আরেফ বিল্লাহ হযরত শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার রহ.

আরেফ বিল্লাহ হযরত শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার রহ.

আল্লামা হাকিম আখতার (রহ.) : ঝরে গেল আশরাফি বাগানের আরেকটি ফুল জহির উদ্দিন বাবর পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম, থানভী সিলসিলার বিশিষ্ট বুজুর্গ ‘করাচির হজরত’খ্যাত আরেফবিল্লাহ মাওলানা শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার (রহ.) আর নেই। দীর্ঘ ১৩ বছর অসুস্থ থাকার পর ৯০ বছর বয়সে গত জুন রোববার আসর মাগরিবের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার ইন্তেকালে উপ-মহাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশেষ করে বাংলাদেশের আলেম-ওলামা, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক দ্বীনদার মুসলমানদের মধ্যে শোকাচ্ছন্নতা অনুভব করা যায়। হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) সুন্নতি যে বিশুদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেছিলেন তা বাংলাদেশে প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল হাকিম মুহাম্মদ আখতার (রহ.)-এর। তার আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি শত শত আলেম বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে দ্বীনের বিশুদ্ধ ধারা চর্চা করছেন এবং হেদায়াতের আলোকচ্ছটা বিলিয়ে যাচ্ছেন। বার বার তিনি এদেশে এসেছেন এবং সুন্নত অনুযায়ী জীবন গঠনের তাগিদ দিয়েছেন। তার আধ্যাত্মিক দীক্ষা নির্দেশনা পেয়ে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন এদেশের আলেম-ওলামা। শেষ বয়সে অসুস্থতার কারণে তিনি নিয়মিত আসতে না পারলেও অনেকেই তার দরবারে গিয়ে আধ্যাত্মিক দীক্ষা অর্জন করতেন। পাকিস্তানের করাচি শহরে তার খানকা ছিল বাংলাদেশের আলেম-ওলামার বিশেষ ঠিকানা। তাছাড়া সুন্নতের চর্চা বিকাশের লক্ষ্যে গঠিত সংগঠন দাওয়াতুল হকের বাংলাদেশের কার্যক্রম তিনিই তত্ত্বাবধান করতেন। তার ইন্তেকালে উপমহাদেশের আলেম সমাজ একজন হৃদয়বান, দরদি যোগ্য অভিভাবক হারিয়েছে। মাওলানা শাহ আখতার (রহ.)-এর জন্ম ১৯২৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড়ে। তার বাবা মুহাম্মদ হোসাইন ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন মা-বাবার একমাত্র ছেলে। এছাড়া তার দু’জন বোন ছিলেন। হাকিম আখতার (রহ.) ছিলেন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি আলিগড় তিব্বিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তার পারিবারিক পরিমণ্ডলে ছিল দ্বীনদারি। এজন্য ছোটবেলা থেকেই তিনি বুজুর্গদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। যে কোনো দ্বীনি কাজে তিনি এগিয়ে যেতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হাকিমী চিকিৎসক ছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে তিনি দ্বীনি শিক্ষাও অর্জন করেন এবং পুরোপুরিই দ্বীনের খেদমতে নিজেকে নিবেদন করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আখতার প্রথমে ভারতের বিশিষ্ট আলেম মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদী মাওলানা সাইয়েদ বদরে আলম শাহ’র কাছ থেকে আধ্যাত্মিত দীক্ষা লাভ করেন। একই সময় তিনি মাওলানা শাহ মুহাম্মদ প্রতাপগড়ীর কাছ থেকেও খেলাফত লাভ করেন। পরে তিনি ১৭ বছর পর্যন্ত মাওলানা শাহ আবদুল গনি ফুলপুরীর সান্নিধ্যে কাটান। সময়ই তিনি নিয়মতান্ত্রিক দ্বীনি শিক্ষা হাসিল করেন। পরবর্তী সময়ে ফুলপুরী (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরিও তিনি নির্বাচিত হন। শেষ জীবনে তিনি ‘হারদুঈর হজরত’ খ্যাত মাওলানা শাহ আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করেন। তিনি যে তিনজন বুজুর্গ থেকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা অর্জন করেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর খলিফা। আর থানভী (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের দ্বীনদার মুসলমানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক রাহবার। তাসাউফের যে চারটি ধারা চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশেবন্দিয়া সোহরাওয়ার্দীয়া-প্রতিটি তরিকার বুজুর্গ ছিলেন মাওলানা হাকিম মুহাম্মদ আখতার (রহ.)। একজন পূর্ণাঙ্গ পীর অলি হিসেবে তিনি খ্যাত ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর ১৯৫৪ অথবা ১৯৫৫ সালে হাকিম মুহাম্মদ আখতার পাকিস্তান চলে আসেন। পাকিস্তানের নাজিমাবাদে তিনি দীর্ঘদিন দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দেন। পরে তিনি করাচির গুলশান ইকবালে খানকাহে আশরাফিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দেন। হাকিমুল উম্মতের অনুসারীদের প্রধান কেন্দ্র ছিল তার খানকা। দীর্ঘ জীবনে বড় বড় অলী-বুজুর্গের কাছ থেকে তিনি যে আধ্যাত্মিক সম্পদ অর্জন করেছিলেন এই খানকা থেকে বিলিয়েছেন অকাতরে। এজন্য সারা দুনিয়া থেকে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ভিড় করতেন তার দরবারে। এখানকার শিক্ষা, নির্দেশনা স্পৃহা ছড়িয়ে পড়ত উপমহাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে। বাংলাদেশেরও শত শত আলেম বিভিন্ন সময় ছুটে যেতেন খানকায়ে আশরাফিয়ায়। এদেশের অনেক খানকাহ, মসজিদ, মাদরাসা চলত হাকিম মুহাম্মদ আখতার (রহ.)-এর সরাসরি নির্দেশনায়। মাওলানা মুহাম্মদ আখতার (রহ.) জামেয়া আশরাফুল মাদারিস নামে বিশ্ববিদ্যালয় মানের একটি বিশাল দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পাঁচ হাজারের বেশি ছাত্র সেখানে পড়াশোনা করছেন। করাচিতে প্রতিষ্ঠানের ১০টির বেশি শাখা রয়েছে। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। বাংলা ভাষায়ও তার বেশকিছু বই অনূদিত হয়েছে। ‘মাআরিফে মসনভী’ নামে তিনি ঐতিহাসিক গ্রš’ ‘মসনবী’র ব্যাখ্যা লিখেছেন। কিতাবটি সারা বিশ্বে সমানভাবে সমাদৃত। বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। মানবকল্যাণেও নিবেদিত ছিলেন এই মহান বুজুর্গ। মানবসেবার লক্ষ্যে তিনি আল আখতার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানের যে ক’টি প্রতিষ্ঠানের ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আল আখতার ট্রাস্ট-এর অন্যতম। শুধু উপমহাদেশই নয়, সারা বিশ্বেই তার ভক্ত-অনুরাগী রয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আমলা হাশেম আমলাও তার বিশেষ অনুরাগী। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও তিনি দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। সেখানেও তার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী রয়েছেন। ২০০০ সালের ২৮ মে মাওলানা হাকিম মুহাম্মদ আখতার প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তিনি অসুস্থই ছিলেন। তবে এর মধ্য দিয়েই চলছিল তার দ্বীনি খেদমতের অব্যাহত ধারা। জুন বিকেলে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। পরদিন সকাল নয়টায় তার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আশরাফুল মাদারিস প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। পাকিস্তান ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে তার ভক্ত-অনুরাগীরা জানাজায় অংশ নেন। লাখো মানুষের চোখের পানিতে সমাহিত করা হয় তাকে। এভাবেই ঝরে গেল আশরাফি বাগানের আরেকটি ফুল। যে ফুলের সৌরভে মুখরিত হয়েছিল দেশ-বিদেশ, যার সুগন্ধি মুগ্ধ করেছিল উম্মতে মুহাম্মদীকে তার অভাব আর কোনোদিন পূরণ হবে না। এমন মৃত্যুকেই বলা হয়, ‘আলেমের মৃত্যু আলমের (দুনিয়ার) মৃত্যু’। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। লেখক : তরুণ আলেম, সাংবাদিক দৈনিক আমার দেশ : ০৭/০৬/২০১৩

আরেফ বিল্লাহ হযরত শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার রহ. -এর প্রবন্ধসমূহ

আরেফ বিল্লাহ হযরত শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার রহ. -এর কিতাবসমূহ

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy