আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৭৭- স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা সংক্রান্ত অধ্যায়
৬৫২৫। খালিদ ইবনে খালিয়্যি (রাহঃ) ......... আবু কাতাদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ যে আমাকে স্বপ্নে দেখে সে ঠিকই দেখে।
ইউনুস ও ইবনে আখীয যুহরী (রাহঃ) যুবায়দীর অনুসরণ করেছেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে অচিরেই জাগ্রত অবস্থায় আমাকে দেখতে পাবে। অথবা তিনি বলেছেন, সে যেন জাগ্রত অবস্থায় আমাকে দেখল। শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। এ হাদীছটির বিষয়বস্তু দু'টি। (ক) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলে জাগ্রত অবস্থায়ও তাঁর সাক্ষাৎ লাভ হওয়া। (খ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলে অন্য কাউকে নয়; তাঁকেই দেখতে পাওয়া। প্রথম বিষয়টি সম্পর্কে হাদিছটিতে বলা হয়েছে - مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ فَسَيَرَانِي فِي الْيَقَظَة (যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে অচিরেই জাগ্রত অবস্থায় আমাকে দেখতে পাবে)। কেউ কেউ বলেন, এ কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানার জন্য প্রযোজ্য। এর অর্থ- যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে কিন্তু এখনও হিজরত করেনি, সে যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখতে পায়, তবে এটা একটা সুসংবাদ যে বাস্তবিকই সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাবে। হয়তো সে হিজরত করে মদীনা মুনাউওয়ারায় আসবে অথবা নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও সফরে তাঁর সঙ্গে তার দেখা হবে। অনেকের মতে এ হাদীছ সব যুগের জন্যই প্রযোজ্য। সে হিসেবে এর অর্থ- যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখবে, সে জাগ্রত অবস্থায় এ দেখার কল্যাণ ও বরকত লাভ করবে। সে কল্যাণ একেকজনের জন্য একেক রকম। হয়তো অনেকে বুঝতেও পারে না এ স্বপ্ন দেখার ফলে কী কল্যাণ তার লাভ হয়ে গেল। ওলী-বুযুর্গদের কারও কারও ক্ষেত্রে সে কল্যাণ এভাবেও লাভ হয় যে, জাগ্রত অবস্থায় স্বয়ং তাঁকেই দেখার সৌভাগ্য হয়। এটা তাদের কারামাত। কেউ তো তাঁকে দেখতে পায় অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা আবার কেউ দেখতে পায় বাহ্যদৃষ্টি দ্বারাও। আওলিয়া কেরামের অনেকের সম্পর্কে এরকম বর্ণিত আছে যে, তারা জাগ্রত অবস্থায়ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। ইমাম গাযালী রহ., ইবনুল আরাবী রহ., ইবনু আব্দিস সালাম রহ. প্রমুখ এ জাতীয় বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- كَأَنَّمَا رَآنِي فِي اليَقَظَةِ (সে যেন জাগ্রত অবস্থায় আমাকে দেখল)। অর্থাৎ তার সে স্বপ্ন দেখাটা ভুল নয়। জাগ্রত অবস্থায় আমাকে দেখলে যেমনটা দেখত, এ দেখাটাও সেরকমই। সে অন্য কাউকে নয়। আমাকেই দেখেছে। অপর এক বর্ণনায় আছে- مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ فَقَدْ رَآنِي যে স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে আমাকেই দেখল। (সহীহ মুসলিম: ২২৬৬) অপর এক বর্ণনায় আছে- مَنْ رَآنِي فَقَدْ رَأَى الْحَقَّ যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে সত্যই দেখল। (সহীহ মুসলিম: ২২৬৭) সবগুলো বর্ণনার মর্ম একই। অর্থাৎ স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলে তাঁকেই দেখা হয়, অন্য কাউকে নয়। কেন নয়, তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। তিনি বলেন- لَا يَتَمَثَلُ الشَّيْطَانُ بِي (শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না)। অর্থাৎ এমন নয় যে, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করে ওই ব্যক্তিকে দেখা দিল। কেননা শয়তানকে এ ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি যে, সে আমার আকৃতি ধারণ করবে। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাস্তবিকপক্ষে এমনই হওয়ার কথা। কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের পথপ্রদর্শক। তাঁর এক নাম হাদী। অর্থাৎ সত্য-সঠিক পথের দিশারী। তাঁকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য। পক্ষান্তরে শয়তান হল গোমরাহকারী। তার কাজই হল মানুষকে পথভ্রষ্ট করা। তাঁকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। বিপথে-কুপথে নিয়ে যায়। দু'জনের স্বভাব-প্রকৃতি, কাজকর্ম এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজেই দুষ্ট শয়তান যাতে হিদায়াতের প্রতীক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকৃতি ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে, তাই আল্লাহ তা'আলা তাকে অনেক কাজেই দুষ্ট ক্ষমতা দিলেও এই ক্ষমতা দেননি যে, সে ওই পবিত্র বেশ ধরে স্বপ্নযোগে মানুষের সামনে হাজির হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বপ্নে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে-কোনও আকৃতিতে দেখলেই তাঁকে দেখা হবে, নাকি এর জন্য কোনও শর্ত আছে? এ বিষয়ে দু'টি মত আছে। একটি মত হল স্বপ্নে যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর নির্ধারিত আকৃতি ও পরিচিত হুলিয়ায় দেখা হয়, তবেই তাঁকে দেখা হবে। অর্থাৎ বিশুদ্ধ হাদীছসমূহে তাঁর যে রূপ ও আকার-আকৃতি বর্ণিত হয়েছে, তার সঙ্গে স্বপ্নের মিল থাকা শর্ত। সেই বর্ণনার সঙ্গে যার স্বপ্ন মিলবে, তার ক্ষেত্রেই বলা যাবে যে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই দেখেছে। দ্বিতীয় মত হল এরূপ কোনও শর্ত নেই। বরং স্বপ্ন দেখাকালে স্বপ্নদ্রষ্টার যদি মনে হয় যে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই দেখেছে, তবে সে তাঁকেই দেখল, তা যে আকৃতিতেই দেখুক না কেন। কেননা শয়তান যে তাঁর আকৃতি ধরতে পারে না এর অর্থ যে-কোনও আকৃতি ধরে সে স্বপ্নদ্রষ্টার অন্তরে এই ভাব জন্মাতে পারে না যে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখছে। কাজেই অন্তরে এ ভাব জন্মানোর অর্থই হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখা। স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও আদেশ বা নিষেধ পেলে কেউ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখে আর এ অবস্থায় তিনি তাকে কোনও আদেশ বা নিষেধ করেন, তবে সে আদেশ বা নিষেধ কি শরী'আতের দলীল বলে গণ্য হবে? এ বিষয়ে সমস্ত আলেম একমত যে, এরূপ আদেশ-নিষেধ শরী'আতের দলীল নয়। হাঁ, সে আদেশ-নিষেধ যদি শরী'আতের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তবে এর আদব রক্ষা করা চাই। আদব হল সে অনুযায়ী আমল করা। পক্ষান্তরে তা যদি শরী'আতের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে কিছুতেই তা অনুসরণযোগ্য হবে না। কেননা স্বপ্নের আদেশ কখনওই জাগ্রত অবস্থার আদেশের সমতুল্য হতে পারে না। প্রশ্ন হতে পারে, স্বপ্নে যাকে দেখা হয়েছে তিনি যদি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হন, তবে এ অবস্থায় তাঁর দেওয়া আদেশ-নিষেধ কেন দলীল বলে গণ্য হবে না? এর উত্তর হল, স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার ক্ষেত্রে যদিও শয়তান কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারে না. কিন্তু এমন তো হতে পারে যে, জাগ্রত হওয়ার পর শয়তান ওই ব্যক্তির মনে কোনও ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করেছে আর সেই ওয়াসওয়াসা আদেশ-নিষেধের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাছাড়া স্বপ্নে পাওয়া কথার ভেতর ব্যক্তির কল্পনার কোনও প্রভাব থাকাও অসম্ভব নয়। সে প্রভাবের কারণেই স্বপ্নে পাওয়া দেখার মধ্যে অনেক সময় বাস্তব আকৃতি ও হুলিয়ার সঙ্গে পার্থক্য হয়ে যায়। অর্থাৎ দেখে তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই, কিন্তু কল্পনাশক্তির প্রভাবের কারণে তাঁকে দেখে অন্য কোনও চেহারায় বা অন্য কোনও হুলিয়ায় সুতরাং এটা মোটেই অসম্ভব নয় যে, স্বপ্নদ্রষ্টার কল্পনায় এমন কোনও কথা সঞ্চারিত হয়েছে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদৌ বলেননি। তাছাড়া এরও সম্ভাবনা আছে যে, স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যা বলেছেন তা সে ভালোভাবে বুঝতে পারেনি বা যথাযথভাবে মনে রাখতে পারেনি। কাজেই এতসব সম্ভাবনা যখন স্বপ্নে পাওয়া আদেশ-নিষেধের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, তখন তা কীভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জাগ্রত অবস্থায় দেওয়া শরী'আতের সমতুল্য হতে পারে এবং কীভাবেই বা তা দ্বারা শরী'আতের বরখেলাফ কাজ করা জায়েয হতে পারে? ইমাম সুবকী রহ. মিনহাজুস সুন্নাহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছেন- মদ পান করো। ওই ব্যক্তি ইমাম আলী মুত্তাকী রহ.-এর কাছে এ স্বপ্নের কথা বললে তিনি উত্তর দিলেন, প্রকৃতপক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তুমি মদ পান করো না। কিন্তু শয়তান তোমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। ইমাম আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. বলেন, জাগ্রত অবস্থায়ও তো অনেক সময় পারিপার্শ্বিক কারণে মানুষ বক্তা যা বলে তার বিপরীত শুনে থাকে। কাজেই ঘুমন্ত অবস্থায় এর সম্ভাবনা আরও বেশি, যেহেতু তখন মানুষের অনুভূতিশক্তি সক্রিয় থাকে না। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. স্বপ্নেরও একটা বাস্তবতা আছে। একে অস্বীকার করা ঠিক নয়। খ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলে সে দেখাটা তাঁকেই হয়। এটা একটা নি'আমত। এর জন্য শোকর আদায় করা চাই। গ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা বৈশিষ্ট্য হল শয়তান তাঁর আকৃতি ধারণ করতে পারে না।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন