মুসলিম বিবাহ

আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৯- শপথ ও মান্নতের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬২৪৭
আন্তর্জতিক নং: ৬৭০৪

পরিচ্ছেদঃ ২৭৭৯. গুনাহের কাজের এবং ঐ বস্তুর মান্নত করা, যার উপর অধিকার নেই।

৬২৪৭। মুসা ইবনে ইসমাঈল (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা নবী (ﷺ) খুতবা প্রদান করছিলেন। এক ব্যক্তিকে দাঁড়ানো দেখে তার সম্পর্কে লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন। লোকেরা বলল যে, এ লোকটির নাম আবু ইসরাঈল। সে মান্নত করেছে যে, দাঁড়িয়ে থাকবে, বসবে না, ছায়াতে যাবে না, কারও সঙ্গে কথা বলবে না এবং রোযা পালন করবে। নবী (ﷺ) বললেনঃ লোকটিকে বলে দাও সে যেন কথা বলে, ছায়াতে যায়, বসে এবং তার রোযা সমাপ্ত করে।
আব্দুল ওয়াহহাব ইকরিমার সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে অত্র হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এ হাদীছে যে খুতবার কথা বলা হয়েছে, অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জুমু'আর খুতবা। তিনি যে ব্যক্তিকে রোদে দাঁড়ানো দেখতে পান, এ বর্ণনায় তার নাম বলা হয়েছে আবূ ইসরাঈল। তিনি আনসারী ছিলেন না মুহাজির তা উল্লেখ করা হয়নি। কেউ কেউ তাকে আনসারী সাহাবী বলেছেন। কিন্তু হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রহ আল-ইসাবা গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন তিনি একজন কুরায়শী সাহাবী। বলা হয়েছে, তিনি রোদে দাঁড়িয়ে থাকার মানত করেছিলেন। বসবেনও না, ছায়ায়ও যাবেন না এবং কারও সাথে কথাও বলবেন না। সেইসঙ্গে এই মানতও করেছিলেন যে, তিনি রোযা অবস্থায় থাকবেন। এর ভেতর রোযা থাকা তো একটি উচ্চস্তরের ইবাদত। বাকি যে কাজগুলোর মানত করেছিলেন তার কোনওটিই 'ইবাদত ও ছাওয়াবের কাজ নয়। নামাযে কিয়াম করা ফরয বটে, কিন্তু নামাযের বাইরে এটা কোনও 'ইবাদত নয়। এমনিভাবে ছায়ায় না যাওয়া এবং কথা না বলাও কোনও ছাওয়াবের কাজ নয়। হাঁ, আযান দাঁড়িয়ে দেওয়া সুন্নত আর আরাফার ময়দানে উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে দু'আয় রত থাকার উৎসাহও হাদীছ দ্বারা পাওয়া যায়। এমনিভাবে বেহুদা কথা না বলে চুপ থাকাও ছাওয়াবের কাজ। কিন্তু আমাদের ধর্মে দীনী কথা বা দুনিয়াবী প্রয়োজনীয় কথা না বলে চুপ থাকা আদৌ কোনও ছাওয়াবের কাজ নয়। হযরত আবূ ইসরাঈল রাযি.-এর মানতের যে অংশটি 'ইবাদত ছিল অর্থাৎ রোযা রাখা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা অনুমোদন করলেন এবং তাঁকে তা পূরণ করতে বললেন। কারণ এর মানত সহীহ হয়েছে। মানত কেবল এমন কাজেরই করা যায়, যা মৌলিকভাবে ইবাদত। যেমন নামায, রোযা, হজ্জ ও দানখয়রাত। যেগুলো 'ইবাদত ও ছাওয়াবের কাজ ছিল না সেগুলোর মানত অনুমোদন করলেন না এবং তা পূর্ণ করতেও বললেন না, যেহেতু 'ইবাদত না হওয়ায় এর মানতই সহীহ হয়নি। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃথা কষ্টভোগ ছাড়া কিছু নয়। আবার রোদে দাঁড়িয়ে থাকা তো দ্বিগুণ কষ্ট। অহেতুক আত্মপীড়ন ইসলাম অনুমোদন করে না। কেউ তা করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তিরস্কার করেছেন। যেমন এক ব্যক্তি তার দুই পুত্রের কাঁধে ভর করে চলছিল। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তার এ অবস্থা কেন? জানানো হল, সে হেঁটে হেঁটে হজ্জে যাওয়ার মানত করেছে (অনেকক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় পুত্রদের কাঁধে ভর দিয়ে চলছে)। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এর আত্মপীড়নের কোনও প্রয়োজন আল্লাহর নেই। এই বলে তাকে সওয়ার হতে হুকুম দিলেন। এরকম আরও বহু ঘটনা আছে, যাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহেতুক আত্মপীড়নের নিন্দা করেছেন। এমনিভাবে অহেতুক চুপ থাকা যেহেতু কোনও 'ইবাদত নয়, তাই এর মানতও সহীহ হয় না। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চুপ থাকাকে অনুমোদন করেননি; বরং তাঁকে কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলার এক মহামূল্যবান নি'আমত। এ নি'আমতকে উপকারী কাজে ব্যবহার করা চাই। যেমন যিকর ও তিলাওয়াত করা, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, বৈধ সুপারিশ করা ইত্যাদি। এ শক্তির অপচয় ও অন্যায় ব্যবহার জায়েয নয়। এটা নি'আমতের নাশুকরিও বটে। কাজেই যে ক্ষেত্রে কথা বলার প্রয়োজন নেই সেখানে চুপ থাকাই শ্রেয়। নি'আমতের হেফাজতকল্পে সে চুপ থাকাও একটি ছাওয়াবের কাজ। কিন্তু চুপ থাকার মানত করার যারা একে একটি মৌলিক ইবাদত বানিয়ে দেওয়া হয়। মৌলিকভাবে যা ইবাদত নয় তাকে ইবাদত বানানো একটি বিদ'আতী কাজ ও কঠিন গুনাহ, যা থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য। হাফেজ ইবন রজব হাম্বলী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি এমন কোনও কাজ দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায়, যে কাজকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম (ইবাদত) বানাননি, সে কাজ বাতিল এবং তা তার কর্তার প্রতি ছুঁড়ে মারা হয়। অনেকে আজমীরের দরগা, শাহজালালের দরগা এবং এ জাতীয় আরও বিভিন্ন দরগা যিয়ারতের মানত করে থাকে, আবার কেউ দরগায় শিরনি দেওয়ার মানত করে। এসব মানত সহীহ নয়; বরং এ জাতীয় মানত করাই কঠিন গুনাহ। কেননা এটা কেবল অহেতুক কাজই নয় এবং কেবল নিজেকে বৃথা কষ্ট দেওয়া ও অর্থের অপচয়ই নয়; সেইসঙ্গে শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। কেননা এসব মানতের পেছনে দরগা ও দরগাওয়ালা সম্পর্কে এমন এমন বিশ্বাস রাখা হয়, যা শিরকেরই পর্যায়ভুক্ত। তাই এগুলো পূরণ করার প্রশ্নই আসে না। পূরণ করলে দ্বিগুণ গুনাহ। এ জাতীয় মানত করার পর তা পূরণ না করে বরং মানত করার কারণে যে গুনাহ হয়েছে সেজন্য তাওবা করা জরুরি। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কোনও কাজের মানত করতে চাইলে আগে জেনে নেওয়া দরকার শরী'আতে সে মানত জায়েয কি না। খ. ইসলাম যে কাজকে ছাওয়াবের কাজরূপে স্বীকৃতি দেয়নি, ছাওয়াবের আশায় সে কাজ করা নিছক আত্মপীড়ন বা অর্থের অপচয়, যা থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। গ. ইসলাম যে কাজকে ছাওয়াবের কাজ সাব্যস্ত করেছে কিন্তু ফরয করেনি, সেগুলো করার ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা রক্ষা জরুরি। কিছুতেই বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। ঘ. আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমত দ্বারা শরী'আতসম্মত পন্থায় উপকৃত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তা পরিহার করে অহেতুক কষ্টভোগ ইসলামে প্রশংসনীয় নয়।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন

সহীহ বুখারী - হাদীস নং ৬২৪৭ | মুসলিম বাংলা