আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৭৭- স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা সংক্রান্ত অধ্যায়
৬৫১১। ইয়াহয়া ইবনে বুকায়র ও আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ (রাহঃ) ......... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ওহীর সূচনা হয় ঘুমের ঘোরে ভালো স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের আলোর ন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে প্রতিফলিত হতো। তিনি হেরা গুহায় গমন করে সেখানে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন এবং এজন্য খাদ্য সামগ্রীও সাথে নিয়ে যেতেন। এরপর খাদীজা (রাযিঃ) এর কাছে ফিরে আসতেন এবং তিনি তাকে অনুরূপ খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুত করে দিতেন। অবশেষে তাঁর কাছে সত্যের বাণী (ওহী) আসল। আর এ সময় তিনি হেরা গুহায় ছিলেন। সেখানে ফিরিশতা এসে তাঁকে বলল, আপনি পড়ুন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি বললামঃ আমি তো পাঠক নই। তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে চাপ দিলেন। এমনকি এতে আমার খুব কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, আপনি পড়ুন। আমি বললাম, আমি তো পাঠক নই। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে শক্ত করে চাপ দিলেন। এবারেও এতে আমার খুব কষ্ট হল। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনি পড়ুন। আমি বললাম, আমি তো পাঠক নই। এরপর তিনি তৃতীয়বার আমাকে শক্ত করে এমন চাপ দিলেন যে, এবারেও এতে আমার খুব কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন ......... যা সে জানত না (৯৪ঃ ১-৫) এ আয়াত পর্যন্ত।
এরপর তিনি তা নিয়ে খাদীজা (রাযিঃ) এর কাছে কম্পিত হৃদয়ে ফিরে এলেন। আর বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। ফলে তাঁরা তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর থেকে ভীতি দূর হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেন, হে খাদীজা! আমার কি হল? এবং তাকে সমূহ ঘটনা জানালেন। আর বললেনঃ আমি আমার জীবন সম্পর্কে শংকাবোধ করছি। খাদীজা (রাযিঃ) তাকে বললেন, কখনোই না। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ্ আপনাকে কখনোই লাঞ্চিত করবেন না। কেননা, আপনি তো আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখেন, সত্য কথা বলেন, অনাথ অক্ষমদের বোঝা বহন করেন, মেহমানদের মেহমানদারী করেন এবং হকের পথে আগত যাবতীয় বিপদে সাহায্য করেন। অতঃপর খাদীজা (রাযিঃ) তাঁকে নিয়ে ওরাকা ইবনে নাওফাল ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল উযযা ইবনে কুসাই এর কাছে এলেন। আর তিনি খাদীজা (রাযিঃ) এর চাচার পুত্র (চাচাত ভাই) ছিলেন। তিনি জাহিলী যুগে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরবী কিতাব লিখতেন। তিনি ইঞ্জিল কিতাব আরবীতে ভাষান্তর করেছেন যতখানি লেখা আল্লাহর মনযুর হত। তিনি ছিলেন অতি বৃদ্ধ, দৃষ্টিশক্তিহীন ব্যক্তি। খাদীজা (রাযিঃ) তাকে বললেন, হে আমার চাচাত ভাই! তোমার ভাতিজার কথা শুন। তখন ওরাকা বললেন, হে ভাতিজা! তুমি কী দেখেছ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা কিছু দেখেছিলেন তা তাকে অবহিত করলেন। তখন ওরাকা বললেন, এই তো আল্লাহর সেই নামুস (দূত), যাকে মুসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। হায় আফসোস! যদি সেদিন আমি জীবিত থাকতে পারতাম যেদিন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তারা কি আমাকে বের করে দেবে? ওরাকা বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছ, এমন বস্তু নিয়ে কোন দিনই কেউ আসেনি যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি। যদি তোমার জীবনকাল আমাকে পায়, তাহলে আমি পরিপূর্ণরূপে তোমাকে সাহায্য করব।
এরপর কিছুদিনের মধ্যেই ওরাকার মৃত্যু হয়। আর কিছু দিনের জন্য ওহীও বন্ধ থাকে। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অবস্থার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি আমরা এ সম্পর্কে তার থেকে জানতে পেরেছি যে, তিনি পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচে পড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একাধিকবার দ্রুত সেখানে চলে গেছেন। যখন নিজেকে নিক্ষেপ করার জন্য তিনি পাহাড়ের চূড়া পৌঁছতেন, তখনই জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে বলতেন, হে মুহাম্মাদ! নিঃসন্দেহে আপনি তো আল্লাহর রাসূল! এতে তাঁর অস্থিরতা প্রশমিত হত এবং নিজে মনে শান্তিবোধ করতেন। তাই সেখান থেকে ফিরে আসতেন। ওহীর বন্ধ অবস্থা যখন তাঁর উপর দীর্ঘায়িত হল, তখনই তিনি অনুরূপ উদ্দেশ্যে দ্রুত চলে যেতেন। যখনই তিনি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতেন, তখনই জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে পূর্বের ন্যায় বলতেন। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, فَالِقُ الإِصْبَاحِ দিনের বেলায় সূর্যের আলো ও রাতের বেলায় চাঁদের আলো।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
সত্য স্বপ্ন বলা হয়, এমন একটি অবস্থাকে যা স্বপ্নে দৃষ্টিগোচর হয়। কোন কোন সময় জাগ্রতাবস্থায় কিছু দেখা গেলে সেটির উপরও الرؤيا الصالحة শব্দের প্রয়োগ হয়। (الصالحة) এমন উত্তম স্বপ্ন, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়্যতের ভূমিকাস্বরূপ ছিল। অন্য এক রেওয়ায়াতে 'সালিহা' শব্দের পরিবর্তে 'সাদিকা' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সে স্বপ্ন যা বাস্তবসম্মত। তাতে কোন বস্তুর আকৃতি দেখানো হোক অথবা ফেরেশতা দৃষ্টিগোচর হোক অথবা আল্লাহ তাআলার তাজাল্লী পরিলক্ষিত হোক না কেন? কারো কারো মতে, ওহী ৪৬ প্রকারে বিভক্ত। তার মধ্য থেকে এক প্রকার হলো তথা উত্তম স্বপ্ন। কিন্তু এর উপর প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, উত্তম স্বপ্নকে ওহীর শামিল করা সঠিক নয়। কেননা ওহীর সূচনা হয়েছে হেরাপর্বত গুহা থেকে। আর স্বপ্নের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে নবুওয়ত প্রাপ্তির ছয় মাস পূর্ব থেকে। অত্র প্রশ্নের জবাব হলো, অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, নবীগণের স্বপ্নও ওহীর অন্তর্ভূক্ত। অতএব বলা যায়, এটি ওহীর প্রথম প্রকার, সর্বপ্রথম যেটির সূচনা হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রকার ওহীর সূচনা হয়েছে হেরা গুহায়। আর কোন বস্তুর বাস্তব ভূমিকা বস্তুর অন্তর্ভুক্তই হয়। মোটকথা, أول ما بدئ এমন এক প্রাথমিক বস্তু; যা দ্বারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরে ওহী নাযিল শুরু হয়েছে । الرؤيا الصالحة অর্থ সত্য ও উত্তম স্বপ্ন । উসা যোগ করার কারণে বুঝা গেল স্বপ্নও ওহীর প্রকারভেদের অন্তর্ভূক্ত। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবীগণের স্বপ্নও ওহী। (উমদাতুল কারী, ১ম খণ্ড،পৃষ্ঠা ৫৩) হেরাগুহা বেছে নেয়ার কারণসমূহ ১. নির্জনবাসের জন্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরাগুহাকে কেন নির্বাচন করলেন? এ জিজ্ঞাসার জবাবে আল্লামা কাস্তালানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন, কুরাইশদের থেকে সর্বপ্রথম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব ওখানে নির্জন বাস করেন। (কাস্তালানী, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৪৭৬) দাদার সাথে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও কোন কোন সময় হেরাগুহায় যাওয়া আসা করতেন। সে সময় থেকেই তাঁর সে স্থানের প্রতি একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয় । কিন্তু এ ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়। কেননা এর উপর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তাঁর দাদা তা নির্বাচন করেছিলেন কেন? ২. কিতাবুত তাবীরে হাফেয রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইবনে আবূ হামযার মতে হেরা গুহাকে নির্জনবাসের জন্যে নির্ধারণ করার রহস্য হল, তাতে অবস্থানকারীর পক্ষে কা'বা শরীফ দর্শন করা সম্ভব হয় । অতএব যে ব্যক্তি সেখানে নির্জনে থাকে, সে তিনটি বস্তুর অধিকারী হয়। ১. কাফির-মুশরিকদের থেকে নির্জনতা অবলম্বন, ২ যিকিরে মনোনিবেশ করা, ৩. বাইতুল্লাহ দেখা। হাদীসে আছে, 'বাইতুল্লাহর দিকে প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে বিশটি রহমত নাযিল হয়।' এজন্যে হাজী ব্যক্তির পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব না হলে কমপক্ষে বাইতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকা চাই। ৩. হেরাগুহা স্বচক্ষে দর্শন করার মাধ্যমে বুঝা যায়, উল্লিখিত ব্যাখ্যাসমূহের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা তা এমন এক জায়গা, যেটি নির্জনবাস ও ইবাদতের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। শহর থেকে এত নিকটেও নয় যে, নির্জনতার উদ্দেশ্য বিনষ্ট হবে, আবার অত দূরেও নয়, সেখানে পৌঁছা কষ্টকর হবে। তদুপরি গুহাটিও এত উঁচু নয় যে, সেখানে পৌছা কঠিন। এর উচ্চতা এত কমও নয়। যে, যে কেউ সহজেই সেখানে পৌঁছতে পারে। তা ছাড়া গুহাটি এমন, মনে হয় আল্লাহ্ তাআলা ইবাদাতের উদ্দেশ্যে স্থানটিকে ছোট একটি কামরা হিসেবে বানিয়েছেন। ভেতরে উচ্চতা এতটুকু যে, কোন ব্যক্তি সহজেই সেখানে দাঁড়াতে পারে । প্রশস্ত এতটুকু যে আরামের সাথে সিজদা করা যায় । মোটকথা জায়গাটির সৃষ্টিগত অবস্থা পরিদর্শন করলে কোন ব্যাখ্যারই প্রয়োজন হয় না । রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন চল্লিশে পদার্পণ করলেন, ঐ সময় তাঁর এত দিনের বিচার বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা-ভাবনা যা জনগণ এবং তাঁর মধ্যে ব্যবধানের এক প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছিল তা উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে উঠতে থাকলেন। খাবার এবং পানি সঙ্গে নিয়ে মক্কা নগরী হতে দু’মাইল দূরত্বে অবস্থিত হেরা পর্বত গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতে লাগলেন। এটা হচ্ছে ক্ষুদ্র আকার-আয়তনের একটি গুহা। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে চার গজ এবং প্রস্থ পৌনে দু’গজ। এর নীচ দিকটা তেমন গভীর ছিল না। একটি ছোট্ট পথের প্রান্তভাগে অবস্থিত পর্বতের উপরি অংশের একত্রে মিলে মিশে ঠিক এমন একটি আকার আকৃতি ধারণ করেছিল যা শোভাযাত্রার পুরোভাগে অবস্থিত আরোহী শূন্য সুসজ্জিত অশ্বের মতো দেখায়। রাসূলুল্লাহ (ষাঃ) হেরা গুনায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকেন। বিশ্বের দৃশ্যমান বস্তুনিচয়ের অন্তরাল থেকে যে মহাশক্তি প্রতিটি মুহুর্তে সকল কিছুকে জীবন, জীবিকা ও শক্তি জাগিয়ে চলেছেন, সেই মহা মহীয়ান ও গরীয়ান সত্ত্বার ধ্যানে মশগুল থাকতেন। স্বগোত্রীয় লোকদের অর্থহীন বহুত্ববাদী বিশ্বাস ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা তাঁর অন্তরে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করত। কিন্তু তাঁর সামনে এমন কোন পথ খোলা ছিল না যে পথ ধরে তিনি শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে পদচারণা করতে সক্ষম হতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্জন-প্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যতের এক মহতী কর্মসূচীর জন্য তাঁকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। যে আত্মার নসীবে নবুয়তরূপী এক মহান আসমানী নেয়ামত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে এবং যিনি পথভ্রষ্ট ও অধঃপতিত মানুষকে সঠিকপথ নির্দেশনা দিয়ে করবেন ধন্য তাঁর জন্য যথার্থই প্রয়োজন সমাজ জীবনের যাবতীয় ব্যস্ততা, জীবন যাত্রা নির্বাহের যাবতীয় ঝামেলা এবং সমস্যা থেকে মুক্ত থেকে নির্জনতা অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বিশ্বব্যবস্থায় সব চাইতে মর্যাদাশীল ও দায়িত্বশীল-আমানতদার মনোনীত করে তাঁর কাঁধে দায়িত্বভার অর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জীবন বিধানের রূপরেখা পরিবর্তন এবং অর্থহীন আদর্শের জঞ্জাল সরিয়ে শাশ্বত আদর্শের আঙ্গিকে ইতিহাসের পরিমার্জিত ধারা প্রবর্তন করতে চাইলেন, তখন নবুয়ত প্রদানের প্রাককালে তাঁর জন্য একমাসব্যাপী নির্জনতা অবলম্বন অপরিহার্য করে দিলেন যাতে তিনি গভীর ধ্যানের সূত্র ধরে দিব্যজ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। নির্জন হেরা গুহার সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি বিশ্বের আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণ করতেন এবং সকল অস্তিত্বের অন্তরালে লুক্কায়িত অদৃশ্য রহস্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করতেন যাতে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসা মাত্রই তিনি বাস্তবায়নের ব্যাপারে ব্রতী হতে পারেন। ওহীর সূচনাঃ নবী কারীম (ﷺ)-এর বয়সের ৪০তম বছর যখন পূর্ণ হল- এটাই হচ্ছে মানুষের পূর্ণত্ব প্রাপ্তির বয়স এবং বলা হয়েছে যে, এ বয়স হচ্ছে পয়গম্বরগণের নবুয়ত প্রাপ্তির উপযুক্ত বয়স-তখন নবুওয়তের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ হতে লাগল। সে লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি যখনই কোন স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদেকের মত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল ছয়টি মাস যা ছিল নবুওয়তের সময় সীমার ছয়চল্লিশতম অংশ এবং নবুওয়তের সময়সীমা ছিল তেইশ বছর। এরপর তিনি যখন হেরাগুহায় নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে হতে তৃতীয় বর্ষ অতিবাহিত হতে থাকল তখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর মানুষের উপর স্বীয় রহমত বর্ষণের ইচ্ছা করলেন। তারপর আল্লাহ রাববুল আলামীন জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর কুরআনুল কারীমের কয়েকটি আয়াতে করীমা নাযিল করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নবুওয়তের মহান মর্যাদা প্রদানে ভূষিত করেন। ওহীর সূচনা ও সর্বপ্রথম ওহী : বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত থেকে প্রমাণিত রয়েছে এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অধিকাংশ আলিম এ বিষয়ে একমত যে,সূরা আলাক থেকেই ওহীর সূচনা হয় এবং এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত ( مَا لَمْ يَعْلَمْপর্যন্ত) সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। কেউ কেউ সূরা মুদ্দাস্সিরকে সর্বপ্রথম সূরা এবং কেউ কেউ সূরা ফাতিহাকে সর্বপ্রথম সূরা বলে অভিহিত করেছেন। ইমাম বগভী অধিকাংশ আলিমের মতকেই বিশুদ্ধ বলেছেন। সূরা মুদ্দাস্সিরকে প্রথম সূরা বলার কারণ এই যে, সূরা আলাকের পাঁচ আয়াত নাযিল হওয়ার পর দীর্ঘকাল কোরআন অবতরণ বন্ধ থাকে, যাকে ওহীর বিরতিকাল বলা হয়ে থাকে—এই বিরতির কারণে রসূলুল্লাহ্ (সা) ভীষণ মর্মবেদনা ও মানসিক অশান্তির সম্মুখীন হন। এরপর একদিন হঠাৎ জিবরাঈল (আ) সামনে আসেন এবং সূরা মুদ্দাস্সির অবতীর্ণ হয়। এ সময়ও ওহী অবতরণ এবং জিবরাঈলের সাথে সাক্ষাতের দরুন রসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যে সে পূর্বের মতই ভাবত্তির দেখা দেয়, যা সূরা আলিকি অবতীর্ণ হওয়ার সময় দেখা দিয়েছিল। এভাবে বিরতিকালের পর সর্বপ্রথম সূরা মুদ্দাস্সিরের প্রাথমিক আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। ফলে একেও প্রথম সূরা আখ্যা দেওয়া যায়। সূরা ফাতিহাকে প্রথম সূরা বলার কারণ এই যে, পূর্ণ সূরা হিসাবে একত্রে সূরা ফাতিহাই সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। এর আগে কয়েকটি সূরার অংশবিশেষই অবতীর্ণ হয়েছিল।—(মাযহারী) বুখারী ও মুসলিমের একটি দীর্ঘ হাদীসে নবুয়ত ও ওহীর সূচনা সম্পর্কে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) বলেনঃ সর্বপ্রথম সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি ওহীর সূচনা হয়। তিনি স্বপ্নে যা দেখতেন, বাস্তবে হুবহু তাই সংঘটিত হত এবং তাতে কোনরূপ ব্যাখ্যার প্রয়োজন থাকত না। স্বপ্নে দেখা ঘটনা দিবালোকের মত সামনে এসে যেত। এরপর রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মধ্যে নির্জনতার ও একান্তে ইবাদত করার প্রবল ঝোঁক সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি হেরা গিরিগুহাকে পছন্দ করে নেন ( এ গুহাটি মক্কার কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লা থেকে একটু সামনে জাবালুন্নুর নামক পাহাড়ে অবস্থিত। এর শৃঙ্গ দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হয়)। হযরত আয়েশা (রা) বলেন। তিনি এ গুহায় রাত্রিতে গমন করতেন এবং ইবাদত করতেন। পরিবার-পরিজনের খবরাখবর নেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন দেখা না দিলে তিনি সেখানেই অবস্থান করতেন এবং প্রয়োজনীয় পাথেয় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পাথেয় শেষ হয়ে গেলে তিনি পত্নী খাদীজা (রা)-র কাছে ফিরে আসতেন এবং আরও কিছুদিনের পাথেয় নিয়ে গুহায় গমন করতেন। এমনিভাবে গুহায় অবস্থানকালে হঠাৎ একদিন তাঁর কাছে ওহী আগমন করে। হেরা গুহায় নির্জনবাসের সময়কাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। বুখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে আছে যে, তিনি পূর্ণ রমযান মাস এ গুহায় অবস্থান করেন। ইবনে ইসহাক ও ।যরকানী (র) বলেন: এর চেয়ে বেশী সময় অবস্থান করার প্রমাণ কোন রেওয়ায়েতে নেই। ওহী অবতরণের পূর্বে নামায ইত্যাদি ইবাদতের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং হেরা গুহায় রসূলুল্লাহ্ (সা) কিভাবে ইবাদত করতেন সে সম্পর্কে কোন কোন আলিম বলেন। তিনি নূহ, ইবরাহীম ও ঈসা (আ)-র শরীয়ত অনুসরণ করে ইবাদত করতেন। কিন্তু কোন রেওয়ায়েতে এর প্রমাণ নেই এবং তিনি নিরক্ষর ছিলেন বিধায় একে বিশুদ্ধও মেনে নেওয়া যায় না। বরং বাহ্যত বোঝা যায় যে, তখন জনকোলাহল থেকে একান্তে গমন এবং আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ ধ্যানে মগ্ন হওয়াই ছিল তাঁর ইবাদত।(মাযহারী) ওহীর আগমন সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা) বলেন। হযরত জিবরাঈল (আ)। রসূলুল্লাহ্ (সা)-র কাছে আগমন করে বললেনঃاقْرَأْ (পাঠ করুন)। তিনি বললেনঃ ماانا بقاری আমি পড়া জানি না। [ কারণ, তিনি উম্মী ছিলেন। জিবরাঈল (আ) এর উদ্দেশ্য কি, কিভাবে পড়াতে চান এবং কোন লিখিত বিষয় পড়তে হবে কিনা ইত্যাদি বিষয় তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে সক্ষম হন নি। তাই ওযর পেশ করেছেন! ] রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, আমার এ জওয়াব শুনে জিবরাঈল (আ) আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং সজোরে চাপ দিলেন। ফলে আমি চাপের কষ্ট অনুভব করি। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ اقْرَأْ (পাঠ করুন)। আমি আবার পূর্ববৎ জওয়াব দিলাম।। এতে তিনি পুনরায় আমাকে চেপে ধরলেন। চাপের কষ্ট অনুভব করলাম। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে তৃতীয় বারের মত পাঠ করতে বললেন। আমি এবারও পূর্ববৎ জওয়াব দিলে তিনি তৃতীয়বারের মত আমাকে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ - خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ - اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ - الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ কোরআনের এই সর্বপ্রথম পাঁচখানি আয়াত নিয়ে রসূলুল্লাহ্ (সা) ঘরে ফিরলেন। তাঁর হৃদয় কাঁপছিল। খাদীজা (রা)-র কাছে পৌঁছে বললেন : زملوني زملونی আমাকে আবৃত কর, আমাকে আবৃত কর। খাদীজা (রা) তাঁকে বস্ত্র দ্বারা আবৃত করলে কিছুক্ষণ পর ভীতি বিদূরিত হল। এ ভাবান্তর ও কম্পন জিবরাঈল (আ)-এর ভয়ে ছিল না। তাঁর শান এর চেয়ে আরও অনেক ঊর্ধ্বে বরং এই ওহীর মাধ্যমে নবুয়তের যে বিরাট দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করা হয়েছিল, তারই গুরুভার তিনি তিলে তিলে অনুভব করছিলেন। এছাড়া একজন ফেরেশতাকে তাঁর আসল আকৃতিতে দেখার কারণে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ভীত হয়ে পড়েছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর রসূলুল্লাহ্ (সা) খাদীজা (রা)-কে হেরা গুহার সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিয়ে বললেন : এতে আমার মধ্যে এমন ভাবান্তর দেখা দেয় যে, আমি জীবনের ব্যাপারে শংকিত হয়ে পড়ি। হযরত খাদীজা (রা) বললেন : না, এরূপ কখনও হতে পারে না। আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে কখনও ব্যর্থ হতে দেবেন না। কেননা, আপনি আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, বোঝাক্লিষ্ট লোকদের বোঝা বহন করেন, বেকারকে কাজে নিয়োজিত করেন, অতিথি সেবা করেন এবং বিপদগ্রস্তদেরকে সাহায্য করেন। হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন বিদূষী মহিলা। তিনি সম্ভবত তওরাত ও ইঞ্জিল থেকে অথবা এসব আসমানী কিতাবের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, উপরোক্ত চরিত্র গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি কখনও বঞ্চিত ও ব্যর্থ হন না। তাই এভাবে তিনি রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। এরপর খাদীজা (রা) তাঁকে আপন পিতৃব্যপুত্র ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে নিয়ে গেলেন। ইনি জ়াহিলিয়াত যুগে প্রতিমাপূজা বর্জন করে খৃস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, যা ছিল তৎকালে একমাত্র সত্য ধর্ম। শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে হিব্রু ভাষায়ও তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। আরবী ছিল তাঁর মাতৃভাষা। তিনি হিব্রু ভাষায়ও লিখতেন এবং ইঞ্জীল আরবীতে অনুবাদ করতেন। তখন তিনি অত্যধিক বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। বার্ধক্যের কারণে তাঁর দৃষ্টিশক্তি লুপ্তপ্রায় ছিল। হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে বললেন : ভাইজান, আপনি তাঁর কথাবার্তা একটু শুনুন। ওয়ারাকার জিজ্ঞাসার জওয়াবে রসূলুল্লাহ্ (সা) হেরা গুহার সমুদয় বৃত্তান্ত বলে শোনালেন। শোনামাত্রই ওয়ারাকা বলে উঠলেন : ইনিই সে পবিত্র ফেরেশতা, যাঁকে আল্লাহ্ তা’আলা মুসা (আ)-র কাছে প্রেরণ করেছিলেন। হায়, আমি যদি আপনার নবুয়তকালে শক্তিশালী হতাম! হায়, আমি যদি তখন জীবিত থাকতাম, যখন আপনার কওম আপনাকে (দেশ থেকে ) বহিষ্কার করবে। রসূলুল্লাহ্ (সা) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন : আমার স্বজাতি কি আমাকে বহিষ্কার করবে ? ওয়ারাকা বললেন : অবশ্যই বহিষ্কার করবে। কারণ, যখনই কোন ব্যক্তি সত্য পয়গাম ও সত্যধর্ম নিয়ে আগমন করে, যা আপনি নিয়ে এসেছেন, তখনই তার কওম তার উপর নিপীড়ন চালায়। যদি আমি সে সময়কাল পাই, তবে আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব। ওয়ারাকা এর কয়েকদিন পরই ইহলোক ত্যাগ করেন। এই ঘটনার পরই ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে যায়।—(বুখারী, মুসলিম) সোহায়লী বর্ণনা করেন, ওহীর বিরতিকাল ছিল আড়াই বছর। কোন কোন রেওয়ায়েতে তিন বছরও আছে। (মাযহারী )** ** কত দিন যাবৎ ওহী বন্ধ ছিল সেই ব্যাপারে মুহাদ্দীস ও ইতিহাসবেত্তাগণ কয়েকটি মতামত পেশ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সঠিক কথা হলো ওহী বন্ধ ছিল মাত্র কয়েকদিন। কতদিন যাবৎ ওহী বন্ধ ছিল সে ব্যাপারে ইবনে সা‘দ ইবনে আব্বাস হতে একটি উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন যা এ দাবীর পৃষ্ঠপোষকতা করে। কোন কোন সূত্রে এ কথাটি প্রচারিত হয়ে এসেছে যে, আড়াই কিংবা তিন বছর যাবৎ ওহী অবতীর্ণ বন্ধ ছিল; কিন্তু তা সঠিক নয়। (মূহাশশী) নবীজীকে সজোরে চাপ দেয়ার রহস্যঃ আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বস্তুত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার নির্দেশে বক্ষ বিদারণের মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরে রূহানী তাজাল্লীর মহাশক্তি পুরে দিয়েছিলেন। অতঃপর মহান কালাম পড়তে বললেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর চাপ প্রয়োগ এ কাঠিন্য দূরীকরণের লক্ষ্যেই ছিল। আল্লামা ওসমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কোন কোন নব্য যুক্তিবাদীর (সম্ভবত শিবলী নোমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর) উদ্দেশ্যে বলেন, একথা বুঝে আসে না, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন সজোরে চাপ দিয়েছেন; বরং তিনি তা অনুভব করেছেন এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর জিবরাঈল আলাইহিস সালামের কথামত পড়তে শুরু করেন। আমরা বলছি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন ব্যাপারটাই আমাদের বুঝে আসার মত নয়, ওহীর মূলতত্ত্ব উম্মতের কারোই বুঝে আসার মত ব্যাপার নয়। এই সিলসিলার সব কয়টি বিষয়ই আমাদের বুদ্ধি ও জ্ঞানের বাইরে। তাই বলে কি আমরা সবগুলোই অস্বীকার করব? আল্লামা উসমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বিশেষ অবস্থা বর্ণনা করা যায় না। তবে আমার নিজস্ব একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্যাপার কিছুটা বুঝে এসেছে। আমি হায়দারাবাদের এক ক্লিনিকে ভর্তি হলে ডাক্তার বিদ্যুতের মাধ্যমে চিকিৎসা করে অনেক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ডাক্তার সাহেব আমার শরীরে বিদ্যুৎ পৌছান। আমি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে একটি চেয়ারে বসানো হল। পিতল নির্মিত একটি যন্ত্র আমার এক হাত ধরে ফেলল আর ডাক্তার সাহেব তার মেশিন চালিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরে বলল, আমরা এ পরিমাণ বিদ্যুত আপনার দেহে প্রবেশ করিয়েছি। আমার আশ্চর্য লাগল। কিন্তু তারা বলল, আশ্চর্য হওয়ার কোন কারণ নেই। এখনই অনুভব করতে পারবেন। আমার কাছে তখন মাওলানা ইয়াহইয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন। তাঁকে বলা হল, ওনার উপর একটু হাত রাখুন। তিনি হাত নিকটে এনে একটি আঙ্গুল বাড়ানোর সাথে সাথে দেখলাম, তাঁর আঙ্গুল থেকে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। তিনি মনে করলেন আঙ্গুলটি জ্বলেই গেছে। আমি কষ্ট অনুভব করলাম। তখন বুঝতে পারলাম কোন ভিন্ন প্রকৃতির বস্তু আমার দেহে প্রবেশ করেছে। অতঃপর মাওলানা ইয়াহইয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে বলা হল, একটু শক্ত করে ধরুন। এখন আর কোন সমস্যা নেই। তিনি শক্ত করে ধরা অবস্থায় তৃতীয় এক জনকে হাত রাখতে বলা হল। হাত নিকটে আনার সাথে সাথে পূর্বের অবস্থার সৃষ্টি হল। অতঃপর মজবুত করে আঁকড়ে ধরার পর কোন অসুবিধা রইল না। আমি বললাম, আজ একটি বিরাট মাসয়ালার সমাধান খুঁজে পেলাম। বুঝতে পারলাম কোন কোন সময় শক্ত করে ধরলে ব্যাপার সহজ। আর আস্তে ধরলে কঠিন হয়ে যায়। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কোলাকুলি করলেন, তখন প্রথম প্রথম কষ্ট হয়ে থাকলেও পরে শক্তভাবে চাপ প্রয়োগ করার ফলে কঠিন বস্তু সহজ হয়ে গেল। (ফাতহুল মুলহিম) অবতীর্ণ প্রথম পাঁচ আয়াতঃ اقْرَأْ থেকে مَا لَمْ يَعْلَمْ পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতরণের মাধ্যমে নবুওয়্যাতের সূচনা হয়। নবুয়ত লাভের কিছু দিন পূর্বে রসূলুল্লাহ্ (সা) আপনাআপনি নির্জনতাপ্রিয় হয়ে যান। তিনি হেরা গিরিগুহায় গমন করে কয়েক রাত্রি পর্যন্ত অবস্থান করতেন। এক দিন হঠাৎ জিবরাঈল উপস্থিত হলেন এবং বললেনঃ اقْرَأْ অর্থাৎ পাঠ করুন। রসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ ما أنا بقارى অর্থাৎ আমি যে পড়তে জানি না। জিবরাঈল তাঁকে সজোরে চেপে ধরলেন, অতঃপর ছেড়ে দিয়ে বললেন اقْرَأْ পাঠ করুন। তিনি আবারও সে জওয়াবই দিলেন।এমনিভাবে তিন বার চেপে ধরলেন ও ছেড়ে দিয়ে বললেন: اقْرَأْ থেকে مَا لَمْ يَعْلَمْ এ পর্যন্ত) হে পয়গম্বর (এ সময়কার আয়াতগুলোসহ আপনার প্রতি যে কোরআন নাযিল হবে, তা) আপনি আপনার পালনকর্তার নাম নিয়ে পাঠ করুন। [ অর্থাৎ যখন পাঠ করেন, তখন’বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ বলে পাঠ করুন। অন্য এক আয়াতে إِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ বলে কোরআন পাঠের সাথে আউযুবিল্লাহ্ পড়ার আদেশ করা হয়েছে। এ দু’টি আদেশের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর উপর ভরসা করা ও তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। এটা মনে মনে বলা ওয়াজিব এবং মুখে উচ্চারণ করা সুন্নত। এ আয়াত নাযিল হওয়ার সময় রসূলুল্লাহ্ (সা)-র বিসমিল্লাহ্ জানা থাকা জরুরী নয়। কিন্তু কোন কোন রেওয়ায়েতে এ সূরার সাথে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম নাযিল হওয়াও বর্ণিত আছে। الله اخرجه الواحدي من عكرمة والحسن أنهما قالا أول ما نزل بسم الرحمن الرحيم وأول سورة اقرأ وأخرجه ابن جرير وغيره عن ابن عباس أنه قال أول ما نزل جبرائيل عليه السلام علی النبی صلی الله عليه وسلم قال يا محمد استعذ ثم قل بسم الله الرحمن الرحيم - ۔ کذا في روح المعاني আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর নামে পাঠ করতে বলা হয়েছে। এ আয়াতে স্বয়ং এই আয়াতসমূহও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটা এমন যেমন কেউ অপরকে বলে, আমি যা বলি শুন। এতে স্বয়ং এই বাক্যটি শুনার আদেশ করাও বক্তার উদ্দেশ্য থাকে। অতএব সারকথা এই যে, এ আয়াতগুলো পাঠ করুন অথবা পরে যেসব আয়াত নাযিল হবে, সেগুলো পাঠ করুন, সবগুলোর পাঠই আল্লাহর নামে হওয়া উচিত। রসুলুল্লাহ্ (সা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে জানতে পেরে ছিলেন যে, এটা কোরআন ও ওহী। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, তিনি ভীত হয়ে গিয়েছিলেন এবং ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গমন করেছিলেন। অবশ্য সন্দেহের কারণে ছিল না বরং ওহীর ভীতির কারণে তিনি এরূপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিষয়টি ওয়ারাকার কাছে বর্ণনা করা ছিল মানসিক শান্তি ও বিশ্বাস বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, অবিশ্বাসের কারণে নয়। শিক্ষক ছাত্রকে অক্ষর শিক্ষাদান আরম্ভ করার সময় বলেনঃ পড়। একে কেউ অসাধ্য কাজের আদেশ বলে না। রসুলুল্লাহ্ (সা)-র ওজর করার এক কারণ এই যে, তিনি কি পড়বেন, তা তাঁর কাছে নির্দিষ্ট ছিল না। এটা পয়গম্বরের শানের খেলাফ হয়। দ্বিতীয় কারণ এই যে, পাঠ করা অধিকাংশ সময় লিখিত বিষয় পড়ার অর্থে ব্যবহৃত নয়। তাঁর যেহেতু অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তাই এই অযর করেছেন। রসূলুল্লাহ্ (সা)-র মধ্যে ওহীর গুরুভার বহন করার যোগ্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্ভবত জিবরাঈল তাঁকে চেপে ধরেছিলেন!والله أعلم পালনকর্তা (رب) শব্দের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আমি আপনার পুরোপুরি পালন করব এবং নবুয়তের উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দেব। অতঃপর বলা হয়েছে যে, তিনি এমন পালনকর্তা যিনি ( সবকিছু ) সৃষ্টি করেছেন। ( বিশেষভাবে এ গুণটি উল্লেখ করার তাত্ত্বিক কারণ এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামতসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম এ নিয়ামতটিই প্রকাশ পায়। অতএব সর্বাগ্রে এরই উল্লেখ সমীচীন। এছাড়া সৃষ্টিকর্ম স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। স্রষ্টার জ্ঞান লাভ করাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রগণ্য কাজ। ব্যাপক সৃষ্টির কথা বলার পর এখন বিশেষ বিশেষ সৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে— ) যিনি (সব সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে বিশেষভাবে ) মানুষকে জমাট রক্ত থেকে সৃষ্টি করেছেন। (এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৃষ্টিরূপী নিয়ামতসমূহের মধ্যে সাধারণ সৃষ্ট বস্তুর তুলনায় মানুষের প্রতি অধিক নিয়ামত রয়েছে। তাকে অনেক উন্নত করেছেন, চমৎকার আকার-আকৃতি দিয়েছেন এবং জ্ঞান গরিমায় সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং মানুষের অধিক শোকর ও যিকর করা উচিত। বিশেষভাবে জমাট রক্ত উল্লেখ করার কারণ সম্ভবত এই যে, এটা একটা বরযখী অবস্থা। এর আগে রয়েছে বীর্য, খাদ্য ও উপাদান এবং এরপরে রয়েছে মাংসপিণ্ড, অস্থি গঠন ও আত্মাদান। সুতরাং জমাট রক্ত যেন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থা সমূহের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। অতঃপর কোরআন পাঠ যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা সাব্যস্ত করার জন্য বলা হয়েছে :) আপনি কোরআন পাঠ করুন। (অর্থাৎ প্রথম আদেশ اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ থেকে এরূপ বোঝা উচিত নয় যে, এখানে আসল উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর নাম বরং পাঠ করাও উদ্দেশ্য। কেননা, পাঠ করাই তবলীগের উপায় এবং পয়গম্বরের আসল কাজ তাবলীগ। সুতরাং এই পুনরুল্লের দ্বারা একথাও প্রকাশ পেয়েছে যে. রাসুলুল্লাহ (সা)-কে তবলীগের আদেশ করা হয়েছে। অতঃপর সে ওযর দূর করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, যা তিনি প্রথমে জিবরাঈলের কাছে পেশ করেছিলেন যে, তিনি পড়া জানেন না। বলা হয়েছে) আপনার পালনকর্তা দয়ালু (যা ইচ্ছা দান করেন) যিনি (লেখোপড়া জানাদেরকে) কালমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন (এবং সাধারণভাবে ) মানুষকে (অন্যান্য উপায়ে) শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। [ অর্থাৎ প্রথমত শিক্ষা লেখার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্যান্য উপায়েও শিক্ষা হতে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত উপায়াদি স্বতন্ত্র ক্রিয়াশীল নয়। প্রকৃত শিক্ষাদাতা আমি। সুতরাং আপনি লেখা না জানলেও আমি অন্য উপায়ে আপনাকে পড়া এবং ওহীর জ্ঞান সংরক্ষণের শক্তি দান করব। কারণ, আমি আপনাকে পাঠ করার আদেশ দিয়েছি। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। সুতরাং এ আয়াতসমূহে নবুয়ত ও তার ভূমিকা এবং পরিপূরক বিষয়াদির বর্ণনা হয়ে গেছে। (মারেফুল কুরআন)

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন