وعلى من تبعهم من عباد الله الصالحين.
(মুজামে কাবীর, তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৩২)
৭. আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘অযু নামাযের চাবি, তাকবীর তার সূচনা ও সালাম তার সমাপ্তি। আর প্রতি দু’ রাকাতে সালাম পাঠ কর। অর্থাৎ তাশাহহুদ পড়। আর নামায হয় না ফাতিহাতুল কিতাব ও কিছু অংশ ছাড়া।
والضوء مفتاح الصلاة والتكبير تحريمها والتسليم تحليلها وفي كل ركعتين فسل يعني فتشهد ولا تجزئ صلاة إلا بفاتحة الكتاب ومعها غيرها.
(কিতাবুল আছার, পৃ. ১৫৭) সুনানে দারাকুতনী ১/৩৬৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ২/৩৮০
৮. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, ‘‘সকল নামাযে কিরাত আছে। আর আছে দু রাকাতে বসা এবং তাশাহহুদ ও তাসলীম। তুমি যদি তা আদায় না কর তাহলে তোমাকে সালাম ফিরিয়ে দু’টি সিজদা করতে হবে।’’
ليس من صلاة إلا وفيها قراءة وجلوس في الركعتين وتشهد وتسليم فإن لم تفعل سجدت سجدتين بعدما تسلم وأنت جالس.
মুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৭
৯. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, ‘‘দু’ রাকাতের পর ‘বিশ্রাম’ তো তাশাহহুদের জন্যই।’’
ما جعلت الراحة في الركعتين إلا للتشهد
মুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা ৩/৪৭
এজন্যই নামাযের প্রতি দু’ রাকাতের পর বৈঠক করা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মতে ফরয, ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মতে ওয়াজিব এবং ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর মতে সুন্নত। মাযহাবসমূহের বিবরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক ওয়াজিব হওয়ার মতটি হল মাঝামাঝি ও ভারসাম্যপূর্ণ।
শরীয়ত যখন সকল নামাযের জন্য একটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছে তখন বিতরের নামাযও যে সে মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোটকথা, বহু হাদীসে এ বিষয়টি রয়েছে যে, নামাযের প্রতি দু’ রাকাতে তাশাহহুদ পাঠ করতে হবে। সালাতুল লায়ল ও বিতর সংক্রান্ত ইবনে উমর রা.-এর হাদীসেও এই মূলনীতি উল্লেখিত হয়েছে। অতএব বিতর নামাযকে তা থেকে খারিজ করার কোনো অবকাশ নেই।
দুই. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত মশহূর হাদীস-
صلاة الليل مثنى مثنى
‘‘রাতের নামায দুই রাকাত, দুই রাকাত’’ সালাতুল লায়ল ও বিতর সম্পর্কেই বলা হয়েছে। এই হাদীস থেকে দু’টি বিষয় বোঝা যায় : ১. নামায সর্বনিম্ন দুই রাকাত। এর নীচে নামায নেই। এজন্য ফরয থেকে নফল কোনো নামাযই এক রাকাত পড়ার নিয়ম নেই। অতএব বিতর নামাযেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
২. নামাযের প্রতি দু’ রাকাতে আত্তাহিয়্যাতুর জন্য বসা জরুরি। এটা ছাড়া দুই রাকাত সম্পন্ন হয় না। সহীহ মুসলিমে (১/২৫৭) আছে যে, ইবনে উমর রা.কে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘দুই রাকাত, দুই রাকাত’ কথাটার অর্থ কী? তিনি বললেন, ‘প্রতি দু’ রাকাতের পর সালাম পাঠ করবে।’
قيل لابن عمر : ما مثنى مثنى؟ قال : أن تسلم في كل ركعتين.
এখানে ‘সালাম পাঠ’ অর্থ আত্তাহিয়্যাতু পড়া। এই ব্যাখ্যা হাদীস শরীফ থেকেই পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে তা আলোচনা করা হয়েছে।
তিন. ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন। সা’দ ইবনে হিশামের বর্ণনায় একথাও আছে যে, ‘দ্বিতীয় রাকাতে আত্তাহিয়্যাতু পড়তেন। তবে সালাম ফেরাতেন না।’ হুবহু এটিই হচ্ছে হানাফী মাযহাব।
আর হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. ও আরো যেসব সাহাবীর রেওয়ায়েতে পাঁচ, সাত বা নয় রাকাত বিতর পড়ার কথা আছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, এসব রেওয়ায়েতে বিতর ও তাহাজ্জুদের সমষ্টিকে ‘বিতর’ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
চার. শরীয়তে এমন কোনো নামায নেই, যা শুধু এক রাকাত পড়া যায় কিংবা মাঝে তাশাহহুদ ছাড়া দু’ রাকাতের অধিক আদায় করা যায়।
যারা বিতর নামাযে শরীয়তের এই মূলনীতিকে অস্বীকার করেন এবং রাবীদের তা’বীর ও উপস্থাপনায় বিভ্রান্ত হয়ে বিতর নামায পাঁচ, সাত বা নয় রাকাত এক সালামে ও এক বৈঠকে আদায় করার ফতোয়া দেন তারা কি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতেরও এমন অর্থই করবেন? ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আট রাকাত একসাথে ও সাত রাকাত একসাথে আদায় করেছি।’
صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ثمانيا جميعا وسبعا جميعا.
তারা কি বলবেন যে, যোহর-আসরের আট রাকাত এবং মাগরিব-ইশার সাত রাকাত এক বৈঠক ও এক সালামে আদায় করা যাবে? তদ্রূপ যারা ‘বিতর এক রাকাত রাতের শেষে’-এই বর্ণনার ভিত্তিতে ফতোয়া দেন যে, বিতর এক রাকাত পড়াও জায়েয তারা কি ‘হজ্ব হল আরাফা’-এই হাদীসের ভিত্তিতে বলবেন যে, শুধু উকুফে আরাফা দ্বারাই হজ্ব সম্পন্ন হয়, অন্যান্য কাজকর্মের কোনো প্রয়োজন নেই?
যদি তারা এমন না বলেন এবং কোনো বর্ণনার বিশেষ উপস্থাপনার দ্বারা শুধু এই কারণে ভুল বোঝাবুঝির শিকার না হন যে, যোহর-আসর ও মাগরিব-ইশার নিয়ম তো সুবিদিত তদ্রূপ হজ্বের আরকান ও আহকাম সম্পর্কেও কোনো অস্পষ্টতা নেই তাহলে বিতরের ক্ষেত্রেও একথা মনে রাখা উচিত। কারণ মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা বিতর তিন রাকাত হওয়া এবং নামায বিষয়ক শরীয়তের উসূল ও আদিল্লা দ্বারা প্রতি দু’ রাকাতের পর বৈঠক হওয়া সুপ্রমাণিত। অতএব বর্ণনাসমূহের ভাষাগত বিভিন্নতাকেও এরই আলোকে বুঝতে হবে। বর্ণনাকারীদের ভাষাগত বিভিন্নতাকে স্বতন্ত্র নীতি ও পদ্ধতি সাব্যস্ত করে মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সুবিদিত নিয়মকে অস্বীকার করা মোটেই যুক্তিসংগত চিন্তা নয়।
والله اعلم بالصواب
মন্তব্য (০)
কোনো মন্তব্য নেই।
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
৪৩০৮৪
ইউটিউব বা ফেসবুকে বা ইনস্টাগ্রাম এ ইসলামিক ভিডিও বা ভালো ভিডিও আপলোড করে অর্থ উপার্জন
১৬ অক্টোবর, ২০২৩
ঢাকা

উত্তর দিয়েছেনঃ ইসহাক মাহমুদ
১৩১৮৫
১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
Dhaka 1205

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
সাম্প্রতিক প্রশ্নোত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে