আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

প্রশ্নঃ ১৪২৯০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। হুজুর আমার প্রশ্ন হচ্ছে:(১) ছাগল দিয়ে কোরবানি করার ক্ষেত্রে কি কি নিয়ম মানতে হয়।(২) কোন কোন জাতের ছাগল দিয়ে কোরবানি করা যায়। কোরআন হাদিসের আলোকে দয়াকরে জানাবেন।জাযাকাল্লাহ খাইর।,

২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

চট্টগ্রাম

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم





কোরবানীর পশুর ক্ষেত্রে ৬ টি শর্ত রয়েছে:

এক:

‘আনআম’ শ্রেণীর চতুষ্পদ জন্তু হওয়া। আনআম হচ্ছে- উট, গরু, ভেড়া ও ছাগল। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “আর আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য ‘মানসাক’ এর নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ ‘আনআম’ শ্রেণীর যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সে সবের উপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৩৪]

আয়াতে بهيمة الأنعام (বাহিমাতুল আনআম) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- উট, গরু, ভেড়া ও ছাগল। আরবদের কাছে بهيمة الأنعام এর এ অর্থই পরিচিত। এটি হাসান, কাতাদা ও আরও অনেকের অভিমত।

দুই:

শরিয়ত নির্ধারিত বয়সে পৌঁছা। ভেড়া হলে ‘জাযআ’ হওয়া (অর্থাৎ ছয়মাস পূর্ণ হওয়া)। আর অন্য শ্রেণীর হলে ‘ছানিয়্যা’ হওয়া (অর্থাৎ এক বছর পূর্ণ হওয়া)। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমরা মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হওয়া ছাড়া কোন প্রাণী জবাই করবে না। তবে তোমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেলে ছয় মাস বয়সী ভেড়া জবাই করতে পার”।[সহিহ মুসলিম]

মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হচ্ছে- ‘ছানিয়্যা’ ও ‘ছানিয়্যা’ এর চেয়ে বেশি বয়স্ক পশু। আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- ‘ছানিয়্যা’ চেয়ে কম বয়স্ক পশু।

উটের ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’ হচ্ছে- যে উটের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে।

গরুর ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’ হচ্ছে- যে গরুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।

ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’ হচ্ছে- যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে।

আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- যে পশুর ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে।

সুতরাং উট, গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কোরবানী শুদ্ধ হবে না। আর ভেড়ার ক্ষেত্রে ‘জাযআ’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কোরবানী হবে না।

তিন:

কোরবানীর পশু ঐ সব দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়া যেগুলোর কারণে কোরবানী আদায় হয় না; এমন ত্রুটি ৪টি:

১। চোখে স্পষ্ট ত্রুটি থাকা: যেমন চোখ একেবারে কোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া কিংবা বোতামের মত বের হয়ে থাকা কিংবা এমন সাদা হয়ে যাওয়া যে, সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, চোখে সমস্যা আছে।
২। সুস্পষ্ট রুগ্নতা: যে রোগের প্রতিক্রিয়া পশুর উপরে ফুটে উঠে। যেমন, এমন জ্বর হওয়া যার ফলে পশু চরতে বের হয় না ও খাবারে তৃপ্তি পায় না। এমন চর্মরোগ যা পশুর গোশত নষ্ট করে দেয় কিংবা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।

৩। স্পষ্ট খোঁড়া হওয়া: যার ফলে পশুর স্বাভাবিক হাঁটা-চলা ব্যাহত হয়।

৪। এমন জীর্ণ-শীর্ণতা; যা অস্থির মজ্জা নিঃশেষ করে দেয়।

এ সংক্রান্ত দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরবানীর ক্ষেত্রে কোন ধরণের পশু পরিহার করতে হবে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলেন: “চারটি: পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট, চোখে সমস্যাযুক্ত; যে সমস্যা স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, এবং দুর্বল; যার অস্থি-মজ্জা নেই”।[ইমাম মালেক ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থে বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে হাদিসটি সংকলন করেন। সুনান গ্রন্থসমূহের অপর একটি রেওয়ায়েতে এসেছে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন: “কোরবানীর ক্ষেত্রে চার ধরণের পশু জায়েয হবে না” এরপর তিনি অনুরূপ হাদিস উল্লেখ করেন।[আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (১১৪৮) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

এ চারটি ত্রুটি থাকলে সে পশু দিয়ে কোরবানী দেয়া জায়েয হবে না। এ ত্রুটিগুলোর সমপর্যায়ের কিংবা এগুলোর চেয়ে মারাত্মক অন্য ত্রুটিসমূহকেও এ ত্রুটিগুলোর অধিভুক্ত করা হবে। সে রকম কিছু ত্রুটি নিম্নরূপ:

১। অন্ধ পশু; যে তার দুই চোখে কিছুই দেখে না।

২। যে পশু তার সাধ্যের অতিরিক্ত খাবার খেয়েছে; যতক্ষণ না তার তরল পায়খানা হয়ে সে আশংকামুক্ত হয়।

৩। যে পশু গর্ভবতী; কিন্তু পশুটি শংকার মধ্যে রয়েছে; যতক্ষণ না তার শংকা দূরীভূত হয়।

৪। গলায় ফাঁস লেগে কিংবা উপর থেকে পড়ে যে পশু আহত হয়ে মৃত্যুপথ-যাত্রী যতক্ষণ না সে পশু শংকামুক্ত হয়।

৫। যে পশু কোন রোগজনিত কারণে হাঁটতে অক্ষম।

৬। সামনের এক পা কিংবা পিছনের এক পা কর্তিত পশু।

এ ত্রুটিগুলো যদি পূর্বে হাদিসে উল্লেখিত ত্রুটিগুলোর সাথে একত্রিত করা হয় তাহলে সর্বমোট ১০ টি ত্রুটি হবে; যেগুলোর কারণে কোন পশুকে কোরবানী করা জায়েয হবে না। উল্লেখিত ৬ টি এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত ৪ টি।

চার:

পশুটি কোরবানীকারীর মালিকানাধীন হতে হবে। কিংবা শরিয়তের পক্ষ থেকে সে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে কিংবা মালিকের পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে। অতএব, যে ব্যক্তি যে পশুর মালিক নয় তার জন্য সে পশু দিয়ে কোরবানী দেয়া জায়েয হবে না; যেমন- ছিনতাইকৃত পশু, চুরিকৃত পশু কিংবা অন্যায় মামলা দিয়ে প্রাপ্ত পশু ইত্যাদি। কেননা কোন পাপ দিয়ে আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিল করা শুদ্ধ নয়।

ইয়াতিমের অভিভাবক যদি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ইয়াতিমের সম্পদ থেকে কোরবানী করে তাহলে সে কোরবানী সহিহ হবে; যদিও কোরবানী করতে না পারার কারণে ইতিপূর্বে সে ছিল ভগ্নহৃদয়।

কোন প্রতিনিধি তার নিয়োগকারীর পক্ষ থেকে কোরবানী করলে সেটা সহিহ হবে।

পাঁচ:

কোরবানীর পশুর সাথে অন্য কারো অধিকার যেন সম্পৃক্ত না থাকে; এ কারণে বন্ধককৃত পশু দিয়ে কোরবানী করা জায়েয হবে না।

ছয়:

শরিয়ত নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পশুটিকে কোরবানী দিতে হবে। এ সময়সীমা হচ্ছে- ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর থেকে তাশরিকের দিনগুলোর সর্বশেষ দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তাশরিকের সর্বশেষ দিন হচ্ছে- ১৩ ই যিলহজ্জ। সুতরাং কোরবানী দেয়ার সর্বমোট দিন সংখ্যা হচ্ছে- ৪ দিন। ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর থেকে পরবর্তী ৩ দিন। তাই কেউ যদি ঈদের নামাযের আগে কিংবা ১৩ ই যিলহজ্জের সূর্যাস্তের পরে কোরবানী করে তাহলে তার কোরবানী শুদ্ধ হবে না। দলিল হচ্ছে- সহিহ বুখারীতে এসেছে বারা বিন আযেব (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি নামাযের পূর্বে জবাই করেছে সে তার পরিবারের জন্য গোশত পেশ করল ঠিক; কিন্তু এটা কোরবানীর কিছুই নয়”। জুনদুব বিন সুফিয়ান আল-বাজালি (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম কাছে উপস্থিত ছিলাম; তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি নামাযের আগে জবাই করেছে সে যেন এর বদলে অন্য একটি পশু জবাই করে”। নুবাইশা আল-হুযালি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে- পানাহার ও আল্লাহ্‌র যিকিরের দিন”।[সহিহ মুসলিম]
কিন্তু, কোন ওজরের কারণে কারো যদি তাশরিকের দিনগুলোর চেয়ে বেশি বিলম্ব হয়ে যায় এতে কোন অসুবিধা হবে না; যেমন- অবহেলা না করা সত্ত্বেও কারো কোরবানীর পশুটি পালিয়ে গেল এবং কোরবানীর সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে পশুটি পাওয়া গেল। কিংবা যাকে কোরবানী করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তিনি ভুলে গেলেন এবং এর মধ্যে কোরবানী করার সময় পার হয়ে গেল সেক্ষেত্রে সময়ের পরে জবাই করতে কোন অসুবিধা নেই। এ মাসয়ালাটিকে কিয়াস করা হয়েছে ঐ মাসয়ালার উপর: যে ব্যক্তি নামায না পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কিংবা নামাযের কথা ভুলে গিয়েছে সে ব্যক্তি যখন জেগে উঠে কিংবা তার স্মরণে পড়ে তখনি সে নামায পড়ে।

নির্ধারিত দিনগুলোতে রাতে কিংবা দিনে কোরবানীর পশু জবাই করা জায়েয হবে। তবে, দিনে জবাই করা শ্রেয়। আর ঈদের দিন খোতবার পর পর জবাই করা উত্তম। আগের দিনে জবাই করা পরের দিনে জবাই করার চেয়ে উত্তম। যেহেতু এতে নেকীর কাজে দ্রুত সাড়া দেওয়া হয়।
সংগৃহীত

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
বাইতুল কুরআন মাদারাসা , মোহাম্মাদপুর

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩৫৭৩৫

ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব কিনা?


২৬ জুন, ২০২৩

রংপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৩৫৪৫৫

সুদী ব্যাংকে চাকুরীরত ব্যক্তির সাথে কুরবানী


২৮ জুন, ২০২৩

দর্শনা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৩৫৮২২

হারাম উপার্জনের বিষয়টি অজানা থাকলে তার সঙ্গে কুরবানী দেওয়া


২৮ জুন, ২০২৩

পাবনা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৩৪৮৫০

গরীব লোক কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করলে তার হুকুম কি?


১৪ জুন, ২০২৩

তন্তুর - কুকুটিয়া রোড

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy