আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৯- শপথ ও মান্নতের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬২৬৭
আন্তর্জতিক নং: ৬৭২২

পরিচ্ছেদঃ ২৭৯০. কসম ভঙ্গ করার পূর্বে এবং পরে কাফফারা আদায় করা।

৬২৬৭। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) ......... আব্দুর রহমান ইবনে সামুরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না। কেননা, চাওয়া ব্যতীত যদি তোমাকে তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তাতে সাহায্য করা হবে। আর যদি চাওয়ার পর তা তোমাকে দেওয়া হয়, তবে তা তোমার দায়িত্বেই ছেড়ে দেওয়া হবে (অর্থাৎ ভাল মন্দের দায়িত্ব তোমারই থাকবে)। তুমি যখন কোনকিছুতে কসম কর আর কল্যাণ তার অন্যটির মাঝে দেখতে পাও। তখন যেটির মাঝে কল্যাণ পাও, সেটাই বাস্তবায়িত কর। আর তোমার কৃত কসমের কাফফারা আদায় করে দাও।
আশহাল ইবনে হাতিম, ইবনে আউন থেকে উসমান ইবনে আমরের অনূসরণ করেছেন এবং ইউনুস, সিমাক ইবনে আতিয়্যা, সিমাক ইবনে হারব, হুমায়দ, কাতাদা, মানসুর, হিশাম ও রাবী উক্ত বর্ণনায় ইবনে আউনের অনুসরণ করেছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করছিলেন। এ সময় হযরত আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি. তাঁর কাছে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে নিজের কাছে ডাকলেন। বললেন, এসো হে আব্দুর রহমান ইবন সামুরা! তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না। হতে পারে তাঁর অন্তরে নেতৃত্বের অভিলাষ ছিল। তিনি তা চাওয়ার জন্যই এসেছিলেন। এ কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাই তিনি তাঁকে এই বলে সতর্ক করেন যে- لَا تَسْأَلِ الْإِمَارَةَ (তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না)। বোঝা গেল নেতৃত্ব চাওয়া জায়েয নয়। কাজেই যে ব্যক্তি নেতৃত্ব চায়, তাকে নেতা বানানো উচিত নয়। সুতরাং এক ব্যক্তি নেতৃত্ব চাইলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন- إِنَّا وَاللَّهِ لَا نُوَلِّي عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ، وَلَا أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ আল্লাহর কসম! আমরা এ কাজের দায়িত্ব এমন কারও উপর অর্পণ করি না, যে তা চায় এবং এমন কারও উপরও নয়, যে তার লোভ করে। (সহীহ বুখারী: ৭১৪৯; সহীহ মুসলিম: ১৭৩৩) এখানে সাধারণভাবে বলা হয়েছে, নেতৃত্ব চেয়ো না। বোঝা গেল, বড় নেতৃত্ব-ছোট নেতৃত্ব কোনওটাই চাওয়া জায়েয নয়। রাষ্ট্রক্ষমতাও চাওয়া জায়েয নয় এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক অন্য কোনও পদও আর না রাষ্ট্রীয় অন্য কোনও দায়িত্ব। তবে হাঁ, যদি সরকারি কোনও পদ কোনও অযোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষতি হবে বলে প্রবল আশঙ্কা থাকে, তবে এরূপ ঠেকা অবস্থায় সৎ, যোগ্য ও মুত্তাকী ব্যক্তির পক্ষে পদ প্রার্থনা করা জায়েয আছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনায়। ইয়ূসুফ আলাইহিস সালাম মিশরের রাজাকে বলেছিলেন- قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ (55) ইউসুফ বলল, আপনি আমাকে দেশের অর্থ-সম্পদের (ব্যবস্থাপনা) কার্যে নিযুক্ত করুন। নিশ্চিত থাকুন আমি রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো পারি এবং আমি (এ কাজের) পূর্ণ জ্ঞান রাখি। (সূরা ইয়ূসুফ (১২), আয়াত ৫৫) তিনি আশঙ্কাবোধ করেছিলেন দুর্ভিক্ষকালে মানুষ অন্যায়-অবিচারের সম্মুখীন হতে পারে। এ অবস্থায় দেশের অর্থ-সম্পদের বিলি-বণ্টনব্যবস্থা কোনও সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির হাতে থাকা দরকার। আর সেজন্য তাঁর বিশ্বাসমতে তিনি নিজেই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বেশি উপযুক্ত। তাছাড়া মিশর দেশটি ছিল অমুসলিম অধ্যুষিত। সেখানে আল্লাহ তা'আলার আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের নিজের দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। এ কারণেই তিনি দেশের অর্থ বিভাগের দায়িত্ব নিজ মাথায় তুলে নেন। সুতরাং আজও যদি কেউ রাষ্ট্রীয় কোনও পদের ক্ষেত্রে মনে করে যে, সে পদ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত কোনও লোক নেই আর তার নিজের প্রতি এ আত্মবিশ্বাস থাকে যে, তার পক্ষে তা যথাযথভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে আর সে পদের প্রতি তার নিজের কোনও লোভ নেই কিংবা ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যও তার নেই, উদ্দেশ্য কেবলই মানুষের সেবা করা ও আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা, তবে তার জন্যও সে পদ চেয়ে নেওয়ার অবকাশ আছে। এরূপ ব্যতিক্রম অবস্থা ছাড়া সাধারণভাবে পদ প্রার্থনা করার কোনও সুযোগ নেই। কেন তা করা উচিত নয়, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا (কেননা বিনা চাওয়ায় তোমাকে তা দেওয়া হলে তাতে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে)। অর্থাৎ তোমার মনে যদি নেতৃত্বের লোভ না থাকে এবং নিজের পক্ষ থেকে তা পাওয়ার জন্য আগ্রহও প্রকাশ না কর আর এ অবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তোমাকে নেতৃত্বের আসনে বসান অথবা জনগণ তোমাকে ক্ষমতাসীন করে কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান নিজের থেকে তোমাকে কোনও দায়িত্বে নিয়োজিত করেন, তবে তোমার জন্য তা গ্রহণ করা নাজায়েয হবে না। বরং তুমি যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পার, সেজন্য আল্লাহ তা'আলা তোমাকে সাহায্য করবেন। আল্লাহ তা'আলা তোমার উপযুক্ত সহযোগী মিলিয়ে দেবেন। জনগণ তোমার পক্ষে থাকবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি তুমি অনুকূলে পাবে। ফলে দায়িত্ব পালন করা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। বোঝা গেল পদের প্রতি যদি চাহিদা না থাকে আর এ অবস্থায় তা এসে যায়, তবে গ্রহণ করা দোষের নয়; বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে তা গ্রহণ করলে তা নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর হবে এবং মানুষও উপকৃত হবে। وَإِنْ أعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا ‘আর যদি চাওয়ার কারণে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তাতে (বিনা সাহায্যে) ছেড়ে দেওয়া হবে'। অর্থাৎ ক্ষমতা ও পদের প্রতি লোভী হয়ে যদি তুমি তার প্রার্থী হও আর এ অবস্থায় তোমাকে তাতে বসানো হয়, তবে তুমি আল্লাহর সাহায্য পাবে না। সে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে একাকী ছেড়ে দেবেন। তিনি জনমনে তোমার প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করবেন না। তুমি তোমার পাশে উপযুক্ত সহযোগী পাবে না। পরিবেশ- পরিস্থিতি তোমার অনুকূলে থাকবে না। ফলে সহজ সহজ কাজও তোমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। তুমি দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। এভাবে তুমি দুনিয়ায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আখিরাতও হারাবে। এটা লোভের খেসারত। কাজেই কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তির কিছুতেই ক্ষমতার প্রতি লোভ করা উচিত নয়। তা চাওয়া উচিত নয় কিছুতেই। হাঁ, সে যদি আগ্রহী না হয় আর এ অবস্থায় তাকে ক্ষমতায় বা বিশেষ কোনও পদে বসিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাতে কোনও দোষ নেই; বরং এটা তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি.-কে শপথ সম্পর্কেও নির্দেশনা দান করেন। মানুষ অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে বা উত্তেজনাবশত কোনও কাজ সম্পর্কে শপথ করে বসে যে, সে ওই কাজটি অবশ্যই করবে বা কিছুতেই তা করবে না। কিন্তু পরে যখন আবেগ স্বাভাবিক হয়ে আসে বা উত্তেজনা প্রশমিত হয়, তখন লক্ষ করে দেখে যে, তার এ শপথ করা ঠিক হয়নি। কারণ শপথের বিপরীত কাজটি তার জন্য ভালো ছিল। এখন শপথ করার কারণে সে আটকে গেছে। তার পক্ষে ওই ভালো কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। তা করতে গেলে শপথ ভাঙতে হয়। কিন্তু শপথ করে তা ভেঙ্গে ফেলাও গুনাহের কাজ। এতে আল্লাহর নামের অমর্যাদা হয়। এ অবস্থায় তার করণীয় কী? কীভাবে এ উভয়সংকট থেকে সে বাঁচতে পারে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দান করেন- وَإِذَا حَلَفْتَ عَلَى يَمِين، فَرَأَيْتَ غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا ، فَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ وَكَفِّرْ عَنْ يَمِينِكَ (তুমি যখন কোনও বিষয়ে শপথ করবে, তারপর তার বিপরীত কাজকে তারচে' উত্তম দেখতে পাবে, তখন যা উত্তম তাই করবে আর তোমার শপথের কাফফারা আদায় করবে)। অর্থাৎ শপথ করাটা যেন তোমার সেই উত্তম কাজ করার পক্ষে বাধা না হয়। বরং তুমি শপথ ভেঙ্গে সেই উত্তম কাজটিই করবে। আর শপথ ভাঙ্গার কারণে কাফফারা আদায় করবে। শপথ ভাঙ্গার কাফফারা হল দশজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাবার সকাল-বিকাল দু'বেলা খাওয়ানো বা একজন মিসকীনকে দশদিন খাওয়ানো অথবা দশজন গরীবকে ছতর ঢাকা পরিমাণ কাপড় দেওয়া। আর যদি এর কোনওটিরই সামর্থ্য না থাকে, তবে পরপর তিনদিন তিনটি রোযা রাখা। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রীয় কোনও পদ নিজের পক্ষ থেকে চাইতে নেই। খ. নিজ চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও পদ এসে যায়, তবে তা গ্রহণ করতে দোষ নেই। গ. কোনও বিষয়ে কসম করলে যদি তার বিপরীত বিষয়টি উত্তম হয়, তবে কসমের কারণে সে বিপরীত বিষয়টি করা হতে বিরত থাকা উচিত নয়। ঘ. যে-কোনও অবস্থায় কসম ভেঙ্গে ফেললে সেজন্য কাফফারা আদায় করা জরুরি।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy